আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না।
এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছেকথা ছলনা ?।
এ যে নয়নের জল, হতাশের শ্বাস, কলঙ্কের কথা দরিদ্রের আশ,
এ যে বুক-ফাটা দুখে গুমরিছে বুকে গভীর মরমবেদনা।
এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছেকথা ছলনা ?।
এসেছি কি হেথা যশের, কাঙালি কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি—
মিছে কথা কয়ে, মিছে যশ লয়ে, মিছে কাজে নিশিযাপনা।
কে জাগিবে আজ, কে করিবে কাজ, কে ঘুচাতে চাহে জননীর লাজ—
কাতরে কাঁদিবে, মায়ের পায়ে দিবে সকল প্রাণের কামনা ?
এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছেকথা ছলনা ?।
একদিনের ঘটনা মনে পড়েছে, সে বহুদিন পূর্বের কথা। তখনকার দিনে আমাদের রাষ্ট্রনায়কদের অঙ্গুলি তোলা ছিল রাজপ্রসাদকণা বর্ষণের প্রত্যাশায়। একদা কোনো জায়গায় তাঁদের কয়েকজনের সান্ধ্য বৈঠক বসবার কথা ছিল। তাঁদের দূত ছিলেন আমার পরিচিত এক ব্যক্তি। আমার অসম্মতি সত্ত্বেও তিনি বারবার করে বলতে লাগলেন আমি না গেলে আসর জমবে না। শেষ পর্যন্ত ন্যায্য অসম্মতিকেও বলবৎ রাখাবার শক্তি বিধাতা আমাকে দেন নি। যেতে হোল। ঠিক যাবার পূর্বক্ষণেই আমি নিম্নোদ্বৃত গানটি রচনা করেছিলেম- আমায় বোলো না গাহিতে.....। এই গান গাবার পরে আর আসর জমল না। সভাস্থগণ খুশি হন নি।
কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ তাঁর পিতৃস্মৃতি' গ্রন্থে লিখেছেন- 'যে সময়কার কথা বলছি তখনকার একটি গল্প উল্লেখযোগ্য। আমার মনে থাকার কথা নয়— বড়ো হয়ে বাবার মুখে শুনেছি। কলকাতায় সেবার কংগ্রেস হচ্ছে। নানান প্রদেশ থেকে বড়ো বড়ো নেতারা এসেছেন। দেশোদ্ধার কী করে করা যায় তাই নিয়ে কদিন ধরে ওজস্বী বক্তৃতা অনেক হয়ে গেছে কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে। হাট ভাঙার আগে তারকনাথ পালিত ঠিক করলেন তাঁর বাড়িতে নেতাদের ডিনার পার্টি দেবেন। উদ্দেশ্য, পরস্পরকে সাধুবাদ দেওয়া। আমার পিতাকে পালিত সাহেব কেবল সাদর নিমন্ত্রণ জানিয়ে ক্ষান্ত হলেন না, বিশেষ করে অনুরোধ করেলেন নেতাদের বিনোদনের জন্য গান গাইতে হবে। গগনদাদাদের তিন ভাইয়েরও নিমন্ত্রণ ছিল। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির হল জোড়াসাঁকো-বাড়ি থেকে যে চারজন যাবেন একবারে বাঙালি দস্তুরে ধুতিচাদর পরে ডিনারে হাজির হবেন। ধুতি-পরা বাঙালি বাবুদের ডিনারে যোগ দেওয়া বিদেশীভাবাপন্ন কংগ্রেস নেতৃবর্গের কাছে কী রকম উপহাসের বিষয় হয়েছিল অনুমান করতে পারা যায়। ইংরেজি কায়দায় ডিনার পার্টি কী ধরনের হবে বাবা সহজেই অনুমান করেছিলেন — সেই বিদেশী আবহাওয়ার মধ্যে স্বদেশী গান গাইতে তাঁর একটুও ইচ্ছা করছিল না। উতলা মন নিয়ে গাড়িতে উঠলেন।
আহারান্তে বক্তৃতা যখন চলছে, তার মধ্যে একসময় বাবাকে গান গাইতে বলা হল। বাবা গাইলেন—
আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না...।
...গান শুনে সকলে স্তব্ধ। ডিনার পার্টি মাটি হয়ে গেল। মুখ বিষণ্ণ করে একে একে সবাই চলে গেলেন।'
[পিতৃস্মৃতি।রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জিজ্ঞাসা পাবলিকেশন্স্, কলিকাতা, ২৫শে বৈশাখ ১৩৯৫। পৃষ্ঠা: ৯-১০]