|
খর বায়ু বয় বেগে,
চারি দিক ছায় মেঘে,
ওগো নেয়ে, নাওখানি বাইয়ো।
তুমি কষে ধরো হাল,
আমি তুলে বাঁধি পাল—
হাঁই মারো,
মারো টান হাঁইয়ো॥
শৃঙ্খলে বারবার
ঝন্ঝন্ ঝংকার,
নয় এ তো তরণীর
ক্রন্দন শঙ্কার—
বন্ধন দুর্বার
সহ্য না হয় আর,
টলমল করে আজ তাই ও।
হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো।
গণি গণি দিন খন
চঞ্চল করি মন
বোলো না, যাই কি
নাহি যাই রে।
সংশয়পারাবার
অন্তরে হবে পার,
উদ্বেগ তাকায়ো না
বাইরে।
যদি মাতে মহাকাল,
উদ্দাম জটাজাল
ঝড়ে হয়
লুণ্ঠিত, ঢেউ উঠে উত্তাল,
হোয়ো নাকো কুণ্ঠিত,
তালে তার দিয়ো তাল,
জয়-জয় জয়গান
গাইয়ো।
হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো।
প্রথম দৃশ্য
রাজপুত্র ও সদাগরপুত্র
রাজপুত্র। আর তো চলছে না, বন্ধু।
সদাগর। কিসের চাঞ্চল্য তোমার, রাজকুমার।
রাজপুত্র। কেমন করে বলব। কিসের চাঞ্চল্য বলো দেখি ঐ হাঁসের দলের, বসন্তে
যারা ঝাঁকে ঝাঁকে চলেছে হিমালয়ের দিকে।
সদাগর। সেখানে যে ওদের বাসা।
রাজপুত্র। বাসা যদি, তবে ছেড়ে আসে কেন। না না, ওড়বার আনন্দ, অকারণ আনন্দ।
সদাগর। তুমি উড়তে চাও?
রাজপুত্র। চাই বৈকি।
সদাগর। বুঝতেই পারি নে তোমার কথা। আমি তো বলি অকারণ ওড়ার চেয়ে সকারণ খাঁচায়
বন্ধ থাকাও ভালো।
রাজপুত্র। সকারণ বলছ কেন।
সদাগর। আমরা-যে সোনার খাঁচায় থাকি শিকলে বাঁধা দানাপানির লোভে।
রাজপুত্র। তুমি বুঝতে পারবে না, বুঝতে পারবে না।
সদাগর। আমার ও দোষটা আছে, যা বোঝা যায় না তা আমি বুঝতেই পারি নে। একটু
স্পষ্ট করেই বলো-না, কী তোমার অসহ্য হল।
রাজপুত্র। রাজবাড়ির এই একঘেয়ে দিনগুলো।
সদাগর। একঘেয়ে বল তাকে? কতরকম আয়োজন, কত উপকরণ।
রাজপুত্র। নিজেকে মনে হয় যেন সোনার মন্দিরে পাথরের দেবতা। কানের কাছে কেবল
একই আওয়াজে বাজছে শঙ্খ কাঁসর ঘণ্টা। নৈবেদ্যের বাঁধা বরাদ্দ, কিন্তু ভোগে
রুচি নেই। এ কি সহ্য হয়।
সদাগর। আমাদের মতো লোকের তো খুবই সহ্য হয়। ভাগ্যিস বাঁধা বরাদ্দ। বাঁধন
ছিঁড়লেই তো মাথায় হাত দিয়ে পড়তে হয়। যা পাই তাতেই আমাদের ক্ষুধা মেটে। আর,
যা পাও না তাই দিয়েই তোমরা মনে মনে ক্ষুধা মেটাতে চাও।
রাজপুত্র। আর, রোজ রোজ ঐ-যে চারণদের স্তব শুনতে হয় একই বাঁধা ছন্দে— সেই
শার্দুলবিক্রীড়িত।
সদাগর। আমার তো মনে হয়, স্তব জিনিসটা বারবার যতই শোনা যায় ততই লাগে ভালো।
কিছুতেই পুরোনো হয় না!
রাজপুত্র। ঘুম ভাঙতেই সেই এক বৈতালিকের দল। আর, রোজ সকালে সেই এক
পুরুতঠাকুরের ধান দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ। আর আসতে যেতে দেখি, সেই বুড়ো
কঞ্চুকীটা কাঠের পুতুলের মতো খাড়া দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে। কোথাও যাবার
জন্যে একটু পা বাড়িয়েছি কি অমনি কোথা থেকে প্রতিহারী এসে হাজির, বলে— ইত
ইতৌ, ইত ইতৌ, ইত ইতৌ। সব্বাই মিলে মনটাকে যেন বুলি-চাপা দিয়ে রেখেছে।
সদাগর। কেন, মাঝে মাঝে যখন শিকারে যাও তখন বুনোজন্তু ছাড়া আর-কোনো উৎপাত তো
থাকে না।
রাজপুত্র। বুনোজন্তু বলো কাকে। আমার তো সন্দেহ হয়, রাজশিকারী বাঘগুলোকে
আফিম খাইয়ে রাখে। ওরা যেন অহিংস্রনীতির দীক্ষা নিয়েছে। এ পর্যন্ত একটাকেও
তো ভদ্ররকম লাফ মারতে দেখলুম না।
সদাগর। যাই বল, বাঘের এই আচরণকে আমি তো অসৌজন্য ব’লে মনে করি নে। শিকারে
যাবার ধুমধামটা সম্পূর্ণই থাকে, কেবল বুক দুর্দুর্ করে না।
রাজপুত্র। সেদিন ভালুকটাকে বহুদূর থেকে তীর বিঁধেছিলুম, তা নিয়ে চার দিক
থেকে ধন্য-ধন্য পড়ে গেল; বললে, রাজপুত্রের লক্ষ্যভেদের কী নৈপুণ্য! তার পরে
কানাকানিতে শুনলুম, একটা মরা ভালুকের চামড়ার মধ্যে খড়বিচিলি ভরে দিয়ে
সাজিয়ে রেখেছিল। এত বড়ো পরিহাস সহ্য করতে পারি নি। শিকারীকে কারাদণ্ডের
আদেশ করে দিয়েছি।
সদাগর। তার উপকার করেছ। তার সে কারাগারটা রানীমার অন্দরমহলের সংলগ্ন, সে
দিব্যি সুখে আছে। এই তো সেদিন, তার জন্য তিন মন ঘি আর তেত্রিশটা পাঁঠা
পাঠিয়ে দিয়েছি আমাদের গদি থেকে।
রাজপুত্র। এর অর্থ কী।
সদাগর। সে ভালুকটার সৃষ্টি যে রানীমারই আদেশে।
রাজপুত্র। ঐ তো। আমরা পড়েছি অসত্যের বেড়াজালে। নিরাপদের খাঁচায় থেকে থেকে
আমাদের ডানা আড়ষ্ট হয়ে গেল। আগাগোড়া সবই অভিনয়। আমাকে যুবরাজী সঙ বানিয়েছে।
আমার এই রাজসাজ ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ঐ-যে ফসলখেতে ওদের চাষ করতে দেখি,
আর ভাবি, পূর্বপুরুষের পুণ্যে ওরা জন্মেছে চাষী হয়ে।
সদাগর। আর, ওরা তোমার কথা কী ভাবে সে ওদের জিজ্ঞাসা করে দেখো দেখি।
রাজপুত্র, তুমি কী সব বাজে কথা বলছ— মনের আসল কথাটা লুকিয়েছ। ওগো পত্রলেখা,
আমাদের রাজপুত্রের গোপন কথাটি হয়তো তুমিই আন্দাজ করতে পারবে, একবার সুধিয়ে
দেখো-না।
পত্রলেখার প্রবেশ
গান
পত্রলেখা। গোপন কথাটি রবে না গোপনে,
উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে—
রাজপুত্র। না না
না, রবে না গোপনে।
বিভল হাসিতে
বাজিল বাঁশিতে,
স্ফুরিল অধরে নিভৃত স্বপনে—
রাজপুত্র।
না না না, রবে না গোপনে।
পত্রলেখা।
মধুপ গুঞ্জরিল,
মধুর বেদনায় আলোক-পিয়াসি
অশোক মুঞ্জরিল।
হৃদয়শতদল
করিছে টলমল
অরুণ প্রভাতে করুণ তপনে—
রাজপুত্র। না না
না, রবে না গোপনে॥
রাজপুত্র। আছে আমার গোপন কথা, সে কথাটা গোপন রয়েছে দূরের আকাশে। সমুদ্রের
ধারে বসে থাকি পশ্চিম দিগন্তের দিকে চেয়ে। সেইখানে আমার অদৃষ্ট যা যক্ষের
ধনের মতো গোপন করে রেখেছে যাব তারই সন্ধানে।
গান
যাবই আমি যাবই ওগো
বাণিজ্যেতে যাবই।
লক্ষ্মীরে হারাবই যদি
অলক্ষ্মীরে পাবই।
সদাগর। ও কী কথা। বাণিজ্য? ও যে তুমি সদাগরের মন্ত্র আওড়াচ্ছ।
রাজপুত্র। সাজিয়ে নিয়ে জাহাজখানি
বসিয়ে হাজার দাঁড়ি
কোন্ পুরীতে যাব দিয়ে
কোন্ সাগরে পাড়ি।
কোন্ তারকা লক্ষ্য করি
কূল-কিনারা পরিহরি
কোন্ দিকে যে বাইব তরী
বিরাট কালো নীরে—
মরব না আর ব্যর্থ আশায়
সোনার বালুর তীরে।
সদাগর। অকূলের নাবিকগিরি ক’রে নিরুদ্দেশ হওয়া, এ তো বাণিজ্যের রাস্তা নয়।
খবর কিছু পেয়েছ কি।
রাজপুত্র। পেয়েছি বৈকি। পেয়েছি আভাসে, পেয়েছি স্বপ্নে।
নীলের কোলে শ্যামল সে দ্বীপ
প্রবাল দিয়ে ঘেরা।
শৈলচূড়ায় নীড় বেঁধেছে
সাগরবিহঙ্গেরা।
নারিকেলের শাখে শাখে
ঝোড়ো হাওয়া কেবল ডাকে,
ঘন বনের ফাঁকে ফাঁকে
বইছে নগনদী।
সাত রাজার ধন মানিক পাবই
সেথায় নামি যদি॥
সদাগর। তোমার গানের সুরে বোঝা যাচ্ছে, এ মানিকটি তো সদাগরি মানিক নয়, এ
মানিকের নাম বলো তো।
রাজপুত্র। নবীনা! নবীনা!
সদাগর। নবীনা! এতক্ষণে একটা স্পষ্ট কথা পাওয়া গেল।
রাজপুত্র। স্পষ্ট হয়ে রূপ নিতে এখনো দেরি আছে।
গান
হে নবীনা, হে নবীনা
প্রতিদিনের
পথের ধুলায় যায় না চিনা।
শুনি বাণী ভাসে
বসন্তবাতাসে,
প্রথম
জাগরণে দেখি সোনার মেঘে লীনা।
সদাগর। তোমার এ স্বপ্নের ধন কিন্তু সংগ্রহ করা শক্ত হবে।
রাজপুত্র। স্বপনে দাও ধরা
কী কৌতুকে ভরা।
কোন্ অলকার ফুলে
মালা গাঁথ চুলে,
কোন্ অজানা সুরে
বিজনে বাজাও বীণা॥
রাজমাতার প্রবেশ
সদাগর। রানীমা, উনি মরীচিকাকে জাল ফেলে ধরবেন, উনি রূপকথার দেশের সন্ধান
পেতে চান।
মা। সে কী কথা। আবার ছেলেমানুষ হতে চাস নাকি।
রাজপুত্র। হাঁ, মা, বুড়োমানুষির সুবুদ্ধি-ঘেরা জগতে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছে।
মা। বুঝেছি, বাছা, আসলে, তোমার অভাবটা অভাবেরই অভাব। পাওয়া জিনিসে তোমার
বিতৃষ্ণা জন্মেছে। তুমি চাইতে চাও, আজ পর্যন্ত সে সুযোগ তোমার ঘটে নি।
রাজপুত্র।
গান
আমার মন বলে, ‘চাই চাই গো
যারে নাহি পাই গো।’
সকল পাওয়ার মাঝে
আমার মনে বেদন বাজে,
‘নাই নাই নাই গো।’
হারিয়ে যেতে হবে,
ফিরিয়ে পাব তবে,
সন্ধ্যাতারা যায় যে চলে
ভোরের তারায় জাগবে ব’লে,
বলে সে, ‘যাই যাই যাই গো।’
মা। বাছা, তোমাকে ধরে রাখতে গেলেই হারাব। তুমি বইতে পারবে না আরামের বোঝা,
সইতে পারবে না সেবার বন্ধন। আমি ভয় ক’রে অকল্যাণ করব না। ললাটে দেব
শ্বেতচন্দনের তিলক, শ্বেত উষ্ণীষে পরাব শ্বেতকরবীর গুচ্ছ। যাই কুলদেবতার
পুজো সাজাতে। সন্ধ্যার সময় আরতির কাজল পরাব চোখে। পথে দৃষ্টির বাধা যাবে
কেটে। [ রাজমাতার প্রস্থান
রাজপুত্র।
গান
হেরো, সাগর উঠে তরঙ্গিয়া
বাতাস বহে বেগে।
সূর্য যেথায় অস্তে নামে
ঝিলিক মারে মেঘে।
দক্ষিণে চাই, উত্তরে চাই,
ফেনায় ফেনা, আর কিছু নাই,
যদি কোথাও কূল নাহি পাই
তল পাব তো তবু।
ভিটার কোণে হতাশমনে
রবই না আর কভু।
অকূল-মাঝে ভাসিয়ে তরী
যাচ্ছি অজানায়।
আমি শুধু একলা নেয়ে
আমার শূন্য নায়।
নব নব পবন-ভরে
যাব দ্বীপে দ্বীপান্তরে,
নেব তরী পূর্ণ ক’রে
অপূর্ব ধন যত—
ভিখারি মন ফিরবে যখন
ফিরবে রাজার মতো॥
দ্বিতীয় দৃশ্য
রাজপুত্র ও সদাগরপুত্র
রাজপুত্র। এক ডাঙা থেকে দিলেম পাড়ি, তরী ডুবল মাঝ সমুদ্রে, ভেসে উঠলেম
আর-এক ডাঙায়। এতদিন পরে মনে হচ্ছে, জীবনে নতুন পর্ব শুরু হল।
সদাগর। রাজপুত্র, তুমি তো কেবলই নতুন নতুন করে অস্থির হলে। আমি ভয় করি ঐ
নতুনকেই। যাই বল, বন্ধু, পুরোনোটা আরামের।
রাজপুত্র। ব্যাঙের আরাম এঁদো কুয়োর মধ্যে। এটা বুঝলে না, উঠে এসেছি মরণের
তলা থেকে। যম আমাদের ললাটে নতুন জীবনের তিলক পরিয়ে দিলেন।
সদাগর। রাজতিলক তোমার ললাটে তো নিয়েই এসেছ জন্মমুহূর্তে।
রাজপুত্র। সে তো অদৃষ্টের ভিক্ষেদানের ছাপ। যমরাজ মহাসমুদ্রের জলে সেটা
কপাল থেকে মুছে দিয়ে হুকুম করেছেন, নতুন রাজ্য নতুন শক্তিতে জয় করে নিতে
হবে, নতুন দেশে।–
গান
এলেম নতুন দেশ
তলায় গেল ভগ্ন তরী, কূলে এলেম ভেসে।
অচিন মনের ভাষা
শোনাবে অপূর্ব কোন্ আশা,
বোনাবে রঙিন সুতোয় দুঃখসুখের জাল,
বাজবে প্রাণে নতুন গানের তাল,
নতুন বেদনায় ফিরব কেঁদে হেসে।
নাম-না-জানা প্রিয়া
নাম-না-জানা ফুলের মালা নিয়া
হিয়ায় দেবে হিয়া।
যৌবনেরি নবোচ্ছ্বাসে
ফাগুনমাসে
বাজবে নূপুর ঘাসে ঘাসে,
মাতবে দখিনবায়
মঞ্জরিত লবঙ্গলতায়
চঞ্চলিত এলোকেশে॥
সদাগর। রাজপুত্র, তোমার গানের সুরে কথাটা শোনাচ্ছে ভালো। কিন্তু, জিজ্ঞাসা
করি, এ দেশে যৌবনের নবীন রূপ দেখলে কোথায়। চারি দিকটা তো একবার ঘুরে এসেছি।
দেখে মনে হল, যেন ছুতোরের তৈরি কাঠের কুঞ্জবন। দেখলুম, ওরা চৌকো চৌকো কেঠো
চালে চলেছে, বুকে পিঠে চ্যাপটা, পা ফেলছে খিট্খুট্ খিট্খুট্ শব্দে, বোধ
করি চৌকুনি নূপুর পরেছে পায়ে, তৈরি সেটা তেঁতুল কাঠে। এই মরা দেশকে কি বলে
নতুন দেশ।
রাজপুত্র। এর থেকেই বুঝবে, জিনিসটা সত্যি নয়, এটা বানানো, এটা উপর থেকে
চাপানো, এদের দেশের পণ্ডিতদের হাতে গড়া খোলস। আমরা এসেছি কী করতে— খসিয়ে
দেব। ভিতর থেকে প্রাণের কাঁচা রূপ যখন বেরিয়ে পড়বে, আশ্চর্য করে দেবে।
সদাগর। আমরা সদাগর মানুষ, যা পষ্ট দেখি তার থেকেই দর যাচাই করি। আর, যা
দেখতে পাও না তারই উপর তোমাদের বিশ্বাস। আচ্ছা, দেখা যাক, ছাইয়ের মধ্যে
থেকে আগুন বেরোয় কি না। আমার তো মনে হয়, ফুঁ দিতে দিতে দম ফুরিয়ে যাবে। ঐ
দেখো-না, এই দিকেই আসছে— এ যেন মরা দেহে ভূতের নৃত্য।
রাজপুত্র। একটু সরে দাঁড়ানো যাক। দেখি-না কাণ্ডটা কী।
তাসের দলের প্রবেশ
তাসের কাওয়াজ
গান
তোলন নামন
পিছন সামন,
বাঁয়ে ডাইনে
চাই নে চাই নে,
বোসন ওঠন,
ছড়ান গুটন,
উলটো-পালটা
ঘূর্ণি চালটা—
বাস্ বাস্ বাস্।
সদাগর। দেখছ ব্যাপারটা! লাল উর্দি, কালো উর্দি, উঠছে পড়ছে, শুচ্ছে বসছে,
একেবারে অকারণে— ভারি অদ্ভুত। হা হা হা হা।
ছক্কা। এ কী ব্যাপার! হাসি!
পঞ্জা। লজ্জা নেই তোমাদের! হাসি!
ছক্কা। নিয়ম মান না তোমরা! হাসি!
রাজপুত্র। হাসির তো একটা অর্থ আছে। কিন্তু, তোমরা যা করেছিলে তার অর্থ নেই
যে।
ছক্কা। অর্থ? অর্থের কী দরকার। চাই নিয়ম। এটা বুঝতে পার না? পাগল নাক
তোমরা!
রাজপুত্র। খাঁটি পাগল তো চেনা সহজ নয়। চিনলে কী করে।
পঞ্জা। চালচলন দেখে।
রাজপুত্র। কীরকম দেখলে।
ছক্কা। দেখলেম, কেবল চলনটাই আছে তোমাদের, চালটা নেই।
সদাগর। আর, তোমাদের বুঝি চালটাই আছে, চলনটা নেই?
পঞ্জা। জান না, চালটা অতি প্রাচীন, চলনটাই আধুনিক, অপোগণ্ড, অর্বাচীন,
অজাতশ্মশ্রু।
ছক্কা। গুরুমশায়ের হাতে মানুষ হও নি। কেউ বুঝিয়ে দেয় নি, রাস্তায় ঘাটে খানা
আছে, ডোবা আছে, কাঁটা আছে, খোঁচা আছে— চলন জিনিসটার আপদ বিস্তর।
রাজপুত্র। এ দেশটা তো গুরুমশায়েরই দেশ। শরণ নেব তাঁদের।
ছক্কা। এবার তোমাদের পরিচয়টা?
রাজপুত্র। আমরা বিদেশী।
পঞ্জা। বাস্। আর, বলতে হবে না। তার মানে, তোমাদের জাত নেই, কুল নেই, গোত্র
নেই, গাঁই নেই, ঞ্জাত নেই, গুষ্টি নেই, শ্রেণী নেই, পঙ্ক্তি নেই।
রাজপুত্র। কিছু নেই, কিছু নেই— সব বাদ দিয়ে এই যা আছে, দেখছই তো। এখন
তোমাদের পরিচয়টা?
ছক্কা। আমরা ভুবনবিখ্যাত তাসবংশীয়। আমি ছক্কা শর্মণ।
পঞ্জা। আমি পঞ্জা বর্মণ।
রাজপুত্র। ঐ যারা সংকোচে দূরে দাঁড়িয়ে?
ছক্কা। কালো-হানো, ঐ তিরি ঘোষ।
পঞ্জা। আর, রাঙা-মতো এই দুরি দাস।
সদাগর। তোমাদের উৎপত্তি কোথা থেকে।
ছক্কা। ব্রহ্মা হয়রান হয়ে পড়লেন সৃষ্টির কাজে। তখন বিকেল বেলাটায় প্রথম যে
হাই তুললেন, পবিত্র সেই হাই থেকে আমাদের উদ্ভব।
পঞ্জা। এই কারণে কোনো কোনো ম্লেচ্ছভাষায় আমাদের তাসবংশীয় না বলে হাইবংশীয়
বলে।
সদাগর। আশ্চর্য।
ছক্কা। শুভ গোধূলিলগ্নে পিতামহ চার মুখে একসঙ্গে তুললেন চার হাই।
সদাগর। বাস্ রে। ফল হল কী।
ছক্কা। বেরিয়ে পড়ল ফস্ ফস্ করে ইস্কাবন, রুইতন, হরতন, চিঁড়েতন। এঁরা
সকলেই প্রণম্য। (প্রণাম)
রাজপুত্র। সকলেই কুলীন?
ছক্কা। কুলীন বৈকি। মুখ্য কুলীন। মুখ থেকে উৎপত্তি।
পঞ্জা। তাসবংশের আদিকবি ভগবান তাসরঙ্গনিধি দিনের চার প্রহর ঘুমিয়ে স্বপ্নের
ঘোরে প্রথম যে ছন্দ বানালেন সেই ছন্দের মাত্রা গুনে গুনে আমাদের
সাড়ে-সাঁইত্রিশ রকমের পদ্ধতির উদ্ভব।
রাজপুত্র। অন্তত তার একটাও তো জানা চাই।
পঞ্জা। আচ্ছা, তা হলে মুখ ফেরাও।
রাজপুত্র। কেন।
পঞ্জা। নিয়ম। ভাই ছক্কা, ঠুং মন্ত্র প’ড়ে ওদের কানে একটা ফুঁ দিয়ে দাও।
রাজপুত্র। কেন।
পঞ্জা। নিয়ম।
তাসের দলের গান
হা-হা-আ-আই।
হাতে কাজ নাই।
দিন যায় দিন যায়।
আয় আয় আয় আয়।
হাতে কাজ নাই॥
রাজপুত্র। আর সহ্য করতে পারছি নে, মুখ ফেরাতে হল।
পঞ্জা। এঃ! ভেঙে দিলে মন্ত্রটা! অশুচি করে দিলে!
রাজপুত্র। অশুচি?
পঞ্জা। অশুচি নয় তো কী। মন্ত্রের মাঝখানটায় বিদেশীর দৃষ্টি পড়ল।
রাজপুত্র। এখন উপায়?
ছক্কা। বাদুড়ে-খাওয়া গাবের আঁটি পুড়িয়ে তিন দিন চোখে কাজল পরতে হবে, তবেই
স্বর্গে পিতামহদের উপোস ভাঙবে।
রাজপুত্র। বিপদ ঘটিয়েছি তো। তোমাদের দেশে খুব সাবধানে চলতে হবে।
ছক্কা। একেবারে না চললেই ভালো হয়, শুচি থাকতে পারবে।
রাজপুত্র। শুচি থাকলে কী হয়।
পঞ্জা। কী আর হবে, শুচি থাকলে শুচি হয়। বুঝতে পারছ না?
রাজপুত্র। আমাদের পক্ষে বোঝা অসম্ভব। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, ঐ পাড়ির উপরে
কী করছিলে দল বেঁধে।
ছক্কা। যুদ্ধ।
রাজপুত্র। তাকে বলে যুদ্ধ?
পঞ্জা। নিশ্চয়! অতি বিশুদ্ধ নিয়মে। তাসবংশোচিত আচার-অনুসারে।
গান
আমরা চিত্র, অতি বিচিত্র,
অতি
বিশুদ্ধ, অতি পবিত্র।
সদাগর। তা হোক। যুদ্ধে একটু রাগারাগি না হলে রস থাকে না।
ছক্কা। আমাদের রাগ রঙে।
আমাদের যুদ্ধ—
নহে কেহ ক্রুদ্ধ,
ওই দেখো গোলাম
অতিশয় মোলাম।
সদাগর। তা হোক্-না, তবু কামান-বন্দুকটা যুদ্ধক্ষেত্রে মানায় ভালো।
পঞ্জা। নাহি কোনো অস্ত্র,
খাকি-রাঙা বস্ত্র।
নাহি লোভ,
নাহি ক্ষোভ,
নাহি লাফ,
নাহি ঝাঁপ।
রাজপুত্র। নাই রইল, তবু একটা নালিশ থাকা চাই তো। তাই নিয়েই তো দুই পক্ষে
লড়াই।
ছক্কা।
যথারীতি জানি
সেইমতে মানি,
কে তোমার শত্রু, কে তোমার
মিত্র,
কে তোমার টক্কা, কে তোমার
ফক্কা।
পঞ্জা। ওহে বিদেশী, শাস্ত্রমতে তোমাদেরও তো একটা উৎপত্তি ঘটেছিল?
সদাগর। নিশ্চিত। পিতামহ ব্রহ্মা সৃষ্টির গোড়াতেই সূর্যকে সেই শানে চড়িয়েছেন
অমনি তাঁর নাকের মধ্যে ঢুকে পড়ল একটা আগুনের স্ফুলিঙ্গ। তিনি কামানের মতো
আওয়াজ ক’রে হেঁচে ফেললেন— সেই বিশ্ব-কাঁপানি হাঁচি থেকেই আমাদের উৎপত্তি।
ছক্কা। এখন বোঝা গেল! তাই এত চঞ্চল!
রাজপুত্র। স্থির থাকতে পারি নে, ছিটকে ছিটকে পড়ি।
পঞ্জা। সেটা তো ভালো নয়।
সদাগর। কে বলছে ভালো। আদিযুগের সেই হাঁচির তাড়া আজও সামলাতে পারছি নে।
ছক্কা। একটা ভালো ফল দেখতে পাচ্ছি— এই হাঁচির তাড়ায় তোমরা সকাল-সকাল এই
দ্বীপ থেকে ছিটকে পড়বে, টিঁকতে পারবে না।
সদাগর। টেঁকা শক্ত।
পঞ্জা। তোমাদের যুদ্ধটা কী ধরনের।
সদাগর। সেটা দুই দুই পক্ষের চার-চার জোড়া হাঁচির মাপে।
ছক্কা। হাঁচির মাপে? বাস্ রে, তা হলে মাথা ঠেকাঠুকি হবে তো!
সদাগর। হাঁ, একেবারে দমাদ্দম।
ছক্কা। তোমাদেরও আদিকবির মন্ত্র আছে তো?
সদাগর। আছে বৈকি।
গান
হাঁচ্ছোঃ,
ভয় কী দেখাচ্ছ।
ধরি টিপে টুঁটি,
মুখে মারি মুঠি,
বলো দেখি কী আরাম
পাচ্ছ॥
ছক্কা। ওহে ভাই পঞ্জা, একেবারে অসবর্ণ। কী জাতি তোমরা।
সদাগর। আমরা নাশক, নাসা থেকে উৎপন্ন।
পঞ্জা। কোনো উচ্চবংশীয় জাতির অমনতরো নাম তো শুনি নি।
সদাগর। হাইয়ের বাষ্পে তোমরা উড়ে গেছ উচ্চে, পরলোকের পারে; হাঁচির চোটে আমরা
পড়েছি নীচে, এই ইহলোকের ধারে।
ছক্কা। পিতামহের নাসিকার অসংযমবশতই তোমরা এমন অদ্ভুত।
রাজপুত্র। এতক্ষণে ঠিক কথাটাই বেরিয়েছে তোমার মুখ থেকে, আমরা অদ্ভুত।
গান
আমরা নূতন যৌবনেরই
দূত,
আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত।
আমরা বেড়া ভাঙি,
আমরা অশোকবনের রাঙা নেশায় রাঙি,
ঝঞ্ঝার বন্ধন ছিন্ন করে দিই,
আমরা বিদ্যুৎ।
আমরা করি ভুল।
অগাধ জলে ঝাঁপ দিয়ে
যুঝিয়ে পাই কূল।
যেখানে ডাক পড়ে
জীবন-মরণ-ঝড়ে
আমরা প্রস্তুত॥
ছক্কা-পঞ্জা। (পরস্পর মুখ চেয়ে) এ চলবে না, এ চলবে না।
রাজপুত্র। যা চলবে না তাকেই আমরা চালাই।
ছক্কা। কিন্তু, নিয়ম!
রাজপুত্র। বেড়ার নিয়ম ভাঙলেই পথের নিয়ম আপনিই বেরিয়ে পড়ে, নইলে এগোব কী
করে।
পঞ্জা। ওরে ভাই, কী বলে এরা। এগোবে! অম্লানমুখে ব’লে বসল, এগোব।
রাজপুত্র। নইলে চলা কিসের জন্যে।
ছক্কা। চলা! চলবে কেন তুমি! চলবে নিয়ম।
গান
চলো নিয়ম-মতে।
দূরে তাকিয়ো
নাকো,
ঘাড় বাঁকিয়ে নাকো,
চলো সমান পথে।
রাজপুত্র। হেরো অরণ্য ওই,
হোথা শৃঙ্খলা কই,
পাগল ঝরনাগুলো
দক্ষিণ পর্বতে।
তাসের দল। ওদিকে চেয়ো না চেয়ো না,
যেয়ো না যেয়ো না—
চলো সমান পথে॥
পঞ্জা। আর নয়, ঐ আসছেন রাজাসাহেব,
আসছেন রানীবিবি। এইখানে আজ সভা। এই নাও ভুঁইকুমড়োর ডাল একটা করে।
রাজপুত্র। ভুঁইকুমড়োর ডাল? হা হা হা হা— কেন।
পঞ্জা। চুপ। হেসো না, নিয়ম। বোসো ঈশান কোণে মুখ ক’রে, খবরদার বায়ুকোণে মুখ
ফিরিয়ো না।
রাজপুত্র। কেন।
ছক্কা। নিয়ম।
রাজা
রানী টেক্কা গোলাম প্রভৃতির
যথারীতি যথাভঙ্গিতে প্রবেশ
রাজপুত্র। ওহে ভাই, স্তবগান করে রাজাকে খুশি করে দিই। তুমি ভুঁইকুমড়োর
ডালটা দোলাও।
গান
জয় জয় তাসবংশ-অবতংস,
তন্দ্রাতীরনিবাসী,
সব-অবকাশ ধ্বংস।
তাসের দল। ভ্যাস্তা ভ্যাস্তা ভ্যাস্তা! অকালে সভা দিলে ভেঙে, বর্বর!
রাজা। শান্ত হও, এরা কারা।
ছক্কা। বিদেশী।
রাজা। বিদেশী! তা হলে নিয়ম খাটবে না। একবার সকলে ঠাঁই বদল করে নাও, তা হলেই
দোষ যাবে কেটে। সর্বাগ্রে তাসমহাসভার জাতীয় সংগীত।
সকলে।
গান
চিঁড়েতন, হর্তন, ইস্কাবন—
অতি সনাতন ছন্দে
করতেছে নর্তন
চিঁড়েতন হর্তন।
কেউ-বা ওঠে কেউ পড়ে,
কেউ-বা একটু নাহি নড়ে,
কেউ শুয়ে শুয়ে ভুঁয়ে
করে কালকর্তন।
নাহি কহে কথা কিছু,
একটু না হাসে,
সামনে যে আসে,
চলে তারি পিছু পিছু।
বাঁধা তার পুরাতন চালটা,
নাই কোনো উলটা-পালটা,
নাই পরিবর্তন॥
রাজা। ওহে বিদেশী
রাজপুত্র। কী রাজাসাহেব।
রাজা। কে তুমি।
রাজপুত্র। আমি সমুদ্রপারের দূত।
গোলাম। ভেট এনেছ কী।
রাজপুত্র। এ দেশে সব চেয়ে যা দুর্লভ, তাই এনেছি।
গোলাম। সেটা কী শুনি।
রাজপুত্র। উৎপাত।
ছক্কা। শুনলে তো রাজাসাহেব, কথাটা তো শুনলে? লোকটা এগোতে চায়, বললে বিশ্বাস
করবে না, লোকটা হাসে। দুদিনে এখানকার হাওয়া দেবে হালকা করে।
গোলাম। এখানকার হাওয়া যেমন স্থির, যেমন ভারী, এমন কোনো গ্রহে নেই। ইন্দ্রের
বিদ্যুৎ পর্যন্ত একে নাড়া দিতে পারে না, অন্যে পরে কা কথা।
সকলে। (একবাক্যে) অন্যে পরে কা কথা।
গোলাম। লঘুচিত্ত বিদেশী এই হাওয়াকে যদি হালকা করে তা হলে কী হবে।
রাজা। সেটা চিন্তার বিষয়।
সকলে। সেটা চিন্তার বিষয়।
গোলাম। হালকা হাওয়াতেই ঝড় আসে। ঝড় এলেই নিয়ম যায় উড়ে। তখন আমাদের
পুরুত-ঠাকুর নহলা গোস্বামী পর্যন্ত বলতে শুরু করবেন, আমরা এগোব।
পঞ্জা। এমন-কি, ভগবান না করুন, হয়তো এখানে হাসিটা সংক্রামক হয়ে উঠবে।
রাজা। ওহে ইস্কাবনের গোলাম।
গোলাম। কী রাজাসাহেব।
রাজা। তুমি তো সম্পাদক।
গোলাম। আমি তাসদ্বীপপ্রদীপের সম্পাদক। আমি তাসদ্বীপের কৃষ্টির রক্ষক।
রাজা। কৃষ্টি! এটা কি জিনিস। মিষ্টি শোনাচ্ছে না তো।
গোলাম। না মহারাজ, এ মিষ্টিও নয়, স্পষ্টও নয়, কিন্তু যাকে বলে নতুন, নবতম
অবদান। এই কৃষ্টি আজ বিপন্ন।
সকলে। কৃষ্টি, কৃষ্টি, কৃষ্টি।
রাজা। তোমার পত্রে সম্পাদকীয় স্তম্ভ আছে তো?
গোলাম। দুটো বড়ো বড়ো স্তম্ভ।
রাজা। সেই স্তম্ভের গর্জনে সবাইকে স্তম্ভিত করে দিতে হবে। এখানকার বায়ুকে
লঘু করা সইব না।
গোলাম। বাধ্যতামূলক আইন চাই।
রাজা। ওটা আবার কী বললে! বাধ্যতামূলক আইন!
গোলাম। কানমলা আইনের নব্য ভাষা। এও নবতম অবদান।
রাজা। আচ্ছা, পরে হবে। বিদেশী, তোমার কোনো আবেদন আছে?
রাজপুত্র। আছে, কিন্তু তোমার কাছে নয়।
রাজা। কার কাছে।
রাজপুত্র। এই রাজকুমারীদের কাছে।
রাজা। আচ্ছা, বলো।
রাজপুত্র।
গান
ওগো, শান্ত পাষাণমুরতি সুন্দরী,
চঞ্চলেরে হৃদয়তলে লও বরি।
কুঞ্জবনে এসো একা,
নয়নে অশ্রু দিক দেখা,
অরুণরাগে হোক রঞ্জিত
বিকশিত বেদনার মঞ্জরী॥
রানী। এ কী অনিয়ম, এ কী অবিচার!
পঞ্জা। রাজাসাহেব, নির্বাসন, ওকে নির্বাসন!
রাজা। নির্বাসন! রানীবিবি, তোমার কী মত। চুপ ক’রে রইলে যে। শুনছ আমার কথা?
একটা উত্তর দাও। কী বল, নির্বাসন তো?
রানী। না, নির্বাসন নয়।
টেক্কাকুমারীরা। (একে একে) না, নির্বাসন নয়।
রাজা। রানীবিবি, তোমাকে যেন কেমন-কেমন মনে হচ্ছে।
রানী। আমার নিজেরই মনে হচ্ছে কেমন-কেমন।
গোলাম। টেক্কাকুমারী, বিবিসুন্দরী, মনে রেখো, আমার হাতে সম্পাদকীয় স্তম্ভ।
সকলে। কৃষ্টি, কৃষ্টি, তাসদ্বীপের কৃষ্টি। বাঁচাও সেই কৃষ্টি।
গোলাম। জারি করো বাধ্যতামূলক আইন।
রাজা। অর্থাৎ?
গোলাম। কানমলা মোচড়ের আইন।
রাজা। বুঝেছি। রানীবিবি, তোমার কী মত। বাধ্যতামূলক আইন এবার তবে চালাই?
রানী। বাধ্যতামূলক আইন অন্দরমহলে আমরাও চালিয়ে থাকি— দেখব, কে দেয় কাকে
নির্বাসন।
টেক্কাকুমারীরা। (সকলে) আমরা চালাব অবাধ্যতামূলক বে-আইন।
গোলাম। এ কী হল। হায় কৃষ্টি, হায় কৃষ্টি, হায় কৃষ্টি।
রাজা। সভা ভেঙে দিলুম। এখনি সবাই চলে এসো। আর এখানে থাকা নিরাপদ নয়। [তাসের
দলের প্রস্থান]
সদাগর। ভাই সাঙাত, এখানে তো আর সহ্য হচ্ছে না। এরা যে বিধাতার ব্যঙ্গ। এদের
মধ্যে প’ড়ে আমরা সুদ্ধ মাটি হয়ে যাব।
রাজপুত্র। ভিতরে ভিতরে কী ঘটছে , সেটা কি তোমার চোখে পড়ে না। পুতুলের মধ্যে
প্রথম প্রাণের সঞ্চার কি অনুভব করছ না। আমি তো শেষ পর্যন্ত না দেখে যাচ্ছি
নে।
সদাগর। কিন্তু, এ যে জীবন্মৃতের খাঁচা, নিয়মের জারকরসে জীর্ণ এদের মন।
রাজপুত্র। ঐ দিকে চোখ মেলে দেখো দেখি।
সদাগর। তাই তো, বন্ধু, লেগেছে সমুদ্রপারের মন্ত্র। ইস্কাবনের নহলা গাছের
তলায় পা ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে, দেখছি এখানকার নিয়ম গেল উড়ে।
রাজপুত্র। চিঁড়েতনীর পায়ের শব্দ শুনছে আকাশ থেকে। এ সময়ে বোধ হয় আমাদের
সঙ্গটা ওর পছন্দ হবে না। চলো, আমরা সরে যাই। [ প্রস্থান]
তৃতীয় দৃশ্য
প্রসাধনে রত ইস্কাবনী। টেক্কানীর
প্রবেশ
টেক্কানী।
গান
বলো, সখী, বলো তারি নাম
আমার কানে কানে
যে-নাম বাজে তোমার বীণার তানে তানে।
বসন্তবাতাসে বনবীথিকায়
সে-নাম মিলে যাবে,
বিরহী বিহঙ্গ-কলগীতিকায়
সে-নাম
মদির হবে-যে বকুলঘ্রাণে।
নাহয় সখীদের মুখে মুখে
সে-নাম দোলা
খাবে সকৌতুকে।
পূর্ণিমারাতে একা যবে
অকারণে মন উতলা হবে
সে-নাম শুনাইব গানে গানে॥
ইস্কাবনী। ভাই, এ কী হল বলো তো এই তাসের দেশে। ঐ বিদেশীরা কী খ্যাপামির
হাওয়া নিয়ে এল। মনটা কেবলই টলমল করছে।
টেক্কানী। হাঁ, ভাই ইস্কাবনী, আর দুদিন আগে কে জানত তাসেরা আপন জাত খুইয়ে
ঠিক যেন মানুষের মতো চালচলন ধরবে। ছি ছি, কী লজ্জা।
ইস্কাবনী। বলো তো, ভাই, মানুষপনা, এ-যে অনাচার। এ কিন্তু শুরু করেছে
তোমাদের ঐ হরতনী। দেখিস নি? আজকাল ওর চলন ঠিক থাকে না একেবারে হুবহু
মানুষের ভঙ্গি। কার পাশে কখন দাঁড়াতে হবে তারও সমস্ত ভুল হয়ে যায়, পাড়ায় ঢি
ঢি পড়ে গেছে। তাসের দেশের নাম ডোবালে।
চিঁড়েতনীর প্রবেশ
চিঁড়েতনী। কী গো টেক্কাঠাকরুন, শুনেছি, আমাদের নিন্দে রটিয়ে বেড়াচ্ছ। বলছ,
আমরা আচার খুইয়ে, ওঠবার বেলায় বসি, বসবার বেলায় উঠি।
টেক্কানী। তা, সত্যি কথা বলেছি, দোষ হয়েছে কী। ঐ-যে তোমার গাল দুটি টুকটুক
করছে, রঙ্গিনী, সে কোন্ রঙে। আর, ঐ-যে তোমার ভুরুর ভঙ্গিমা, ধার করেছ
কোন্ বিদেশী অমাবস্যার কাজললতা থেকে। এটা তো সাতজন্মে তাসের দেশের শাস্তরে
লেখে না। তুমি কি ভাব’, এ কারো চোখে পড়ে না।
চিঁড়েতনী। মরে যাই! আর, তুমি যে তোমার ঐ সখীটিকে নিয়ে বকুলতলায় বসে দিনরাত
কানে কানে ফিস্-ফিস্ করছ, এটাই কি তাসের দেশের শাস্ত্রে লেখে না কি।
ওদিকে-যে গোলাম বেচারা তার জুড়ি পায় না, মরে হায়-হায় ক’রে।
ইস্কাবনী। আহা, গুরুঠাকরুন, উপদেশ দিতে হবে না। চুলে যে রাঙা ফিতেটা জড়িয়েছ
ঐ ফিতে দিয়ে তাসের দেশের আচার বিচার গলায় দড়ি দিয়ে মরবে। এতবড়ো বেহায়াগিরি
তাসরমণী হয়ে!
চিঁড়েতনী। তা,হয়েছে কী। আমি ভয় করি নে কাউকে, তোমাদের মতো লুকোচুরি আমার
স্বভাব নয়। ঐ-যে তোমাদের দহলানী সেদিন আমাকে মানবী ব’লে টিটকারি দিতে
এসেছিল, আমি তাকে পষ্ট জবাব দিয়েছি, তোমাদের তাসিনী হয়ে মরে থাকার চেয়ে
মানবী হতে পারলে বেঁচে যেতুম।
ইস্কাবনী। অত গুমোর কোরো না গো কোরো না— জান? তোমাকে জাতে ঠেলবে বলে কথা
উঠেছে।
চিঁড়েতনী। তাসের জাত তো, আমি তা নিজের হাতে জলাঞ্জলি দিয়েছি, আমাকে ভয়
দেখাবে কিসে।
ইস্কাবনী। সর্বনাশ! এমন ধাষ্টমির কথা তো সাত জন্মে শুনি নি। উনি ঢাক পিটিয়ে
মানবী হতে চলেছেন। চল্ ভাই, টেক্কারানী, কে কোথা থেকে দেখবে, ওর সঙ্গে কথা
কচ্ছি, আমাদের সুদ্ধ মজাবে। [
প্রস্থান]
চতুর্থ দৃশ্য
শ্রীমতী হরতনী টেক্কার প্রবেশ
হরতনী।
গান
আমি ফুল তুলিতে এলেম বনে,
জানি নে কী ছিল মনে।
এ তো ফুল তোলা
নয়, এ তো ফুল তোলা নয়,
বুঝি নে কী মনে হয়,
জল ভরে যায় দু নয়নে॥
রুইতনের সাহেবের প্রবেশ
রুইতন। এ কী, হরতনী তুমি এখানে? খুঁজতে খুঁজতে বেলা হয়ে গেল যে।
হরতনী। কেন, কী হয়েছে, কী চাই।
রুইতন। তোমাকে ডাক পড়েছে রাজসভার গরাবুমণ্ডলে।
হরতনী। বলো গে, আমি হারিয়ে গেছি।
রুইতন। হারিয়ে গেছ?
হরতনী। হাঁ, হারিয়ে গেছি, যাকে খুঁজছ তাকে আর খুঁজে পাবে না, কোনোদিনই।
রুইতন। এ কী কাণ্ড। এ কী দুঃসাহস। এই বনে এসেছ তুমি? জান না— নিয়ম নেই?
হরতনী। নিয়ম তো নেই, কিন্তু কার নিয়মে বর্ষাবিহীন তাসের দেশে আজ এমন ঘনঘটা।
হঠাৎ সকালে উঠেই দেখি, নীল মেঘ আকাশ জুড়ে। এতদিন তোমাদের দেশের ময়ূর গুনে
গুনে পা ফেলত, নাচত সাবধানে, আজ কেন এমন অনিয়মের নাচ নাচল, সমস্ত পেখম
ছড়িয়ে দিয়ে।
রুইতন। কিন্তু, ঘর হতে যার আঙিনা বিদেশ, সেও আজ ফুল তুলতে বেরিয়েছে— এতবড়ো
অদ্ভূত কাজ তোমার মাথায় এল কী করে।
হরতনী। হঠাৎ মনে হল, আমি মালিনী, আর-জন্মে ফুল তুলতেম। আজ পুবে হাওয়ায় সেই
জন্মের ফুলবাগানের গন্ধ এল। সেই জন্মের মাধবীবন থেকে ভ্রমর এসেছে মনের
মধ্যে।
গান
ঘরেতে ভ্রমর এল গুন্গুনিয়ে।
আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে।
আলোতে কোন্ গগনে মাধবী জাগল বনে,
এল সেই ফুল - জাগানোর খবর নিয়ে।
সারাদিন সেই কথা সে যায় শুনিয়ে।
কেমনে রহি ঘরে, মন যে কেমন করে,
কেমনে কাটে যে দিন দিন গুনিয়ে।
কী মায়া দেয় বুলায়ে, দিল সব কাজ
ভুলায়ে,
বেলা যায় গানের সুরে জাল বুনিয়ে॥
রুইতন। আচ্ছা, গরাবুমণ্ডলের জন্যে বিবিসুন্দরীদের খুঁজে বেড়াচ্ছি, তারাও কি
তবে—
হরতনী। হাঁ, তারাও এইখানেই, নদীর ধারে ধারে, গাছের তলায় তলায়।
রুইতন। কী করছে।
হরতনী। সাজ বদল করছে, আমারই মতো। কেমন দেখাচ্ছে। পছন্দ হয়?
রুইতন। মনে হচ্ছে, পর্দা খুলে গেছে, চাঁদের থেকে মেঘ গেছে সরে, একেবারে
নতুন মানুষ।
হরতনী। তোমাদের ছক্কা পঞ্জা আমাদের শাসাবার জন্যে এসেছিলেন, তাঁদের কী দশা
হয়েছে দেখো গে যাও।
রুইতন। কেন। কী হল।
হরতনী। খ্যাপার মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছে, এমন-কি
গুন্-গুন্ করে গানও করছে।
রুইতন। গান! ছক্কা-পঞ্জার গান!
হরতনী। সুরে না হোক, বেসুরে। আমি তখন চুল বাঁধছিলুম। থাকতে পারলুম না, চলে
আসতে হল।
রুইতন। আশ্চর্য করলে। চুল বাঁধা ! এ বিদ্যে কে শেখালে।
হরতনী। কেউ না। ঐ দেখো-না, এবার হঠাৎ শুকনো ঝরনায় নামল বর্ষা। জলের ধারায়
ধারায় শুরু হল বেণীবন্ধন। এ বিদ্যা কে শেখাল তাকে। চলো আমার সঙ্গে,
ছক্কা-পঞ্জার গান শুনিয়ে দিই তোমাকে। [প্রস্থান]
বিবিদের প্রবেশ
বিবিরা।
নাচ ও গান
অজানা সুর কে দিয়ে যায় কানে কানে,
ভাবনা আমার যায় ভেসে যায় গানে গানে।
বিস্মৃত জন্মের ছায়ালোকে
হারিয়ে-যাওয়া বীণার শোকে
কেঁদে ফিরে পথহারা রাগিণী।
কোন্ বসন্তের মিলনরাতে তারার পানে
ভাবনা আমার যায় ভেসে যায় গানে গানে॥
[প্রস্থান]
রুইতন-হরতনীর পুনঃপ্রবেশ
রুইতন। দোষ দেব কাকে। আমারই গাইতে ইচ্ছা করছে।
হরতনী। দেখো, সম্পাদক যেন শুনতে না পায়, স্তম্ভে চড়াবে। সে দেখলুম ঘুরে
বেড়াচ্ছে এই বনের খবর নিতে।
রুইতন। দেখো, হরতনী, ভয় কিন্তু আমার গেছে ঘুচে, কেন কী জানি। একটা কিছু
হুকুম করো, তোমার জন্যে দুঃসাধ্য কিছু একটা করতে চাই।
হরতনী। আর যাই কর গান গেয়ো না, বনে জবা ফুটেছে, তুলে এনে দাও। ফুলের রস
দিয়ে রাঙাব পায়ের তলা।
রুইতন। দেখো, সুন্দরী, আজ সকালে উঠেই বুঝেছি, আমাদের এই তাসজন্মটা স্বপ্ন।
সেটা হঠাৎ ভাঙল। আমাদের আর-এক জন্ম বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। তারই বাণী আসছে
মুখে, তারই গান শুনছি কানে। ঐ শোনো, ঐ শোনো, আমার সেই যুগের রচিত গান আকাশ
থেকে ঐ কে বয়ে আনছে।
গান
তোমার
পায়ের তলায় যেন গো রঙ লাগে,
আমার
মনের বনের ফুলের রাঙা রাগে।
যেন
আমার গানের তানে
তোমায়
ভূষণ পরাই কানে,
যেন রক্তমণির হার গেঁথে দিই প্রাণের অনুরাগে॥
হরতনী। এ গান কোনোদিন তুমিই বেঁধেছিলে, আর আমারই জন্যে? কেমন করে বাঁধলে।
রুইতন। যেমন করে তুমি বাঁধলে বেণী।
হরতনী। আচ্ছা, মনে কি আসছে, তোমার গানে আমি নেচেছিলুম কোনো-একটা যুগে।
রুইতন। মনে আসছে, আসছে। এতদিন ভুলে ছিলুম কী করে তাই ভাবি।
গান
উতল হাওয়া লাগল আমার গানের তরণীতে।
দোলা লাগে, দোলা লাগে
তোমার চঞ্চল ওই নাচের লহরীতে।
যদি কাটে রসি,
যদি হাল পড়ে খসি,
যদি ঢেউ উঠে উচ্ছ্বসি,
সম্মুখেতে মরণ যদি জাগে,
করি নে ভয়, নেবই তারে নেবই তারে জিতে।
রুইতন। দেখো হরতনী, মন ছট্ফটিয়ে উঠেছে যমরাজের সঙ্গে পাল্লা দিতে। আমি
চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ছবি, তুমি পরিয়ে দিলে আমার কপালে জয়তিলক, আমি
বেরলুম বন্দিনীকে উদ্ধার করতে, বন্ধ দুর্গের দ্বারে বাজালুম আমার ভেরী।
কানে আসছে বিদায়কালে যে গান তুমি গেয়েছিলে।
গান
বিজয়মালা এনো আমার লাগি।
দীর্ঘ রাত্রি রইব আমি জাগি।
চরণ যখন পড়বে তোমার মরণকুলে
বুকের মধ্যে উঠবে আমার পরান দুলে,
সব যদি যায় হব তোমার সর্বনাশের ভাগী॥
হরতনী। চলো চলো, বীর, মরণ পণ করে বেরিয়ে পড়ি দুজনে মিলে। দেখতে পাচ্ছি যে,
সামনে কী যেন কালো পাথরের ভ্রূকুটি, ভেঙে চুরমার করতে হবে। ভেঙে মাথায় যদি
পড়ে পড়ুক। পথ কাটতে হবে পাহাড়ের বুক ফাটিয়ে দিয়ে। কী করতে এসেছি এখানে। ছি
ছি, কেন আছি এখানে। একি অর্থহীন দিন, কী প্রাণহীন রাত্রি। কী ব্যর্থতার
আবর্তন মুহূর্তে মুহূর্তে।
রুইতন। সাহস আছে তোমার, সুন্দরী?
হরতনী। আছে, আছে।
রুইতন। অজানাকে ভয় করবে না?
হরতনী। না, করব না।
রুইতন। পা যাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে, পথ ফুরোতে চাইবে না।
হরতনী। কোন্ যুগে আমরা চলেছিলুম সেই দুর্গমে। রাত্রে ধরেছি মশাল তোমার
সামনে, দিনে বয়েছি জয়ধ্বজা তোমার আগে আগে। আজ আর-একবার উঠে দাঁড়াও, ভাঙতে
হবে এখানে এই অলসের বেড়া, এই নির্জীবের গণ্ডি, ঠেলে ফেলতে হবে এই-সব
নিরর্থকের আবর্জনা।
রুইতন। ছিড়ে ফেলো আবরণ, টুকরো টুকরো ক’রে ছিঁড়ে ফেলো। মুক্ত হও, শুদ্ধ হও,
পূর্ণ হও।
[প্রস্থান]
ছক্কা-পঞ্জার প্রবেশ
ছক্কা। ওহে পঞ্জা, কী হলো বলো দেখি।
পঞ্জা। ভারি লজ্জা হচ্ছে নিজের দিকে তাকিয়ে। মূঢ়, মূঢ়! কী করছিলি এতদিন।
ছক্কা। এতদিন পরে কেন মনে প্রশ্ন জাগছে, এ-সমস্তর অর্থ কী।
পঞ্জা। ঐ-যে দহলা পণ্ডিত আসছেন, ওঁকে জিজ্ঞাসা করি।
দহলার প্রবেশ
ছক্কা। এতকাল যে-সব ওঠাপড়া-শোওয়াবসার কোট্কেনা নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলুম তার
অর্থ কী।
দহলা। চুপ।
ছক্কা-পঞ্জা। (উভয়ে) করব না চুপ।
দহলা। ভয় নেই?
ছক্কা-পঞ্জা। (উভয়ে) নেই ভয়, বলতে হবে অর্থ কী।
দহলা। অর্থ নেই— নিয়ম।
ছক্কা। নিয়ম যদি নাই মানি?
দহলা। অধঃপাতে যাবে।
ছক্কা। যাব সেই অধঃপাতেই।
দহলা। কী করতে।
পঞ্জা। সেখানে যদি অগৌরব থাকে তার সঙ্গে লড়াই করতে।
দহলা। এ কেমন গোঁয়ারের কথা শান্তিপ্রিয় দেশে!
পঞ্জা। শান্তিভঙ্গ করব পণ করেছি।
হরতনীর প্রবেশ
দহলা। শুনছ, শ্রীমতী হরতনী? এরা শান্তি ভাঙতে চায় আমাদের এই অতলস্পর্শ
প্রশান্তমহাসাগরের ধারে।
হরতনী। আমাদের শান্তিটা বুড়ো গাছে মতো। পোকা লেগেছে ভিতরে ভিতরে, সেটা
নির্জীব, তাকে কেটে ফেলা চাই।
দহলা। ছি ছি ছি ছি, এমন কথা তোমার মুখে বেরোল! তুমি নারী, রক্ষা করবে
শান্তি; আমরা পুরুষ রক্ষা করব কৃষ্টি।
হরতনী। অনেকদিন তোমরা আমাদের ভুলিয়েছ, পণ্ডিত। আর নয়, তোমাদের শান্তিরসে
হিম হয়ে জমে গেছে আমাদের রক্ত, আর ভুলিয়ো না।
দহলা। সর্বনাশ! কার কাছ থেকে পেলে এ-সব কথা।
হরতনী। মনে মনে তাকেই তো ডাকছি। আকাশে শুনতে পাচ্ছি তারই গান।
দহলা। সর্বনাশ। আকশে গান! এবার মজল তাসের দেশ। আর এখানে নয়।
[ প্রস্থান]
ছক্কা। সুন্দরী, তুমিই আমাদের পথ দেখাও।
পঞ্জা। অশান্তিমন্ত্র পেয়েছ তুমি, সেই মন্ত্র দাও আমাদের।
হরতনী। বিধাতার ধিক্কারের মধ্যে আছি আমরা, মূঢ়তার অপমানে। চলো, বেরিয়ে পড়ি।
ছক্কা। একটু নড়লেই যে ওরা দোষ ধরে, বলে ‘অশুচি’।
হরতনী। দোষ হয় হোক, কিন্তু মরে থাকার মতো অশুচিতা নেই। [
প্রস্থান]
ইস্কাবনী ও টেক্কানী ফুল তুলছে
টেক্কানী। ঐ-রে, দহলানী এসেছে। আর রক্ষে নেই।
দহলানীর প্রবেশ
দহলানী। লুকোচ্ছ কোথায়। কে গো, চেনা যায় না যে! এ-যে আমাদের টেক্কানী। আর,
উনি কে, উনি যে আমাদের ইস্কাবনী। মরে যাই। কী ছিরি করেছ! মানুষ সেজেছ বুঝি?
লজ্জা নেই?
টেক্কানী। সাজি নি, দৈবাৎ সাজ খসে পড়েছে।
দহলানী। তাসের দেশের বন্ধন আঁট বন্ধন— হাজার বছরের হাজার গিরে দেওয়া খসে
পড়ল? কাণ্ডটা ঘটল কী ক’রে।
ইস্কাবনী। একটা হাওয়া দিয়েছিল।
দহলানী। ওমা, কী বলো গো। তাসের দেশের হাওয়ায় বাঁধন ছেঁড়ে! আমাদের পবনদেবের
নামে এত বড়ো বদনাম। বলি, এ কি মেলেচ্ছ দেশ পেয়েছ, যেখানে একটু হাওয়া দিলেই
গাছের শুকনো পাতা খসে উড়ে যায়।
ইস্কাবনী। স্বচক্ষেই দেখো-না, দিদি, কী বদল ঘটিয়েছেন আমাদের পবনদেব!
দহলানী। দেখো, ছোটো মুখে বড়ো কথা ভাল নয়। আমাদের সনাতন পবনদেব! তবে কিনা
পুঁথিতে লিখছে তাঁর এক মহাবীর পুত্র আছেন, তিনি নাকি লম্বা লম্বা লম্ফ দিয়ে
বেড়ান। হয়তো বা তিনিই ভর করেছেন তোমাদের ‘পরে।
টেক্কানী। কেবল আমাদের খোঁটা দিচ্ছ কেন। এখনো চোখে বুঝি পড়ে নি? তিনি যে
লম্ফ লাগিয়েছেন তাসের দেশময়। তাসিনীদের বুকে আগুন লাগিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ইস্কাবনী। সাগরপারের মানুষরা বলছে, তিনিই নাকি ওদের পূর্বপুরুষ।
দহলানী। হতে পারে— ওরা লাফ-মারা-বংশেরই সন্তান।
টেক্কানী। আচ্ছা, সত্যি কথা বলো দিদি— ভিতরে ভিতরে তোমারও মন চঞ্চল হয়েছে?
না, চুপ করে থাকলে চলবে না।
দহলানী। কাউকে বলে দিবি নে তো?
টেক্কানী। তোমার গা ছুঁয়ে বলছি, কাউকে বলব না।
দহলানী। কাল ভোর রাত্তিরের ঘুমে স্বপ্ন দেখলুম, হঠাৎ মানুষ হয়ে গেছি,
নড়েচড়ে বেড়াচ্ছি ঠিক ওদেরই মতো। জেগে উঠে লজ্জায় মরি আর কি। কিন্তু—
টেক্কানী। কিন্তু কী।
দহলানী। সে কথা থাক্ গে।
ইস্কাবনী। বুঝেছি, বুঝেছি, দিনের বেলাকার বাঁধা পাখি খোলা পেয়েছিল স্বপ্নে।
দহলানী। চুপ চুপ চুপ, নহলাপণ্ডিত শুনলে স্বপ্নেরও প্রায়শ্চিত্ত লাগিয়ে
দেবে। ওটা পাপ যে। কিন্তু, স্বপ্নে কী ফুর্তি।
টেক্কানী। যা বলিস, ভাই, তাসের দেশে সাগরপারের হাওয়া দিয়েছে খুব জোরে। কিছু
যেন ধরে রাখতে পারছি নে, সব দিচ্ছে উড়িয়ে।
দহলানী। তা হোক, এখনো কিন্তু কিছু উড়ল, কিছু রইল বাকি। মাথার ঘোমটা যদি বা
খসল, পায়ের বাঁক-মল তো সোজা করতে পারল না।
ইস্কাবনী। সত্যি বলেছিস, মনটা সমুদ্রের এপারে ওপারে দোলাদুলি করছে। ঐ
দেখ্-না, চিঁড়েতনীর মানুষ হবার অসহ্য শখ, পারে না, তাই মানুষের মুখোশ
পরেছে— সেটা তাসমহলেরই কারখানাঘরে তৈরি। কী অদ্ভুত দেখতে হয়েছে।
দহলানী। আমাদের কাকে কী রকম দেখতে হয়েছে নিজেরা বুঝতেই পারি নে। গাছের আড়াল
থেকে কাল শুনলুম, সদাগরের পুত্তুর বলছিল, এরা যে মানুষের সঙ সাজছে।
টেক্কানী। ওমা, কী লজ্জা। রাজপুত্তুর কী বললেন।
দহলানী। তিনি রেগে উঠে বললেন, সে তো ভালোই— সাজের ভিতর দিয়ে রুচি দেখা দিল।
তিনি বললেন, এ দেখে হেসো না, হাসতে চাও তো যাও তাদের কাছে মানুষের মধ্যে
যারা তাসের সঙ সেজে বেড়ায়।
ইস্কাবনী। ওমা, তাও কি ঘটে নাক। মানুষ হয়ে তাসের নকল! আচ্ছা, কী করে তারা।
দহলানী। রাজপুত্তুর বলছিলেন, তারা রঙের কাঠি বুলোয় ঠোঁটে, কালো বাতি দিয়ে
আঁকে ভুরু, আরো কত কী, আমাদের রঙ-করা তাসেদেরই মতো। সব চেয়ে মজার কথা, ওরা
খুরওয়ালা চামড়া লাগায় পায়ের তলায়।
টেক্কানী। কেন।
দহলানী। পদোন্নতি ঘটে, মাটিতে পা পড়ে না। এ-সমস্তই তাসের ঢঙ। এঁকে দেওয়া,
সাজিয়ে দেওয়া কায়দা।
ইস্কাবনী। এ তো দেখি পবনদেবের উলটোপালটা খেলা— তাসীরা হতে চায় রঙ খসিয়ে
মানুষ, মানুষ চায় রঙ মেখে তাসী হতে। আমি কিন্তু, ভাই, ঠিক করেছি, মানুষের
মন্তর নেব রাজপুত্তুরের কাছে।
টেক্কানী। আমিও।
দহলানী। আমারও ইচ্ছে করে, কিন্তু ভয়ও করে। শুনেছি মানুষের দুঃখ ঢের, তাসের
কোনো বালাই নেই।
ইস্কাবনী। দুঃখের কথা বলছিস, ভাই? দুঃখ যে এখনি শুরু করেছে তার নৃত্য বুকের
মধ্যে।
টেক্কানী। কিন্তু, সেই দুঃখের নেশা ছাড়তে চাই নে। থেকে থেকে চোখ জলে ভেসে
যায়, কেন যে ভেবেই পাই নে।
গান
কেন নয়ন আপনি ভেসে যায়,
মন কেন এমন করে—
যেন সহসা কী কথা মনে পড়ে,
মনে পড়ে না গো, তবু মনে পড়ে।
যেন কাহার বচন দিয়েছে বেদন,
যেন কে চলে গিয়েছে অনাদরে—
বাজে তারি অযতন প্রাণের ‘পরে।
যেন সহসা কী কথা মনে পড়ে,
মনে পড়ে না গো, তবু মনে পড়ে॥
ইস্কাবনী। পালাও পালাও, সম্পাদক আসছে। কাগজে যদি রটে যায় তা হলে মুখ দেখাতে
পারব না।
দহলানী। ঐ-যে দলবল সবাই আসছে। বুড়োনিমতলায় আজ সভা বসবে। এখানে আর নয়।
[প্রস্থান]
রাজাসাহেব প্রভৃতির প্রবেশ
রাজা। এ জায়গাটা কেমন ঠেকছে। ওটা কিসের গন্ধ।
পঞ্জা। কদম্বের।
রাজা। কদম্ব! অদ্ভুত নাম। ওটা কী পাখি ডাকছে।
পঞ্জা। শুনেছি, ওকে বলে ঘুঘু।
রাজা। ঘুঘু! তাসের ভাষায় ওকে একটা ভদ্র নাম দাও, বলো বিন্তি।– আজ তো কাজ
করা দায় হয়েছে। আজ আকাশে কথা শোনা যাচ্ছে, বাতাসে সুর উঠেছে। অনেক কষ্টে
মনকে শান্ত রেখেছি। রানীবিবিকে তো ঘরে রাখা শক্ত হল, নেচে বেড়াচ্ছে
ভূতে-পাওয়ার মতো। সভ্যগণ, তোমাদের আজ চেনা যায় না— সভার সাজ নেই, অত্যন্ত
অসভ্যের মতো।
সকলে। দোষ নেই। ঢিলে হয়ে গেল আমাদের সাজ, আপনি পড়ল খসে— সেগুলো রাস্তায়
রাস্তায় ছড়িয়ে আছে।
রাজা। সম্পাদক, তোমারও যেন গাম্ভীর্যহানি হয়েছে বলে বোধ হচ্ছে।
গোলাম। সকাল থেকে আছি বনে, পলাতকাদের নাম সংগ্রহ করার জন্যে। এখানকার হাওয়া
লেগেছে। সম্পাদকীয় স্তম্ভ ভরাতে গিয়ে দেখি, লেখনী দিয়ে ছন্দ ঝরছে। শুনেছি,
আধুনিক ডাক্তার এইরকম নিঃসারণকেই বলে ইন্ফুলুয়েঞ্জা।
রাজা। কী রকম, একটা নমুনা দেখি।
গোলাম।
যে দেশে বায়ু না মানে
বাধ্যতামূলক বিধি,
সে দেশে দহলা তত্ত্বনিধি
কেমনে করিবে রক্ষা কৃষ্টি—
সে দেশে নিশ্চিত অনাসৃষ্টি॥
রাজা। থাক্, আর প্রয়োজন নেই। এটা চতুর্থবর্গের পাঠ্য পুস্তকে চালিয়ে দিয়ো।
তাসবংশীয় শিশুরা কণ্ঠস্থ করুক।
ছক্কা। রাজাসাহেব, তোমার চতুর্থবর্গের শিশুবিভাগের ছাত্র নই আমরা। আজ হঠাৎ
মনে হচ্ছে, আমাদের বয়স হয়েছে। ও ছন্দ মনে লাগছে না।
পঞ্জা। ওগো বিদেশী, সমুদ্রের ওপারের ছন্দ আমাদের কানে দিতে পার?
রাজপুত্র। পারি, তবে শোনো।
গান
গগনে গগনে যায় হাঁকি
বিদ্যুৎবাণী বজ্রবাহিনী বৈশাখী,
স্পর্ধাবেগের ছন্দ জাগায়
বনস্পতির শাখাতে।
শূন্যমদের নেশায় মাতাল ধায় পাখি,
অচিন পথের ছন্দ উড়ায়
মুক্ত বেগের পাখাতে।
অন্তরতল মন্থন করে ছন্দে
সাদার কালোর দ্বন্দ্বে,
নানা ভালো নানা মন্দে,
নানা সোজা নানা বাঁকাতে।
ছন্দ নাচিল হোমবহ্নির তরঙ্গে,
মুক্তিরণের যোদ্ধৃবীরের ভ্রূভঙ্গে,
ছন্দ ছুটিল প্রলয়পথের
রুদ্ররথের চাকাতে॥
রাজা। কিছু বুঝলে তোমরা?
তাসের দল। কিছুই না।
রাজা। তবে?
তাসের দল। মন মেতে উঠল।
রাজা। সেটা তো ভালো নয়। আমাদের সনাতন শাসেত্রর ছন্দ একটা শোনো—
শান্ত যেই জন
যম তারে ঠেলে ঠেলে
নেড়েচেড়ে যায় ফেলে;
বলে, “মোর নাহি প্রয়োজন”।
শোনো বিদেশী।
রাজপুত্র। আদেশ করো।
রাজা। তোমরা যে তাসদ্বীপময় অস্থির হয়ে বেড়াচ্ছ— জলে দিচ্ছ ডুব, চড়ছ পাহাড়ের
মাথায়, কুড়ুল হাতে বনে কাটছ পথ— এ-সব কেন।
রাজপুত্র। রাজাসাহেব, তোমরা যে কেবলই উঠছ বসছ, পাশ ফিরছ, পিঠ ফেরাচ্ছ,
গড়াচ্ছ মাটিতে, সেই বা কেন।
রাজা। সে আমাদের নিয়ম।
রাজপুত্র। এ আমাদের ইচ্ছে।
রাজা। ইচ্ছে? কী সর্বনাশ! এই তাসের দেশে ইচ্ছে! বন্ধুগণ, তোমরা সবাই কী বল।
ছক্কা-পঞ্জা। আমরা ওর কাছে ইচ্ছেমন্ত্র নিয়েছি।
রাজা। কী মন্ত্র!
ছক্কা-পঞ্জা।
গান
ইচ্ছে।
সেই তো ভাঙছে, সেই তো গড়ছে,
সেই তো দিচ্ছে নিচ্ছে।
সেই তো আঘাত করছে তালায়,
সেই তো বাঁধন ছিঁড়ে পালায়,
বাঁধন পরতে সেই তো আবার ফিরছে॥
রাজা। যাও, যাও, এখান থেকে চলে যাও,
শীঘ্র চলে যাও। হরতনী, কানে পৌঁছল না কথাটা? চিঁড়েতনী, দেখছ ওর ব্যবহারটা?
হঠাৎ এমন হল কেন।
হরতনী। ইচ্ছে।
অন্য টেক্কারা। ইচ্ছে।
রাজা। ও কী রানীবিবি, তাড়াতাড়ি উঠে পড়লে যে।
রানী। আর বসে থাকতে পারছি নে।
রাজা। রানীবিব, সন্দেহ হচ্ছে, তোমার মন বিচলিত হয়েছে।
রানী। সন্দেহ নেই, বিচলিত হয়েছে।
রাজা। জান? চাঞ্চল্য তাসের দেশে সব চেয়ে বড়ো অপরাধ।
রানী। জানি, আর এও জানি, এই অপরাধটাই সব চেয়ে বড়ো সম্ভোগের জিনিস।
রাজা। শাস্তির জিনিসকে তুমি বললে ভোগের জিনিস, তাসের দেশের ভাষাও ভুলে গেছ?
রানী। আমাদের তাসের দেশের ভাষায় শিকলকে বলে অলংকার, এ ভাষা ভোলবার সময়
এসেছে।
রুইতন। হাঁ বিবিরানী, এদের ভাষায় জেলখানাকে বলে শ্বশুরবাড়ি।
রাজা। চুপ।
হরতনী। এরা হেঁয়ালীকে বলে শাস্তর।
রাজা। চুপ।
হরতনী। বোবাকে বলে সাধু।
রাজা। চুপ।
হরতনী। বোকাকে বলে পণ্ডিত।
রাজা। চুপ।
পঞ্জা। এরা মরাকে বলে বাঁচা।
রাজা। চুপ।
রানী। আর, স্বর্গকে বলে অপরাধ। বলো তোমরা, জয় ইচ্ছের জয়।
সকলে। জয় ইচ্ছের জয়।
রাজা। রানীবিবি, তোমার বনবাস!
রানী। বাঁচি তা হলে।
রাজা। নির্বাসন!— ও কী, চললে যে! কোথায় চললে।
রানী। নির্বাসনে।
রাজা। আমাকে ফেলে রেখে যাবে?
রানী। ফেলে রেখে যাব কেন।
রাজা। তবে?
রানী। সঙ্গে নিয়ে যাব তোমাকে।
রাজা। কোথায়।
রানী। নির্বাসনে।
রাজা। আর এরা, আমার প্রজারা?
সকলে। যাব নির্বাসনে।
রাজা। দহলাপণ্ডিত কী মনে করছ।
দহলা। নির্বাসনটা ভালোই মনে করছি।
রাজা। আর, তোমার পুঁথিগুলো?
দহলা। ভাসিয়ে দেব জলে।
রাজা। বাধ্যতামূলক আইন?
দহলা। আর চলবে না।
সকলে। চলবে না, চলবে না।
রানী। কোথায় গেল সেই মানুষরা।
রাজপুত্র। এই-যে আছি আমরা।
রানী। মানুষ হতে পারব আমরা?
রাজপুত্র। পারবে, নিশ্চয় পারবে।
রাজা। ওগো বিদেশী, আমিও কি পারব।
রাজপুত্র। সন্দেহ করি। কিন্তু, রানী আছেন তোমার সহায়। জয় রানীর।
সকলের গান
বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও,
বাঁধ ভেঙে দাও।
বন্দী প্রাণমন হোক উধাও।
শুকনো গাঙে আসুক
জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক ;
ভাঙনের জয়গান গাও।
জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক ,
যাক ভেসে যাক , যাক ভেসে যাক ।
আমরা শুনেছি ওই
‘মাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃ'
কোন্ নূতনেরই ডাক ।
ভয় করি না অজানারে,
রুদ্ধ তাহারি দ্বারে
দুর্দাড় বেগে ধাও॥
|