বিসর্জন

রবীন্দ্রনাথের রচিত একটি নাটক।

বিসর্জন নাটকের রচনার প্রেক্ষাপট ও সংস্করণসমূহের পরিচয়:
রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি স্বপ্নের সাথে ত্রিপুরা রাজ্যের ইতিহাস মিশিয়ে একটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এই উপন্যাসটি 'রাজর্ষি' নামে 'বালক' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'জীবনস্মৃতি' গ্রন্থের 'বালক' অধ্যায়ে লিখেছেন-

'ছবি ও গান’ এবং 'কড়ি ও কোমল’-এর মাঝখানে বালক নামক একখানি মাসিকপত্র এক বৎসরের ওষধির মতো ফসল ফলাইয়া লীলা সংবরণ করিল।... দুই-এক সংখ্যা বালক বাহির হইবার পর দুই-একদিনের জন্য দেওঘরে রাজনারায়ণ বাবুকে দেখিতে যাই। কলিকাতায় ফিরিবার সময় রাত্রের গাড়িতে ভিড় ছিল; ভালো করিয়া ঘুম হইতেছিল না– ঠিক চোখের উপর আলো জ্বলিতেছিল। মনে করিলাম, ঘুম যখন হইবেই না তখন এই সুযোগে বালকের জন্য একটা গল্প ভাবিয়া রাখি। গল্প ভাবিবার ব্যর্থ চেষ্টার টানে গল্প আসিল না, ঘুম আসিয়া পড়িল। স্বপ্ন দেখিলাম, কোন্‌ এক মন্দিরের সিঁড়ির উপর বলির রক্তচিহ্ন দেখিয়া একটি বালিকা অত্যন্ত করুণ ব্যাকুলতার সঙ্গে তাহার বাপকে জিজ্ঞাসা করিতেছে– বাবা, একি! এ যে রক্ত! বালিকার এই কাতরতায় তাহার বাপ অন্তরে ব্যথিত হইয়া অথচ বাহিরে রাগের ভান করিয়া কোনোমতে তার প্রশ্নটাকে চাপা দিতে চেষ্টা করিতেছে। জাগিয়া উঠিয়াই মনে হইল, এটি আমার স্বপ্নলব্ধ গল্প। এমন স্বপ্নে-পাওয়া গল্প এবং অন্য লেখা আমার আরো আছে। এই স্বপ্নটির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দমাণিক্যের পুরাবৃত্ত মিশাইয়া রাজর্ষি গল্প মাসে মাসে লিখিতে লিখিতে বালকে বাহির করিতে লাগিলাম।"

রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দমাণিক্যের ইতিহাস পেয়েছিলেন ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্রমাণিক্যের কাছ থেকে। রাজর্ষি উপন্যাসের প্রথম সংস্করণে ওই ইতিহাস পরিশিষ্টরূপে প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর বিভিন্ন সংস্করণে রবীন্দ্রনাথ 'রাজর্ষি' উপন্যাসে  নানা রকম পরিবর্তন এনেছিলেন। এই পরিবর্তনের ধারায় তিনি উপন্যাসটিকে নাট্যরূপ দেওয়ার উদ্যোগ নেন। এই সূত্রেই রাজর্ষির প্রথমাংশ নিয়ে 'বিসর্জন' নাটকটি রচনা করেন। এই নাটকটি ১২৯৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি 'বিসর্জন'-এর আদি এই পাঠে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। এই পাঠটি ১৩০৩ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থাবলী নামক গ্রন্থ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এই পাঠটিতে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। তাই এই গ্রন্থটির আরও পরিবর্তন করে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন ১৩০৬ বঙ্গাব্দে।

এরপর বিসর্জনের একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে। এই সংস্করণের অংশবিশেষ সংশোধিত হয়ে, বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীর দ্বিতীয় খণ্ডে স্থান পেয়েছে।

 

বিসর্জনের মূলকথা
কাহিনীর প্রেক্ষাপটের বিচারে বিসর্জন উপন্যাসের মূল কথা হলো কুসংস্কারের বিসর্জন। এই নাটকটি রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নলব্ধ গল্প এবং ত্রিপুরারাজ্যের ইতিহাসের অংশ বিশেষের সংমিশ্রণে। রাজর্ষি উপন্যাস বা বিসর্জন নাটকের একটি গল্প আছে। সেটা নিতান্তই অবলম্বন মাত্র। এই অবলম্বনের ভিতরে দুটি পরস্পর-বিরোধী মতাদর্শের দ্বান্দ্বিকতাকে বিশেষভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

প্রথাগত কোনো আচার বা সংস্করণ যখন মানুষের স্বাভাবিক সুকুমার প্রবৃত্তি এবং সেই সাথে কল্যাণকর চেতানকে কলুষিত করতে থাকে, তখনই জন্ম নেয় কুসংস্কার। ত্রিপুরা রাজ্যের এমনি একটি কুসংস্কার ছিল- পশুবলি দিয়ে দেবীকে সন্তুষ্ট করা। যেমন অন্ধকারের বুক থেকে আলোর প্রকাশ ঘটে, তেমনি মহারাজা গোবিন্দ্যমাণিক্যের মনে কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে জ্বলে উঠেছিল কল্যাণের দ্বীপ। এরই মধ্য দিয়ে বিসর্জন নাটকের সূচনা ঘটে।

বিসর্জন নাটকের মূলবিষয় হলো কল্যাণকর সত্য-সুন্দর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে- অকল্যাণ, অসত্য, অসুন্দরের মধ্যে দ্বন্দ্ব। আর পুরো বিষয়টি আবর্তিত হয়েছে **কালিকাদেবীর উদ্দেশ্যে বলি দেওয়ার কুসংস্কারকে ভিত্তি করে। এই দ্বন্দ্বে সত্য-সুন্দরের প্রতিনিধি রাজা গোবিন্দমাণিক্য আর বলী নামক কুসংস্কারকে প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রতিনিধি রঘুপতি। কুসংস্কার বিরোধী স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের সহানুভূতি গোবিন্দমাণিক্যের পক্ষে। সত্যের পথ সরল। এই নাটকে গোবিন্দমাণিক্য সেই সরল পথের পথিক, এরই ভিতরে তাঁর মহৎ ব্যক্তিত্ব উপস্থাপিত হয়েছে। নাটকের প্রথমাংশে রঘুপতি কুসংস্কারাচ্ছন্ন হলেও সত্যসন্ধ ছিলেন তাঁর ভক্তিতে। কিন্তু সেই সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন রঘুপতি, যখন অন্তরালে থেকে তিনি দেবীকে দিয়ে রাজরক্ত প্রার্থনার কপটতা, দেবীর মুখ ফেরানো মতো কুটিল এবং অসত্যের পথ বেছে নেন। রঘুপতি এই পথ বেছে নিয়েছিলেন রাজশক্তিকে অবদমিত করার জন্য। এর সাথে ছিল জয়সিংহের** প্রতিষ্ঠা করা। এখানে রঘুপতি হিংস্র, যখন সে যে কোনো ভাবেই জয়ী হতে চান। তাই তিনি রাজরক্তের জন্য প্রতিপক্ষ গোবিন্দমাণিক্যের মৃত্যু চান। অন্য দিকে জয়সিংহের প্রতি পরম স্নেহে তাঁকে ধরে রাখতে চান। তাই এই প্রেম-হিংসার দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে রঘুনাথের পরাজয় হয়, যখন রাজসিংহ রাজরক্ত হিসেবে নিজের রক্তই দেবীর পায়ে উৎসর্গ করেন। জয়সিংহের এই আত্ম-বিসর্জনের মধ্য দিয়ে জয় হয় গোবিন্দমাণিক্যের, জয় হয় কল্যাণকর সত্য-সুন্দরের। কঠিন আঘাতের ভিতর দিয়ে রঘুনাথের মনে জন্ম নেয় আত্মধিক্কার, আর আত্মধিক্কারের আঘাতে কুসংস্কার বিদূরিত হয়। কিন্তু এর জন্য দিতে হয় কঠিন মূল্য।  শেষ পর্যন্ত জয়সিংহের আত্ম-বিসর্জনের মধ্য দিয়ে এই অপ্রেম -কুসংস্কারের বিসর্জন হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজে এই নাটকের ব্যাখ্যায় লিখেছেন-

'নাটকের শেষে রঘুপতি প্রতিমা বিসর্জন দিলেন, এটা বাইরের ঘটনা ঘটল। কিন্তু, এই নাটকে এর চেয়েও মহত্তর আর এক বিসর্জন হয়েছে। জয়সিংহ তার প্রাণ বিসর্জন দিয়ে রঘুপতির মনে চেতনার সঞ্চার করে দিয়েছিল। সুতরাং প্রতিমা বিসর্জনই  এই নাটকের শেষ কথা নয়, তার চেয়ে বড় কথা হল জয়সিংহের আত্মত্যাগ; কারণ তখনই রঘুপতি সুষ্পষ্টভাবে এই সত্য অনুভব করতে পারল যে, প্রেম হিংসার পথে চলে না, বিশ্বমাতার পূজা প্রেমের দ্বারাই হয়।'

জয়সিংহের মৃত্যু হয় বলে এই নাটকটিকে অনেকে বেদনাধর্মী বা ট্র্যাজেডি বলে থাকেন। কিন্তু এই নাটকে বেদনা বলতে শুধু জয়সিংহের মৃত্যুই মনে হয়। এই বেদনাকে খাটো না করেই বলা যায় যে, এই নাটকের বেদনাকে ছাপিয়ে ফুটে উঠে সত্য-সুন্দরের অঙ্গীকারে কল্যাণকর ভবিষ্যতের প্রত্যাশা। তাই একে নির্ভেজাল ট্র্যাজেডি বলতে বাধে।