ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী
[গ্রন্থপরিচয়]

বসন্ত আওল রে
শুনহ শুনহ বালিকা
হৃদয়ক সাধ মিশাওল হৃদয়ে
শ্যাম রে , নিপট কঠিন মন তোর
সজনি সজনি রাধিকা লো
বঁধুয়া, হিয়া'পর আও রে
শুন সখি, বাজত বাঁশি
গহন কুসুমকুঞ্জমাঝে
সতিমির রজনী, সচকিত সজনী
বজাও রে মোহন বাঁশি
আজু সখি, মুহু মুহু
শ্যাম, মুখে তব মধুর অধরমে
সজনি গো, শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা
বাদরবরখন নীরদগরজন
মাধব, না কহ আদরবাণী
সখি লো , সখি লো , নিকরুণ মাধব
বার বার সখি, বারণ করনু
হম যব না রব সজনী
মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান
কো তুঁহু বোলবি মোয়


উৎসর্গ
ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার
অনুরোধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরোধ পালন করি নাই।
আজ ছাপাইছি, আজ তুমি আর দেখিতে পাইলে না।
 


                                                                                         সূচনা

অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয় পর্যায়ক্রমে বৈষ্ণব পদাবলী প্রকাশের কাজে যখন নিযুক্ত হয়েছিলেন আমার বয়স তখন যথেষ্ট অল্প। সময়নির্ণয় সম্বন্ধে আমার স্বাভাবিক অন্যমনস্কতা তখনো ছিল, এখনো আছে। সেই কারণে চিঠিতে আমার তারিখকে যাঁরা ঐতিহাসিক বলে ধরে নেন তাঁরা প্রায়ই ঠকেন। বর্তমান আলোচ্য বিষয়ের কাল অনুমান করা অনেকটা সহজ। বোম্বাইয়ে মেজদাদার কাছে যখন গিয়েছিলুম তখন আমার বয়স ষোলোর কাছাকাছি, বিলাতে যখন গিয়াছি তখন আমার বয়স সতেরো। নূতন-প্রকাশিত পদাবলী নিয়ে নাড়াচাড়া করছি, সে আরো কিছুকাল পূর্বের কথা। ধরে নেওযা যাক, তখন আমি চোদ্দয় পা দিয়েছি। খন্ড খন্ড পদাবলীর প্রকাশ্যে ভোগ করবার যোগ্যতা আমার তখন ছিল না। অথচ আমাদের বাড়িতে আমিই একমাত্র তার পাঠক ছিলুম। দাদাদের ডেস্ক্ থেকে যখন সেগুলি অন্তর্ধান করত তখন তারা তা লক্ষ্য করতেন না। পদাবলীর যে ভাষাকে ব্রজবুলি বলা হোত আমার কৌতুহল প্রধানত ছিল তাকে নিয়ে। শব্দতত্ত্বে আমার ঔৎসুক্য স্বাভাবিক। টীকায় যে শব্দার্থ দেওয়া হয়েছিল তা আমি নির্বিচারে ধরে নিই নি। এক শব্দ যতবার পেয়েছি তার সমুচ্চয় তৈরি করে যাচ্ছিলুম। একটি ভালো বাঁধানো খাতা শব্দে ভরে উঠেছিল। তুলনা করে আমি অর্থ নির্ণয় করেছি। পরবর্তীকালে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ যখন বিদ্যাপতির সটীক সংস্করণ প্রকাশ করতে প্রবৃত্ত হলেন তখন আমার খাতা তিনি সম্পূর্ণ ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। তার কাজ শেষ হয়ে গেলে সেই খাতা তাঁর ও তাঁর উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে ফিরে পাবার অনেক চেষ্টা করেও কৃতকার্য হতে পারি নি। যদি ফিরে পেতুম তা হলে দেখাতে পারতুম কোথাও কোথাও যেখানে তিনি নিজের ইচ্ছামত মানে করেছেন ভুল করেছেন। এটা আমার নিজের মত। তার পরের সোপানে ওঠা গেল পদাবলীর জালিয়াতিতে। অক্ষয়বাবুর কাছে শুনেছিলুম বালক কবি চ্যাটার্টনের গল্প। তাঁকে নকল করার লোভ হয়েছিল। এ কথা মনেই ছিল না যে, ঠিকমত নকল করতে হলেও শুধু ভাষায় নয়, ভাবে খাঁটি হওয়া চাই। নইলে কথার গাঁথনিটা ঠিক হলেও সুরে তার ফাঁকি ধরা পরে। পদাবলী শুধু কেবল সাহিত্য নয়, তার রসের বিশিষ্টতা বিশেষ ভাবের সীমানার দ্বারা বেষ্টিত। সেই সীমানার মধ্যে আমার মন স্বাভাবিক স্বাধীনতার সঙ্গে বিচরণ করতে পারে না। তাই ভানুসিংহের সঙ্গে বৈষ্ণবচিত্তের অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা নেই। এইজন্যে ভানুসিংহের পদাবলী বহুকাল সংকোচের সাথে বহন করে এসেছি। একে সাহিত্যের একটা অনধিকার প্রবেশের দৃষ্টান্ত বলেই গণ্য করি। প্রথম গানটি লিখেছিলুম একটা স্লেটের উপরে, অন্তপুরের কোণের ঘরে––
 

  গহনকুসুমকুঞ্জমাঝে
মৃদুল মধুর বংশি বাজে।


মনে বিশ্বাস হল চ্যাটার্টনের চেয়ে পিছিয়ে থাকব না। এ কথা বলে রাখি ভানুসিংহের পদাবলী ছোটো বয়স থেকে অপেক্ষাকৃত বড়ো বয়স পর্যন্ত দীর্ঘকালের সূত্রে গাঁথা। তাদের মধ্যে ভালোমন্দ সমান দরের নয়।


 

                      
                বসন্ত আওল রে !
মধুকর গুন গুন, অমুয়ামঞ্জরী
              কানন ছাওল রে!
শুন শুন সজনী, হৃদয় প্রাণ মম
              হরখে আকুল ভেল,
জর জর রিঝসে দু:খ জ্বালা সব
              দূর দূর চলি গেল।
মরমে বহই বসন্তসমীরণ,

              মরমে ফুটই ফুল,
মরমকুঞ্জ-'পর বোলই কুহু কুহু
              অহরহ কোকিলকুল।
সখি রে, উছসত প্রেমভরে অব
              ঢলঢল বিহ্বল প্রাণ,
নিখিল জগত জনু হরখভোর ভই
             গায় রভসরসগান।
বসন্তভূষণভূষিত ত্রিভুবন
            কহিছে, দুখিনী রাধা,
কঁহি রে সো প্রিয়, কঁহি সো প্রিয়তম,
            হৃদিবসন্ত সো মাধা ?
ভানু কহত, অতি গহন রয়ন অব,
           বসন্তসমীরশ্বাসে
মোদিত বিহ্বল চিত্তকুঞ্জতল
           ফুল্লবাসনা-বাসে।

 

                    
           শুনহ শুনহ বালিকা,
           রাখ কুসুমমালিকা,
কুঞ্জ কুঞ্জ ফেরনু সখি শ্যামচন্দ্র নাহি রে ।
           দুলই কুসুমমুঞ্জরী,
           ভমর ফিরই গুঞ্জরি,
অলস যমুনা বহয়ি যায় ললিত গীত গাহি রে ।
           শশিসনাথ যামিনী,
           বিরহবিধুর কামিনী,
কুসুমহার ভইল ভার
হৃদয় তার দাহিছে ।
          অধর উঠই কাঁপিয়া
          সখিকরে কর আপিয়া,
কুঞ্জভবনে পাপিয়া কাহে গীত গাহিছে ।
           মৃদু সমীর সঞ্চলে,
           হরয়ি শিথিল অঞ্চলে,
চকিত হৃদয় চঞ্চলে কাননপথ চাহি রে ।
           কুঞ্জপানে হেরিয়া
           অশ্রুবারি ডারিয়া
ভানু গায় শূন্যকুঞ্জ শ্যামচন্দ্র নাহি রে !

 

              
হৃদয়ক সাধ মিশাওল হৃদয়ে,
        কণ্ঠে বিমলিন মালা ।
বিরহবিষে দহি বহি গল রয়নী,
       নহি নহি আওল কালা ।
বুঝনু বুঝনু সখি বিফল বিফল সব,
       বিফল এ পীরিতি লেহা

বিফল রে এ মঝু জীবন যৌবন,
       বিফল রে এ মঝু দেহা !
চল সখি গৃহ চল, মুঞ্চ নয়নজল,
       চল সখি চল গৃহকাজে,
মালতিমালা রাখহ বালা,
       ছি ছি সখি মরু মরু লাজে ।
সখি লো দারুণ আধিভরাতুর
       এ তরুণ যৌবন মোর,
সখি লো দারুণ প্রণয়হলাহল
      জীবন করল অঘোর ।
তৃষিত প্রাণ মম দিবসযামিনী
      শ্যামক দরশন আশে,
আকুল জীবন থেহ ন মানে,
      অহরহ জ্বলত হুতাশে ।
      সজনি , সত্য কহি তোয়,
খোয়াব কব হম শ্যামক প্রেম
      সদা ডর লাগয়ে মোয় ।
হিয়ে হিয়ে অব রাখত মাধব,
      সো দিন আসব সখি রে

বাত ন বোলবে , বদন ন হেরবে ,
     মরিব হলাহল ভখি রে ।
ঐস বৃথা ভয় না কর বালা ,
     ভানু নিবেদয় চরণে ,
সুজনক পীরিতি নৌতুন নিতি নিতি ,
     নহি টুটে জীবনমরণে।

 

              
শ্যাম রে , নিপট কঠিন মন তোর ।
বিরহ সাথি করি সজনী রাধা
     রজনী করত হি ভোর ।
একলি নিরল বিরল পর বৈঠত
     নিরখত যমুনা-পানে,
বরখত অশ্রু, বচন নহি নিকসত,
     পরান থেহ ন মানে ।
গহনতিমির নিশি ঝিল্লিমুখর দিশি
     শূন্য কদমতরুমূলে,
ভূমিশয়ন-'পর আকুল কুন্তল,
     কাঁদই আপন ভুলে ।
মুগধ মৃগীসম চমকি উঠই কভু
     পরিহরি সব গৃহকাজে
চাহি শূন্য-'পর কহে করুণস্বর

     বাজে রে বাঁশরি বাজে ।
নিঠুর শ্যাম রে, কৈসন অব তুঁহু
     রহই দূর মথুরায়

রয়ন নিদারুণ কৈসন যাপসি,
     কৈস দিবস তব যায় !
কৈস মিটাওসি প্রেমপিপাসা,
     কঁহা বজাওসি বাঁশি ?
পীতবাস তুঁহু কথি রে ছোড়লি,
     কথি সো বঙ্কিম হাসি ?
কনকহার অব পহিরলি কন্ঠে,
    কথি ফেকলি বনমালা ?
হৃদিকমলাসন শূন্য করলি রে,
    কনকাসন কর আলা !
এ দুখ চিরদিন রহল চিত্তমে,
    ভানু কহে , ছি ছি কালা !
ঝটিতি আও তুঁহু হমারি সাথে,
    বিরহব্যাকুলা বালা ।

            
সজনি সজনি রাধিকা লো
      দেখ অবহু চাহিয়া,
মৃদুলগমন শ্যাম আওয়ে
      মৃদুল গান গাহিয়া ।
পিনহ ঝটিত কুসুমহার,
     পিনহ নীল আঙিয়া ।
সুন্দরি সিন্দূর দেকে
     সীঁথি করহ রাঙিয়া ।
সহচরি সব নাচ নাচ
     মিলন - গীতি গাও রে ,
চঞ্চল মঞ্জীর - রাব
     কুঞ্জগগন ছাও রে ।
সজনি অব উজার মঁদির
     কনকদীপ জ্বালিয়া,
সুরভি করহ কুঞ্জভবন
     গন্ধসলিল ঢালিয়া ।
মল্লিকা চমেলী বেলি
     কুসুম তুলহ বালিকা,
গাঁথ যূথি, গাঁথ জাতি,
     গাঁথ বকুল - মালিকা ।
তৃষিতনয়ন ভানুসিংহ
     কুঞ্জপথম চাহিয়া

মৃদুল গমন শ্যাম আওয়ে,
     মৃদুল গান গাহিয়া ।
 

              
        বঁধুয়া, হিয়া'পর আও রে,
মিঠি মিঠি হাসয়ি, মৃদু মধু ভাষয়ি,
        হমার মুখ'পর চাও রে !
যুগযুগসম কত দিবস বহয়ি গল,
        শ্যাম তু আওলি না,
চন্দ্র - উজর মধু - মধুর কুঞ্জ'পর
        মুরলি বজাওলি না !
লয়ি গলি সাথ বয়ানক হাস রে,
        লয়ি গলি নয়নআনন্দ !
শূন্য কুঞ্জবন, শূন্য হৃদয়মন,
        কঁহি তব ও মুখচন্দ ?
ইথি ছিল আকুল গোপনয়নজল,
        কথি ছিল ও তব হাসি ?
ইথি ছিল নীরব বংশীবটতট,
       কথি ছিল ও তব বাঁশি;
তুঝ মুখ চাহয়ি শতযুগভর দুখ
      নিমিখে ভেল অবসান ।
লেশ হাসি তুঝ দূর করল রে
      সকল মানঅভিমান ।
ধন্য ধন্য রে ভানু গাহিছে

      প্রেমক নাহিক ওর ।
হরখে পুলকিত জগতচরাচর
     দুঁহুক প্রেমরস ভোর ।

              
     শুন সখি, বাজত বাঁশি
গভীর রজনী, উজল কুঞ্জপথ,
     চন্দ্রম ডারত হাসি ।
দক্ষিণপবনে কম্পিত তরুগণ,
     তম্ভিত যমুনাবারি,
কুসুমসুবাস উদাস ভইল, সখি,
     উদাস হৃদয় হমারি ।
বিগলিত মরম, চরণ খলিতগতি,
     শরম ভরম গয়ি দূর,
নয়ন বারিভর, গরগর অন্তর,
     হৃদয় পুলকপরিপূর ।
কহ সখি, কহ সখি, মিনতি রাখ সখি,
     সো কি হমারই শ্যাম ?
মধুর কাননে মধুর বাঁশরি
     বজায় হমারি নাম ?
কত কত যুগ সখি, পুণ্য করনু হম,
    দেবত করনু ধেয়ান,
তব ত মিলল সখি, শ্যামরতন মম,
     শ্যাম পরানক প্রাণ ।
         শ্যাম রে,
শুনত শুনত তব মোহন বাঁশি,
    জপত জপত তব নামে,
সাধ ভইল ময় দেহ ডুবায়ব
    চাঁদউজল যমুনামে !
'চলহ তুরিত গতি শ্যাম চকিত অতি ,
     ধরহ সখীজন হাত,
নীদমগন মহী, ভয় ডর কছু নহি,
    ভানু চলে তব সাথ।'

          
গহন কুসুমকুঞ্জমাঝে
মৃদুল মধুর বংশি বাজে,
বিসরি ত্রাস - লোকলাজে
     সজনি , আও আও লো ।
অঙ্গে চারু নীল বাস,
হৃদয়ে প্রণয়কুসুমরাশ,
হরিণনেত্রে বিমল হাস,
     কুঞ্জবনমে আও লো ।
ঢালে কুসুম সুরভভার,
ঢালে বিহগ সুরবসার,
ঢালে ইন্দু অমৃতধার
    বিমল রজত ভাতি রে ।
মন্দ মন্দ ভৃঙ্গ গুঞ্জে,
অযুত কুসুম কুঞ্জে কুঞ্জে,
ফুটল সজনি, পুঞ্জে পুঞ্জে
    বকুল যূথি জাতি রে ।
দেখ সজনি, শ্যামরায়
নয়নে প্রেম উথল যায়,
মধুর বদন অমৃতসদন
    চন্দ্রমায় নিন্দিছে ।
আও আও সজনিবৃন্দ,
হেরব সখি শ্রীগোবিন্দ,
শ্যামকো পদারবিন্দ
    ভানুসিংহ বন্দিছে ।

 

                    
সতিমির রজনী, সচকিত সজনী,

         শূন্য নিকুঞ্জ-অরণ্য ।
কলয়িত মলয়ে, সুবিজন নিলয়ে

         বালা বিরহবিষণ্ণ!
নীল আকাশে তারক ভাসে,

         যমুনা গাওত গান,
পাদপ-মরমর, নির্ঝর-ঝরঝর,
        কুসুমিত বল্লিবিতান।
তৃষিত নয়ানে বনপথপানে
        নিরখে ব্যাকুল বালা,
দেখ ন পাওয়ে, আঁখ ফিরাওয়ে,
        গাঁথে বনফুলমালা !
সহসা রাধা চাহল সচকিত,
        দূরে খেপল মালা

কহল
সজনি, শুন বাঁশরি বাজে,
        কুঞ্জে আওল কালা।
চকিত গহন নিশি, দূর দূর দিশি
       বাজত বাঁশি সুতানে।
কণ্ঠ মিলাওল ঢলঢল যমুনা
       কল কল কল্লোলগানে ।
ভণে ভানু, অব শুন গো কানু,
      পিয়াসিত গোপিনিপ্রাণ
তোঁহার পীরিত বিমল অমৃতরস
      হরষে করবে পান।

 

                   ১০
        বজাও রে মোহন বাঁশি ।
সারা দিবসক             বিরহদহনদুখ,
       মরমক তিয়াষ নাশি।
রিঝমনভেদন            বাঁশরিবাদন
      কঁহা শিখলি রে কান ?
হানে থিরথির            মরমঅবশকর
      লহু লহু মধুময় বাণ ।
ধসধস করতহ          উরহ বিয়াকুলু,
      ঢুলু ঢুলু অবশনয়ান;
কত কত বরষক       বাত সোঁয়ারয়,
      অধীর করয় পরান ।
কত শত আশা         পূরল না বঁধু,
      কত সুখ করল পয়ান ।
পহু গো কত শত     পীরিতযাতন
      হিয়ে বিঁধাওল বাণ ।
হৃদয় উদাসয়,        নয়ন উছাসয়
      দারুণ মধুময় গান।
সাধ যায় বঁধূ,         যমুনাবারিম
     ডারিব দগধপরান ।
সাধ যায় পহু,        রাখি চরণ তব
     হৃদয়মাঝ হৃদয়েশ,
হৃদয়জুড়াওন        বদনচন্দ্র তব
     হেরব জীবনশেষ ।
সাধ যায়, ইহ       চন্দ্রমকিরণে
     কুসুমিত কুঞ্জবিতানে
বসন্তবায়ে           প্রাণ মিশায়ব
     বাঁশিক সুমধুর গানে ।
প্রাণ ভৈবে মঝু     বেণুগীতময়,
     রাধাময় তব বেণু ।
জয় জয় মাধব,   জয় জয় রাধা ,
     চরণে প্রণমে ভানু ।

 

           ১১
আজু সখি, মুহু মুহু
গাহে পিক কুহু কুহু,
কুঞ্জবনে দুঁহু দুঁহু
     দোঁহার পানে চায়।
যুবনমদবিলসিত
পুলকে হিয়া উলসিত,
অবশ তনু অলসিত
     মূরছি জনু যায়।
আজু মধু চাঁদনী
প্রাণউনমাদনী,
শিথিল সব বাঁধনী,
     শিথিল ভই লাজ ।
বচন মৃদু মরমর,
কাঁপে রিঝ থরথর,
শিহরে তনু জরজর
     কুসুমবনমাঝ।
মলয় মৃদু কলয়িছে,
চরণ নহি চলয়িছে,
বচন মুহু খলয়িছে,
    অঞ্চল লুটায়।
আধফুট শতদল
বায়ুভরে টলমল
আঁখি জনু ঢলঢল
    চাহিতে নাহি চায়।
অলকে ফুল কাঁপয়ি
কপোলে পড়ে ঝাঁপয়ি,
মধু-অনলে তাপয়ি,
    খসয়ি পড়ু পায়।
ঝরই শিরে ফুলদল,
যমুনা বহে কলকল,
হাসে শশি ঢলঢল

    ভানু মরি যায় ।

           ১২
শ্যাম, মুখে তব মধুর অধরমে
    হাস বিকশিত কায় ?
কোন স্বপন অব দেখত মাধব,
    কহবে কোন হমায় !
নীদমেঘ'পর স্বপনবিজলিসম
    রাধা বিলসত হাসি ।
শ্যাম, শ্যাম মম, কৈসে শোধব
    তুঁহুক প্রেমঋণরাশি ।
বিহঙ্গ , কাহ তু বোলন লাগলি ?
    শ্যাম ঘুমায় হমারা !
রহ রহ চন্দ্রম, ঢাল ঢাল তব
    শীতল জোছনধারা ।
তারকমালিনী সুন্দর যামিনী
    অবহুঁ ন যাও রে ভাগি,
নিরদয় রবি, অব কাহ তু আওলি,
    জ্বাললি বিরহক আগি ।
ভানু কহত—অব রবি অতি নিষ্ঠুর
    নলিনমিলনঅভিলাষে
কত নরনারীক মিলন টুটাওত,
    ডারত বিরহহুতাশে ।

 

             ১৩
সজনি গো,
      শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা
            নিশীথযামিনী রে ।
      কুঞ্জপথে সখি, কৈসে যাওব
            অবলা কামিনী রে ।
      উন্মদ পবনে যমুনা তর্জিত,
            ঘন ঘন গর্জিত মেহ ।
      দমকত বিদ্যুত, পথতরু লুণ্ঠত,
            থরহর কম্পত দেহ ।
      ঘন ঘন রিম্‌ ঝিম্‌ রিম্‌ ঝিম্‌ রিম্‌ ঝিম্‌
            বরখত নীরদপুঞ্জ ।
      ঘোর গহন ঘন তালতমালে
            নিবিড় তিমিরময় কুঞ্জ ।
      বোল ত সজনী, এ দুরুযোগে
            কুঞ্জে নিরদয় কান
      দারুণ বাঁশী কাহ বজায়ত
            সকরুণ রাধা নাম ।

সজনি,
     মোতিম হারে বেশ বনা দে,
           সীঁথি লগা দে ভালে ।
     উরহি বিলোলিত শিথিল চিকুর মম
           বাঁধহ মালত মালে
     খোল দুয়ার ত্বরা করি সখি রে ,
           ছোড় সকল ভয়লাজে —
     হৃদয় বিহগসম ঝটপট করত হি
          পঞ্জরপিঞ্জরমাঝে ।
     গহন রয়নমে ন যাও বালা
          নওলকিশোরক পাশ —
     গরজে ঘন ঘন, বহু ডর পাওব,
          কহে ভানু তব দাস ।

 

               ১৪
বাদরবরখন নীরদগরজন
      বিজুলী চমকন ঘোর,
উপেখই কৈছে আও তু কুঞ্জে
     নিতি নিতি, মাধব মোর।
ঘন ঘন চপলা চমকয় যব পহু,
     বজরপাত যব হোয়,
তুঁহুক বাত তব সমরয়ি প্রিয়তম,
     ডর অতি লাগত মোয়।
অঙ্গবসন তব ভীঁখত মাধব,
     ঘন ঘন বরখত মেহ —
ক্ষুদ্র বালি হম , হমকো লাগয়
     কাহ উপেখবি দেহ ?
বইস বইস পহু, কুসুমশয়ন'পর
     পদযুগ দেহ পসারি —
সিক্ত চরণ তব মোছব যতনে —
     কুন্তলভার উঘারি ।
শ্রান্ত অঙ্গ তব হে ব্রজসুন্দর,
     রাখ বক্ষ -' পর মোর,
তনু তব ঘেরব পুলকিত পরশে
     বাহুমৃণালক ডোর ।
ভানু কহে বৃকভানুনন্দিনী,
     প্রেমসিন্ধু মম কালা,
তোঁহার লাগয়, প্রেমক লাগয়
    সব কছু সহবে জ্বালা ।
 

               ১৫
মাধব, না কহ আদরবাণী,
      না কর প্রেমক নাম ।
জানয়ি মুঝকো অবলা সরলা
      ছলনা না কর শ্যাম ।
কপট, কাহ তুঁহু ঝূট বোলসি,
     পীরিত করসি তু মোয় ?
ভালে ভালে হম অলপে চিহ্ননু,
     না পতিয়াব রে তোয় ।
ছিদল তরীসম কপট প্রেম'পর
    ডারনু যব মনপ্রাণ,
ডুবনু ডুবনু রে ঘোর সায়রে
    অব কুত নাহিক ত্রাণ ।
মাধব, কঠোর বাত হমারা
    মনে লাগল কি তোর ?
মাধব, কাহ তু মলিন করলি মুখ,
    ক্ষমহ গো কুবচন মোর !
নিদয় বাত অব কবহুঁ ন বোলব,
     তুঁহু মম প্রাণক প্রাণ ।
অতিশয় নির্মম ব্যথিনু হিয়া তব
     ছোড়য়ি কুবচনবাণ
মিটল মান অব — ভানু হাসতহি
     হেরই পীরিতলীলা ।
কভু অভিমানিনী, আদরিণী কভু
     পীরিতিসাগর বালা ।

              ১৬
সখি লো , সখি লো , নিকরুণ মাধব
        মথুরাপুর যব যায়
করল বিষম পণ মানিনী রাধা,
রোয়বে না সো, না দিবে বাধা —
কঠিনহিয়া সই, হাসয়ি হাসয়ি
          শ্যামক করব বিদায় ।
    মৃদু মৃদু গমনে আওল মাধা,
    বয়নপান তছু চাহল রাধা,
চাহয়ি রহল স চাহয়ি রহল,
দণ্ড দণ্ড সখি, চাহয়ি রহল,
মন্দ মন্দ সখি, নয়নে বহল
          বিন্দু বিন্দু জলধার ।
      মৃদু মৃদু হাসে বৈঠল পাশে,
      কহল শ্যাম কত মৃদু মধু ভাষে,
টুটয়ি গইল পণ, টুটইল মান,
গদগদ আকুলব্যাকুলপ্রাণ,
     ফুকরয়ি উছসয়ি কাঁদল রাধা,
গদগদ ভাষ নিকাশল আধা,
     শ্যামক চরণে বাহু পসারি,
     কহল — শ্যাম রে, শ্যাম হমারি,
রহ তুঁহু, রহ তুঁহু, বঁধু গো, রহ তুঁহু,
অনুখন সাথ সাথ রে রহ পঁহু,
তুঁহু বিনে মাধব, বল্লভ, বান্ধব,
     আছয় কোন হমার !
পড়ল ভূমি'পর শ্যামচরণ ধরি,
রাখল মুখ তছু শ্যামচরণ'পরি
উছসি উছসি কত কাঁদয়ি কাঁদয়ি
       রজনী করল প্রভাত ।
মাধব বৈসল, মৃদু মধু হাসল,
কত অশোয়াসবচন মিঠ ভাষল,
      ধরইল বালিক হাত ।
সখি লো, সখি লো, বোল ত সখি লো,
      যত দুখ পাওল রাধা
নিঠুর শ্যাম কিয়ে আপন মনমে
      পাওল তছু কছু আধা ?
হাসয়ি হাসয়ি নিকটে আসয়ি
     বহুত স প্রবোধ দেল,
হাসয়ি হাসয়ি পলটয়ি চাহয়ি
     দূর দূর চলি গেল ।
অব সো মথুরাপুরক পন্থমে,
     ইঁহ যব রোয়ত রাধা,
মরমে কি লাগল তিলভর বেদন,
     চরণে কি তিলভর বাধা ?
বরখি আঁখিজল ভানু কহে — অতি
     দুখের জীবন ভাই ।
হাসিবার তর সঙ্গ মিলে বহু,
    কাঁদিবার কো নাই ।

 

            ১৭
বার বার সখি, বারণ করনু,
       ন যাও মথুরাধাম ।
বিসরি প্রেমদুখ রাজভোগ যথি
      করত হমারই শ্যাম ।
ধিক তুঁহু দাম্ভিক, ধিক রসনা ধিক,
      লইলি কাহারই নাম ?
বোল তো সজনি, মথুরাঅধিপতি
      সো কি হমারই শ্যাম ?
ধনকো শ্যাম সো, মথুরাপুরকো,
      রাজ্যমানকো হোয় ।
নহ পীরিতিকো, ব্রজকামিনীকো,
      নিচয় কহনু ময় তোয় ।
যব তুঁহু ঠারবি সো নব নরপতি
      জনি রে করে অবমান,
ছিন্নকুসুমসম ঝরব ধরা'পর,
      পলকে খোয়ব প্রাণ ।
বিসরল বিসরল সো সব বিসরল
      বৃন্দাবন সুখসঙ্গ,
নব নগরে সখি নবীন নাগর
      উপজল নব নব রঙ্গ ।
ভানু কহত — অয়ি বিরহকাতরা
      মনমে বাঁধহ থেহ ।
মুগুধা বালা, বুঝই বুঝলি না,
     হমার শ্যামক লেহ ।

 

             ১৮
      হম যব না রব সজনী,
নিভৃত বসন্ত - নিকুঞ্জবিতানে
      আসবে নির্মল রজনী,
মিলনপিপাসিত আসবে যব সখি
      শ্যাম হমারি আশে,
ফুকারবে যব রাধা রাধা
      মুরলী ঊরধ শ্বাসে,
যব সব গোপিনী আসবে ছুটই,
      যব হম আসব না,
যব সব গোপিনী জাগবে চমকই,
      যব হম জাগব না,
তব কি কুঞ্জপথ হমারি আশে
      হেরবে আকুল শ্যাম ?
বন বন ফেরই সো কি ফুকারবে
      রাধা রাধা নাম ?
না যমুনা, সো এক শ্যাম মম,
      শ্যামক শত শত নারী —
হম যব যাওব শত শত রাধা
      চরণে রহবে তারি ।
তব সখি যমুনে, যাই নিকুঞ্জে,
      কাহ তয়াগব দে ?
হমারি লাগি এ বুন্দাবনমে,
      কহ সখি, রোয়ব কে ?
ভানু কহে চুপি — মানভরে রহ,
      আও বনে, ব্রজনারী,
মিলবে শ্যামক থরথর আদর
      ঝরঝর লোচনবারি ।

                 ১৯
মরণ রে,
      তুঁহু মম শ্যামসমান ।
মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজুট,
রক্ত কমল কর, রক্ত অধরপুট,
তাপ - বিমোচন করুণ কোর তব
      মৃত্যু - অমৃত করে দান ।
      তুঁহু মম শ্যামসমান ।

মরণ রে,
     শ্যাম তোঁহারই নাম !
চির বিসরল যব নিরদয় মাধব
     তুঁহু ন ভইবি মোয় বাম,
আকুল রাধা - রিঝ অতি জরজর,
ঝরই নয়ন দউ অনুখন ঝরঝর ।
তুঁহু মম মাধব, তুঁহু মম দোসর,
      তুঁহু মম তাপ ঘুচাও,
মরণ, তু আও রে আও ।

ভুজপাশে তব লহ সম্বোধয়ি,
আঁখিপাত মঝু আসব মোদয়ি,
কোরউপর তুঝ রোদয়ি রোদয়ি,
     নীদ ভরব সব দেহ ।
তুঁহু নহি বিসরবি, তুঁহু নহি ছোড়বি,
রাধাহৃদয় তু কবহুঁ ন তোড়বি,
হিয় হিয় রাখবি অনুদিন অনুখন,
    অতুলন তোঁহার লেহ ।

দূর সঙে তুঁহু বাঁশি বজাওসি,
অনুখন ডাকসি, অনুখন ডাকসি
    রাধা রাধা রাধা ।
দিবস ফুরাওল , অবহুঁ ম যাওব,
বিরহতাপ তব অবহুঁ ঘুচাওব,
কুঞ্জবাট'পর অবহুঁ ম ধাওব,
    সব কছু টুটইব বাধা ।
গগন সঘন অব, তিমিরমগন ভব,
তড়িত চকিত অতি, ঘোর মেঘরব,
শালতালতরু সভয় তবধ সব,
    পন্থ বিজন অতি ঘোর —
একলি যাওব তুঝ অভিসারে,
যাক পিয়া তুঁহু কি ভয় তাহারে,
ভয় বাধা সব অভয় মুরতি ধরি,
     পন্থ দেখাওব মোর ।

ভানুসিংহ কহে — ছিয়ে ছিয়ে রাধা,
     চঞ্চল হৃদয় তোহারি,
মাধব পহু মম, পিয় স মরণসে
     অব তুঁহু দেখ বিচারি ।

 

                  ২০
      কো তুঁহু বোলবি মোয় !
হৃদয়মাহ মঝু জাগসি অনুখন,
আঁখউপর তুঁহু রচলহি আসন,
অরুণ নয়ন তব মরমসঙে মম
     নিমিখ ন অন্তর হোয় ।
     কো তুঁহু বোলবি মোয় !

হৃদয়কমল তব চরণে টলমল,
নয়নযুগল মম উছলে ছলছল,
প্রেমপূর্ণ তনু পুলকে ঢলঢল
    চাহে মিলাইতে তোয় ।
    কো তুঁহু বোলবি মোয় !

বাঁশরিধ্বনি তুহ অমিয় গরল রে,
হৃদয় বিদারয়ি হৃদয় হরল রে,
আকুল কাকলি ভুবন ভরল রে,
    উতল প্রাণ উতরোয় ।
    কো তুঁহু বোলবি মোয় !

হেরি হাসি তব মধুঋতু ধাওল,
শুনয়ি বাঁশি তব পিককুল গাওল,
বিকল ভ্রমরসম ত্রিভুবন আওল,
    চরণকমলযুগ ছোঁয় ।
    কো তুহু বোলবি মোয় !

গোপবধূজন বিকশিতযৌবন,
পুলকিত যমুনা , মুকুলিত উপবন,
নীলনীর'পর ধীর সমীরণ,
    পলকে প্রাণমন খোয়
    কো তুঁহু বোলবি মোয় !

তৃষিত আঁখি, তব মুখ'পর বিহরই,
মধুর পরশ তব রাধা শিহরই,
প্রেমরতন ভরি হৃদয় প্রাণ লই
    পদতলে অপনা থোয় ।
    কো তুঁহু বোলবি মোয় !

কো তুঁহু কো তুঁহু সব জন পুছয়ি,
অনুদিন সঘন নয়নজল মুছয়ি,
যাচে ভানু, সব সংশয় ঘুচয়ি,
     জনম চরণ'পর গোয় ।
     কো তুঁহু বোলবি মোয় !