টুনটুনির বই
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
গৃহস্থের ঘরের পিছনে বেগুন গাছ আছে। সেই বেগুন গাছের
পাতা ঠোঁট দিয়ে সেলাই করে টুনটুনি পাখিটি তার বাসা বেঁধেছে।
বাসার ভিতর তিনটি ছোট্ট-ছোট্ট ছানা হয়েছে। খুব ছোট্ট ছানা, তারা উড়তে
পারে না, চোখও মেলতে পারে না। খালি হাঁ করে আর চীঁ-চীঁ করে।
গৃহস্থের বিড়ালটা ভারি দুষ্টু। সে খালি ভাবে ‘টুনটুনির ছানা খাব।’ একদিন সে বেগুন
গাছের তলায় এসে বললে, ‘কি করছিস লা টুনটুনি?’
টুনটুনি তার মাথা হেঁট করে বেগুন গাছের ডালে ঠেকিয়ে
বললে, ‘প্রণাম হই, মহারানী!’ তাতে বিড়ালনী ভারি খুশি হয়ে চলে গেল।
এমনি সে রোজ আসে, রোজ টুনটুনি তাকে প্রণাম করে আর মহারানী বলে, আর সে খুশি হয়ে
চলে যায়।
এখন টুনটুনির ছানাগুলি বড় হয়েছে, তাদের সুন্দর পাখা হয়েছে। তারা আর চোখ বুজে থাকে
না। তা দেখে টুনটুনি তাদের বললে, ‘বাছা, তোরা উড়তে পারবি?’
ছানারা বললে, ‘হ্যাঁ মা, পারব।’ টুনটুনি বললে, ‘তবে দেখ তো দেখি, ঐ তাল গাছটার
ডালে গিয়ে বসতে পারিস কি না।’
ছানারা তখনই উড়ে গিয়ে তাল গাছের ডালে বসল। তা দেখে টুনটুনি হেসে বললে, ‘এখন দুষ্টু
বিড়াল আসুক দেখি!’
খানি বাদেই বিড়াল এসে বললে, ‘কি করছিস লা টুনটুনি?’
তখন টুনটুনি পা উঁচিয়ে তাকে লাথি দেখিয়ে বললে, ‘দূর হ, লক্ষ্মীছাড়ী বিড়ালনী!’ বলেই
সে ফুডুক করে উড়ে পালাল।
দুষ্টু বিড়াল দাঁত খিঁচিয়ে লাফিয়ে গাছে উঠে, টুনটুনিকেও ধরতে পারলে না, ছানাও খেতে
পেল না। খালি বেগুন কাঁটার খোঁচা খেয়ে নাকাল হয়ে ঘরে ফিরল।
টুনটুনি গিয়েছিল বেগুন পাতায় বসে নাচতে। নাচতে-নাচতে খেল বেগুন কাঁটায় খোঁচা। তাই
থেকে তার হল মস্ত বড় ফোঁড়া।
ও মা, কি হবে? এত বড় ফোঁড়া কি করে সারবে?
টুনটুনি একে জিগগেস করে, তাকে জিগগেস করে। সবাই বললে,
‘ওটা নাপিত দিয়ে কাটিয়ে ফেল।’
তাই টুনটুনি নাপিতের কাছে গিয়ে বললে, নাপিতদাদা, নাপিতদাদা, আমার ফোঁড়াটা কেটে দাও
না!’
নাপিত তার কথা শুনে ঘাড় বেঁকিয়ে নাক সিটকিয়ে বললে, “ঈস্! আমি রাজাকে কামাই, দেখি
তোর ফোঁড়া কাটতে গেলুম আর কি!’
টুনটুনি বললে, ‘আচ্ছা দেখতে পাবে এখন, ফোঁড়া কাটতে যাও কি না।’
বলে সে রাজার কাছে নালিশ করলে, ‘রাজামশাই, আপনার নাপিত কেন আমার ফোঁড়া কেটে দিচ্ছে
না? ওকে সাজা দিতে হবে!’
শুনে রাজামশাই হো হো করে হাসলেন, বিছানায় গড়াগড়ি দিলেন, নাপিতকে কিছু বললেন না।
তাতে টুনটুনির ভারি রাগ হল। ইঁদুরের কাছে গিয়ে বললে, ‘ইঁদুরভাই, ইঁদুরভাই, বাড়ি
আছ?’
ইঁদুর বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই!
খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’
টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি এক কাজ করে।’ ইঁদুর বললে, ‘কি কাজ?’
টুনটুনি বললে, ‘রাজামশাই যখন ঘুমিয়ে থাকবেন, তখন গিয়ে তাঁর ভুঁড়িটা কেটে ফুটো করে
দিতে হবে।’
তা শুনে ইঁদুর জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে বললে, ‘ওরে বাপরে! আমি তা পারব না।’ তাতে
টুনটুনি রাগ করে বিড়ালের কাছে গিয়ে বললে, ‘বিড়ালভাই, বাড়ি আছ?’
বিড়াল বললে, ‘কে ভাই? টুনি ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’
টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি ইঁদুর
মার।’
বিড়াল বললে, ‘এখন আমি ইঁদুর-টিদুর মারতে যেতে পারব না, আমার বড্ড ঘুম পেয়েছে।’ শুনে
টুনটুনি রাগের ভরে লাঠির কাছে গিয়ে বললে, ‘লাঠি ভাই, লাঠি ভাই, বাড়ি আছ?’
লাঠি বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বসস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে
ভাই?’
টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি বিড়ালকে ঠেঙাও।’
লাঠি বললে, ‘বিড়াল আমার কি করেছে যে আমি তাকে ঠেঙাতে যাব? আমি তা পারব না।’
তখন টুনটুনি আগুনের কাছে গিয়ে বললে, ‘আগুনভাই, আগুনভাই,
বাড়ি আছ?’
আগুন বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে
ভাই?’
টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাই খাই, যদি তুমি লাঠি পোড়াও।’
আগুন বললে, ‘আজ ঢের জিনিস পুড়িয়েছি, আজ আর কিছু পোড়াতে পারব না।’
তাতে টুনটুনি তাকে খুব করে বকে, সাগরের কাছে গিয়ে বললে, ‘সাগরভাই, সাগরভাই, বাড়ি
আছ?’
সাগর বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে
ভাই?’
টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাই খাই, যদি তুমি আগুন নিবাও।’
সাগর বললে, ‘আমি তা পারব না।’ তখন টুনটুনি হাতির কাছে গিয়ে বললে, ‘হাতিভাই,
হাতিভাই, বাড়ি আছ?
হাতি বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে
ভাই?’
টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি সাগরের জল সব খেয়ে ফেল।’
হাতি বললে, ‘অত জল খেতে পারব না, আমার পেট ফেটে যাবে।’
কেউ তার কথা শুনল না দেখে টুনটুনি শেষে মশার কাছে গেল। মশা দূর থেকে তাকে দেখেই
বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’
টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি হাতিকে কামড়াও।’
মশা বললে, ‘সে আবার একটা কথা! এখুনি যাচ্ছি! দেখব হাতি বেটার কত শক্ত চামড়া!’ বলে,
সে সকল দেশের সকল মশাকে ডেকে বললে, ‘তোরা আয় তো রে ভাই, দেখি হাতি বেটার কত শক্ত
চামড়া! অমনি পীন্-পীন্-পীন্-পীন্ করে যত রাজ্যের মশা, বাপ বেটা ভাই বন্ধু মিলে
হাতিকে কামড়াতে চলল। মশায় আকাশ ছেয়ে গেল, সূর্য ঢেকে গেল। তাদের পাখার হাওয়ায় ঝড়
বইতে লাগল। পীন্-পীন্-পীন্-পীন্ ভয়ানক শব্দ শুনে সকলের প্রাণ কেঁপে উঠল। তখন-
হাতি
বলে, আগুন শুষি।
সাগর
বলে, আগুন নেবাই!
আগুন
বলে, লাঠি পোড়াই!
লাঠি
বলে, বিড়াল ঠেঙাই!
বিড়াল
বলে, ইঁদুর মারি।
ইঁদুর
বলে, রাজার ভুঁড়ি কাটি!
রাজা
বলে, নাপতে বেটার মাথা কাটি!
নাপিত হাত জোড় করে কাঁপতে কাঁপতে বললে, ‘রক্ষে কর, টুনিদাদা! এস তোমার ফোঁড়া
কাটি।
তারপর টুনটুনির ফোঁড়া সেরে গেল, আর সে ভারি খুশি হয়ে আবার গিয়ে নাচতে আর গাইতে
লাগল-টুনটুনা টুন্ টুন্ টুন্! ধেই ধেই!
রাজার
বাগানের কোণে টুনটুনির বাসা ছিল। রাজার সিন্দুকের টাকা রোদে শুকুতে দিয়েছিল,
সন্ধ্যার সময় তার লোকেরা তার একটি টাকা ঘরে তুলতে ভুলে গেল।
টুনটুনি সেই চকচকে টাকাটি দেখতে পেয়ে তার বাসায় এনে রেখে দিলে, আর ভাবলে, ‘ঈস! আমি
কত বড়লোক হয়ে গেছি। রাজার ঘরে যে ধন আছে, আমার ঘরে সে ধন আছে!’ তারপর থেকে সে খালি
এই কথাই ভাবে, আর বলে-
রাজার ঘরে যে ধন আছে
টুনির ঘরেও সে ধন আছে!
রাজা তাঁর সভায় বসে সে কথা শুনতে পেয়ে জিগগেস করলেন, ‘হ্যাঁরে? পাখিটা কি বলছে রে?’
সকলে হাত জোড় করে বললে, ‘মহারাজ, পাখি বলছে, আপনার ঘরে যে ধন আছে, ওর ঘরেও নাকি
সেই ধন আছে!’ শুনে রাজা খিলখিল করে হেসে বললেন, ‘দেখ তো ওর বাসায় কি আছে?’
তারা দেখে এসে বললে, ‘মহারাজ, বাসায় একটা টাকা আছে।’
শুনে রাজা বললেন, ‘সে তো আমারই টাকা, নিয়ে আয় সেটা।’
তখুনি লোক গিয়ে টুনটুনির বাসা থেকে টাকাটি নিয়ে এল। সে বেচারা আর কি করে, সে মনের
দুঃখে বলতে লাগল-
‘রাজা
বড় ধনে কাতর
টুনির
ধন নিলে বাড়ির ভিতর!’
শুনে রাজা আবার হেসে বললেন, ‘পাখিটা তো বড় ঠ্যাঁটা রে! যা ওর টাকা ফিরিয়ে দিয়ে
আয়।’
টাকা ফিরে পেয়ে টুনির বড় আনন্দ হয়েছে। তখন সে বলছে-
‘রাজা ভারি ভয় পেল
টুনির টাকা ফিরিয়ে দিল।’
রাজা জিগগেস করলেন, ‘আবার কি বলছে রে?’
সভার লোকেরা বললে, ‘বলছে যে মহারাজ নাকি বড্ড ভয় পেয়েছেন, তাই ওর টাকা ফিরিয়ে
দিয়েছেন।’
শুনে তো রাজামশাই রেগে একেবারে অস্থির! বললেন, ‘কি, এত বড় কথা! আন তো ধরে, বেটাকে
ভেজে খাই!’
যেই বলা, অমনি লোক গিয়ে টুনটুনি বেচারাকে ধরে আনলে। রাজা তাকে মুঠোয় করে নিয়ে
বাড়ির ভিতর গিয়ে রানীদের বললেন, ‘এই পাখিটাকে ভেজে আজ আমাকে খেতে হবে!’
বলে তো রাজা চলে এসেছেন, আর রানীরা সাতজনে মিলে সেই পাখিটাকে দেখছেন।
একজন বললেন, ‘কি সুন্দর পাখি! আমার হাতে দাও তো একবার দেখি।’ বলে তিনি তাকে হাতে
নিলেন। তা দেখে আবার একজন দেখতে চাইলেন। তাঁর হাত থেকে যখন আর-একজন নিতে গেলেন, তখন
টুনটুনি ফসকে গিয়ে উড়ে পালাল।
কি সর্বনাশ! এখন উপায় কি হবে? রাজা জানতে পারলে তো রা থাকবে না।
এমনি করে তাঁরা দুঃখ করছেন, এমন সময় ব্যাঙ সেইখান দিয়ে থপ-থপ করে যাচ্ছে।
সাত রানী তাকে দেখতে পেয়ে খপ করে ধরে ফেললেন, আর বললেন, ‘চুপ চুপ! কেউ যেন জানতে না
পারে। এইটেকে ভেজে দি, আর রাজামশাই খেয়ে ভাববেন টুনটুনিই খেয়েছেন!’
সেই ব্যাঙটার ছাল ছাড়িয়ে তাকে ভেজে রাজামশাইকে দিলে তিনি খেয়ে খুশি হলেন। তারপর সবে
তিনি সভায় গিয়ে বসেছেন, আর ভাবছেন, ‘এবারে পাখির বাছাকে জব্দ করেছি।’
অমনি টুনি বলছে-
‘বড় মজা, বড় মজা,
রাজা খেলেন ব্যাঙ
ভাজা!’
শুনেই তো রাজামশাই লাফিয়ে উঠেছেন। তখন তিনি থুতু ফেলেন, ওয়াক তোলেন, মুখ ধোন,
আরো কত কি করেন। তারপর রেগে বললেন, ‘সাত রানীর নাক কেটে ফেল।’
অমনি জল্লাদ গিয়ে সাত রানীক নাক কেটে ফেললে।
তা দেখে টুনটুনি বললে-
‘এই টুনিতে টুনটুনাল
সাত রানীর নাক কাটাল!’
তখন রাজা বললেন, ‘আন বেটাকে ধরে! এবার গিলে খাব! দেখি কেমন করে পালায়!’
টুনটুনিকে ধরে আনলে।
রাজা বললেন, ‘আন জল!’
জল এল। রাজা মুখ ভরে জল নিয়ে টুনটুনিকে মুখে পুরেই চোখ বুজে ঢক করে গিলে ফেললেন।
সবাই বললে, ‘এবারে পাখি জব্দ!’
বলতে বলতেই রাজামশাই ভোক্ করে মস্ত একটা ঢেকুর তুললেন।
সভার লোক চমকে উঠল, আর টুনটুনি সেই ঢেকুরের সঙ্গে বেরিয়ে এসে উড়ে পালালো।
রাজা বললেন, ‘গেল, গেল! ধর্ ধর্!’ অমনি দুশো লোক ছুটে গিয়ে আবার বেচারাকে ধরে
আনলো।
তারপর আবার জল নিয়ে এল, আর সিপাই এসে তলোয়ার নিয়ে রাজা মশায়ের কাছে দাঁড়াল,
টুনটুনি বেরুলেই তাকে দু টুকরো করে ফেলবে।
এবার টুনটুনিকে গিলেই রাজামশাই দুই হাতে মুখ চেপে বসে থাকলেন, যাতে টুনটুনি আর
বেরুতে না পারে। সে বেচারা পেটের ভিতরে গিয়ে ভয়ানক ছটফট করতে লাগল!
খানিক বাদে রাজামশাই নাক সিঁটকিয়ে বললেন, ‘ওয়াক্।’ অমনি টুনটুনিকে সুদ্ধ তাঁর
পেটের ভিতরের সকল জিনিস বেরিয়ে এল।
সবাই বললে, ‘সিপাই, সিপাই! মারো, মারো! পালালো!’
সিপাই তাতে থতমত খেয়ে তলোয়ার দিয়ে যেই টুনটুনিকে মারতে যাবে, অমনি সেই তলোয়ার
টুনটুনির গায়ে না পড়ে, রাজামশায়ের নাকে পড়ল।
রাজামশাই তো ভয়ানক চ্যাঁচালেন, সঙ্গে-সঙ্গে সভার সকল লোক চ্যাঁচাতে লাগল। তখন
ডাক্তার এসে ওধুধ দিয়ে পটি বেঁধে অনেক কষ্টে রাজামশাইকে বাঁচাল।
টুনটুনি তা দেখে বলতে লাগল-
‘নাক-কাটা রাজা রে।
দেখ
তো কেমন সাজা রে!’
বলেই সে উড়ে সে-দেশ থেকে চলে গেল। রাজার লোক ছুটে এসে দেখল, খালি বাসা পড়ে আছে।
যেখানে
মাঠের পাশে বন আছে, আর বনের ধারে মস্ত পাহাড় আছে, সেইখানে, একটা গর্তের ভিতরে একটি
ছাগলছানা থাকত। সে তখনো বড় হয়নি, তাই গর্তের বাইরে যেতে পেত না। বাইরে যেতে চাইলেই
তার মা বলত, ‘যাসনে! ভালুকে ধরবে, বাঘে নিয়ে যাবে, সিংহে খেয়ে ফেলবে!’ তা শুনে তার
ভয় হত, আর সে চুপ করে গর্তের ভিতরে বসে থাকতো। তারপর সে একটু বড় হল, তার ভয়ও কমে
গেল। তখন তার মা বাইরে চলে গেলেই সে গর্তের ভিতর থেকে উঁকি মেরে দেখত। শেষে একদিন
একেবারে গর্তের বাইরে চলে এল।
সেইখানে এক মস্ত ষাঁড় ঘাস খাচ্ছিল। ছাগলছানা আর এত বড় জন্তু কখনো দেখেনি। কিন্তু
তার শিং দেখেই সে মনে করে নিল, ওটাও ছাগল, খুব ভালো জিনিস খেয়ে এত বড় হয়েছে। তাই
সে ষাঁড়ের কাছে গিয়ে জিগগেস করল, ‘হ্যাঁগা, তুমি কি খাও?’
ষাঁড় বললে, ‘আমি ঘাস খাই।’
ছাগলছানা বললে, ‘সে ঘাস কোথায়?’
ষাঁড় বললে, ‘ঐ বনের ভিতরে।’
ছাগলছানা বললে, ‘আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে।’ একথা শুনে ষাঁড় তাকে নিয়ে গেল। সেই
বনের ভিতরে খুব চমৎকার ঘাস ছিল। ছাগলছানার পেটে যত ঘাস ধরল, সে তত ঘাস খেল।
খেয়ে তার পেট এমনি ভারি হল যে, সে আর চলতে পারে না। সন্ধে হলে ষাঁড় এসে বললে, ‘এখন
চল বাড়ি যাই।’
কিন্তু ছাগলছানা কি করে বাড়ি যাবে? সে চলতেই পারে না।
তাই সে বললে, ‘তুমি যাও, আমি কাল যাব’।
তখন ষাঁড় চলে গেল। ছাগলছানা একটি গর্ত দেখতে পেয়ে তার ভিতরে ঢুকে রইল।
সেই গর্তটা ছিল এক শিয়ালের। সে তার মামা বাঘের বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিল। অনেক
রাত্রে ফিরে এসে দেখে, তার গর্তের ভিতর কি রকম একটা জন্তু ঢুকে রয়েছে। ছাগলছানাটা
কালো ছিল, তাই শিয়াল অন্ধকারের ভিতর ভালো করে দেখতে পেল না। সে ভাবল, বুঝি
রাস-টাস হবে। এই মনে করে সে ভয়ে-ভয়ে জিগগেস করল,
‘গর্তের ভিতর কে ও?’
ছাগলছানাটা ভারি বুদ্ধিমান ছিল, সে বললে-
‘লম্বা লম্বা দাড়ি
ঘন ঘন নাড়ি।
সিংহের মামা আমি
নরহরি দাস
পঞ্চাশ বাঘে মোর
এক-এক গ্রাস!’
শুনেই তো শিয়াল ‘বাবা গো!’ বলে সেখান থেকে সে ছুট! এমন ছুট দিল যে একেবারে বাঘের
ওখানে গিয়ে তবে সে নিঃশ্বাস ফেললে।
বাঘ তাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে জিগগেস করলে, ‘কি ভাগ্নে, এই গেলে,
আবার এখুনি এত ব্যস্ত হয়ে ফিরলে যে?’
শিয়ার হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ‘মামা, সর্বনাশ তো হয়েছে, আমার গর্তে এক নরহরি দাস
এসেছে। সে বলে কিনা যে পঞ্চাশ বাঘে তার এক গ্রাস!’
তা শুনে বাঘ ভয়ানক রেগে বললে, ‘বটে, তার এত বড় আস্পর্ধা! চলতো ভাগ্নে! তাকে দেখতে
কেমন পঞ্চাশ বাঘে যার এক গ্রাস!’
শিয়াল বললে, ‘আমি আর সেখানে যেতে পারব না, আমি সেখানে গেলে যদি সে হাঁ করে আমাদের
খেতে আসে, তা হলে তুমি তো দুই লাফেই পালাবে। আমি তো তেমন ছুটতে পারব না, আর সে
বেটা আমাকেই ধরে খাবে।’
বাঘ বললে, ‘তাও কি হয়? আমি কখনো তোমাকে ফেলে পালাব না।’
শিয়াল বললে, ‘তবে আমাকে তোমার লেজের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে চল।’
তখন বাঘ তো শিয়ালকে বেশ করে লেজের সঙ্গে বেঁধে নিয়েছে, আর শিয়াল ভাবছে, ‘এবার আর
বাঘমামা আমাকে ফেলে পালাতে পারবে না।’
এমনি করে তারা দুজনে শিয়ালের গর্তের কাছে এল। ছাগলছানা দূর থেকেই তাদের দেখতে পেয়ে
শিয়ালকে বললে-
‘দূর হতভাগা! তোকে দিলুম দশ বাঘের কড়ি,
এক বাঘ নিয়ে এলি লেজে দিয়ে দড়ি!’
শুনেই তো ভয়ে বাঘের প্রাণ উড়ে গিয়েছে। সে ভাবলে যে, নিশ্চয় শিয়াল তাকে ফাঁকি দিয়ে
নরহরি দাসকে খেতে দেবার জন্য এনেছে। তারপর সে কি আর সেখানে দাঁড়ায়! সে পঁচিশ হাত
লম্বা এক-এক লাফ দিয়ে শিয়ালকে সুদ্ধ নিয়ে পালাল। শিয়াল বেচারা মাটিতে আছাড় খেয়ে,
কাঁটাল আঁচড় খেয়ে, খেতের আলে ঠোক্কর খেয়ে একেবারে যায় আর কি! শিয়াল চেঁচিয়ে
বললে, ‘মামা, আল! মামা, আল!’ তা শুনে বাঘ ভাবে বুঝি সেই নরহরি দাস এল, তাই সে আরো
বেশি করে ছোটে। এমনি করে সারারাত ছুটোছুটি করে সারা হল।
সকালে ছাগলছানা বাড়ি ফিরে এল।
শিয়ালের সেদিন ভারি সাজা হয়েছিল। সেই থেকে বাঘের উপর তার এমনি রাগ হল যে, সে রাগ আর
কিছুতেই গেল না।
শিয়াল
ভাবে, ‘বাঘমামা, দাঁড়াও তোমাকে দেখাচ্ছি!’ এখন সে আর নরহরি দাসের ভয়ে তার পুরনো
গর্তে যায় না, সে একটা নতুন গর্ত খুঁজে বার করেছে।
সেই গর্তের কাছে একটা কুয়ো ছিল।
একদিন শিয়াল নদীর ধারে একটা মাদুর দেখতে পেয়ে, সেটাকে টেনে তার বাড়িতে দিয়ে এল।
এনে, সেই কুয়োর মুখের উপর তাকে বেশ করে বিছিয়ে বাঘকে গিয়ে বলল, ‘মামা, আমার নতুন
বাড়ি দেখতে গেলে না?’ শুনে বাঘ তখনি তার বাড়ি দেখতে এল। শিয়াল তাকে সেই কুয়োর মুখে
বিছানা মাদুরটা দেখিয়ে বললে, ‘মামা, একটু বস, জলখাবার খাবে।’
জলখাবারের কথা শুনে বাঘ ভারি খুশি হয়ে, লাফিয়ে সেই মাদুরের উপর বসতে গেল, আর অমনি
সে কুয়োর ভিতরে পড়ে গেল। তখন শিয়াল বললে, ‘মামা, খুব করে জল খাও, একটুও রেখ না
যেন!’
সেই কুয়োর ভিতরে কিন্তু বেশি জল ছিল না, তাই বাঘ তাতে ডুবে মারা যায় নি। সে আগে
খুবই ভয় পেয়েছিল, কিন্তু শেষে অনেক কষ্টে উঠে এল। উঠেই সে বললে, ‘কোথায় গেলিরে
শিয়ালের বাচ্চা? দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি।’ কিন্তু শিয়াল তার আগেই পালিয়ে গিয়েছিল,
তাকে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া গেল না।
তারপর থেকে বাঘের ভয়ে শিয়াল আর তার বাড়িতেও আসতে পায় না, খাবার খুঁজতেও যেতে পারে
না। দূর থেকে দেখতে পেলেই বাঘ তাকে মারতে আসে। বেচারী না-খেয়ে না-খেয়ে শেষে আধমরা
হয়ে গেল। তখন সে ভাবলে, ‘এমন হলে তো মরেই যাব। তার চেয়ে বাঘ মামার কাছে যাই না
কেন? দেখি যদি তাকে খুশি করতে গেল। বাঘের বাড়ি থেকে অনেক দূরে থাকতেই সে খালি নমস্কার
করছে আর বলছে, ‘মামা, মামা!’
শুনে বাঘ আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘তাই তো, শিয়াল যে!’
শিয়াল অমনি ছুটে এসে দুহাতে তার পায়ের ধুলো নিয়ে বললে, ‘মামা, আমাকে খুঁজতে গিয়ে
তোমার বড় কষ্ট হচ্ছিল, দেখে আমার কান্না পাচ্ছিল। মামা, আমি তোমাকে বড্ড
ভালোবাসি, তাই এসেছি। আর কষ্ট করে খুঁজতে হবে না, ঘরে বসেই আমাকে মার।’
শিয়ালের কথায় বাঘ তো ভারি থতমত, খেয়ে গেল। সে তাকে মারলে না, খালি ধমকিয়ে বললে,
‘হতভাগা পাজি, আমাকে কুয়োয় ফেলে দিয়েছিলি কেন?’
শিয়াল জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে বললে, ‘রাম-রাম! তোমাকে আমি কুয়োয় ফেলতে পারি?
সেখানকার মাটি বড্ড নরম ছিল, তার উপর তুমি লাফিয়ে পড়েছিলে, তাই গর্ত হয়ে গিয়েছিল।
তোমার মতো বীর কি মামা আর কোথাও আছে?’
তা শুনে বোকা বাঘ হেসে বললে, ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ ভাগ্নে, সে কথা ঠিক। আমি তখন বুঝতে
পারিনি।’
এমনি করে তাদের আবার ভাব হয়ে গেল।
তারপর একদিন শিয়াল নদীর ধারে গিয়ে দেখল যে, বিশ হাত লম্বা একটা কুমির ডাঙায় উঠে
রোদ পোয়াচ্ছে। তখন সে তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে বাঘকে বললে, ‘মামা, মামা, একটা নৌকা
কিনেছি, দেখবে এসো।’
বোকা বাঘ এসে সেই কুমিরটাকে সত্যি সত্যি নৌকো মনে করে লাফিয়ে তার উপর উঠতে গেল,
আর অমনি কুমির তাকে কামড়ে ধরে জলে গিয়ে নামল।
তা দেখে শিয়াল নাচতে-নাচতে বাড়ি চলে গেল।
এক বোকা
জোলা ছিল। সে একদিন কাস্তে নিয়ে ধান কাটতে গিয়ে খেতের মাঝখানেই ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম
থেকে উঠে আবার কাস্তে হাতে নিয়ে দেখল, সেটা বড্ড গরম হয়েছে।
কাস্তেখানা রোদ লেগে গরম হয়েছিল, কিন্তু জোলা ভাবলে তার জ্বর হয়েছে। তখন সে ‘আমার
কাস্তে তো মরে যাবে রে!’ বলে হাউ-মাউ করে কাঁদতে লাগল। পাশের ক্ষেতে এক চাষা কাজ
করছিল। জোলার কান্না শুনে সে বললে, ‘কি হয়েছে?’
জোলা বললে, ‘আমার কাস্তের জ্বর হয়েছে।’
তা শুনে চাষা হাসতে-হাসতে বললে, ‘ওকে জলে ডুবিয়ে রাখ, জ্বর সেরে যাবে।’
জলে ডুবিয়ে কাস্তে ঠাণ্ডা হল, জোলাও খুব সুখী হল।
তারপর একদিন জোলার মায়ের জ্বর হয়েছে। সকলে বললে, ‘বদ্যি ডাক।’ জোলা বললে, ‘আমি
ওষুধ জানি।’ বলে, সে তার মাকে পুকুরে নিয়ে জলের ভিতরে চেপে ধরল। সে বেচারী যতই ছটফট
করে, জোলা ততই আরো চেপে ধরে, আর বলে, ‘রোস, এই তোর জ্বর সারছে।’
তারপর যখন দেখল বুড়ি আর নড়ছে-চড়ছে
না, তখন তাকে তুলে দেখে, সে মরে গেছে। তখন জোলা চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগল, তিনদিন কিছু
খেল না, পুকুর পাড় থেকে ঘরেও গেল না।
এক শিয়াল সেই জোলার বন্ধু ছিল। সে জোলাকে কাঁদতে দেখে এসে বললে, ‘বন্ধু, তুমি
কেঁদ না, তোমাকে রাজার মেয়ে বিয়ে করাব।’
শুনে জোলা চোখ মুছে ঘরে গেল। তারপর থেকে সে রোজ শিয়ালকে বলে, ‘কই বন্ধু, সেই যে
বলেছিলে?’
শিয়াল বললে, ‘যখন বলেছি, তখন করাবই। আগে তুমি খান কতক খুব ভালো কাপড় বুনগে দেখি।’
জোলা দুমাস খালি কাপড়ই বুনল। তারপর শিয়াল তাকে খুব করে সাবান মেখে স্নান করতে বলে,
রাজার কাছে মেয়ে চাইতে বেরুল।
কানে কলম গুঁজে, পাগড়ি এঁটে, জামা জুতো পরে, চাদর জড়িয়ে, ছাতা বগলে করে, শিয়াল যখন
রাজার কাছে উপস্থিত হল, তখন রাজামশাই ভাবলেন, এ খুব পণ্ডিত লোক হবে। তিনি জিগগেস
করলেন, ‘কি শিয়াল পণ্ডিত, কি জন্যে এসেছ?’
শিয়াল বললে, ‘মহারাজ, আমাদের রাজার সঙ্গে আপনার মেয়ের বিয়ে দেবেন কি-না, তাই জানতে
এসেছি।’
শিয়াল মিছে কথা বলেনি, সেই জোলার নাম ছিল ‘রাজা’। কিন্তু
রাজামশাই মনে করলেন বুঝি সত্যি-সত্যিই রাজা। তিনি ব্যস্ত হয়ে জিগগেস করলেন,
‘তোমাদের রাজা কেমন?’
শিয়াল বললে-
‘দেখতে রাজা বড়ই ভালো
ঘরময় তার চাঁদের আলো।
বুদ্ধি তার আছে যেমন
লেখাপড়া জানে তেমন।
এক ঘায় তার দশটা পড়ে
তার গুণে লোক খায় পরে।’
সত্যি-সত্যিই সে জোলা দেখতে ভারি সুন্দর ছিল, তাই শিয়াল বললে, ‘দেখতে বড়ই ভালো।’
তার ঘরে চাল ছিল না বলে ভিতরে চাঁদের আলো আসত, তাই শিয়াল বললে, ‘ঘরময় চাঁদের
আলো।’ কিন্তু রাজামশাই ভাবলেন, বুঝি সেটা তাঁর নিজের বাড়ির মতন খুব ঝকঝকে জমকালো
একটা বাড়ি!
বুদ্ধি তার ছিল না, আর সে লেখাপড়াও জানত না। কাজেই শিয়াল বললে, ‘বুদ্ধি তার
আছে যেমন, লেখাপড়া জানে তেমন।’ কিন্তু রাজা ভাবলেন, তার ভারি বুদ্ধি, সে ঢের
লেখাপড়া জানে।
‘এক ঘায়, তার দশটা পড়ে,’ এ কথাও সত্যি। দশটা মানুষ নয়, দশটা ধানের গাছ! সে চাষা
ছিল, কাস্তে নিয়ে ধান কাটত। রাজামশাই কিন্তু ভাবলেন, সে মস্ত বড় বীর, তার এক ঘায়
দশজন মানুষ মরে যায়।
সে ধানের চাষ করত আর কাপড় বুনত। ধান থেকেই তো ভাত হয়, তাই লোকে খায়, আর কাপড় পরে।
তাই শিয়াল বললে, ‘তার গুণে লোক খায় পরে।’ রাজামশাই কিন্তু সেইরকম বুঝলেন না। তিনি
ভাবলেন, বুঝি সে ঢের গরীব লোককে খেতে পরতে দেয়।
কাজেই তিনি খুব খুশি হয়ে শিয়ালকে এক হাজার টাকা বকশিশ দিলেন, আর বললেন, ‘এমন লোকের
সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেব না তো কার সঙ্গে দেব? তোমার রাজাকে নিয়ে এস, আট দিনের পর
বিয়ে হবে।’
শিয়াল সেই হাজার টাকার থলে বগলে করে, নাচতে-নাচতে জোলার কাছে এল। এসে দেখে, জোলা
খালি কাপড়ই বুনছে। দুমাসে সে এত কাপড় বুনেছে যে সেই গ্রামের সকলের এক-একখানি করে
কাপড় হতে পারে।
শিয়াল সেই টাকার থলে থেকে দুটি করে টাকা আর এক-একখানি কাপড় গ্রামের সকলকে দিয়ে
বললে, ‘আট দিন পরে রাজার মেয়ের সঙ্গে আমাদের বন্ধুর বিয়ে হবে, আপনাদের নিমন্ত্রণ।’
শুনে তারা ভারি খুশি হল। জোলা বোকা হলেও বড় ভালোমানুষ ছিল, তাই সকলে তাকে
ভালোবাসত।
তারপর শিয়াল আর সব শিয়ালের কাছে গিয়ে বললে, ‘ভাই সকল, আমার বন্ধুর বিয়ে, তোমাদের
নিমন্ত্রণ। তোমরা গান গাইতে যাবে।’ শুনে শিয়াল সব হোয়া-হোয়া করে বললে, ‘হ্যাঁ,
হ্যাঁ, যাব, যাব।’
তারপর শিয়াল ব্যাঙদের কাছে গিয়ে বললে, ‘ভাই সকল, আমার বন্ধুর বিয়ে, তোমাদের
নিমন্ত্রণ। তোমরা গান গাইতে যাবে।’
সকল ব্যাঙ ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে বললে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাব, যাব।’ তারপর শিয়াল শালিকদের
কাছে গিয়ে বললে, ‘ভাই সকল, আমার বন্ধুর বিয়ে, তোমাদের নিমন্ত্রণ। তোমরা গান গাইতে
যাবে।’
শালিকের দল কিচির-মিচির করে বললে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাব, যাব।’
তারপর শিয়াল তাঁড়িচাঁচাদের কাছে, ঘুঘুদের কাছে কুঁক্কো পাখিদের কাছে, উৎক্রোশ
পাখিদের কাছে, বৌ কথা-ক-দের কাছে, ময়ূরদের কাছে, চোখগেলদের আর ভগদত্তদের কাছে
গিয়েও তেমনি করে নিমন্ত্রণ করে এল। তারা সবাই বললে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাব, যাব।’
এ-সব কাজ শেষ হতে সাতদিন লাগল। তার পরের দিন রাত্রিতে বিয়ে। শিয়াল তার বন্ধুদের
জন্যে চমৎকার পোশাক ভাড়া করে এনে যখন সেই পোশাক তাকে পরিয়ে তখন সত্যিসত্যিই তাকে
খুব বড় একটা রাজার মতন মনে হতে লাগল। যাদের নিমন্ত্রণ, তারা সবাই এল। যাবার সময়
হলে, শিয়াল তাদের সকলকে নিয়ে রাজার বাড়ি চলল।
রাজার বাড়ি যখন এক ক্রোশ দূরে, তখন শিয়াল সকলকে ডেকে বললে, ‘ভাই সকল, ঐ দেখ জোর।
অমনি পাঁচ হাজার শিয়াল মিলে চ্যাঁচাতে লাগল, ‘হুয়া, হুয়া, হুয়া, হুয়া!’
বারো হাজার ব্যাঙ বললে, ‘ঘোঁৎ, ঘোঁৎ, ঘেঁয়াও ঘেঁয়াও।’
সাত হাজার শালিক বললে-
‘ফড়িং সঙ্গে সঙ্গে
চারিজনং
চকিৎ কাট
কাট কাট গুরুচরণ!’
দুহাজার হাঁড়িচাঁচা বললে, ‘ঘ্যাঁচা, ঘ্যাঁচা, ঘ্যাঁচা, ঘ্যাঁচা, ঘ্যাঁচা!’
চার হাজার ঘুঘু বললে, ‘রঘু, রঘু, রঘু, রঘু, রঘু, রঘু!’
তিন হাজার কুঁক্কো বললে, ‘পুৎ, পুৎ, পুৎ, পুৎ, পুৎ, পুৎ!’
উনিশ শো উৎক্রোশ বললে, ‘হাঁ আঃ, হাঁ আঃ, হাঁ আঃ, ও হো হো হো হো!’
আর যত বৌ-কথা-ক, ময়ূর, ভগদত্ত আর চোখ-গেল, তারাও সবাই মিলে যার-যার নিজের গান
ধরতে ছাড়ল না।
তখন শুনতে কেমন হয়েছিল, তা সেখানে থাকলে বোঝা যেত। রাজার বাড়ির লোকেরা দূর থেকে
তা শুনে তো ভয়ে কাঁপতেই লাগল। তারপর যখন শিয়াল রাজামশাইকে খবর দিতে এল, তখন তিনি
ভারি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘শিয়াল পণ্ডিত, ওটা কিসের গোলমাল?’
শিয়াল বললে, ‘ওটা আমাদের বাজনা আর লোকজনের শব্দ।’
শুনে রাজা তো ভয়ে অস্থির হলেন। এত লোককে কোথায় বসাবেন, কি দিয়ে খাওয়াবেন, ভেবে
ঠিক করতে পারলেন না। তিনি শিয়ালকে বললেন, ‘তাই তো, কি হবে?’
শিয়াল বললে, ‘ভয় কি মহারাজ! আমি এখুনি গিয়ে লোকজন সব ফিরিয়ে দিচ্ছি। খালি রাজাকে
আপনার কাছে আনব।’
রাজা তখন বড়ই খুশি হয়ে শিয়ালকে পাঁচ হাজার টাকা বকশিশ দিলেন। শিয়াল ফিরে এসে মাঠের
মাঝখানে অনেক টাকার মুড়ি-মুড়কি, আর ছোট ছোট মাছ ছড়িয়ে দিয়ে বললে, ‘তোমরা খাও।’
অমনি তার সঙ্গের সব শিয়াল, ব্যাঙ আর পাখি মিলে কাড়াকাড়ি করে সে সব খেতে লাগল। শিয়াল
গ্রামের লোকদের প্রাণ ভরে সন্দেশ খাইয়ে বাড়ি পাঠিয়ে
দিল। তারপর জোলাকে নিয়ে রাজার কাছে এল। আসবাব সময় তাকে শিখিয়ে আনল, ‘খবরদার! কথা
বলো না যেন, তবে কিন্তু বিয়ে করতে পারবে না।’
রাজার বাড়ির লোকেরা বর দেখে কি যে খুশি হল, কি বলব! তারা খালি এইজন্য দুঃখ করতে
লাগল যে, এমন সুন্দর বর, কিন্তু সে কথা কয় না কেন?
শিয়াল বললে, ‘ওঁর মা মরে গিয়েছেন, সেই দুঃখে উনি কথা বলছেন না।’ শুনে সবাই বললে,
‘আহা!’ কিন্তু আসল কথা এই যে, কথা বললেই কিনা জোলা ধরা পড়ে যাবে, তাই শিয়াল তাকে
মানা করেছে।
খাবার সময় জোলাকে সোনার থালায় ভাত, আর একশোটা সোনার বাটিতে নানা রকম তরকারি আর
মিঠাই দিয়েছিল। সে এক-একটি করে সবগুলো বাটি হাতে নিয়ে ওঁকে দেখল। শেষে তার কোনটাই
চিনতে না পেরে, মিঠাই, ঝোল, অম্বল সব একসঙ্গে ভাতের উপর ঢেলে মেখে নিল। তারপর তার
খানিকটা খেতে না পেরে, যা বাকি ছিল চাদরে বাঁধতে গেল।
সকলে শিয়ালকে বললে, ‘তোমাদের রাজা কেন এমন? কখনো কিছু খায়নি নাকি?’
শিয়াল চোখ ঠেরে তাদের কানে-কানে বলল, ‘উনি একবার মেখে দুই দুবার মেখে খান না, আর
পাতে যা থাকে তা চাদরে বেঁধে, সেই চাদরখানি সুদ্ধ গরীবকে দেন। একজন গরীবকে ডাক। বলে
সে খাবার-বাঁধা চাদরখানি জোলার গা থেকে খুলে গরীবকে দিতে দিল।
শোবার সময় জোলার ভারি মুশকিল হল। হাতির দাঁতের খাটে বিছানা, তাতে মশারি খাটানো।
সে বেচারা কোনদিন খাটও দেখেনি, মশারিও দেখেছি।
আগে বিয়ে খাটের তলায় ঢুকল, সেখানে বিছানা নেই দেখে বেরিয়ে এল। তারপর মশারির চারধার
খুঁজে তার দরজা টের না পেয়ে বললে, ‘বুঝেছি, ঘরের ভিতর ঘর করেছে, তার দোর রেখেছে
চালের উপর!’
বলে সে খাটের খুঁটি বেয়ে যেই মশারির চালে উঠতে গিয়েছে, অমনি সবসুদ্ধ ভেঙে নিয়ে
ধপাৎ! তখন সে কাঁদতে কাঁদতে বললে, ‘ধান কাটতুম, কাপড় বুনতুম, সেই ছিল ভালো। রাজার
মেয়ে বিয়ে করে মোর কোমর ভেঙে গেল।’
ভাগ্যিস সেখানে আর লোক ছিল না, কেবল রাজার মেয়ে ছিলেন, আর বাইরে শিয়াল বসে ছিল।
রাজার মেয়ে অনেক কাঁদলেন, আর শিয়ালকে বকলেন। কিন্তু তাঁর ভারি বুদ্ধি ছিল, তাই এ
কথা আর কাউকে বললেন না।
পরদিন রাজার মেয়ের কথায় শিয়াল গিয়ে রাজাকে বললে, ‘মহারাজ, আপনার জামাই বলছেন, আপনার
মেয়েকে নিয়ে তিনি নানান দেশ দেখতে যাবেন। তাই ছুটি চাচ্ছেন।’
রাজা খুশি হয়ে ছুটি দিলেন, আর লোকজন, টাকাকড়ি সঙ্গে দিলেন। তারপর রাজার মেয়ে
জোলাকে নিয়ে আর-এক দেশে গিয়ে বড় বড় মাস্টার রেখে তাকে সকল রকম বিদ্যে শেখাতে
লাগলেন। দু-তিন বছরের মধ্যে জোলা মস্ত পণ্ডিত আর বীর হয়ে উঠল।
তখন খবর এল যে, রাজা মরে গেছেন, আর তাঁর ছেলে নেই বলে জামাইকে রাজা করে গিয়েছেন।
তখন খুব সুখের কথা হল।
এক যে
ছিল কুঁজো বুড়ি। সে লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে চলত, আর তার মাথাটা খালি ঠক-ঠক করে
নড়ত। বুড়ির দুটো কুকুর ছিল। একটা নাম রঙ্গা, আর একটার নাম ভঙ্গা।
বুড়ি যাবে নাতনীর বাড়ি, তাই কুকুর দুটোকে বললে, ‘তোরা যেন বাড়ি থাকিস, কোথাও চলে
টলে যাসনে।’
রঙ্গা-ভঙ্গা বললে, ‘আচ্ছা’।
তারপর বুড়ি লাঠি ভর দিয়ে, কুঁজো হয়ে যাচ্ছে, আর তার মাথাটা খালি ঠক ঠক করে নড়ছে।
এমনি করে সে খানিক দূর গেল।
তখন শিয়াল তাকে দেখতে পেয়ে বললে, ‘ঐ রে, সেই কুঁজো বুড়ি যাচ্ছে। বুড়ি, তোকে তো
খাব!’
বুড়ি বললে, ‘রোস, আমি আগে নাতনীর বাড়ি থেকে মোটা হয়ে আসি, তারপর খাস। এখন খেলে
তো শুধু হাড় আর চামড়া খাবি, আমার গায়ে কি আর কিছু আছে?’
শুনে শিয়াল বললে, ‘আচ্ছা, তবে মোটা হয়ে আয়, তারপর খাব এখন।’ বলে শিয়াল চলে গেল।
তারপর বুড়ি আবার লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে যাচ্ছে, আর তার মাথাটা ঠক-ঠক করে নড়ছে।
এমনি করে আরো খানিক দূর গেল।
তখন এক বাঘ তাকে দেখতে পেয়ে বললে, ‘ঐ রে, সেই কুঁজো বুড়ি যাচ্ছে। বুড়ি, তোকে তো
খাব!’
বুড়ি বললে, ‘রোস, আমি আগে নাতনীর বাড়ি থেকে মোটা হয়ে আসি, তারপর খাস। এখন খেলে
তো শুধু হাড় আর চামড়া খাবি, আমার গায়ে কি আর কিছু আছে?’
শুনে বাঘ বললে, ‘আচ্ছা, তবে মোটা হয়ে আয়, তারপর খাব এখন।’ বলে বাঘ চলে গেল।
তারপর বুড়ি আবার লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে যাচ্ছে, আর তার মাথাটা ঠক-ঠক করে নড়ছে।
এমনি করে সে আরো খানিক দূর গেল।
তখন এক ভাল্লুক তাকে দেখতে পেয়ে বললে, ‘ঐ রে, সেই কুঁজো বুড়ি যাচ্ছে। বুড়ি, তোকে
তো খাব!’
বুড়ি বললে, ‘রোস, আমি আগে নাতনীর বাড়ি থেকে মোটা হয়ে আসি, তারপর খাস। এখন খেলে
তো শুধু হাড় আর চামড়া খাবি, আমার গায়ে কি আর কিছু আছে?’
শুনে ভাল্লুক বললে, ‘আচ্ছা, তবে মোটা হয়ে আয়, তারপর খাব এখন।’
এই বলে ভাল্লুক চলে গেল।
বুড়িও আর খানিক দূর গিয়েই তার নাতনীর বাড়ি পৌঁছল। সেখানে দই আর ক্ষীর খেয়ে-খেয়ে
এমনি মোটা হল যে, কি বলব! আর একটু মোটা হলেই সে ফেটে যেত।
তাই সে তার নাতনীকে বললে, ‘ওগো নাতনী, আমি তো বাড়ি চললুম। এবারে আর আমি চলতে পারব
না। আমাকে গড়িয়ে যেতে হবে। আবার পথে ভাল্লুক, বাঘ আর শিয়াল হাঁ করে বসে আছে। আমাকে
দেখতে পেলেই ধরে খাবে। এখন বল দেখি কি করি?’
নাতনী বললে, ‘ভয় কি দিদিমা? তোমাকে এই লাউয়ের খোলটার ভিতরে পুরে দেব। তাহলে বাঘ
ভাল্লুক বুঝতেও পারবে না, তোমাকে খেতেও পারবে না।’
বলে, সে বুড়িকে একটা লাউয়ের খোলার ভিতর পুরে, তার খাবার জন্যে চিঁড়ে আর তেঁতুল
সঙ্গে দিয়ে, হেঁইয়ে বলে লাউয়ে ধাক্কা দিলে, আর লাউ গাড়ির মতন গড়গড়িয়ে চলল।
লাউ চলছে আর বুড়ি তার ভিতর থেকে বললে-
‘লাউ গড়-গড়,
লাউ গড়-গড়
খাই
ছিঁড়ে আর তেঁতুল,
বীচি
ফেলি টুল্-টুল্।
বুড়ি
গেল ঢের দূর!’
পথের মাঝখানে সেই ভাল্লুক হাঁ করে বসে আচে, বুড়িকে খাবে বলে। সে বুড়ি-টুড়ি কিছু
দেখতে পেলে না, খালি দেখলে একটা লাউ গড়িয়ে যাচ্ছে। লাউটাকে নেড়ে-চেড়ে দেখলে, বুড়িও
নয়, খাবার জিনিসও নয়। আর তার ভিতর থেকে কে যেন বলছে, ‘বুড়ি গেল ঢের দূর!’ শুনে সে
ভাবলে, বুড়ি চলে গিয়েছে। তখন সে ঘোঁৎ করে তাতে দিলে এক ধাক্কা আর সেটা গাড়ির মতন
গড়গড়িয়ে চলল।
লাউ চলছে আর বুড়ি তার ভিতর থেকে। বলছে-
‘লাউ
গড়-গড়, লাউ গড়-গড়,
খাই ছিঁড়ে আর তেঁতুল,
বীচি ফেলি টুল্-টুল্।
বুড়ি গেল ঢের দূর!’
আবার খানিক দূরে বাঘ বসে আছে বুড়িকে খাবে বলে। সে বুড়িকে দেখতে পেল না, খালি দেখলে
একটা লাউ গড়িয়ে যাচ্ছে। সেটাকে নেড়ে-চেড়ে দেখলে, বুড়িও নয়, খাবার জিনিসও নয়। আর তার
ভিতর থেকে সে যেন বলছে, ‘বুড়ি গেল ঢের দূর।’ শুনে সে ভাবলে বুড়ি চলে গিয়েছে। তখন সে
ঘোঁৎ করে তাতে দিলে এক ধাক্কা, আর সেটা গাড়ির মতন গড়গড়িয়ে চলল।
লাউ চলছে আর বুড়ি তার ভিতর থেকে চললে-
‘লাউ গড়-গড়,
লাউ গড়-গড়,
খাই
ছিঁড়ে আর তেঁতুল,
বীচি
ফেলি টুল্-টুল্।
বুড়ি
গেল ঢের দূর!’
আবার খানিক দূরে সেই শিয়াল পথের মাঝখানে বসে আছে। সে লাউ দেখে বললে, ‘হুঁ! লাউ কিনা
আবার কথা বলে। ওর ভিতর কি আছে দেখতে হবে।’ তখন সে হতভাগা লাথি মেরে লাউটা ভেঙেই বলে
কিনা, ‘বুড়ি তোকে তো খাব!’
বুড়ি বললে ‘খাবি বইকি! নইলে এসেছি কি করতে? তা, আগে দুটো গান শুনবিনে?’
শিয়াল বললে, ‘হ্যাঁ, দুটো গান হলে মন্দ হয় না। আমিও একটু-আধটু গাইতে পারি।’
বুড়ি বললে, ‘তবে ভালোই হল। চল ঐ চিপিটায় উঠে গাইব এখন।’
বলে বুড়ি সেই টিপির উপরে উঠে সুর ধরে চেঁচিয়ে বললে, ‘আয়, রঙ্গা-ভঙ্গা, তু-উ-উ-উ-উ!’
অমনি বুড়ির দুই কুকুর ছুটে এসে, একটা ধরলে শিয়ালের ঘাড়, আর একটায় ধরলে তার কোমর।
ধরে টান কি টান! শিয়ালের ঘাড় ভেঙে গেল, কোমর ভেঙে গেল, জিভ বেরিয়ে গেল, প্রাণ
বেরিয়ে গেল-তবু তারা টানছেই, টাইছেই, খালি টানছে।
এক যে
ছিল উকুনে-বুড়ি, তার মাথায় বড্ড ভয়ানক উকুন ছিল। সে যখন তার বুড়োকে ভাত খেতে দিত,
তখন ঝরঝর করে সেই উকুন বুড়োর পাতে পড়ত। তাইতে সে একদিন রেগে গিয়ে, ঠাঁই করে বুড়িকে
এক ঠেঙার বাড়ি মারলে। তখন বুড়ি ভাতের হাঁড়ি আছড়ে গুঁড়ো করে রাগে ভয়ে সেই যে নদীর
ধার দিয়ে চলে গেল, আর তাকে বুড়ো ডেকে ফিরাতে পারলে না।
নদীর ধারে এক বক বসে ছিল, সে উকুনে-বুড়িকে দেখে বললে, ‘উকুনে-বুড়ি, কোথা যাস?’
উকুনে-বুড়ি বললে,
স্বামী
মারলে, রাগে তাই
ঘর-গেরস্তী
ফেলে যাই।
বক বললে, ‘তোর স্বামী মারলে কেন? কি হয়েছে?
উকুনে-বুড়ি বললে, ‘আমার মাথা থেকে তার পাতে উকুন পড়েছিল।’
বক বললে, ‘কেন, উকুন তো বেশ লাগে! তার জন্যে মারলে কেন? তুই আমার বাড়ি চল। শুনেছি
তুই খুব ভালো বাঁধিস।’ তাইতে উকুনে-বুড়ি বকের বাড়িতে রাঁধুনি হল। তার রান্না বকের
বেশ ভালো লাগত, আর পাতে উকুন পড়লে তো সে খুব খুশিই হত।
তখন, একদিন হয়েছে কি-বক এনেছে একটা মস্ত শোল মাছ। এনে সে উকুনে বুড়িকে বললে,
‘উকুনে-বুড়ি, মাছটা বেশ করে রাঁধ।’ বলে সে আবার নদীর
ধারে চলে গেল। উকুনে-বুড়ি মাছ রাঁধতে লাগল। রাঁধতে রাঁধতে বেচারা মাথা ঘুরে কখন
কড়ার মধ্যে পড়ে গিয়েছে কেউ জানতে পারেনি।
বক এসে দেখলে, উকুন-বুড়ি পুড়ে মরে আছে। দেখে তার এমনি দুঃখ হল যে, সে নদীর ধারে
গিয়ে মুখ ভার করে বসে রইল, সাতদিন কিছু খেল না।
নদী বললে, ‘ভালোরে ভালো, সাতদিন ধরে এমন করে বক বসে আছে, খায় দায়নি! এর হল কি?
হ্যাঁ ভাই বক, তোর হয়েছে কি ভাই?’
বক বললে, ‘আরে ভাই, সে কথা বলে কি হবে? আমার যা হবার তা হয়েছে।’
নদী বললে, ‘ভাই, আমাকে বলতে হবে।’
বক বললে, ‘যদি বলি, তবে কিন্তু তোর সব জল ফেনা হয়ে যাবে।’
নদী বললে, ‘হয় হবে, তুই বল।’
তখন বক বললে-
উকুনে-বুড়ি পুড়ে মোলো,
বক
সাতদিন উপোস রইল।
অমনি ফ্যান-ফ্যান করে দেখতে-দেখতে নদীর চল ফেনিয়ে সাদা হয়ে গেল।
সেই নদীতে এক হাতি রোজ জল খেতে আসে। সেদিন সে জল খেতে এসে দেখে, একি কাণ্ড হয়ে
আছে!
হাতি বললে, ‘নদী, তোর কি হল? তোর জল কি করে ফেনা হয়ে গেল?’
নদী বললে, ‘তা যদি বলি, তবে কিন্তু তোর লেজটি খসে পড়ে যাবে।’
হাতি বললে, ‘যায় যাবে, তুই বল।’
উকুনে-বুড়ি পুড়ে মোলো,
বক
সাতদিন উপোস রইল,
নদীর
জল ফেনিয়ে গেল।
অমনি ধপাস করে হাতির লেজটা খসে পড়ে গেল!
তারপর হাতি গাছতলা দিয়ে যাচ্ছে, গাছ তাকে দেখে বললে, ‘বাঃ রে, তোর একি হল? লেজ
কোথায় গেল?’
হাতি বললে, ‘তা যদি বলি, তবে কিন্তু তোর পাতাগুলি সব এক্ষুনি ঝড়ে পড়বে।’
গাছ বলল, ‘পড়ে পড়ুক, তুই বল্।’
তখন হাতি বললে-
উকুনে-বুড়ি পুড়ে, মোলো,
বক
সাতদিন উপোস রইল,
নদীর
জল ফেনিয়ে গেল,
হাতির
লেজ খসে পড়ল।
অমনি ঝর-ঝর করে গাছের সব পাতাগুলি ঝড়ে পড়ে গেল। সেই গাছে এক ঘুঘুর বাসা ছিল। সে তখন
খাবার খুঁজতে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখে, ওমা একি হয়েছে! ঘুঘু বললে, ‘গাছ, তোর একি
হল? তোর পাতা সব কোথায় গেল?’
গাছ বললে, ‘তা যদি বলি, তবে কিন্তু তোর চোখ কানা হয়ে যাবে।’
ঘুঘু বললে, ‘যায় যাবে, তুই বল্।’
তখন গাছ বললে-
উকুনে-বুড়ি পুড়ে মোলো,
বক
সাতদিন উপোস রইল,
নদীর
জল ফেনিয়ে গেল,
হাতির
লেজ খসে পড়ল,
গাছের
পাতা ঝড়ে পড়ল।
অমনি টস্ করে ঘুঘুর একটা চোখ কানা হয়ে গেল।
কানা চোখ নিয়ে ঘুঘু মাঠে চরতে গিয়েছে, তখন রাজার বাড়ির রাখাল তাকে দেখে বললে, ‘সে
কি রে ঘুঘু, তোর চোখ কি হল?’
ঘুঘু বললে, ‘তা যদি বলি, তবে কিন্তু তোমার হাতে তোমার লাঠিটা আটকে যাবে।’
রাখাল বললে, ‘যায় যাবে, তুই বল্।’
তখন ঘুঘু বললে-
উকুনে-বুড়ি
পুড়ে মোলো,
বক সাতদিন
উপোস রইল,
নদীর জল
ফেনিয়ে গেল,
হাতির লেজ
খসে পড়ল,
গাছের পাতা
ঝড়ে পড়ল,
ঘুঘুর
চোখ কানা হল।
অমনি চটাস করে রাখালের লাঠি তার হাতে আটকে গেল। সে কত হাত ঝাড়লে, কিছুতেই তাকে
ফেলতে পারলে না। যখন গোরু নিয়ে সে রাজার বাড়িতে ফিরে এসেছে, তখনো সে হাত ঝাড়ছে।
রাজার বাড়ির দাসী ভাঙা কুলোয় করে ছাই ফেলতে যাচ্ছিল। সে রাখালকে দেখে বললে, ‘দূর
হতভাগা! অমনি করে হাত ঝাড়ছিস কেন? কি হয়েছে তোর হাতে?’
রাখাল বললে, ‘সে কথা যদি বলি, তবে কিন্তু আর ঐ কুলোখানা
তোমার হাত থেকে নামাতে পারবে না, সেখানা তোমার হাতেই আটকে থাকবে।’
দাসী বললে, ‘ঈস! আচ্ছা থাকে থাকবে, তুই বর।’
তখন রাখাল বললে-
উকুনে-বুড়ি
পুড়ে মোলো,
বক সাতদিন
উপোস রইল,
নদীর জল
ফেনিয়ে গেল,
হাতির লেজ
খসে পড়ল,
গাছের পাতা
ঝড়ে পড়ল,
ঘুঘুর চোখ
কানা হল।
রাখালের
হাতে লাঠি আটকাল।
অমনি দাসী ‘ওমা! এ কি গো! কি হবে গো!’ বলে কাঁদতে লাগল। সে অনেক করেও কুলো হাত
থেকে নামাতে পারলে না।
শেষে রাখাল-ছোকরাকে গাল দিতে দিতে ঘরে গেল।
ঘরে গিয়ে দাসী হাত থেকে আর কুলো নামাচ্ছে না। রানী তখন থালা হাতে করে রাজার জন্যে
ভাত বাড়ছিলেন। দাসীকে দেখে তিনি হেসে বললেন, ‘দাসী, তোর হয়েছে কি? কুলোটা হাত
থেকে নামাচ্ছিস নে কেন?’
দাসী বললে, ‘তা যদি বলি রানীমা, তবে কিন্তু ঐ থালাখানা আর আপনার হাত থেকে নামাতে
পারবেন না, ওখানা আপনার হাতে আটকে যাবে।’
রানী বললেন, ‘বটে! আচ্ছা বল্, দেখি কেমন আটকায়।’
তখন দাসী বললে-
উকুনে-বুড়ি
পুড়ে মোলো,
বক সাতদিন
উপোস রইল,
নদীর জল
ফেনিয়ে গেল,
হাতির লেজ
খসে পড়ল,
গাছের পাতা
ঝড়ে পড়ল,
ঘুঘুর চোখ
কানা হল।
রাখালের
হাতে লাঠি আটকাল।
দাসীর হাতে
কুলো আটকাল।
অমনি রানীর হাতে থালাখানি আটকে গেল, কিছুতেই তিনি আর তা নামাতে পারলেন না। তখন আর
কি করেন? আর একখানা থালায় করে রাজামশাইয়ের জন্যে ভাত বেড়ে নিয়ে চললেন।
রাজামশাই তাঁকে দেখেই বললেন, ‘রানী, ঐ থালাখানা হাতে করে রেখেছ যে?’
রানী বললেন, ‘তা যদি বলি, তবে কিন্তু আর তুমি এখান থেকে উঠে যেতে পারবে না, তুমি ঐ
পিঁড়িতে আটকে থাকবে।’
শুনে রাজা হো-হো করে হাসলেন, তারপর বললেন, ‘আচ্ছা তাই হোক, তুমি বল।’
তখন রানী বললেন-
উকুনে-বুড়ি
পুড়ে মোলো,
বক সাতদিন
উপোস রইল,
নদীর জল
ফেনিয়ে গেল,
হাতির লেজ
খসে পড়ল,
গাছের পাতা
ঝড়ে পড়ল,
ঘুঘুর চোখ
কানা হল।
রাখালের
হাতে লাঠি আটকাল।
দাসীর হাতে
কুলো আটকাল।
রানীর হাতে
থালা আটকাল।
বলতে-বলতেই তো রাজামশাই পিঁড়িতে খুব ভালোমতোই আটকে গেলেন। কত টানাটানি করলেন,
কিছুতেই উঠতে পারলেন না। চাকরদের ডাকলেন, তারাও কিছু করতে পারল না। তখন সেই
পিঁড়িসুদ্ধ তাঁকে চারজনে ধরাধরি করে এনে সভায় বসিয়ে দিলে!
তা দেখে সভার লোকদের তো ভারি মুশকিলেই হল। তাদের ভয়ানক হাসি পাচ্ছে। তারা হাসি
থামাতে পারছে না, হাসতে পারছে না, পাছে রাজামশাই রাগ করেন। কেউ ভয়ে জিগগেস করতেও
পারছে না, রাজামশাইয়ের কি হয়েছে।
তখন রাজামশাই নিজেই বললেন, ‘তোমরা বুঝি জানতে চাচ্ছ, আমি পিঁড়িতে কি করে আটকে
গেলাম।’
তারা হাত জোড় করে বললে, ‘হ্যাঁ, মহারাজ।’
রাজা বললেন, ‘তা যদি বলি, তবে তোমরাও যে যার বসবার জায়গার আটকে যাবে।’
তারা বললে, ‘মহারাজ যদি আটকালেন, তবে আমরা আর বাকি থাকি কেন?
তখন রাজা বললেন-
উকুনে-বুড়ি
পুড়ে মোলো,
বক সাতদিন
উপোস রইল,
নদীর জল
ফেনিয়ে গেল,
হাতির লেজ
খসে পড়ল,
গাছের পাতা
ঝড়ে পড়ল,
ঘুঘুর চোখ
কানা হল।
রাখালের
হাতে লাঠি আটকাল।
দাসীর হাতে
কুলো আটকাল।
রানীর হাতে
থালা আটকাল।
পিঁড়িতে
রাজা আটকাল।’
বলতেই আর তারা যাবে কোথায়! এমনি করে তারা তক্তাপোশে আটকে গেল যে, আর তাদের উঠবার
সাধ্য নেই।
ভাগ্যিস সেই দেশে এক খুব বুদ্ধিমান নাপিত ছিল, নইলে মুশকিল হয়েছিল আর কি। নাপিত এসে
বললে, “শিগগির ছুতোয় ডাক।’
তখন ছুতোর এসে পিঁড়ি কেটে রাজামশাইকে ছাড়ালে, আর তক্তাপোশ কেটে সভার লোকদের
ছাড়ালে। একটু একটু কাঠ তবু সকলের গায়ে লেগে ছিল, সেটুকু চেঁচে তুলে দিলে।
রানীর হাতের থালা, দাসীর হাতের কুলো আর রাখালের হাতের লাঠিও ফেলে দেওয়া হল।
এক যে
ছিল পান্তাবুড়ি, সে পান্তাভাত খেতে বড্ড ভালোবাসত।
এক চোর এসে রোজ পান্তাবুড়ির পান্তাভাত খেয়ে যায়, তাই বুড়ি লাঠি ভর দিয়ে রাজার
কাছে নালিশ করতে চলল।
পান্তাবুড়ি পুকুর ধার দিয়ে যাচ্ছিল। একটা শিঙিমাছ তাকে দেখতে পেয়ে বললে,‘
পান্তাবুড়ি, কোথায় যাচ্ছ?’
পান্তাবুড়ি বললে, ‘চোরে আমার পান্তাভাত খেয়ে যায়, তাই রাজার কাছে নালিশ করতে
যাচ্ছি!’
শিঙিমাছ বললে, ‘ফিরে যাবার সময় আমাকে নিয়ে যেও, তোমার ভালো হবে।’
পান্তাবুড়ি বললে, ‘আচ্ছা।’
তারপর পান্তাবুড়ি বেলতলা দিয়ে যাচ্ছে। একটা বেল মাটিতে পড়ে ছিল, সে বললে,
‘পান্তাবুড়ি কোথায় যাচ্ছ?’
পান্তাবুড়ি বললে, ‘চোরে আমার পান্তাভাত খেয়ে যায়, তাই রাজার কাছে নালিশ করতে
যাচ্ছি।’
বেল বললে, ‘ফিরে যাবার সময় আমাকে নিয়ে যেও, তোমার ভালো হবে।’
পান্তাবুড়ি বললে, ‘আচ্ছা।’
তারপর পান্তাবুড়ি পথের ধারে খানিকটা গোবর দেখতে পেলে। গোবর বললে, ‘পান্তাবুড়ি,
কোথায় যাচ্ছ?’
পান্তাবুড়ি বললে, ‘চোরে আমার পান্তাভাত খেয়ে যায়, তাই রাজার কাছে নালিশ করতে
যাচ্ছি।’
গোবর বললে, ‘ফিরে যাবার সময় আমাকে নিয়ে যেও, তোমার ভালো হবে।’
পান্তাবুড়ি বললে ‘আচ্ছা।’
তারপর খানিক দূরে গিয়ে পান্তাবুড়ি দেখলে, পথের ধারে একখানা ক্ষুর পড়ে রয়েছে।
ক্ষুর বললে, ‘পান্তাবুড়ি, কোথায় যাচ্ছ?’
পান্তাবুড়ি বললে, ‘চোরে আমার পান্তাভাত খেয়ে যায়, তাই রাজার কাছে নালিশ করতে
যাচ্ছি।’
ক্ষুর বললে, ‘ফিরে যাবার সময় আমাকে সঙ্গে নিও। তোমার ভালো হবে।’
পান্তাবুড়ি বললে, ‘আচ্ছা।’
তারপর পান্তাবুড়ি রাজার বাড়ি গিয়ে দেখলে, রাজামশাই বাড়ি নেই। কাজেই সে আর নালিশ
করতে পেল না।
বাড়ি ফিরবার সময় তার ক্ষুর আর গোবর আর বেল আর শিঙিমাছের কথা মনে হল। সে তাদের
সকলকে তার থলেয় করে নিয়ে এল।
পান্তাবুড়ি যখন বাড়ির আঙিনায় এসেছে, তখন ক্ষুর তাকে বললে, ‘আমাকে ঘাসের উপর রেখে
দাও।’
তাই বুড়ি ক্ষুরখানাকে ঘাসের উপর রেখে দিল।
তারপর যখন সে ঘরে উঠতে যাচ্ছে, তখন গোবর বললে, ‘আমাকে পিঁড়ির উপর রেখে দাও।’
তাই বুড়ি গোবরটাকে পিঁড়ির উপর রেখে দিল।
বুড়ি যখন ঘরে ঢুকল, তখন বেল বললে, ‘আমাকে উনুনের ভিতরে রাখ।’ শুনে বুড়ি তাই করলে।
শেষে শিঙিমাছ বললে, ‘আমাকে তোমার পান্তাভাতের ভিতরে রাখ।’
বুড়ি তাই করল।
তারপর রাত হলে বুড়ি রান্না-খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে রইল।
ঢের রাত্রে চোর এসেছে। সে তোর আর জানে না, সেদিন বুড়ি কি ফন্দি করেছে। সে এসেই
পান্তাভাতের হাঁড়িতে হাত ঢুকিয়ে দিল। সেখানে ছিল শিঙিমাছ। সে চোর বাছাকে এমনি
কাঁটা ফুটিয়ে দিল যে তার দুই চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
শিঙিমাছের খোঁচা খেয়ে চোর কাঁদতে কাঁদতে উনুনের কাছে গেল। তার ভিতর ছিল বেল। চোর
যেই আঙুলের তাত দেবার জন্য উনুনে হাত ঢুকিয়েছে, অমনি পটাশ করে বেল ফেটে, তার
চোখেমুখে ভয়ানক লাগল।
তখন সে ব্যথা আর ভয়ে পাগলের মতো হয়ে যেই ঘর থেকে ছুটে বেরুবে, অমনি সেই গোবরে তার
পা পড়েছে। তাতে সে পা হড়কে ধপাস করে সেই গোবরের উপরেই বসে পড়ল।
তারপর গোবর লেগে ভূত হয়ে বেটা গিয়েছে ঘাসে পা মুছতে। সেইখানে ছিল ক্ষুর, তাতে
ভয়ানক কেটে গেল। তাতে আর ‘ও মা গো! বলে না চেঁচিয়ে বাছা যান কোথায়?
তা শুনে পাড়ার লোক ছুটে এসে বললে, ‘এই বেটা চোর! ধর বেটাকে! মার বেটাকে। কান
ছিঁড়ে ফেল!’
তখন যে চোরের সাজাটা!
কাক আর
চড়াইপাখিতে খুব ভাব ছিল।
গৃহস্থদের উঠানে চাটাই ফেলে ধান আর লঙ্কা রোদে দিয়েছে। চড়াই তা দেখে কাককে বললে,
‘বন্ধু, তুমি আগে লঙ্কা খেয়ে শেষ করতে পারবে, না আমি আগে ধান খেয়ে শেষ করতে পারব?’
কাক বললে, ‘না, আমি লঙ্কা আগে খাব।’
চড়াই বললে, ‘না, আমি ধান আগে খাব।’
কাক বললে, ‘যদি না খেতে পার, তবে কি হবে?’
চড়াই বললে, ‘যদি না খেতে পারি, তবে তুমি আমার বুক খুঁড়ে খাবে। আর যদি তুমি না খেতে
পার, তবে কি হবে?’
কাক বললে, ‘তুমি আমার বুক খুঁড়ে খাবে।’
এই বলে তো দুজনে ধান আর লঙ্কা খেতে লাগল। চড়াই কুট-কুট করে এক-একটি ধান খায়, আর
কাক খপ-খপ করে একটি-একটি লঙ্কা খায়। দেখতে-দেখতে কাক সব লঙ্কা খেয়ে শেষ করলে,
চড়াইয়ের তখন ধানের সিকিও খাওয়া হয়নি।
তখন কাক বললে, ‘কি বন্ধু, এখন?’
চড়াই বললে, ‘এখন আর কি হবে। বন্ধু হয়ে যদি আমার বুক খেতে চাও, তবে খাবে। তবে ঠোঁট
দুটো ধুয়ে নিও, তুমি নোংরা জিনিস খাও।’
কাক বললে, ‘আমি ঠোঁট ধুয়ে আসছি।’ বলে সে গঙ্গায় ঠোঁট ধুতে গেল।
তখন গঙ্গা তাকে বললেন, ‘তোর নোংরা ঠোঁট আমার গায়ে ছোঁয়াসনে। জল তুলে নিয়ে ঠোঁট
ধো।’
তাতে কাক বললে, ‘আচ্ছা, আমি ঘটি নিয়ে আসছি।’ বলে সে কুমোরের কাছে গিয়ে বললে-
কুমোর, কুমোর! দে তো ঘটি,
তুলব জল, ধোব ঠোঁট-
তবে খাব চড়াইর বুক।
কুমোর বললে, ‘ঘটি তো নেই। মাটি আন, গড়ে দি।’ শুনে কাক মোষের কাছে তার শিং চাইতে
গেল, সেই শিং দিয়ে মাটি খুঁড়বে। কাক বললে-
মোষ,
মোষ! দে তো শিং,
খুঁড়ব
মাটি, গড়বে ঘটি,
তুলব
জল, ধোব ঠোঁট-
তবে
খাব চড়াইর বুক।
শুনে মোষ রেগে তাকে এমনি গুঁতোতে এল যে সে সেখান থেকে দে ছুট! তারপর সে কুকুরের
কাছে গিয়ে বললে-
কুত্তা, কুত্তা! মারবি মোষ,
লব
শিং, কুঁড়ব মাটি, গড়বে ঘটি,
তুলব
জল, ধোব ঠোঁট-
তবে
খাব চড়াইর বুক।
কুকুর বললে, ‘আগে দুধ আন, খেয়ে গায়ে জোর করি, তবে মোষ মারব এখন।’ শুনে কাক গাইয়ের
কাছে গিয়ে বললে-
গাই,
গাই! দে তো দুধ,
খাবে
কুত্তা, হবে তাজা,
মারবে
মোষ, লব শিং,
কুঁড়ব
মাটি, গড়বে ঘটি,
তুলব
জল, ধোব ঠোঁট-
তবে
খাব চড়াইর বুক।
গাই বললে, ‘আগে ঘাস আন খাই, তারপর দুধ দেব।’
শুনে কাক মাঠের কাছে গিয়ে বললে-
মাঠ,
মাঠ! দে তো ঘাস,
খাবে
গাই, দেবে দুধ,
খাবে
কুত্তা, হবে তাজা
মারবে
মোষ, লব শিং,
খুঁড়ব
মাটি, গড়বে ঘটি,
তুলব
জল, ধোব ঠোঁট-
তবে খাব চড়াইব বুক।
মাঠ বললে, ‘ঘাস তো রয়েছে, নিয়ে যা না!’
তখন কাক কামারের বাড়ি গিয়ে বললে-
কামার, কামার! দে তো কাস্তে,
কাটব ঘাস, খাবে গাই,
দেবে দুধ, খাবে কুত্তা,
হবে তাজা, মারবে মোষ, লব শিং,
খুঁড়ব মাটি, গড়বে ঘটি,
তুলব জল, ধোব ঠোঁট-
তবে খাব চড়াইর বুক।
কামার বললে, ‘আগুন নেই। আগুন নিয়ে আয়, কাস্তে গড়ে দি।’ তা শুনে কাক গৃহস্থদের বাড়ি
গিয়ে বললে-
গেরস্ত ভাই, দাও তো আগুন,
গড়বে কাস্তে, কাটব ঘাস,
খাবে গাই, দেবে দুধ, খাবে কুত্তা,
হবে তাজা, মারবে মোষ, লব শিং,
খুঁড়ব মাটি, গড়বে ঘটি,
তুলব জল, ধোব ঠোঁট-
তবে খাব চড়াইব বুক।
তখন গৃহস্থ এক হাঁড়ি আগুন এনে বললে, ‘কিসে করে নিবি?’
বোকা কাক তার পাখা ছড়িয়ে বললে, ‘এই আমার পাখার উপরে ঢেলে দাও।’
গৃহস্থ সেই হাঁড়িসুদ্ধ আগুন কাকের পাখার উপর ঢেলে দিলে, আর সে বেটা তখুনি পুড়ে মরে
গেল। তার আর চড়াইর বুক খাওয়া হল না।
গৃহস্থের
ঘরের কোণে একটি হাঁড়ি ঝোলানো ছিল, তার ভিতরে
চড়াই-চড়নী থাকত।
একদিন চড়াই বললে, ‘চড়নী, আমি পিঠে খাব।’
চড়নী বললে, ‘পিঠের জিনিসপত্র এনে দাও, পিঠে গড়ে দেব এখন।’
চড়াই বললে, ‘কি জিনিস লাগবে?’
চড়নী বললে, ‘ময়দা লাগবে, গুড় লাগবে, কলা লাগবে, দুধ লাগবে, কাঠ লাগবে।’
চড়াই বললে, ‘আচ্ছা আমি সব এনে দিচ্ছি।’ বলে সে বনের ভিতর গিয়ে গাছের সরু-সরু শুকনো
ডাল মট-মট ভাঙতে লাগল।
সেই বনের ভিতর এক মস্ত বাঘ ছিল, সে চড়াইকে বলত, ‘বন্ধু’।
ডাল ভাঙার শব্দ শুনে সে বললে, ‘মট-মট করে ডাল ভাঙছ, ওকি আমার বন্ধু?’
চড়াই বললে, ‘হ্যাঁ, বন্ধু।’
বাঘ বললে, ‘ডাল দিয়ে কি হবে?’
চড়াই বললে, ‘কাঠ চাই, চড়নী পিঠে গড়বেন।’
শুনে বাঘ বললে, ‘বন্ধু, আমি কখখনো পিঠে খাইনি, আমাকে দিতে হবে।’
চড়াই বললে, ‘তবে জোগাড় সব এনে দাও।’
বাঘ বললে, ‘কি-কি জোগাড় চাই?’
চড়াই বললে, ‘ময়দা চাই, গুড় চাই, কলা চাই, দুধ চাই, ঘি চাই, হাঁড়ি চাই, কাঠ চাই।’
বাঘ বললে, ‘আচ্ছা তুমি ঘরে যাও, আমি সব এনে দিচ্ছি।’ চড়াই তখন ঘরে চলে এল, আর বাঘ
দুলতে দুলতে বাজারে চলল। বাজারে গিয়ে বাঘ খালি একটিবার বললে, ‘হাল্লুম!’ অমনি
দোকানীরা ‘বাবা গো! বাঘ এসেছে গো!’ পালা, পালা!’ বলে দোকান-টোকান সব ফেলে ছুটে
পালাল। তখন বাঘ সব দোকান খুঁজে ময়দা, গুড়, কলা, দুধ, ঘি, হাঁড়ি আর কাঠ নিয়ে
চড়াইয়ের বাড়িতে দিয়ে এল।
তারপর চড়নী চমৎকার পিঠে গড়ল, আর দুজনে মিলে পেট ভরে খেল। শেষে বাঘের জন্য একখানা
পাতায় করে কতকগুলি পিঠে মাটিতে রেখে দিয়ে, দুজনে চুপ করে হাঁড়ির ভিতর বসে রইল।
বাঘ এসে পিঠে দেখতে পেয়েই খেতে বসে গেল।
একখানা পিঠে মুখে সে বললে, ‘বাঃ! কি চমৎকার!’
আর একখানা মুখে দিয়ে বললে, ‘না, এটা তত ভালো নয়, খালি ময়দা দিয়ে গড়েছে!’
আর একখানা মুখে দিয়ে বললে, ‘ছি! এটাতে খালি ভুষি আর ছাই। চড়াইবন্ধু, এ কি খাওয়ালে!’
আর একখানা মুখে দিয়ে বললে, ‘উঃ হুঁ! এটাতে কিসে গন্ধু! গোবর দিয়েছে নাকি? চড়াই
বেটা তো বড় পাজী।’
এমন সময় হয়েছে কি? চড়াই হাঁড়ির ভিতর থেকে নাক-মুখ সিঁটকিয়ে বলছে, ‘চড়নী, আমি
হাঁচব।’
শুনে চড়নী ভারি ব্যস্ত হয়ে বললে, ‘চুপ, চুপ! এখন হাঁচতে হবে না, তাহলে বড় মুশকিল
হবে।’
তাতে চড়াই চুপ করল। কিন্তু খানিক বাদেই আবার ভয়ানক নাক-মুখ সিঁটকিয়ে হাঁচতে গেল।
চড়নী তাতে থামাতে কত চেষ্টা করল, কিছুতেই থামিয়ে রাখতে পারল না।
বাঘ একটা বিশ্রী পিঠে খেয়ে বললে, ‘থু! থু! এটা খালি গোবর দিয়েই গড়েছে, আর কিছু
দেয়নি! যদি চড়াইয়ের নাগাল পাই, তাকে কামড়িয়ে চিবিয়ে খাব।’
তারপর আর একাট পিঠে মুখে দিয়ে সে সবে ওয়াক্-ওয়াক্ করতে লেগেছে, অমনি হ্যাঁ-চ্ছোঃ
করে চড়াই ভয়ানক শব্দে হেঁচে ফেললে। সে শব্দে বাঘ সেই যেই চমকে লাফিয়ে উঠতে যাবে,
অমনি হাঁড়িসুদ্ধ দড়ি ছিঁড়ে, চড়াই আর চড়নী তার ঘাড়ে পড়ল।
বাঘ কিছুতেই বুঝতে পারলে না, কি বাজ বড়ল, না আকাশ ভেঙে পড়ল! সে খুব ভয় পেয়ে লেজ
গুটিয়ে সেখান থেকে ছুট দিল, আর তার ঘরে না গিয়ে থামল না।
রাজার
বাড়ির সিংহ-দরজার পাশে, লোহার খাঁচার একটা মস্ত বাঘ ছিল। রাজার বাড়ির সামনে দিয়ে
যত লোক যাওয়া-আসা করত, বাঘ হাত জোড় করে তাদের সকলকেই বলত, ‘একটিবার খাঁচার দরজাটা
খুলে দাও না দাদা!’ শুনে তারা বলত, ‘তা বইকি! দরজাটা খুলে দি, আর তুমি আমাদের ঘাড়
ভাঙো।’
এর মধ্যে রাজার বাড়িতে খুব নিমন্ত্রণের ধুম লেগেছে। বড়-বড় পণ্ডিত মশাইয়ের দলে-দলে
নিমন্ত্রণ খেতে আসছেন। তাঁদের মধ্যে একজন ঠাকুর দেখতে ভারি ভালোমানুষের মতো
ছিলেন।
বাঘ এই ঠাকুরমশাইকে বারবার প্রণাম করতে লাগল।
তা দেখে ঠাকুরমশাই বললেন, ‘আহা, বাঘটি তো বড় লক্ষ্মী! তুমি কি চাও বাপু।’
বাঘ হাত জোড় করে বললে, ‘আজ্ঞে, একটি বার যদি এই খাঁচার দরজাটা খুলে দেন! আপনার
দুটি পায়ে পড়ি।’
ঠাকুরমশাই কিনা বড্ড ভালোমানুষ ছিলেন, তাই তিনি বাঘের কথায় তাড়াতাড়ি খাঁচার দরজা
খুলে দিলেন।
তখন হতভাগা বাঘ হাসতে-হাসতে বাইরে এসেই বললে, ‘ঠাকুর, তোমাকে তো খাব!’
আর কেউ হলে হয়তো ছুটে পালাত। কিন্তু এই ঠাকুরটি ছুটতে জানতেন না। তিনি ভারি ব্যস্ত
হয়ে বললেন, ‘এমন কথা তো কখনো শুনিনি! আমি তোমার এত উপকার করলাম আর তুমি বলছ কিনা
আমাকে খাবে! এমন কাজ কি কেউ কখনো করে?’
বাঘ বললে, ‘করে বইকি ঠাকুর, সকলেই তো করে থাকে।’
ঠাকুরমশাই বললেন, ‘তা কখনোই নয়! চল দেখি তিনজন সাক্ষীকে জিগগেস করি, তারা কি বলে।’
বাঘ বললে, ‘আচ্ছা চলুন। আপনি যা বলছেন, সাক্ষীরা যদি তাই বলে, আমি আপনাকে ছেড়ে দিয়ে
চলে যাব। আর যদি তারা আমার কথা ঠিক, তবে আপনাকে ধরে খাব।’
সাক্ষী খুঁজতে দুজনে মাঠে গেলেন। দুই ক্ষেতের মাঝখানে খানিকটা মাটি উঁচু রেখে,
চাষীরা একটি ছোট পথের মতন করে দেয়, তাকে বলে আল। ঠাকুরমশাই সেই আল দেখিয়ে বললেন,
‘এই আমার একজন সাক্ষী।’
বাঘ বললে, ‘আচ্ছা, ওকে জিগগেস করুন, ও কি বলে।’
ঠাকুরমশাই তখন জিগগেস করলেন, ‘ওহে বাপু আল, তুমি বল দেখি, আমি যদি কারো ভালো করি,
সে কি উল্টে আমার মন্দ করে?’
আল বললে, ‘করে বইকি ঠাকুর। এই আমাকে দিয়ে দেখুন না। দুই চাষার ক্ষেতের মাঝখানে আমি
থাকি, তাতে তাদের কত উপকার হয়। একজনের জমি আর একজন নিয়ে যেতে পারে না, একজনের
ক্ষেতের জল আর একজনের ক্ষেতে চলে যায় না। আমি তাদের এত উপকার করি, তবু হতভাগারা
লাঙ্গল দিয়ে আমাকেই কেটে তাদের ক্ষেত বাড়িয়ে নেয়!’
বাঘ বললে, ‘শুনলেন, তো ঠাকুরমশাই, ভালো করলে তার মন্দ কেউ করে কি না!’
ঠাকুরমশাই বললেন, ‘রোসো, আমার তো আরো দুজন সাক্ষী আছে।’
বাঘ বললে, ‘আচ্ছা চলুন।’
মাঠের মাঝখানে একটা বটগাছ ছিল। ঠাকুরমশাই তাকে দেখিয়ে বললেন, ‘ঐ আমার আর একজন
সাক্ষী।’
বাঘ বললে, ‘আচ্ছা, ওকে জিগগেস করুন। দেখি, ও কি বলে।’
ঠাকুরমশাই বললেন, ‘বাপু বটগাছ, তোমার তো অনেক বয়েস হয়েছে, অনেক দেখেছ শুনেছ। বল
দেখি, উপকার যে করে, তার অপকার কি কেউ করে?’
বটগাছ বললে, ‘তাই তো লোক আগে করে। ঐ লোকগুলো আমার ছায়ায় বসে ঠাণ্ডা হয়েছে, আর
আমাকেই খুঁচিয়ে আমার আঠা বের করেছে। আবার সেই আঠা রাখবার জন্যে আমারই পাতা ছিঁড়ছে।
তারপর ঐ দেখুন, আমার ডালটা ভেঙে নিয়ে চলেছে।’
বাঘ বললে, ‘কি ঠাকুরমশাই, ও কি বলছে!’
তখন ঠাকুরমশাই তো মুশকিলে পড়লেন। আর কি বলবেন, ভেবে ঠিক করতে পারলেন না। এমন সময়
সেখান দিয়ে একটা শিয়াল যাচ্ছিল। ঠাকুরমশাই সেই শিয়ালকে দেখিয়ে বললেন, ‘ঐ আমার আর
একজন সাক্ষী। দেখি, ও কি বলে।’
তারপর তিনি শিয়ালকে ডেকে বললে, ‘শিয়ালপণ্ডিত, একটু দাঁড়াও। তুমি আমার সাক্ষী।’
শিয়াল দাঁড়াল, কিন্তু কাছে আসতে রাজী হল না। সে দূর থেকেই জিগগেস করল, ‘সে কি কথা!
আমি কি করে আপনার সাক্ষী হলুম?’
ঠাকুরমশাই বললেন, ‘বল দেখি বাপু, যে ভালো করে, তার মন্দ কি কেউ করে?’
শিয়াল বললে, ‘কার কি ভালো কে করেছিল, আর কার কি মন্দ কে করেছে, শুনলে তবে বলতে
পারি।’
ঠাকুরমশাই বললেন, ‘বাঘ খাঁচার ভিতরে ছিল, আর আমি ব্রাহ্মণ পথ দিয়ে যাচ্ছিলুম-’
এই কথা শুনেই শিয়াল বললে, ‘এটা বড় শক্ত কথা হল। সেই খাঁচা আর সেইপথ না দেখলে, আমি
কিছুই বলতে পারব না।’
কাজেই সকলকে আবার সেই খাঁচার কাছে আসতে হল। শিয়াল অনেকক্ষণ সেই খাঁচার চারধারে
পায়চারি করে বললে, ‘আচ্ছা, খাঁচা আর পথ বুঝতে পেরেছি। এখন কি হয়েছে বলুন।’
ঠাকুরমশাই বললেন, ‘বাঘ খাঁচার ভিতরে ছিল, আর আমি ব্রাহ্মণ পথ দিয়ে যাচ্ছিলুম।’
অমনি শিয়াল তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললে, ‘দাঁড়ান, অত তাড়াতাড়ি করবেন না, আগে ঐটুকু বেশ
করে বুঝে নিই। কি বললেন? বাঘ আপনার বামুন ছিল, আর পথটা খাঁচার ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল?’
এই কথা শুনে বাঘ হো-হো করে হেসে বললে, ‘দূর গাধা! বাঘ খাঁচার ভিতর ছিল, আর বামুন
পথ দিয়ে যাচ্ছিল!’
শিয়াল বললে, ‘রোসো দেখি-বামুন খাঁচার ভিতরে ছিল, আর বাঘ পথ দিয়ে যাচ্ছিল?’
বাঘ বললে, ‘আরে বোকা, তা নয়। বাঘ খাঁচার ভিতরে ছিল, বামুন পথ দিয়ে যাচ্ছিল?’
শিয়াল বললে, ‘এ তো ভারি গোলমালের কথা হল দেখেছি। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কি
বললে? বাঘ বামুনের ভিতরে ছিল, আর খাঁচা পথ দিয়ে যাচ্ছিল?’
বাঘ বললে, ‘এমন বোকা তো আর কোথাও দেখিনি! আরে বাঘ ছিল খাঁচার ভিতরে, আর বামুন
যাচ্ছিল পথ দিয়ে।’
তখন শিয়াল মাথা চুলকাতে-চুলকাতে বললে, ‘না! অত শক্ত কথা আমি বুঝতে পারব না!’
ততক্ষণে বাঘ রেগে গিয়েছে।
সে শিয়ালকে এক ধমক দিয়ে বললে, ‘ও কথা বুঝতেই হবে! দেখ্, আমি এই খাঁচার ভিতরে
ছিলুম-দেখ-এই এমনি করে-’
বলতে-বলতে বাঘ খাঁচার ভিতরে গিয়ে ঢুকল, আর শিয়ালও অমনি খাঁচার দরজা বন্ধ করে হুড়কো
এঁটে দিল। তারপর শিয়াল ঠাকুরমশাইকে বলল, ‘ঠাকুরমশাই, এখন আমি সব বুঝতে পেরেছি। আমার
সাক্ষ্য যদি শুনতে চান, তবে তা হচ্ছে যে, দুষ্ট লোকের উপকার করতে নেই। কাজেই বাঘ
মামার জিৎ। এখন আপনি শিগগির যান, এখনো ফলার ফুরোয়নি।’ বলে শিয়াল বনে চরতে গেল, আর
ঠাকুরমশাই ফলার খেতে গেলেন।
এক গরীর
ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁর ঘরে ব্রাহ্মণী ছিলেন, আর ছোট্র একটি মেয়ে ছিল, কিন্তু তাদের
খেতে দেবার জন্যে কিছু ছিল না। ব্রাহ্মণ অনেক কষ্টে ভিক্ষে করে যা আনতেন, এক বেলায়
ভালো করে না খেতেই তা ফুরিয়ে যেত। সকল দিন আবার তাও মিলত না!
একদিন তাঁদের ছোট্র মেয়েটি পাশের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। গিয়ে দেখল, সে বাড়িতে
পায়েস রান্না হয়েছে, ছেলেরা পায়েস খাচ্ছে। দেখে সেই মেয়েটিরও বড্ড পায়েস খেতে ইচ্ছে
হল। তাই সে বাড়ি এসে তার মাকে বললে, ‘মা, আমাকে পায়েস করে দাও না, আমি পায়েস খাব।’
শুনে তো তার মা কাঁদতে লাগলেন। ভাতই ভালো করে খেতে পান না, পায়েস আবার কি করে
করবেন?
এমন সময় ব্রাহ্মণ ভিক্ষে নিয়ে ফিরে এসে ব্রাহ্মণী কাঁদছেন দেখে জিগগেস করলেন,
‘কাঁদছ কেন ব্রাহ্মণী, কি হয়েছে, ব্রাহ্মণী বললেন, মেয়ে পায়েস খেতে চেয়েছে, পায়েস
কোথেকে দেব, তাই কাঁদছি। শুনে ব্রাহ্মণ বললেন, ‘আচ্ছা, আমি দেখছি এর একটা কিছু
করতে পারি কি না, তুমি কেঁদ না।’ বলে তিনি তখুনি আবার বেরিয়ে গেলেন।
সেই গ্রামে একজন খুব ভালো জমিদার ছিলেন।
তিনি যেই শুনলেন, ব্রাহ্মণের মেয়ে পায়েস খেতে চেয়েছে, অমনি তাঁকে চমৎকার গোপালভোগ
চাল, দু-সের দুধ, চিনি আর মসলা দিলেন।
ব্রাহ্মণ তাতে খুব খুশি হয়ে, জমিদারকে আশীর্বাদ করে, ছুটে এসে ব্রাহ্মণীকে বললেন,
‘এই নাও, তোমার পায়েসের জোগাড় এনেছি।’
সেই ব্রাহ্মণী কি লক্ষ্মী মেয়েই ছিলেন! তিনি এমনি সুন্দর রাঁধতেন যে, তেমন রান্না
কেউ কখনো খায়নি। তিনি পায়েস রাঁধতে লাগলেন, তখন তার চমৎকার গন্ধে আশেপাশে সকল লোক
পাগল হয়ে উঠল!
একটা কাক সেই পায়েসের গন্ধ পেয়ে বললে, ‘আহা! এমন চমৎকার জিনিস একটু না খেয়ে দেখলে
চলছে না।’
বলেই সে ব্রাহ্মণের ঘরের চালে বসল।
কাক অনেকক্ষণ ধরে ঘরের চালে চুপ করে বসে রইল। তারপর রান্নাঘরে একটু শব্দ হতেই সে
বললে, ‘ঐ! এবারে রান্না হয়েছে।’
খানিক বাদে আর একটু শব্দ হল, অমনি কাক বললে, ‘ঐ! এবারে বাড়ছে।’
খানিক বাদে আর একটু শব্দ হল, অমনি কাক বললে, ‘ঐ! এবার খাচ্ছে!’
সত্যি-সত্যি ব্রাহ্মণ আর তাঁর মেয়ে তখন খেতে বসেছিলেন। সে পায়েস এতই ভালো হয়েছিল
যে তাঁরা দুজনেই তা প্রায় শেষ করে ফেললেন। ব্রাহ্মণীর জন্যে খুব কম রইল। তারপর
ব্রাহ্মণীর খাওয়া যখন শেষ হল, তখন পাতে বা হাঁড়িতে পায়েসের একটু দাগ অবধি রইল না।
কাক এতক্ষণ বসে থেকেও যখন কিছু খেতে পেল না, তখন তার বড্ড রাগ হল। সে মনে মনে বললে,
‘আমাকে এমন করে ঠকালে! এর শোধ নিতেই হবে।’
ব্রাহ্মণের বাড়ির কাছে একটি প্রকাণ্ড বন ছিল, সেই বনে মস্ত একটা বাঘ থাকত।
কাক দুষ্ট ফন্দি এঁটে সেই বাঘকে গিয়ে বললে, ‘বাঘমশাই, আমাদের ব্রাহ্মণঠাকুরের একটি
সুন্দর মেয়ে আছে। আপনি এমন সুন্দর বর, আপনার সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে হলে বড় ভালো হয়।’
বাঘ বললে, ‘বিয়ে ঠিক করে দেবে কে? আমি কথা কইতে গেলে তো তারা ছুটে পালাবে।’
কাক বললে, ‘আপনার কিছু করতে হবে না, আমি সব করে দিচ্ছি। আগে আপনি ব্রাহ্মণকে কিছু
খাবার পাঠিয়ে দিন।’
বাঘ বললে, ‘বেশ কথা! আমি গ্রামে গিয়ে কুত্তা মেরে বামুনের বাড়ি রেখে আসব।’
কাক তা শুনে জিভ কেটে বললে, ‘না-না! তারা কুত্তা খাবে না! আপনার বাড়িতে যে লেবুর
গাছ আছে, সেই গাছের লেবু পাঠিয়ে দিন। আমি লেবু নিয়ে যাব এখন।’
বলে সে কয়েকটা লেবু নিয়ে ব্রাহ্মণের বাড়িতে দিয়ে এসে বললে, ‘বাঘমশাই, তারা তো লেবু
খেয়ে ভারি খুশি হয়েছে। এমনি করে দিন কতক লেবু দিলেই মেয়ে বিয়ে দেবে।’
শুনে বাঘ আহ্লাদে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল।
এমনি করে কাক রোজ লেবু নিয়ে যায় আর বাঘকে এসে বলে, ‘তারা মেয়ে বিয়ে দেবে।’
আসলে সেটা মিথ্যে কথা, কিন্তু বাঘ মনে করে, ব্রাহ্মণ বুঝি সত্যি-সত্যি মেয়ে দেবে
বলেছে।
তারপর একদিন বাঘ বললে, ‘কই, লেবু তো ফুরিয়ে গেল, মেয়ে তো বিয়ে দিলে না!’
কাক বললে, ‘দেবে বইকি! আপনি যখন চাইবেন, তক্ষুণি দেবে।’
বাঘ বললে, ‘তবে তাদের বল গিয়ে যে, যদি কাল রাত্রে মেয়ের বিয়ে না দেয়, তাহলে তাদের
সবাইকে চিবিয়ে খাব।’
কাক তো তাই চায়। সে তক্ষুণি ব্রাহ্মণের বাড়ি গিয়ে বরলে,
‘ওগো শুনছ। কাল রাত্রে বাঘ আসবে, তোমাদের মেয়ে বিয়ে করতে। যদি বিয়ে না দাও, সকলকে
চিবিয়ে খাবে।’
একথা শুনেই তো ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণী বুক চাপড়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
কান্না শুনে গ্রামের লোক ছুটে এসে বললে, ‘কি হয়েছে?’
ব্রাহ্মণ কাঁদতে-কাঁদতে বললেন, ‘কাল বাঘ আসবে, আমাদের মেয়েকে বিয়ে করতে। বিয়ে না
দিলে সকলকে চিবিয়ে খাবে।’
শুনে গ্রামের লোক বললে, ‘এই কথা! আচ্ছা, দেখা যাবে বেটা কেমন বিয়ে করে, আর না দিলে
চিবিয়ে খায়! আপনার কোনো ভয় নেই, আমরা সব ঠিক করে দিচ্ছি।’ বলে তারা বাঘের কাছে
খবর পাঠিয়ে দিলে, ‘বাঘমশাই, আপনার মতন এমন ভালো বর কি আর হবে! আপনি পোশাক পরে
আসবেন, সভার মাঝে বসবেন, গান বাজনা শুনবেন, নিমন্ত্রণ খাবেন, তারপর বেশ ভালো মতো
করে বিয়ে করে চলে যাবেন।’
তারপর তারা সকলে মিলে ব্রাহ্মণের উঠানে তিনশো উনুন কেটে তাতে তিনশো হাঁড়ি তেল
চড়াল। কুয়োর উপর চমৎকার বিছানা করে রাখল। তারপর ঢাক ঢোল বাজিয়ে খুব সোরগোল করতে
লাগল।
বাঘ সেই গোলমাল শুনে বললে, ‘ঐ রে আমার বিয়ের ধুম লেগেছে।’ তখন সে তাড়াতাড়ি
জামা-জোড় পরে, পাগড়ি এঁটে, নাচতে-নাচতে এসে ব্রাহ্মণের বাড়ি উপস্থিত হল।
অমনি সকলে, ‘আরে, বর এসেছে! বাজা, বাজা!’ বলে বাঘমশাইকে সেই কুয়োর উপরকার বিছানা
দেখিয়ে দিলে। বাঘমশাই তো তাতে লাফিয়ে বসতে গিয়েই ‘ঘেঁয়াও!’ করে বিছানাযুদ্ধ কুয়োর
পড়েছেন, আর তার সঙ্গে-সঙ্গে গ্রামের সকলে মিলে সেই তিনশো হাঁড়ির গরম তেল, আর
তিনশো উনুনের আগুন কুয়োয় এনে চলেছে।
তারপর দেখতে-দেখতে বোকা বাঘ পুড়ে ছাই হল, ব্রাহ্মণেরও আপদ কেটে গেল।
কাক তামাশা দেখবার জন্যে ঘরের চালে বসে ছিল, পাড়ার ছেলেরা ঢিল ছুঁড়ে তার মাথা
গুঁড়ো করে দিল।
এক জোলা ছিল” তার একটি বড় আদুরে ছেলে ছিল। সে যখন যা চাইত, সেটি না নিয়ে কিছুতেই
ছাড়ত না।
একদিন এক বড়মানুষের ছেলে জোলার বাড়ির সামনে দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিল। তাকে দেখে
জোলার বড় ছেলে তার বাপকে ডেকে বললে, ‘বাবা, আমার কেন ঘোড়া নেই? আমাকে ঘোড়া এনে
দাও।’
জোলা বললে, ‘আমি গরীব মানুষ, ঘোড়া কি করে আনব? ঘোড় কিনতে ঢের টাকা লাগে।’
ছেলে বললে, ‘তা হবে না। আমাকে ঘোড়া এনে দিতেই হবে।’
বলে, সেই ছেলে আগে নেচে-নেচে কাঁদল, তারপর গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদল, তারপর উঠে তার বাপের
হুঁকো কলকে ভেঙ্গে ফেলল। তাতেও ঘোড়া কিনে দিচ্ছে না দেখে, শেষে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে
দিল।
তখন জোলা ত ভারি মুশকিলে পড়ল। ছেলে কিছুতেই খাচ্ছে না দেখে সে ভাবল, ‘এখন তো
ঘোড়া কিনে না দিলেই হচ্ছে না। দেখি ঘরে কিছু টাকা আছে কি না।’
অনেক খুঁজে সে কয়েকটি টাকা বার করল। তারপর সেই টাকা কাপড়ে বেঁধে সে ঘোড়া কিনতে
হাটে চলল।
হাটে গিয়ে জোলা ঘোড়াওয়ালাকে জিগগেস করল, ‘হাঁ গা, তোমার ঘোড়ার দাম ক-টাকা?’
ঘোড়াওয়ালা বললে, ‘পঞ্চাশ টাকা।’
জোলা কাপড়ে বেঁধে মোটে পাঁচটি টাকা এনেছে, পঞ্চাশ টাকা সে কোথা থেকে দেবে? কাজেই
সে ঘোড়া কিনতে না পেরে মনের দুঃখে বাড়ি ফিরে চলল।
এমন সময় হয়েছে কি- দুজন লোক সেইখানে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে। তাদের একজন বললে, ‘তোমার
কিন্তু বড় মুশকিল হবে।’
তা শুনে একজন বললে, ‘ঘোড়ার ডিম হবে!’
ঘোড়ার কিনা ডিম হয় না, তাই ‘ঘোড়ার ডিম হবে’ বললে বুঝতে হয় যে, ‘কিচ্ছু হবে না,’
কিন্ত জোলা সে কথা জানত না। সে ঘোড়ার ডিমের নাম শুনেই ব্যস্ত হয়ে বললে, ‘ভাই,
ঘোড়ার ডিম কোথায় পাওয়া যায় বলতে পার?’
সেখানে একটা ভারি দুষ্টু লোক ছিল। সে জোলাকে বললে, ‘আমার সঙ্গে এস, আমার ঘরে
ঘোড়ার ডিম আছে।’
সে দুষ্টু লোকটার ঘরে ছিল একটা ফুটি। সে জোলাকে তার সঙ্গে বাড়ি নিয়ে, সেই ফুটিটা
তার হাতে দিয়ে বললে, ‘এই নাও ঘোড়ার ডিম। দেখ, কেমন ফেটে রয়েছে। এখুনি এর ভিতর থেকে
ছানা বেরুবে। দেখো ছুটে পালায় না যেন!’
তখন জোলার আনন্দ দেখে কে!
সে জিজ্ঞেস করলে, ‘এর দাম কত?’ দুষ্টু লোকটা বললে, ‘পাঁচ টাকা।’ জোলা তখুনি সেই
পাঁচটা টাকা খুলে দিয়ে ফুটি নিয়ে ঘরে চললে। ফুটি ফেটে রয়েছে, তার ভিতর লাল দেখা
যাচ্ছে। জোলা ভাবলে, ‘ঐ রে, ছানা যদি বেরিয়ে পালাতে চায়, তখুনি খপ করে ধরে ফেলব।
তারপর গলায় চাঁদর বেঁধে তাকে বাড়ি নিয়ে যাব। যদি লাফায়, তবু ছাড়ব না।’
এমনি নানা কথা ভাবতে-ভাবতে জোলা একটা নদীর ধারে এসে উপস্থিত হল, আর ঠিক তখুনি তার
ভয়ানক জল তেষ্টা পেল। জোলা ডাঙ্গার উপর ফুটিটা রেখে জল খেতে গিয়েছে, তার মধ্যে যে
কোথা থেকে এক শিয়াল সেখানে এসেছে, তা সে দেখতে পায়নি। তার জল খাওয়া হতে-হতে, শিয়াল
ফুটি প্রায় শেষ করে এনেছে। এমন সময় জোলা তাকে দেখতে পেয়ে, ‘হায় সর্বনাশ! আমার
ঘোড়ার ছানা পালাল।’ বলে তাড়া করলে!
শিয়ালকে ছুটে ধরা কি জোলার কাজ। শিয়াল তাকে মাঠের উপর দিয়ে, বনের ভিতর দিয়ে,
কোথায় নিয়ে গেল তার ঠিকানা নেই। শেষে জোলা আর চলতে পারে না। তখন ঘরে ফিরতে গিয়ে
দেখে, পথ হারিয়ে গেছে।
তখন রাত হয়েছে, কাজেই আর ঘরে ফিরবার জো ছিল না। জোলা অনেক খুঁজে এক বুড়ির বাড়িতে
গিয়ে, একটু শোবার জায়গা চেয়ে নিল। বুড়ির দুটি বই ঘর ছিল না। তার একটিতে বুড়ি আর
তার নাতনী থাকত। আর একটিতে জিনিসপত্র ছিল, সেইটিতে সে জোলাকে জায়গা দিলে।
একটা বাঘ রোজ রাত্রে বুড়ির ঘরের পিছনে এসে বসে থাকত। বুড়ি তা টের পেয়ে, রাত্রে
কখনো ঘরের বাইরে আসত না, তার নাতনীকেও আসতে দিত না। কিন্ত নাতনীটি জোলার কাছে তার
ঘোড়ার ডিমের কথা একটু শুনতে পেয়েছিল, তার কথা ভালো করে শুনবার জন্য সে আবার তার
কাছে যেতে চাইল। তখন বুড়ি তাকে বললে, ‘না-না, যাস্ নে! বাঘে-টাগে ধরে নেবে!’
‘বাঘে-টাগে’ এমনি করে লোকে বলে থাকে। টাগ বলে কোন জন্তু নেই। কিন্ত বাঘ তো আর সে
কথা জানে না, সে ঘরের পিছনে বসে টাগের কথা শুনে ভারি ভাবনায় পড়ে গেছে। সে ঠিক বুঝে
নিয়েছে যে, টাগ তার নিজের চেয়েও ঢের ভয়ানক একটা জানোয়ার বা রাক্ষস বা ভূত হবে। আর
তখন থেকে তার বেজায় ভয় হয়েছে, আর সে ভাবছে, টাগ যদি আসে, কোনখান দিয়ে সে পালাবে।
এমন সময় সেই জোলা ভোর হয়েছে কি না দেখবার জন্য বাইরে এসেছে। এসেই সে বাঘকে দেখতে
পেয়ে মনে করলে ‘ঐ রে! আমার ঘোড়ার ছানা বসে আছে!’
অমনি সে ছুটে গিয়ে, বাঘের নাকে মুখে গলায় কাপড় জড়িয়ে তড়াক করে তার পিঠে উঠে বসল!
বাঘ যে তখন কি ভয়ানক চমকে গেল কি বলব! সে ভাবল, ‘হায়-হায়! সর্বনাশ হয়েছে! নিশ্চয়
আমাকে টাগে ধরেছে! এই মনে করে বাঘ প্রাণের ভয়ে ছুটতে লাগল। কিন্ত চোখে কাপড় বাঁধা
ছিল বলে ভালো করে ছুটতে পারল না।
জোলা তো গোড়া থেকেই তার পিঠে চড়ে বসে আছে, আর ভাবছে এটা তার ঘোড়ার ছানা! সে ঠিক
করে রেখেছে যে একটু ফরসা হলেই পথ চিনতে পারবে, ঘোড়ার ছানাটিকে নিয়ে বাড়ি যাবে।
ফরসা যখন হল তখন জোলা দেখলে যে, কাজ তো হয়েছে! সে ঘোড়া মনে করে বাঘের উপর চড়ে
বসেছে! তখন আর সে কি করে? সে ভাবলে যে এবার আর রক্ষা নেই!
বাঘ ছুটছে আর বলছে, ‘দোহাই টাগদাদা! আমার ঘাড় থেকে নামো, আমি তোমায় পূজো করব।’
জোলা জানে না যে বাঘ তাকেই টাগ বলছে! জোলা খালি ভাবছে, সে কি করে পালাবে।
এমন সময় একটা বটগাছের তলা দিয়ে যাচ্ছিল। সেই গাছের ডালগুলি খুব নীচু, হাত বাড়ালেই
ধরা যায়! জোলা খপ করে তার একটা ডাল ধরে ঝুলে গাছে উঠে পড়ল।
তখন জোলাও বললে, ‘বড্ড বেঁচে গিয়েছি!’
বাঘও বললে, ‘বড্ড বেঁচে গিয়েছি!’
কিন্ত খালি গাছে উঠলে কি হবে? তা থেকে নামতে পারলে তো হয়। সে হতভাগা বাঘটা সেখান
থেকে ছুটে না পালিয়ে গাছতলায় বসে হাঁপাতে লাগল, আর চেঁচিয়ে অন্য বাঘদের ডাকতে লাগল।
ডাক শুনে চার-পাঁচটা বাঘ সেখানে এসে বললেম ‘কি হয়েছে তোমার? তোমার চোখ বাঁধলে
কে?’
বাঘ হাঁপাতে-হাঁপাতে বললে, ‘আরে ভাই, আজ আর একটু হলেই গিয়েছিলুম আর কি! আমাকে টাগে
ধরেছিল। অনেক হাত জোর করে পূজো দেব বলতে তবে ছেড়ে দিয়েছে। সেই বেটা আমার চোখ
বেঁধে রেখেছে, পূজো না দিলে আবার এসে ধরবে।’
এই কথা শুনে সব বাঘ মিলে, সেই গাছতলায় টাগের পূজো আরম্ভ করল। বড়-বড় মোষ আর হরিণ
নিয়ে দলে-দলে বাঘ আসতে লাগল। জোলা আর অত বাঘ কখনো দেখেনি। সে তো গাছে বসে কেঁপেই
অস্থির!
জোলা কাঁপছে আর গাছের পাতা নড়ছে। বাঘেরা তাতে ব্যস্ত হয়ে চেয়ে দেখল, পাতার আড়ালে
ছিল বলে জোলাকে চিনতে পারল না।
একজন বললে, ‘ভাই, গাছের ওপর ওটা কি?’
আর একজন বললে, দেখ ভাই, ‘ওটার কি মস্ত লেজ!’
লেজ তো নয়, জোলার কাপড় ঝুলছিল। পাতার জন্য ভালো করে দেখতে না পেয়ে বাঘেরা তাকেই
লেজ মনে করছে। সেই লেজ দেখে একটা বুড়ো বাঘ বললে, ‘ওটা একটা খুব ভয়ানক জানোয়ার
হবে, হয়তো বা টাগই হবে!’ এই কথা শুনেই তো সব বাঘ মিলে ‘ধরলে, ধরলে! পালা, পালা!’
বলে সেখান থেকে ছুটে পালাল। তখন জোলাও গাছ থেকে নেমে বাড়ি গেল।
জোলাকে দেখে তার ছেলে বললে, ‘কই বাবা, ঘোড়া কই?’
জোলা তার গালে ঠাস করে এক চড় মেরে বললে, ‘এই নে তোর ঘোড়া!’
তারপর থেকে সে-ছেলে আর ঘোড়ার কথা বলত না।
বাঘ কিনা মামা আর শিয়াল কিনা ভাগ্নে, তাই দুজনের মধ্যে বড্ড ভাব।
শিয়াল একদিন বাঘকে নিমন্ত্রণ করল, কিন্তু তার জন্যে খাবার কিছু তয়ের করল না! বাঘ যখন
খেতে এল, তখন তাকে বললে, ‘মামা, একটু বস। আর দু-চারজনকে নিমন্ত্রণ করেছি, তাদের
ডেকে নিয়ে আসি।’
এই বলে শিয়াল চলে গেল, আর সে রাত্রে ফিরল না। বাঘ সারারাত বসে থেকে, সকালবেলা
শিয়ালকে বকতে-বকতে বাড়ি চলে গেল।
তারপর একদিন বাঘ শিয়ালকে নিমন্ত্রণ করল। শিয়াল এলে তাকে খেতে দিল মস্ত-মস্ত
মোটা-মোটা হাড়। তার এক-একটা লোহার মত শক্ত। শিয়াল বেচারার চারটে দাঁত ভেঙ্গে
গেল, তবু সেই হাড়ের একটুও সে চিবিয়ে ভাঙ্গতে পারল না। বাঘ ঐরকম হাড় খেতেই খুব
ভালবাসে। সে মনের সুখে পেট ভরে হাড় চিবিয়ে খেলে, আর বললে, ‘কি ভাগ্নে, পেট ভরল
তো?’
শিয়াল হাসতে হাসতে বললে, ‘হ্যাঁ মামা, আমার বাড়িতে তোমার যেমন পেট ভরেছিল, তোমার
বাড়িতেও আমার তেমনি পেট ভরেছে।’ মনে-মনে কিন্ত তার ভয়ানক রাগ হল, আর সে বললে, ‘যদি
বাঘমামাকে জব্দ করতে পারি, তবে দেশে ফিরব, নইলে আর দেশে ফিরব না।’
এই মনে করে শিয়াল সে-দেশ ছেড়ে আর এক দেশে চলে গেল। সে নতুন দেশে অনেক আখের তে ছিল।
শিয়াল সেই আখের ক্ষেতে থাকত আর খুব করে আখ খেত। যা খেতে পারত না, ভেঙ্গে রেখে দিত।
চাষীরা বললে, ‘ভালো রে ভালো, এমন করে আমাদের আখ কোন দুষ্টু শিয়াল ভেঙ্গে রেখে
দেয়? বেটাকে এর সাজা দিতে হবে।’
বলে তারা ক্ষেতের পাশে এক খোঁয়ার তয়ের করল।
কাঠ দিয়ে ছোট্ট ঘরের মতন খোঁয়ার তয়ের করতে হয়। তার ভিতরে কোন জন্তু ঢুকলে তার
দরজা আপনি বন্ধ হয়ে যায়। তাতেই সে জন্তু খোঁয়াড়ের ভিতর আটকা পড়ে।
চাষীরা যখন খোঁয়াড় তয়ের করছে, শিয়াল তখন হাসছে আর বলছে ‘আমার জন্যে, না মামার
জন্যে? এমন সুন্দর ঘরে মামা থাকলেই ভালো হয়।’
তার পরদিনই সে বাঘকে গিয়ে বললে, ‘মামা, একটি বড় নিমন্ত্রণ তো এসেছে। রাজার ছেলের
বিয়ে, সেখানে আমি গান গাইব, আর তুমি বাজাবে। আর খাব যা, তার তো কথাই নেই! তারা
পালকি পাঠিয়েছে, যাবে মামা?’
বাঘ বললে, ‘তা আর যাব না! এমন নিমন্ত্রণটা কি ছাড়তে আছে! আবার তারা পালকিও
পাঠিয়েছে!’
শিয়াল বললে, ‘সে কি যে-সে পালকি? এমন পালকিতে আর চড়নি মামা।’ এমনি কথাবার্তা বলে
দুজনে সেই আখের ক্ষেতের ধারে এল, যেখানে সেই খোঁয়াড় রয়েছে। খোঁয়াড় দেখে বাঘ বললে,
‘খালি পালকি পাঠিয়েছে, বেয়ারা পাঠায়নি যে?’
শিয়াল বললে, ‘আমরা উঠে বসলেই বেয়ারা আসবে এখন।’
বাঘ বললে, ‘পালকির যে ডাণ্ডা নেই, বেয়ারারা কি করে বইবে?’
শিয়াল বললে, ‘ডাণ্ডা তারা সঙ্গে আনবে।’
একথা শুনে বাঘ যেই খোঁয়াড়ের ভিতর ঢুকেছে, অমনি ধরাস করে তার দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
তখন শিয়াল বললে, ‘মামা, দরজাটা বন্ধ করে দিলে আমি ঢুকব কি করে?’
বাঘ বললে, ‘তোমার ঢুকে কাজ নেই এবারের নিমন্ত্রণটা আমিই খাইগে।’
শিয়াল বললে, ‘বেশ কথা মামা! খুব ভালো করে পেট ভরে নিমন্ত্রণ খেও। কম খেও না যেন!’
এই বলে শিয়াল হাসতে-হাসতে তার দেশে চলে গেল।
তারপর চাষীরা এসে দেখল যে বাঘমশাই খোঁয়াড়ের ভিতর বসে আছেন। তখন তারা কি খুশি যে
হল, কি বলব!
তারা সকলকে ডেকে বললে, ‘আন খন্তা, আন বল্লম, আন যে যা পারিস! খোঁয়াড়ে বাঘ পড়েছে। আয়
তোরা কে কোথায় আছিস।’
অমনি সকলে ছুটে এসে বাঘকে মেরে শেষ করল।
এক যে ছিল বুড়ো চাষী, তার নাম ছিল বুদ্ধুর বাপ।
বুদ্ধুর বাপের ক্ষেতে ধান পেকেছে, আর দলে দলে বাবুই এসে
সেই ধান খেয়ে ফেলছে। বুদ্ধুর বাপ ঠকঠকি বানিয়ে তাই দিয়ে বাবুই তাড়াতে যায়। কিন্তু
ঠকঠকির শব্দ শুনেও বাবুই পালায় না। তখন সে রেগেমেগে বললে, ‘বেটারা! এবার যদি ধরতে
পারি, তাহলে
ইঁড়ি-মিড়ি-কিঁড়ি-বাঁধন দেখিয়ে দেব!’
ইঁড়ি-মিড়ি-কিঁড়ি-বাঁধন বলে কোনা-একটা জিনিস নেই। বুদ্ধুর বাপ আর কোন ভয়ানক গলা
খুঁজে না পেয়ে ঐ কথা বলে। রোজই বাবুই আসে, রোজই বুদ্ধুর বাপ তাদের তাড়াতে না পেরে
বলে ইঁড়ি-মিড়ি-কিঁড়ি-বাঁধন দেখিয়ে দেব।’
এর মধ্যে একদিন হয়েছে কি-একটা মস্ত বাঘ রাত্রে এসে বুদ্ধুর
বাপের ক্ষেতের ভিতর ঘুমিয়ে ছিল, ঘুমের ভিতর কখন সকাল হয়ে গেছে, আর সে বাঘ সেখান
থেকে যেতে পারেনি।
সেদিনও বুদ্ধুর বাপ বাবুই তাড়াতে এসে, ঠকঠকি নাড়ছে আর বলছে, ‘বেটারা যদি ধরতে পারি
তবে ইঁড়ি-মিড়ি-কিঁড়ি-বাঁধন দেখিয়ে দেব!’
‘ইঁড়ি-মিড়ি-কিঁড়ি-বাঁধন’ শুনেই তো বাঘের বেজায় ভাবনা হয়েছে। সে ভাবলে ‘তাই তো! এটা আবার কি নতুন রকমের জিনিস হল? এমন বাধনের কথা তো জীবনে
শুনিনি!’ যতই ভাবছে, ততই তার মনে হচ্ছে যে, এটা না দেখলেই নয়। তাই সে আস্তে-আস্তে
ধানের ক্ষেতের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে, বুদ্ধুর বাপকে ডেকে বললে, ‘ভাই একটা কথা আছে।’
বাঘ দেখে বুদ্ধুর বাপ যে কি ভয় পেল, তা কি বলব! কিন্ত সে ভারী বুদ্ধিমান লোক ছিল।
সে তখুনি সামলে গেল, বাঘ কিছু টের পেল না। বুদ্ধুর বাপ বাঘকে বললে, ‘কি কথা ভাই?’
বাঘ বললে, ‘ঐ যে তুমি কি বলছ, ‘ইঁড়ি-মিড়ি-কিঁড়ি-বাঁধন না কি! সেইটে আমাকে একটিবার
দেখাতে হচ্ছে।’
বুদ্ধুর বাপ বললে, ‘সে তো ভাই, অমনি দেখানো যায় না! তাতে ঢের জিনিসপত্র লাগে।’
বাঘ বললে, ‘আমি সব জিনিস এনে দিচ্ছি। আমাকে সেটা না দেখালে হবে না।’
বুদ্ধুর বাপ বললে, ‘আচ্ছা, তুমি আগে জিনিস আনো, তারপর আমি দেখাব।’
বাঘ বললে, ‘কি জিনিস চাই?’
বুদ্ধুর বাপ বললে, ‘একটা খুব বড় আর মজবুত থলে চাই, এক গাছি খুব মোটা আর লম্বা দড়ি
চাই, আর একটা মস্ত বড় মুগুর চাই!’
বাঘ বললে , ‘শুধু এই চাই? এসব আনতে আর কতক্ষণ?’
সেটা হাটের দিন ছিল। বাঘ গিয়ে হাটের পথের পাশে ঝোপের ভিতর লুকিয়ে রইল। খানিক বাদেই
সেই পথ দিয়ে তিনজন খইওয়ালা যাচ্ছে। খইওয়ালাদের থলেগুলি খুব বড় হয়, আর তার এক-একটা
ভারি মজবুত থাকে।
বাঘ ঝোপের ভিতর বসে আছে, আর খইওয়ালারা একটু একটু করে তার সামনে এসেছে, অমনি সে
‘হালুম’ বলে লাফিয়ে এসে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়াল। খইওয়ালারা তো খই-টই ফেলে, চেঁচিয়ে
কোথায় পালাবে তার ঠিক নেই।
তখন বাঘ তাদের খইসুদ্ধ থলেগুলি এনে বুদ্ধুর বাপকে দিল। তারপর সে গেল দড়ি আনতে।
দড়ির জন্য তার আর বেশী দূর যেতে হল না। মাঠে ঢের গরু খোঁটায় বাঁধা ছিল, বাঘ তাদের
কাছে যেতেই তারা দড়ি ছিঁড়ে পালাল। সেই সব দড়ি এনে সে বুদ্ধুর বাপকে দিল। তারপর সে
গেল মুগুর আনতে।
পালোয়ানেরা তাদের আড্ডায় মুগুর ভাঁজছে, এমন সময় বাঘ গিয়ে সেখানে উপস্থিত হল। তাতেই
তো ‘বাপ রে, মা রে!’ বলে তারা ছুট দিল। তখন বাঘ তাদের বড় মুগুরটা মুখে করে এনে
বুদ্ধুর বাপকে বললে, ‘তোমার জিনিস তো এনেছি, এখন সেটাকে দেখাও।’
বুদ্ধুর বাপ বললে, ‘আচ্ছা, তবে তুমি একটিবার এই থলের ভিতরে এস দেখি।’
বলতেই তো বাঘমশাই গিয়ে সেই থলির ভিতরে ঢুকেছেন। তখন বুদ্ধুর বাপ তাড়াতাড়ি থলের মুখ
বন্ধ করে, তাকে আচ্ছা করে দড়ি দিয়ে জড়াল। একটু নড়বার জো অবদি রাখল না।
তারপর দু-হাতে সেই মুগুর তুলে ধাঁই করে সেই থলের উপর যেই এক গা লাগিয়েছে, অমনি বাঘ
ভারি আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘ও কি করছ?’
বুদ্ধুর বাপ বললে, ‘কেন? ‘ইঁড়ি-মিড়ি-কিঁড়ি-বাঁধন দেখাচ্ছি। তোমার ভয় হয়েছে নাকি?’
ভয় হয়েছে বললে তো ভারী লজ্জার কথা হয়, তাই বাঘ বললে ‘না।’
তখন বুদ্ধুর বাপ সেই মুগুর দিয়ে ধাঁই ধাঁই করে থলের উপর মারতে লাগল। চ্যাঁচালে পাছে
নিন্দে হয়, তাই মার খেয়েও বাঘ অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল। কিন্ত চুপ করে আর কতক্ষণ
থাকবে! দশ-বারো ঘা খেয়েই সে ‘ঘেয়াও ঘেঁয়াও করে ভয়ানক চ্যাঁচালে লাগল। খানিক বাদে
আর চ্যাঁচাতে না পেরে, গোঙাতে আরম্ভ করল। বুদ্ধুর বাপ তবুও ছাড়ছে না , ধাঁই-ধাঁই
করে সে খালি মারছেই। শেষে আর বাঘের সাড়া শব্দ নেই দেখে সে ভাবলে, মরে গেছে। তখন থলে
খুলে, বাঘটাকে ক্ষেতের ধারে ফেলে রেখে বুদ্ধুর বাপ ঘরে এসে বসে রইল।
বাঘ কিন্ত মরেনি। চার-পাঁচ ঘন্টা মরার মত পড়ে থেকে, তারপর সে উঠে বসেছে। তখনো তার
গায় বড্ড বেদনা, আর জ্বর খুব। কিন্ত রাগের চোটে সেসবে মন দিল না। সে খালি চোখে
ঘোরায় আর দাঁত খিঁচায়, আর বলে ‘বেটা বুদ্ধুর বাপ। পাজি, হতভাগা, লক্ষ্মীছাড়া!
দাঁড়া, তোকে দেখাচ্ছি।’
সেই কথা শুনেই তো ভয়ে বুদ্ধুর বাপের মুখ শুকিয়ে গেল। সে তখুনি ঘরে দোর দিয়ে
হুড়কো এঁটে বসে রইল। তিনদিন আর ঘর থেকে বেরুল না।
বাঘ সেই তিনদিন বুদ্ধুর বাপের ঘরের চারধারে ঘুরে বেড়াল, আর তাকে গালি দিল। তারপর
করেছে কি-দরজার খুব কাছে এসে খুব ভালমানুষের মতন করে বলছে, “আমাকে একটু আগুন দেবে
দাদা? তামাক খাব!’
বুদ্ধুর বাপ দেখলে, কথাগুলি মানুষের মতো, কিন্ত গলার আওয়াজটা বাঘের মতো। তখন সে
ভাবলে, আগুন দেবার আগে একবার ভালো করে দেখে নিতে হবে। এই ভেবে সে যেই দরজার ফাঁক
দিয়ে উঁকি মেরেছে, অমনি দেখে, সর্বনাশ-বাঘ! তখন আর কি সে দরজা খোলে! সে কোঁকাতে
কোঁকাতে বললে, ‘ভাই বড্ড জ্বর হয়েছে, দোর খুলতে পারবো না। তুমি দরজার নীচ দিয়ে
তোমার লাঠিগাছটা ঢুকিয়ে দাও, আমি তাতে আগুন বেঁধে দিচ্ছি।’
বাঘ লাঠি কোথায় পাবে? সে তার লেজটা দরজার নীচ দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। অমনি বুদ্ধুর বাপ
বঁটি দিয়ে খ্যাঁচ করে সেই লেজ কেটে ফেললে।
বাঘ তখন ‘ঘেঁয়াও’ বলে বুদ্ধুর বাপের চালের সমান উঁচু লাফ দিল। তারপর একটুখানি লেজ
যা ছিল, তাই গুটিয়ে চ্যাঁচাতে-চ্যাঁচাতে ছুটে পালাল।
তাতে কিন্ত বুদ্ধুর বাপের ভয় গেল না। সে বেশ বুঝতে পারল যে, এর পর সব বাঘ মিলে তাকে
মারতে আসবে। সত্যি-সত্যি সে তার পরদিন দেখলে, কুড়ি-পঁচিশটা বাঘ তার ঘরের দিকে আসছে।
তখন সে আর কি করবে! ঘরের পিছনে খুব উঁচু একটা তেতুল গাছ ছিল, তার আগায় গিয়ে বসে
রইল।
সেইখানে একটা হাঁড়ি বাঁধা ছিল। বুদ্ধুর বাপ তার পিছনে লুকিয়ে দেখতে লাগল, বাঘেরা কি
করে।
বাঘেরা এসেই সেই হাঁড়ির আড়ালে বুদ্ধুর বাপকে দেখতে পেয়েছে। তখন তারা তাকে গাল দেয়,
ভেঙচায় আর কত রকম ভয় দেখায়! বুদ্ধুর বাপ চুপটি করে হাঁড়ি ধরে বসে আছে, কিচ্ছু বলে
না।
তারপর বাঘেরা মিলে বুদ্ধুর বাপকে ধরবার এক ফন্দি ঠিক করলে। তাদের মধ্যে যার খুব
বুদ্ধি ছিল, সে বললে, ‘আমাদের মধ্যে যে সকলের বড়, সে মাটিতে গুঁড়ি মেরে বসবে। তার
চেয়ে যে ছোট, সে তার ঘাড়ে উঠবে। তার চেয়ে যে ছোট, সে আবার তার ঘাড়ে উঠবে। এমনি
করে উঁচু হয়ে, আমরা ঐ হতভাগাকে ধরে খাব।’
তাদের মধ্যে সকলের বড় ছিল সেই ঠেঙাখেকো লেজকাটা বাঘটা। তার লেজের ঘা তখনো
শুকোয়নি বলে সে বসতে পারত না, বসতে গেলেই তার বড্ড লাগত। কিন্ত না বসলেও তো চলবে
না, যেমন করেই হোক বসতে হবে। এমন সময় একটি গর্ত দেখতে পেয়ে, সে সেই গর্তের ভিতরে
লেজটুকু ঢুকিয়ে, কোনো মতে বসল। তারপর অন্য বাঘেরা এক-একজন করে তার পিঠে উঠতে
লাগল।
এমনি করে, বাঘের পিঠে বাঘ উঠে দেখতে-দেখতে তারা প্রায় বুদ্ধুর বাপের সমান উঁচু হয়ে
গেল। আর একটু উঁচু হলেই তাকে ধরে ফেলবে!
বুদ্ধুর বাপ বলছে, ‘যা হয় হবে, একবার শেষ এক ঘা মেরেই নি!’ এই বলে সে হাঁড়িটি খুলে
হাতে নিয়ে বসেছে- সেই হাঁড়ি সকলের উপরকার বাঘটার মাথায় ভাঙবে।
এমন সময় ভারি একটা মজা হয়েছে। যে গর্তে সেই লেজকাটা বাঘ তার লেজ ঢুকিয়েছিল, সেই
গর্তটা ছিল কাঁকড়ার। কাঁকড়া কাটা লেজের গন্ধ পেয়ে, আস্তে-আস্তে এসে তার দুই দাঁড়া
দিয়ে তাতে চিমটি লাগিয়েছে। চিমটি খেয়ে বেঁড়ে বাঘ বললে, ‘উঃ হুঃ! ঘেঁয়াও! হাল্লুম!
আরে উপরেও বুদ্ধুর বাপ, নীচেও বুদ্ধুর বাপ।’ বলতে বলতেই তো সে লাফিয়ে উঠল আর তার
পিঠের বাঘগুলি জড়াজড়ি করে ধুপধাপ শব্দে মাটিতে পড়ে গেল। ঠিক সেই সময়ে বুদ্ধুর বাপও
লেজকাটা বাঘের পিঠে হাঁড়ি আছড়ে বললে, ‘ধর্ ধর্ বেঁড়ে বেটার ঘাড়ে ধর্ !’
এর পর কি আর বাঘের দল সেখানে দাঁড়ায়? তারা লেজ গুটিয়ে, কান খাড়া করে, যে যেখান দিয়ে
পারল ছুটে পালাল। আর কোনদিন তারা বুদ্ধুর বাপের বাড়ির কাছেও এল না।
এক রাজার বাড়ির কাছে এক শিয়াল থাকত। রাজার ছাগলের ঘরের পিছনে তার গর্ত ছিল। রাজার
ছাগলগুলি খুব সুন্দর আর মোটা-সোটা ছিল।
তাদের দেখলেই শিয়ালের ভারি খেতে ইচ্ছে হত। কিন্ত রাজার রাখালগুলির ভয়ে তাদের কাছে
আসতে পারত না।
তখন শিয়াল তার গর্তের ভিতর থেকে খুঁড়তে আরম্ভ করল। খুঁড়ে-খুঁড়ে সে তো ছাগলের ঘরে
এসে উপস্থিত হল, কিন্ত তবু ছাগল খেতে পেল না।
রাখালের দল তখন সেখানে বসেছিল। তারা শিয়ালকে দেখতে পেয়েই ধরে বেঁধে ফেলল। তারপর
তাকে খোঁটায় বেঁধে রেখে তারা চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল, ‘কাল এটাকে নিয়ে সকলকে
তামাশা দেখাব, তারপর মারব। আজ রাত হয়ে গেছে।’
রাখালেরা চলে গেছে, শিয়াল মাথা হেঁট করে বসে আছে, এমন সময় এক বাঘ সেইখান দিয়ে
যাচ্ছে। শিয়ালকে দেখে বাঘ ভারি আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘কি ভাগ্নে, এখানে বসে কি করছ?’
শিয়াল বললে, ‘বিয়ে করছি।’
বাঘ বললে, ‘তবে কনে কোথায়? লোকজন কোথায়?’
শিয়াল বললে, কনে তো রাজার মেয়ে! লোকজন তাকে আনতে গেছে।’
বাঘ বললে, তুমি বাঁধা কেন?’
শিয়াল বললে, আমি কিনা বিয়ে করতে চাইনি, তাই আমাকে বেঁধে রেখে চলে গেছে, পাছে আমি
পালাই।’
বাঘ বললে, ‘সত্যি নাকি। তুমি বিয়ে করতে চাচ্ছ না?’
শিয়াল বললে, ‘সত্যি মামা। আমার বিয়ে করতে একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না।’
তা শুনে বাঘ ভারি ব্যস্ত হয়ে বললে, ‘তবে তোমার জায়গায় আমাকে বেঁধে রেখে তুমি চলে
যাও না।’
শিয়াল বললে, ‘এক্ষুণি। তুমি আমার বাঁধন খুলে দাও, তারপর আমি তোমাকে বেঁধে রেখে
যাচ্ছি।’
তখন বাঘের আনন্দ আর দেখে কে। সে অমনি এসে শিয়ালের বাঁধন খুলে দিল। শিয়ালও আর দেরি
না করে, তাকে ভালো মতো খোঁটায় বেঁধে বললে, ‘এক কথা, মামা। তোমার শালারা এসে
তোমার সঙ্গে হাসি-তামাশা করবে। তাতে তুমি চটো না যেন?’
বাঘ বললে, ‘আরে না। আমি তাতে চটি? আমি বুঝি এতই বোকা।’ এ কথায় শিয়াল হাসতে-হাসতে
চলে গেল। বাঘ ভাবতে লাগল, কখন কনে নিয়ে আসবে।
সকাল বেলায় রাখালের দল এসে উপস্থিত হল। বাঘ তাদের দেখে ভাবল, ‘ঐ আমার শালারা এসেছে।
এক্ষুণি হয়তো ঠাট্টা করবে। আর তাহলে আমাকেও খুব হাসতে হবে।’
রাখালেরা এসেছিল শিয়াল মারতে। এসে দেখলে, বাঘ বসে আছে। অমনি তো ভারি একটা হৈ-চৈ
পড়ে গেল। কেউ-কেউ পালাতে চায়, কেউ-কেউ তাদের থামিয়ে বললে, ‘আরে, বাঁধা রয়েছে দেখছিস
না? ভয় কি? কুড়ুল, খন্তা, বল্লম নিয়ে আয়।’
তখন একজন একটা মস্ত ইট এনে বাঘের গায়ে ছুঁড়ে মারল।
তাতে বাঘ বললে, ‘হীঃ, হীঃ, হিহি, হিহি।’
আর একজন একটা বাঁশ দিয়ে গুঁতো মারলে।’
তাতে বাঘ বললে, ‘হীঃ, হীঃ, হিহি, হিহি।’
আর একজন একটা বল্লম দিয়ে খোঁচা মারলে।
তাতে বাঘ বললে, ‘উঃ হূ, হুঃ। হোহো হোহো হোহো।-বুঝেছি তোমরা আমার শালা।’
আবার তারা বল্লমের খোঁচা মারলে।
তাতে বাঘ বেজায় রেগে বললে, ‘দুত্তোর! এমন ছাই বিয়ে আমি করব না।’ বলে সে দড়ি ছিঁড়ে
বনে চলে গেল।
বনের ভিতরে এক জায়গায় করাতীরা করাত দিয়ে কাঠ চিরত। একটা মস্ত কাঠ আধখানা চিরে রেখে,
সেইখানে গোঁজ মেরে করাতীরা চলে গিয়েছে। একই সময় বাঘ বনের ভিতর এসে দেখে, শিয়াল সেই
আধচেরা কাঠখানার উপর বিশ্রাম করছে।
শিয়াল তাকে দেখেই বললে, ‘কি মামা, বিয়ে কেমন হল?’
বাঘ বললে, ‘না ভাগ্নে, ওরা বড্ড বেশী ঠাট্রা করে। তাই আমি চলে এসেছি।’
শিয়াল বললে, ‘তা বেশ করেছ। এখন এস, দুজনে বসে গল্প-সল্প করি।’
বলতেই বাঘ লাফিয়ে কাঠের উপর উঠেছে, আর বসেছে ঠিক যেখানটায় কাঠটা খুব হাঁ করে আছে,
সেইখানে। তার লেজটা সেই ফাঁকের ভিতরে ঢুকে ঝুলে রয়েছে।
শিয়াল দেখলে যে, এবার কাঠ থেকে গোঁজটি খুলে নিলেই বেশ তামাশা হবে। সে বাঘকে নানান
ভাষায় ভোলাচ্ছে, আর একটু-আধটু করে গোঁজটিকে নাড়ছে। নাড়তে-নাড়তে এমন করছে যে, এখন
টানলেই সেটা খুলে যাবে, আর কাঠ বাঘের লেজ কামড়ে ধরবে। তখন সে ‘মামা, গেলুম!’ বলে
সেই গোঁজসুদ্ধ মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিতে লাগল।
আর বাঘের যে কি হল, সে আর বলে কি হবে? কাঠ লেজ কামড়ে ধরতেই তো সে বেজায় চেঁচিয়ে এক
লাফ দিল। সেই লাফে ফটাং করে লেজ ছিঁড়ে একেবারে দুইখান। তখন বাঘও শিয়ালের সঙ্গে
মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল।
বাঘ বললে, ‘ভাগ্নে গেলুম! আমার লেজ ছিঁড়ে গিয়েছে।’
শিয়াল বললে, ‘মামা গেলুম! আমার কোমড় ভেঙ্গে গিয়েছে!’
এমনি করে দুজনে গড়াগড়ি দিয়ে এক কচুবনে ঢুকে শুয়ে রইল। বাঘ আর নড়তে-চড়তে পারে না।
কিন্ত শিয়াল বেটার কিচ্ছু হয় নি, সে আগাগোড়াই বাঘকে ফাঁকি দিচ্ছে।
সেই কচুবনের ভিতর ঢের ব্যাঙ ছিল, শিয়াল শুয়ে শুয়ে তাই ধরে পেট ভরে খেল। বাঘ বেদনায়
অস্থির, সে ব্যাঙ দেখতেই পেল না-খাবে কি! কিন্তু তার এমনি খিদে পেয়েছে যে, কিছু না
খেলে সে মরেই যাবে! তখন সে শিয়ালকে জিগগেস করলে, ‘ভাগ্নে, তুমি কিছু খেয়েছ নাকি?’
শিয়াল বললে, ‘আর কি খাব? একটু কচুই খেয়েছি। খেয়ে আমার পেট বড্ড ফেপেছে।’
বাঘ আর কি করে। সে কচুই চিবিয়ে খেতে লাগল। তারপর গলা ফুলে, মুখ ফুলে, সে যায় আর কি!
তা দেখে শিয়াল বললে, ‘কি মামা, কিছু খেলে?’
বাঘ বললে, ‘খেয়েছি তো ভাগ্নে, কিন্ত বড্ড গলা ফুলেছে। তোমার তো পেট ফেঁপেছে,
আমার কেন গলা ফুলল?’
শিয়াল বললে, আমি কিনা শিয়াল, আর তুমি কিনা বাঘ, তাই।’
লেজের ব্যথায় আর গলার ব্যথায় বাঘ ষোল দিন উঠতে পারলে না। এই ষোল দিন কিছু না খেয়ে
সে আধমরা হয়ে গিয়েছে।
এমন সময় সে দেখলে যে, শিয়াল গা ঝাড়া দিয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছে। তাতে সে আশ্চর্য হয়ে
জিগগেস করলে, ‘কি ভাগ্নে, তোমার অসুখ কি করে সারল?’
শিয়াল বললে, ‘মামা, একটি ভারি চমৎকার ওষুধ পেয়েছি। আমি আমার হাত-পা চিবিয়ে খেলুম আর
তক্ষুণি আমার অসুখ সেরে গেল। তারপর দেখতে-দেখতে নতুন হাত-পা হল।”
বাঘ বললে, ‘তাই নাকি? তবে আমাকে বলনি কেন?’
শিয়াল বললে, ‘তুমি কি আর তোমার হাত-পা চিবিয়ে খেতে পারবে? তাই বলিনি।’
এ কথায় বাঘ ভীষণ রেগে বললে, ‘তুই শিয়াল হয়ে পারলি, আর আমি বাঘ হয়ে পারব না।’
শিয়াল বললে, ‘তুমি দুটো ঠাট্রার ভয়ে অমন বিয়েটা ছেড়ে এলে! এখন যে হাত-পা চিবিয়ে
খেতে পারবে, তা আমি কি করে জানব? তখন বাঘ বললে, ‘পারি কি না এই দেখ!’ বলে সে নিজের
হাত-পা চিবিয়ে খেল। তারপর তিন-চার দিনের মধ্যেই ভয়ানক ঘাঁ হয়ে সে মারা গেল।
এক বাঘের বাঘিনী মরে গিয়েছিল। মরবার সময় বাঘিনী বলে গিয়েছিল, ‘আমার দুটো ছানা রইল,
তাদের তুমি দেখো।’
বাঘিনী মরে গেলে বাঘ বললে, ‘আমি কি করে বা ছানাদের দেখব, কি করে বা ঘরকন্না করব।’
তা শুনে অন্য বাঘেরা বললে, ‘আবার একটা বিয়ে কর, তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
বাঘও ভাবলে, ‘একটা বিয়ে করলে হয়। কিন্ত আর বাঘিনী বিয়ে করব না, তারা রাঁধতে-টাধতে
জানে না। এবার বিয়ে করব মানুষের মেয়ে, ‘শুনেছি তারা খুব রাঁধতে পারে।’
এই মনে করে সে মেয়ে খুঁজতে গ্রামে গেল। সেখানে এক গৃহস্থের একটি ছেলে আর একটি মেয়ে
ছিল। বাঘ সেই মেয়েটিকে ধরে এনে তার, তার ছানা দুটোকে বললে, ‘দেখ রে, এই তোদের
মা।’
ছানা দুটো বললে, ‘লেজ নেই, দাঁত নেই, রোঁয়া নেই, ডোরা নেই- ও কেন আমাদের মা হবে!
ওটাকে মেরে দাও, আমরা খাই!’
বাঘ বললে, ‘খবরদার! অমন কথা বলবি তো তোদের ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করব!’ তাতে ছানা
দুটো চুপ করে গেল। কিন্ত সেই মেয়েটিকে তারা একেবারেই দেখতে পারত না। আর কথায়-কথায়
খালি বলত, ‘আর একটু বড় হলেই আমাদের গায়ে জোর হবে, তখন তোর ঘাড় ভেঙ্গে তোকে খাব!’
সেই মেয়েটির দুঃখের কথা আর কি বলব! বাঘ যখন বাড়ি থাকে না, তখন সে তার মা-বাপ আর
ভাইয়ের জন্য গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে। বাঘ এলে তার ভয়ে চুপ করে থাকে। এমনি তার দিন যায়।
আর তার মা-বাপ তো কেঁদে-কেঁদে অই হয়ে গেল। তার ভাইটিও দিনকতক খুব কাঁদলে, তারপর তা
মা-বাপকে বললে, ‘শুধু ঘরে বসে কাঁদলে কি হবে? আমি চললুম, দেখি বোনের সন্ধান করতে
পারি কিনা।’ এই বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে, খালি বনে-বনে ঘুরতে লাগলো। ঘুরতে-ঘুরতে
শেষে সেই বাঘের বাড়ি এসে তার বোনকে দেখতে পেল।
বোনটি তো তাকে দেখেই কাঁদতে-কাঁদাতে বললে, ‘ও দাদা, তুমি কেন এলে? বাঘ এলেই যে
তোমাকে ধরে খাবে!’
ভাই বললে, ‘খায় খাবে!’ আমি তোকে না নিয়ে ফিরছি না। এখন আমাকে লুকিয়ে রাখ, তারপর
দেখব এখন।’
তখন তারা দুজনে মিলে রান্নাঘরে গর্ত খুঁড়ল। মেয়েটি সেই গর্তের ভিতরে তার ভাইকে
বসিয়ে, শিল চাপা দিয়ে রাখল।
তারপরেই বাঘ এসে, তার ছানা দুটোকে নিয়ে খেতে বসল। ছানা দুটো ভালো করে খাচ্ছে না।
খালি বলছে-
‘বাবাগো বাবা, তোর কি শালা? মোর কি মামা?
মা’র কি সোদর ভাই?
শিলের তলে কুমকুম করে-তুলে দে না বাবা খাই!’
বাঘ সেদিন কার উপর চটে এসেছিল, তাই ছানা দুটোর কথা শুনেই, ঠাস-ঠাস করে তাদের দুটো
চড় মারল। তারা কি বলছে, তা ভেবে দেখল না! খাওয়া শেষ হলে সে মেয়েটিকে বলল, ‘আজ পিঠে
করিস, বিকেলে খাব। দেখিস যেন ভালো হয়।’ এই বলে সে আবার বেরিয়ে গেল।
বাঘ চলে গেলে পর মেয়েটি শিলের তলা থেকে তার ভাইকে বার করল। তারপর দুজনে খাওয়া-দাওয়া
সেরে, উনুন ধরিয়ে তার উপর কড়ায় করে তেল চড়াল। তারপর বাঘের ছানা দুটোকে কেটে,
উনুনের উপর ঝুলিয়ে রেখে, ভাই-বোন সেখান থেকে ছুটে পালাল।
বাঘের ছানা উনুনের উপর ঝুলছে, আর ঝাঁৎ-ঝাৎ করে রক্তের ফোঁটা তপ্ত তেলে পড়ছে। রে
বা! ঐ পিঠে হচ্ছে। যদি পিঠে ভালো হয় তো ভালো, নইলে আমরা তিন বাপ-বেটায় মিলে
রাঁধুনী হতভাগীকে ছিঁড়ে খাব!’
তারপর ঘরে ঢুকেই তো দেখল কি রকম পিঠে হচ্ছে! তখন বাঘ ‘হালুম হালুম’ করে ঘরময়
খুঁজতে লাগল। কিন্ত গৃহস্থের মেয়েকে আর কোথায় পাবে! সে ততক্ষণে তার ভাইকে নিয়ে,
মা-বাপের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে। আর গ্রামের সকল লোক ছুটে এসে তাদের নিয়ে কি
আনন্দই যে করছে কি বলব!
কুমির আর শিয়াল মিলে চাষ করতে গেল। কিসের চাষ করবে? আলুর চাষ। আলু হয় মাটির নীচে।
তার গাছ থাকে মাটির উপরে, তা দিয়ে কোনো কাজ হয় না। বোকা কুমির সে কথা জানতো না।
সে ভাবলে বুঝি আলু তার গাছের ফল।
তাই সে শিয়ালকে ঠকাবার জন্য বললে, ‘গাছের আগার দিক কিন্তু আমার, আর গোড়ার দিক
তোমার।’
শুনে শিয়াল হেসে বললে, ‘আচ্ছা তাই হবে।’
তারপর যখন আলু হল, কুমির তখন সব গাছের আগা কেটে তার বাড়িতে নিয়ে এল। এনে দেখে, তাতে
একটিও আলু নেই। তখন সে মাঠে গিয়ে দেখল, শিয়াল মাটি খুঁড়ে সব আলু তুলে নিয়ে গেছে।
কুমির ভাবলে, ‘তাই তো। এবার বড্ড ঠকে গিয়েছি। আচ্ছা, আসছে বার দেখব!’
তার পরের বার হল ধানের চাষ। এবার কুমির মনে ভেবেছে, আর কিছুতেই ঠকতে যাবে না। তাই
সে আগে থাকতেই শিয়ালকে বললে, ‘ভাই, এবারে কিন্তু আমি আগার দিক নেব না, এবার আমাকে
গোড়ার দিক দিতে হবে।’
শুনে শিয়াল হেসে বললে, ‘আচ্ছা তাই হবে!’
তারপর যখন ধান হল, শিয়াল ধানসুদ্ধ গাছের আগা কেটে নিয়ে গেল। কুমির তো এবারে ভারি
খুশি হয়ে আছে। ভেবেছে, মাটি খুঁড়ে সব ধান তুলে নেবে। ও কপাল! মাটি খুঁড়ে দেখে
সেখানে কিছুই নেই। লাভের মধ্যে খড়গুলো পেলো।
তখন কুমির তো বড্ড চটেছে, আর বলছে, ‘দাঁড়াও শিয়ালের বাছা, তোমাকে দেখাচ্ছি; এবারে
আর আমি তোমাকে আগা নিতে দেব না। সব আগা আমি নিয়ে আসব।’
সেবার হল আখের চাষ।
কুমির তো আগেই বলেছে, এবার আর সে
আগা না নিয়ে ছাড়বে না। কাজেই শিয়াল তাকে আগাগুলো দিয়ে নিজে আখগুলো নিয়ে ঘরে বসে
মজা করে খেতে লাগল।
কুমির আখের আগা ঘরে এনে চিবিয়ে দেখলে, খালি নোন্তা, তাতে একটুও মিষ্টি নেই। তখন সে
রাগ করে আগাগুলো সব ফেলে দিয়ে শিয়ালকে বললে, ‘না ভাই, তোমার সঙ্গে আর আমি চাষ
করতে যাব না, তুমি বড্ড ঠকাও!’
কুমির দেখলে, সে শিয়ালের সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠছে না। তখন ভাবলে, ‘ও ঢের লেখাপড়া
জানে, তাতেই খালি আমাকে ফাঁকি দেয়। আমি মূর্খ লোক, তাই তাকে আঁটতে পারি না।’
অনেকক্ষণ ভেবে কুমির ঠিক করল যে, নিজের সাতটা ছেলেকে শিয়ালের কাছে দিয়ে খুব করে
লেখাপড়া শেখাতে হবে। তার পরের দিনই সে ছানা সাতটাকে সঙ্গে করে শিয়ালের বাড়ি গিয়ে
উপস্থিত হল। শিয়াল তখন তার গর্তের ভিতর বসে কাঁকড়া খাচ্ছিল। কুমির এসে ডাকলে,
‘শিয়াল পণ্ডিত, শিয়াল পণ্ডিত, বাড়ি আছ?’
শিয়াল বাইরে এসে বললে, ‘কি ভাই, কি মনে করে?’
কুমির বললে, ‘ভাই, এই আমার ছেলে সাতটাকে তোমার কাছে এনেছি। মূর্খ হলে করে খেতে
পারবে না। ভাই, তুমি যদি এদের একটু লেখাপড়া শিখিয়ে দাও।’
শিয়াল বললে, ‘সে আর বলতে? আমি সাতদিনে সাতজনকে পড়িয়ে পণ্ডিত করে দেব।’ শুনে কুমির
তো খুব খুশী হয়ে ছানা সাতটাকে রেখে চলে গেল।
তখন শিয়াল তাদের একটাকে আড়ালে নিয়ে বললে-
‘পড় তো বাপু-কানা খানা গানা ঘানা, কেমন লাগে কুমির ছানা?’
এই কথা বলে, সেটার ঘাড় ভেঙ্গে, খেয়ে ফেললে।
পরদিন যখন কুমির তার ছানা দেখতে এল, তখন শিয়াল তাদের একেকটি করে গর্তের বাইরে এনে
দেখাতে লাগল।
ছয়টিকে ছয়বার দেখালে, শেষেরটা দেখালে দু’বার। বোকা কুমির তা বুঝতে না পেরে ভাবলে,
সাতটাই দেখানো হয়েছে। তখন সে চলে গেল, আর অমনি শিয়াল ছানাগুলোর একটাকে আড়ালে নিয়ে
বললে-
পড় তো বাপু- কানা খানা গানা ঘানা
কেমন লাগে কুমির ছানা?
এই কথা বলে, সেটার ঘাড় ভেঙ্গে, খেয়ে ফেলল।
পরদিন কুমির তো ছানা দেখতে এল। শিয়াল একেকটি করে গর্তের বাইরে এনে পাঁচবার পাঁচবার
দেখাল, শেষেরটিকে দেখাল তিনবার। তাতেই কুমির খুশি হয়ে চলে গেল। তখন শিয়াল ঠিক আগের
মতো করে আর একটা ছানাকে খেল।
এমনি করে সে রোজ একটি ছানা খায়, আর কুমির এলে তাকে ফাঁকি দিয়ে ভোলায়। শেষে যখন
একটি ছানা বই আর রইল না, তখন সেই একটিকেই সাতবার দেখিয়ে সে কুমিরকে বোঝাল। তারপর
কুমির চলে গেলে সেটিকেও খেয়ে ফেলল। তারপর আর একটিও রইল না।
তখন শিয়ালনী বললে, ‘এখন উপায়? কুমির এলে দেখাবে কি? ছানা দেখতে না পেলে তো অমনি
আমাদের ধরে খাবে!’
শিয়াল বললে, ‘আমাদের পেলে তো ধরে খাবে। নদীর ওপারে বনটা খুব বড়, চল আমরা সেইখানে
যাই, তাহলে কুমির আর আমাদের খুঁজে বার করতে পারবে না।’
এই বলে শিয়াল শিয়ালিনীকে নিয়ে তাদের পুরনো গর্ত ছেড়ে চলে গেল।
এর খানিক বাদেই কুমির এসেছে। সে এসে ‘শিয়াল পণ্ডিত, ‘শিয়াল পণ্ডিত, বলে কত ডাকল,
কেউ তার কথার উত্তর দিল না! তখন সে গর্তের ভিতর-বার খুঁজে দেখল-শিয়ালও নেই,
শিয়ালিনীও নেই! খালি তার ছানাদের হাড়গুলো পড়ে আছে।
তখন তার খুব রাগ হলো, আর সে চারদিকে ছুটোছুটি করে শিয়ালকে খুঁজতে লাগল।
খুঁজতে-খুঁজতে নদীর ধারে গিয়ে দেখল, ঐ! শিয়াল আর শিয়ালিনী সাঁতরে নদী পার হচ্ছে।
অমনি ‘দাঁড়া হতভাগা!’ বলে সে জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। জলের নীচে ছুটতে কুমিরের মত কেউ
পারে না, দেখতে-দেখতে সে গিয়ে শিয়ালের পিছনের একটা পা কামড়ে ধরল!
শিয়াল সবে তার সামনের দু-পা ডাঙ্গায় তুলেছিল, শিয়ালিনী তার আগেই উঠে গিয়েছিল। কুমির
এসে শিয়ালের পা ধরতেই সে শিয়ালিনীকে ডেকে বললে, ‘শিয়ালিনী, শিয়ালিনী, আমার লাঠিগাছা
ধরে কে টানাটানি করছে! লাঠিটা বা নিয়েই যায়!’
একথা শুনে কুমির ভাবলে, ‘তাই তো, পা ধরতে গিয়ে লাঠি ধরে ফেলেছি! শিগগির লাঠি ছেড়ে
পা ধরি।’
এই ভেবে যেই সে শিয়ালের পা ছেড়ে দিয়েছে, অমনি শিয়াল একলাফে ডাঙ্গায় উঠে গিয়েছে।
উঠেই বোঁ করে দে ছুট। তারপর বনের ভিতরে ঢুকে পড়লে আর কার সাধ্য তাকে ধরে।
তারপর থেকে কুমির কেবলই শিয়ালকে খুঁজে বেড়ায়। কিন্ত শিয়াল বড্ড চালাক, তাই তাকে
ধরতে পারে না। তখন সে অনেক ভেবে এক ফন্দি করল।
কুমির একদিন চড়ায় গিয়ে হাত পা ছাড়িয়ে মরার মতো পড়ে রইল। তারপর শিয়াল আর শিয়ালিনী
কচ্ছপ খেতে এসে দেখল, কুমির কেমন হয়ে পড়ে আছে! তখন শিয়ালিনী বললে, ‘মরে গেছে! চল
খাইগে! শিয়াল বললে, ‘রোস একটু দেখে নিই।’ এই বলে সে কুমিরের আর একটু কাছে গিয়ে
বলতে লাগল, ‘না! এটা দেখছি বড্ড বেশী মরে গেছে! অত বেশী মরাটা আমরা খাই না। যেগুলো
একটু-আধটু নড়ে-চড়ে, আমরা সেগুলো খাই।’
তা শুনে কুমির ভাবলে, ‘একটু নড়ি-চড়ি, নইলে খেতে আসবে না।’ এই মনে করে কুমির তার
লেজের আগাটুকু নাড়তে লাগল। তা দেখে শিয়াল হেসে বললে, ‘ঐ দেখ, লেজ নাড়ছে! তুমি তো
বলেছিলে, মরে গেছে!’ তারপর আর কি তারা সেখানে দাঁড়ায়! তখন কুমির বললে, ‘বড্ড ফাঁকি
দিলে তো! আচ্ছা এবারে দেখাব!’
একটা জায়গায় শিয়াল রোজ জল খেতে আসত! কুমির তা দেখতে পেয়ে সেখানে গিয়ে লুকিয়ে রইল।
ভাবল, শিয়াল জল খেতে এলেই ধরে খাবে। সেদিন শিয়াল এসে দেখল, সেখানে একটাও মাছ নেই।
অন্য দিন ঢের মাছ চলা-ফেরা করে। শিয়াল ভাবলে, ‘ভালো রে ভালো, আজ সব মাছ গেল
কোথায়? বুঝেছি, এখানে কুমির আছে!’ তখন সে বললে, ‘এখানকার জলটা বেজায় পরিস্কার।
একটু ঘোলা না হলে কি খাওয়া যায়? চল শিয়ালিনী, আর -এক জায়গায় যাই।’ এ কথা শুনেই
কুমির তাড়াতাড়ি সেখানকার জল ঘোলা করতে আরম্ভ করলে। তা দেকে শিয়াল হাসতে হাসতে ছুটে
পালিয়েছে!
আর একদিন শিয়াল এসেছে কাঁকড়া খেতে। কুমির তার আগেই সেখানে চুপ করে বসে আছে। শিয়াল
তা টের পেয়ে বলল, ‘এখানে কাঁকড়া নেই, থাকলে দু-একটা ভাসত।’
অমনি কুমির তার লেজের আগাটুকু ভাসিয়ে দিল। কাজেই শিয়াল আর জলে নামল না।
অমনি করে বারবার শিয়ালের কাছে ঠকে গিয়ে, শেষে কুমিরের ভারি লজ্জা হল। তখন সে আর কি
করে মুখ দেখাবে। কাজেই সে তার ঘরের ভিতরে গিয়ে বসে রইল।
একজন সওদাগর একটি ঘোড়া নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছিল। যেতে যেতে তার বড্ড ঘুম পেল। তখন সে
ঘোড়াটিকে এক গাছে বেঁধে, সে গাছের তলায় ঘুমিয়ে রইল।
এমন সময় এক চোর এসে সওদাগরের ঘোড়াটিকে নিয়ে চলে যাচ্ছে।
সওদাগর ঘোড়ার পায়ের শব্দে জেগে উঠে বললে, ‘কি ভাই, তুমি আমার ঘোড়াটিকে নিয়ে
কোথায় যাচ্ছ?’
চোর তাতে ভারী রাগ করে বললে, ‘তোমার ঘোড়া আবার কোনটা হল?’
শুনে সওদাগর আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘সেকি কথা! তুমি আমার ঘোড়া নিয়ে চলে যাচ্ছ, আবার
বলছ কোন্টা আমার ঘোড়া?’
দুষ্টু চোর তখন মুখ ভার করে বললে, ‘খবরদার তুমি আমার ঘোড়াকে তোমার ঘোড়া বলবে
না!’
সওদাগর বললে, ‘কি? আমি আমার ঘর থেকে ঘোড়াটাকে নিয়ে এলুম, আর তুমি বলছ সেটা
তোমার?’
চোর বললে, ‘বটে! এটা তো তোমার ঐ গাছের ছানা। এক্ষুনি হল। তুমি বুঝে শুনে কথা কও,
নইলে বড় মুশকিল হবে।’
তখন সওদাগর গিয়ে রাজার কাছে নালিশ করল, ‘মহারাজ, আমি গাছে আমার ঘোড়াটা বেঁধে
ঘুমুচ্ছিলুম, আর ঐ বেটা এসে তাকে নিয়ে যাচ্ছে।’
রাজামশাই চোরকে ডেকে জিগগেস করলেন, ‘কি হে, তুমি ওর ঘোড়া নিয়ে যাচ্ছ কেন?’
চোর হাত জোড় করে বললে, ‘দোহাই মহারাজ! এটি কখনই ওর ঘোড়া নয়। এটি আমার গাছের
ছানা। ছানাটি হতেই আমি তাকে নিয়ে যাচ্ছিলুম, আর ঐ বেটা উঠে বলছে কিনা, ওটা ওর
ঘোড়া! সব মিথ্যা কথা!’
তখন রাজামশাই বললেন, ‘এ তো ভারি অন্যায়। গাছের ছানা হল, আর তুমি বলছ সেটা তোমার
ঘোড়া। তুমি দেখছি বড় দুষ্টু লোক। পালাও এখান থেকে!’ বলে তিনি ঘোড়াটা চোরকেই
দিয়ে দিলেন।
সওদাগর বেচারা তখন মনের দুঃখে কাঁদতে-কাঁদতে বাড়ি ফিরে চলল। খানিক দূরে গিয়ে এক
শিয়ালের সাথে তার দেখা হল।
শিয়াল তাকে কাঁদতে দেখে বললে, ‘কি ভাই? তোমার মুখ এমন ভার দেখছি যে! কি হয়েছে?’
সওদাগর বললে, ‘আর ভাই, সে কথা বলে কি হবে? আমার ঘোড়াটি চোরে নিয়ে গেছে। রাজার
কাছে নালিশ করতে গেলুম, সেখানে চোর বললে কিনা, ওটা তার গাছের ছানা! রাজামশাই তাই
শুনে ঘোড়াটি চোরকেই দিয়ে দিয়েছেন।’
এ কথা শুনে শিয়াল বললে, ‘আচ্ছা, এক কাজ করতে পার?’
সওদাগর বললে, ‘কি কাজ?’
শিয়াল বললে, ‘তুমি রাজামশায়ের কাছে গিয়ে বল, মহারাজ, আমার একজন সাক্ষী আছে। আপনার
বাড়িতে যদি কুকুর না থাকে, তবে সেই সাক্ষীটিকে নিয়ে আসতে পারি।’
তখন সওদাগর আবার রাজার কাছে গিয়ে বললে, ‘মহারাজ, আমার একটি সাক্ষী আছে, কিন্ত আপনার
বাড়ির কুকুরদের ভয়ে সে আসতে পারছে না। অনুগ্রহ করে যদি কুকুর তাড়িয়ে দেবার হুকুম
দেন, তবে আমার সাক্ষীটিকে নিয়ে আসতে পারি।’
তা শুনে রাজামশাই তখুনি সব কুকুর তাড়িয়ে দেবার হুকুম দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, এখন
তোমার সাক্ষী আসুক।’
এসব কথা সওদাগর শিয়ালকে এসে বলতেই শিয়াল চোখ বুজে টলতে-টলতে রাজার সভায় এল। সেখানে
এসেই সে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঝিমুতে লাগল। রাজামশাই তা দেখে হাসতে-হাসতে বললেন, ‘কি
শিয়াল পণ্ডিত? ঘুমুচ্ছে যে?’
শিয়াল আধ চোখে মিট-মিট করে তাকিয়ে বললে, ‘মহারাজ, কাল সারা রাত জেগে মাছ
খেয়েছিলুম, তাই আজ বড্ড ঘুম পাচ্ছে।’
রাজা বললেন, ‘এত মাছ কোথায় পেলে?’
শিয়াল বললে, ‘কাল নদীর জলে আগুন লেগে সব মাছ এসে ডাঙ্গায় উঠল। আমরা সকলে মিলে সারা
রাত খেলুম, খেয়ে কি শেষ করতে পারি!’ এ কথা শুনে রাজামশাই এমনি ভয়ানক হাসলেন যে, আর
একটু হলেই তিনি ফেটে যেতেন। শেষে অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললেন, ‘এমন কথা তো কখনো
শুনিনি! জলে আগুন লাগে, এও কি কখনো হয়? এ সব পাগলের কথা!’
তখন শিয়াল বললে, ‘মহারাজ, ‘ঘোড়া গাছের ছানা হয়, এমন কথাও কি কখনো শুনেছেন? সে কথা
যদি পাগলের না হয়, তবে আমার এই কথাটার কি দোষ হল?’
শিয়ালের কথায় রাজামশাই ভারি ভাবনায় পড়লেন।
ভেবে-চিন্তে শেষে তিনি বললেন, ‘তাই তো! ঠিক বলেছ! গাছের আবার কি করে ছানা হবে? সে
বেটা নিশ্চয় তবে নিশ্চয় চোর।
তখনই হুকুম হল, ‘আন তো রে সেই চোর বেটাকে বেঁধে!’
অমনি দশ পেয়াদা গিয়ে চোরকে বেঁধে আনলে। আনতেই রাজামশাই বললেন, ‘মার বেটাকে পঞ্চাশ
জুতো!’
বলতেই বলতেই পেয়াদারা তাদের নাগরা জুতো খুলে চটাশ-চটাশ চোরের পিঠে মারতে লাগাল।
সে বেটা পঁচিশ জুতো খেয়ে চেঁচিয়ে বললে, ‘গেলুম গেলুম! আমি ঘোড়া এনে দিচ্ছি। আর
এমন কাজ কখনো করব না!’ কিন্ত তার কথা আর তখন কে শোনে! পঞ্চাশ জুতো মারা হলে রাজা
বললেন, ‘শিগগির ঘোড়া এনে দে, নইলে আরো পঞ্চাশ জুতো!’
চোর তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে ঘোড়া এনে দিল। তারপর তার নিজ হাতে নাক-কান মলিয়ে মাথা
চেঁছে, তাতে ঘোল ঢেলে হতভাগাকে দেশ থেকে দূর করে দেওয়া হল। সওদাগর তার ঘোড়া পেয়ে
শিয়ালকে আশীর্বাদ করতে লাগল।
এক শিয়াল আর এক শিয়ালিনী ছিল। তাদের তিনটি ছানা ছিল, কিন্ত থাকবার জায়গা ছিল না।
তারা ভাবলে, ‘ছানাগুলোকে এখন কোথায় রাখি? একটা গর্ত না হলে তো এরা বৃষ্টিতে ভিজে
মারা যাবে।’ তখন তারা অনেক খুঁজে একটা গর্ত বার করলে, কিন্ত গর্তের চারধারে দেখলে,
খালি বাঘের পায়ের দাগ! তা দেখে শিয়ালিনী বললে, ‘ওগো এটা যে বাঘের গর্ত। এর ভিতরে
কি করে থাকবে।?’
শিয়াল বলল, ‘এত খুঁজেও তো আর গর্ত পাওয়া গেল না। এখানেই থাকতে হবে।’
শিয়ালিনী বললে, ‘বাঘ যদি আসে, তখন কি হবে?’
শিয়াল বললে, ‘তখন তুমি খুব করে ছানাগুলির গায়ে চিমটি কাটবে। তাতে তারা চেঁচাবে, আর
আমি জিজ্ঞেস করব-ওরা কাঁদছে কেন? তখন তুমি বলবে-‘ওরা বাঘ খেতে চায়।’
তা শুনে শিয়ালিনী বললে, ‘বুঝেছি। আচ্ছা, বেশ!’ বলেই সে খুব খুশি হয়ে গর্তের ভিতরে
ঢুকল। তখন থেকে তারা সেই গর্তের ভিতরেই থাকে।
এমনি করে দিন কতক যায়, শেষে একদিন তারা দেখলে যে, ঐ বাঘ আসছে। অমনি শিয়ালিনী তার
ছানাগুলোকে ধরে খুব চিমটি কাটতে লাগল। তখন ছানাগুলি যে চেঁচাল, তা কি বলব!
শিয়াল তখন খুব মোটা আর বিশ্রী গলার সুর করে জিগগেস করলে, ‘খোকারা কাঁদছে কেন?’
শিয়ালিনী তেমনি বিশ্রী সুরে বললে, ‘ওরা বাঘ খেতে চায়, তাই কাঁদছে।’
বাঘ তার গর্তের দিকে আসছিল। এর মধ্যে ‘ওরা বাঘ খেতে চায়’ শুনে সে থমকে দাঁড়াল। সে
ভাবলে, ‘বাবা! আমার গর্তের ভিতর না জানি ওগুলো কি ঢুকে রয়েছে। নিশ্চয়ই ভয়ানক
রাক্ষস হবে, নইলে কি ওদের খোকারা বাঘ খেতে চায়!’
তখুনি শিয়াল বললে, ‘আরে বাঘ কোথায় পাব? যা ছিল, সবই তো ধরে এনে ওদের খাইয়েছি!’
তাতে শিয়ালিনী বললে, ‘তা বললে কি হবে? যেমন করে পার একটা ধরে আনো, নইলে খোকারা
থামছে না।’ বলে সে ছানাগুলোকে আরো বেশী করে চিমটি কাটতে লাগল।
তখন শিয়াল বললে, ‘আচ্ছা, রোস রোস। ঐ যে একটা বাঘ আসছে। আমার ঝপাংটা দাও, এখুনি
ওকে ভতাং করছি।’
ঝপাং বলেও কিচ্ছু নেই, ভতাং বলেও কিচ্ছু নেই-সবই শিয়ালের চালাকি। বাঘের কিন্ত সেই
ঝপাং ও ভাতাং শুনেই প্রাণ উড়ে গেল। সে ভাবলে, ‘মাগো, এই বেলা পালাই, নইলে না জানি
কি দিয়ে কি করবে এসে! বলে সে আর সেখানে একটুও দাঁড়াল না। শিয়াল চেয়ে দেখল যে, লম্বা
লম্বা লাফ দিয়ে ঝোপ জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে ছুটে পালাচ্ছে! তখন শিয়াল আর শিয়ালিনী লম্বা
নিঃশ্বাস ছেড়ে বললে, যাক, ‘আপদ কেটে গেছে!’
বাঘ তখনো এমনি ছুটছে যে তেমন আর সে কখনো ছোটেনি।
একটা বানর গাছের উপর থেকে তাকে ছুটতে দেখে ভারি আশ্চর্য হয়ে ভাবলে, ‘তাই তো, বাঘ
এমনি ছুটছে, এ তো সহজ কথা নয়! নিশ্চয় একটা ভয়ানক কিছু হয়েছে!’ এই ভেবে সে বাঘকে
ডেকে জিগগেস করলে, ‘বাঘ ভাই, বাঘ ভাই, কি হয়েছে? তুমি যে অমন করে ছুটে পালাচ্ছ?’
বাঘ হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ‘সাধে কি পালাচ্ছি? নইলে এক্ষুনি আমাকে ধরে খেত!’
বানর বললে, ‘তোমাকে ধরে খায়, এমন কোনো জানোয়ারের কথা তো আমি জানিনে। ও কথা
আমার বিশ্বাস হচ্ছে না!’
বাঘ বললে, ‘যদি সেখানে থাকতে বাপু, তবে দেখতুম! দূর থেকে অমনি করে সকলেই বলতে
পারে!’
বানর বললে, ‘আমি যদি সেখানে থাকতুম, তবে তোমাকে বুঝিয়ে দিতুম যে সেখানে কিছু নেই।
তুমি বোকা, তাই মিছামিছি অত ভয় পেয়েছ!’ এ কথায় বাঘের ভারি রাগ হল।
সে বললে, ‘বটে! আমি বোকা? আর তোমার বুছি ঢের বুদ্ধি! চল তো একবার সেখানে যাই!’
বানর বললে, ‘যাব বইকি, যদি আমাকে পিঠে করে নিয়ে যাও।’
বাঘ বললে, ‘তাই সই! আমার পিঠে বসেই চল।’ এই বলে সে বানরকে পিঠে করে আবার গর্তের
দিকে ফিরে চলল।
শিয়াল আর শিয়ালিনী সবে ছানাদের শান্ত করে একটু বসেছে, আর অমনি দেখে, বানরকে পিঠে
করে বাঘ আবার আসছে। তখন শিয়ালনী তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে আবার ছানাগুলোকে চিমটি কাটতে
লাগল, ছানাগুলিও ভূতের মতো চ্যাঁচাতে শুরু করল।
তখন শিয়াল আবার সেই রকম সুর করে বললে, ‘আরে থামো, থামো! অত চেঁচিও না-অসুখ করবে।’
শিয়ালনী বললে, ‘আমি বলছি, যতক্ষণ না একটা বাঘ এনে ওদের খেতে দেবে, ততক্ষণ এরা
কিছুতেই থামবে না।’
শিয়াল বললে, ‘আমি যে ওদের মামাকে বাঘ আনতে পাঠিয়েছি। এখুনি সে বাঘ নিয়ে আসবে,
তোমরা থামো!’
তারপর একটু চুপ করেই সে আবার বললে, ‘ঐ,ঐ! ঐ যে তোদের বাঁদর মামা একটা বাঘ ধরে
এনেছে! আর কাঁদিসনে; শিগগির ঝপাংটা দে, ভতাং করি!’
বানরের এতক্ষণ খুব সাহস ছিল। কিন্ত ঝপাং আর ভতাঙের কথা শুনে আর সে বসে থাকতে পারল
না। সে এক লাফে একটা গাছে উঠে, দেখতে দেখতে কোথায় পালিয়ে গেল।
আর বাঘের কথা কি আর বলব! সে যে সেইখান থেকে ছুট দিলে, দুদিনের মধ্যে আর দাঁড়ালই না।
তারপর থেকে আর শিয়ালদের কোন কষ্ট হয়নি। তারা মনের সুখে সেই গর্তে থেকে দিন কাটাতে
লাগল।
শিয়াল পণ্ডিত আখ খেতে বড় ভালবাসে, তাই সে রোজ আখ ক্ষেতে যায়। একদিন সে আখের ক্ষেতে
ঢুকে একটি ভিমরুলের চাক দেখতে পেল। ভিমরুলের চাক সে আগে কখনো দেখেনি, সে মনে করল
ওটা বুঝি আখের ফল।
শিয়াল কিনা পণ্ডিত মানুষ, তাই সে আখকে বলে ‘ইক্ষু’, ক্ষেতকে বলে ‘ক্ষেত্র’, লাঠিকে
বলে ‘দণ্ড’,।
ভিমরুলের চাক দেখে সে বললে, ‘আহা ইক্ষুর কি চমৎকার ফল! খেতে না জানি কতই মিষ্টি
হবে?’ এই মনে করে যেই সে ভিমরুলের চাক খেতে গিয়েছে, অমনি সব ভিমরুল বেরিয়ে
কি-মজাটাই তাকে দেখাতে লাগল! শিয়াল তো প্রাণের ভয়ে খালি ছোটে, আর বলে, ‘ইক্ষুর
ক্ষেত্রে আর যাব না!’
খানিক বাদে ভিমরুলগুলো তাকে ছেড়ে গেল। তখন সে ভাবলে, ‘ক্ষেত্রে তো রোজই যাই,
তাতে কিছু হয় না। ফল খেতে গিয়েই আমার বিপদ হল। তবে আর ক্ষেত্রে যাব না কেন? ফল না
খেলেই হল।’ এই ভেবে সে বলতে লাগল, ‘যদি ইক্ষুর ক্ষেত্রে যাব, ইক্ষুর ফল আর না খাব!’
দুদিন সে খালি এ কথাই বলে।
তারপর যখন বেদনা একটু কমে এল, তখন সে ভাবলে, ‘ঐ ফলটার ভিতর পোকা ছিল, তারাই আমাকে
কামড়েছে। আগে যদি ফলটাতে নাড়া দিতুম তবে পোকাগুলি বেরিয়ে যেত। তারপর ফল খেতে
কোনো কষ্ট হত না! আহা, সে ফল খেতে না জানি কতই মিষ্টি। তবে আর ফল খাব না কেন?
খাবার আগে পোকা তাড়িয়ে দিলেই হবে।’ এই ভেবে সে বলতে লাগল, ‘যদি ইক্ষুর ফল খাব, আগে
দণ্ড দিয়ে নাড়া দিব!’ বলতে-বলতে আখের ক্ষেতে গিয়ে সে তো লাঠি দিয়ে নাড়া দিয়েছে।
অমনি আর যাবে কোথায়! ভিমরুলের দল এসে তাকে কামড়িয়ে আধমরা করে তবে ছাড়ল। সেই থেকে
সে আর ইক্ষুর ফল খেত না।
রাজার যে হাতিটা তাঁর আর সকল হাতির চেয়ে ভালো আর বড় দেখতে সুন্দর, সেইটে তাঁর
‘পাটহস্তী’।
সেই হাতিতে চড়ে রাজামশাই চলাফেরা করেন, আর তাকে খুব ভালবাসেন।
একদিন রাজার পাটহস্তী মরে গেল। রাজা অনেকক্ষণ ভারি দুঃখ করলেন, শেষে বললেন, ‘ওটাকে
ফেলে দিয়ে এস।’
তখন সেই হাতির পায়ে বড়-বড় দড়ি বেঁধে পাঁচশো লোক টেনে তাকে মাঠে ফেলে দিয়ে এল।
সেই মাঠের কাছে এক শিয়াল থাকত। সে অনেক দিন পেট ভরে খেতে পায়নি। মাঠে মরা হাতি
দেখতে পেয়ে, সে খুব খুশি হয়ে এসে, তাকে খেতে আরম্ভ করল। তার এতই খিদে হয়েছিল যে,
খেতে-খেতে সে হাতির পেটের ভিতরে ঢুকে গেল, তবুও তার খাওয়া শেষ হল না। এমনি করে
দুদিনে চলে গেল, তখনো সে হাতির পেটের ভিতরে বসে কেবল খাচ্ছেই। ততদিন রোদ লেগে
চামড়া শুকিয়ে, হাতির পেটের ফুটো ছোট হয়ে গেছে, আর শিয়ালও অনেক খেয়ে মোটা হয়ে
গেছে। তখন তো তার ভারি মুশকিল হল। সে অনেক চেষ্টা করেও হাতির পেটের ভিতর থেকে
বেরোতে পারল না। এখন উপায় কি হবে?
এমন সময় তিনজন চাষী সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের দেখতে পেয়েই শিয়ালের মাথায় এক ফন্দি
জোগাল। সে হাতির পেটের ভিতর থেকে তাদের ডেকে বললে, ‘ওহে ভাই সকল, তোমরা রাজার
কাছে একটা খবর দিতে পারবে? আমার পেটে যদি পঞ্চাশ কলসী ঘি মাখানো হয়, তবে আমি উঠে
দাঁড়াব।’
চাষীরা তাতে ভারি আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘শোন-শোন, হাতি কি বলছে! চল রাজামশাইকে খবর
দিইগে।’ তারা তখুনি রাজার কাছে ছুটে গিয়ে বললে, ‘রাজামশাই, আপনার সেই মরা হাতি বলছে
যে তার পেটে পঞ্চাশ কলসী ঘি মাখালে সে আবার উঠে দাঁড়াবে। শিগগির পঞ্চাশ কলসী ঘি
পাঠিয়ে দিন।’
এ কথায় রাজামশাই যে কি খুশি হলেন, কি আর বলব! তিনি বললেন, ‘আমার হাতি যদি বাঁচে,
পঞ্চাশ কলসী ঘি আর কত বড় একটা কথা! হাজার কলসী ঘি নিয়ে তার পেটে মাখাও।’ তখুনি
হাজার মুটে হাজার কলসী ঘি নিয়ে মাঠে উপস্থিত করল। দুহাজার লোক মিলে সেই ঘি হাতির
পেটে মাখাতে লাগল। সাতদিন খালি ‘আনো ঘি’, ‘ঢাল ঘি’ ছাড়া সেখানে আর কোনো কথাই
শোনা গেল না।
সাতদিনের পরে শিয়াল দেখলে যে, হাতির চামড়াও ঢের নরম হয়েছে, পেটের ফুটোও ঢের বড়
হয়েছে, এখন সে ইচছা করলেই বেরিয়ে আসতে পারে। তখন সে সকলকে ডেকে বলল, ‘ভাই সকল,
এইবার আমি উঠব। তোমরা একটু সরে দাঁড়াও, নইলে যদি আমি মাথা ঘুরে তোমাদের উপরে পড়ে
টড়ে যাই!’
তখন ভারি একটা গোলমাল হল। যে যাকে সামনে পাচ্ছে, তাকেই ধাক্কা মেরে বলছে, ‘আরে
বেটা, শিগগির সর! হাতি উঠছে, ঘাড়ে পড়বে।’
একথা শুনে কি কেউ আর সেখানে দাঁড়ায়? ঘি-টি সব ফেলে তারা পালাতে লাগল, একবার চেয়েও
দেখল না, হাতি উঠেছে কি পড়েই আছে। তা দেখে শিয়াল ভাবলে, ‘এই বেলা পালাই।’ তখন সে
তাড়াতাড়ি হাতির পেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে দে ছুট্।
এক গ্রামে দুটো বিড়াল ছিল। তার একটা থাকত গোয়ালাদের বাড়িতে, সে খেত দই, দুধ,
ছানা, মাখন আর সর। আর একটা থাকত জেলেদের বাড়িতে, সে খেত খালি ঠেঙ্গার বাড়ি আর লাথি।
গোয়ালাদের বিড়ালটা খুব মোটা ছিল, আর সে বুক ফুলিয়ে চলত। জেলেদের বিড়ালটার গায়
খালি চামড়া আর হাড় কখানি ছিল। সে চলতে গেলে টলত আর ভাবত, কেমন করে গোয়ালাদের
বিড়ালটার মতো মোটা হব।
শেষে একদিন সে গোয়ালাদের বিড়ালকে বললে, ‘ভাই, আজ আমার বাড়িতে তোমার নিমন্ত্রণ।’
সব কিন্তু মিছে কথা। নিজেই খেতে পায় না, সে আবার নিমন্ত্রণ খাওয়াবে কোথা থেকে? সে
ভেবেছে, ‘গোয়ালাদের বিড়াল আমাদের বাড়ি এলেই আমার মত ঠেঙ্গা খাবে আর মরে যাবে,
তারপর আমি গোয়ালাদের বাড়িতে গিয়ে থাকব।’
যে কথা সেই কাজ। গোয়ালাদের বিড়াল জেলেদের বাড়িতে আসতেই জেলেরা বললে, ঐ রে।
গোয়ালাদের সেই দই-দুধ-খেকো চোর বিড়ালটা এসেছে, আমাদের মাছ খেয়ে শেষ করবে। মার
বেটাকে!’
বলে তারা তাকে এমনি ঠেঙান ঠেঙালে যে, বেচারা তো মরেই গেল। রোগা বিড়াল তো জানতই
যে, এমনি হবে। সে তার আগেই গোয়ালাদের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হয়েছে! সেখানে খুব করে
ক্ষীর-সর খেয়ে, দেখতে-দেখতে সে মোটা হয়ে গেল। তখন আর সে অন্য বিড়ালদের সঙ্গে কথা
কয় না, আর নাম জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘মজন্তালী সরকার।’
একদিন মজন্তালী সরকার কাগজ কলম নিয়ে বেড়াতে বেরুল। বেড়াতে-বেড়াতে সে বনের ভিতরে
গিয়ে দেখল যে, তিনটি বাঘের ছানা খেলা করছে। সে তাদের তিন তাড়া লাগিয়ে বলল, ‘এই-য়ো!
খাজনা দে!’ বাঘের ছানাগুলো তার কাগজ কলম দেখে আর ধমক খেয়ে বড্ড ভয় পেল। তাই তারা
তাড়াতাড়ি তাদের মায়ের কাছে গিয়ে বললে, ‘ও মা, শিগগির এস! দেখ এটা কি এসেছে, আর কি
বলছে!’
বাঘিনী তাদের কথা শুনে এসে বললে, ‘তুমি কে বাছা? কোত্থেকে এলে? কি চাও?’
মজন্তালী বললে, ‘আমি রাজার বাড়ির সরকার, আমার নাম মজন্তালী। তোরা যে আমাদের রাজার
জায়গায় থাকিস, তার খাজনা কই? খাজনা দে!’
বাঘিনী বললে, ‘খাজনা কাকে বলে তা তো জানিনে! আমরা খালি বনে থাকি, আর কেউ এলে তাকে
ধরে খাই। তুমি না হয় একটু বস, বাঘ আসুক।’
তখনই মজন্তালী একটা উঁচু গাছের তলায় বসে, চারদিকে উঁকি মেরে দেখতে লাগল। খানিক
বাদেই সে দেখল-ঐ বাঘ আসছে। তখন সে তাড়াতাড়ি কাগজ কলম রেখে, একেবারে গাছের আগায় গিয়ে
উঠল।
বাঘ আসতেই তো বাঘিনী তার কাছে সব কথা বলে দিয়েছে, আর বাঘের যে কি রাগ হয়েছে কি
বলব! সে ভয়ানক গর্জন করে বললে, ‘কোথায় সে হতভাগা? এখুনি তার ঘাড় ভাঙছি!’
মজন্তালী গাছের আগা থেকে বললে, ‘কি রে বাঘা, খাজনা দিবি না? আয়, আয়!’
শুনেই তো বাঘ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললে, ‘হাল্লুম!’ বলে দুই লাফে সেই গাছে গিয়ে
উঠেছে। কিন্ত খালি উঠলে কি হয়? মজন্তালীকে ধরতে পারলে তো! সে একটুখানি হালকা
জন্তু, সেই কোন সরু ডালে উঠে বসেছে, অত বড় ভারি বাঘ সেখানে যেতে পারছে না। না পেরে
রেগে-মেগে বেটা দিয়েছে এক লাফ, অমনি পা হড়কে গিয়েছে পড়ে! পড়তে গিয়ে দুই ডালের
মাঝখানে মাথা আটকে, তার ভেঙে প্রাণ বেরিয়ে গিয়েছে।
তা দেখে মজন্তালী ছুটে এসে তার নাকে তিন চারটে আঁচড় দিয়ে, বাঘিনীকে ডেকে বললে, এই
দেখ, কি করেছি। আমার সামনে বেয়াদবি!’
এ সব দেখে শুনে তো ভয়ে বাঘিনী বেচারীর প্রাণ উড়ে গেল! সে হাত জোড় করে বললে,
‘দোহাই মজন্তালী মশাই, আমাদের প্রাণে মারবেন না! আমরা আপনার চাকর হয়ে থাকব!’
তাতে মজন্তালী বললে, ‘আচ্ছা তবে থাক্, দোহাই ভালো করে কাজকর্ম করিস, আর আমাকে
খুব ভালো খেতে দিস।’
সেই থেকে মজন্তালী বাঘিনীদের বাড়িতেই থাকে। খুব করে খায় আর বাঘিনীর ছানাগুলির ঘাড়ে
চড়ে বেড়ায়। সে বেচারারা তার ভয়ে একেবারে জড়-সড় হয়ে থাকে, আর তাকে মনে করে, না জানি
কত বড় লোক!
একদিন বাঘিনী তাকে হাতজোড় করে বললে, মজন্তালী মশাই, এ বনে খালি ছোট-ছোট
জানোয়ার, এতে কিছু আপনার পেট ভরে না। নদীর ওপারে খুব ভারি বন আছে, তাতে খুব বড় বড়
জানোয়ার থাকে। চলুন সেখানে যাই।’
শুনে মজন্তালী বললে, ‘ঠিক কথা! চল ওপারে যাই।’ তখন বাঘিনী তার ছানাদের নিয়ে,
দেখতে-দেখতে নদীর ওপারে চলে গেল। কিন্ত মজন্তালী কই? বাঘিনী আর তার ছানারা অনেক
খুঁজে দেখল- ঐ মজন্তালী সরকার নদীর মাঝখানে পড়ে হাবু-ডুবু খাচ্ছে! স্রোতে তাকে
ভাসিয়ে সেই কোথায় নিয়ে গিয়েছে, আর ঢেউয়ের তাড়ায় তার প্রাণ যায়-যায় হয়েছে!
মজন্তালী তো ঠিক বুঝতে পেরেছে যে, আর দুটো ঢেউ এলেই সে মারা যাবে। এমন সময়
ভাগ্যিস বাঘিনীর একটা ছানা তাকে তাড়াতাড়ি ডাঙ্গায় তুলে এনে বাচাল, নইলে সে মরেই
যেত, তাতে আর ভুল কি?
কিন্ত মজন্তালী সরকার তাদের সে কথা জানতেই দিল না। সে ডাঙায় উঠে ভয়ানক চোখ রাঙিয়ে
বাঘের ছানাকে চড় মারতে গেল, আর গাল যে কত দিল, তার তো লেখাজোখাই নেই। শেষে বললে,
‘হতভাগা মূর্খ, দেখ্ দেখি কি করলি! আমি অমন চমৎকার হিসাবটা করছিলুম, সেটা শেষ না
হতেই তুই আমাকে টেনে তুলে আনলি-আর আমার সব হিসাব গুলিয়ে গেল! আমি সব গুণছিলুম, নদীর
কটা ঢেউ, কতকগুলো মাছ আর কতখানি জল আছে। মূর্খ বেটা, তুই এর মধ্যে গিয়ে সব গোলমাল
করে দিলি! এখন যদি আমি রাজামশাইয়ের কাছে গিয়ে এর হিসাব দিতে না পারি, তবে মজাটা টের
পাবি!’
এসব কথা শুনে বাঘিনী তাড়াতাড়ি এসে হাত জোড় করে বললে, ‘মজন্তালী মশাই, ঘাট হয়েছে,
এবারে মাপ করুন। ওটা মূর্খ, লেখাপড়া জানে না, তাই কি করতে কি করে ফেলেছে!’
মজন্তালী বললে, ‘আচ্ছা এবারে মাপ করলুম! খবরদার! আর যেন কখনো এমন হয় না!’ এই বলে
মজন্তালী তার ভিজে গা শুকোবার জন্য রোঁদ খুঁজতে লাগল।
গভীর বনের ভিতরে সহজে রোদ ঢুকতে পায় না। সেখানে রোদ খুঁজতে গেলে উঁচু গাছের আগায়
গিয়ে উঠতে হয়। মজন্তালী একটা গাছের আগায় উঠে দেখলে যে, খুব বড় একটা মরা মহিষ মাঠের
মাঝখানে পড়ে আছে। তখন সে তাড়াতাড়ি গিয়ে সেই মহিষটার গায়ে কয়েকটা আঁচর কামড় দিয়ে এসে
বাঘিনীকে বললে, ‘শিগগির যা আমি একটা মোষ মেরে রেখে এসেছি।’ বাঘিনী আর তার
ছানাগুলো ছুটে গিয়ে দেখল, সত্যি মস্ত এক মোষ পড়ে আছে। তারা চারজনে মিলে অনেক
কষ্টে সেটাকে টেনে আনলে, আর ভাবলে, ‘ঈস! মজন্তালী মশায়ের গায়ে কি ভয়ানক জোর!’
আর একদিন তারা মজন্তালীকে বললে, ‘মজন্তালী মশাই, এ বনে বড়বড় হাতি আর গণ্ডার আছে।
চলুন একদিন সেইগুলো মারতে যাই।’
একথা শুনে মজন্তালী বললে, ‘তাই তো, হাতি গণ্ডার মারব না তো মারব কি? চল আজই যাই।’
বলে সে তখুনি সকলকে নিয়ে হাতি আর গণ্ডার মারতে চলল। যেতে-যেতে বাঘিনী তাকে জিগগেস
করলে, ‘মজন্তালী মশাই, আপনি খাপে থাকবেন, না ঝাঁপে থাকবেন? খাপে থাকবার মানে কি?
না-জন্তু এলে তাকে ধরে মারবার জন্য চুপ করে গুঁড়ি মেরে বসে থাকা। আর ঝাঁপে থাকার
মানে হচ্ছে, বনের ভিতরে গিয়ে ঝাঁপাঝাঁপি করে জন্তু তাড়িয়ে আনা।’
মজন্তালী ভাবলে, ‘আমার তাড়ায় আর কোন জন্তু ভয় পাবে!’ তাই সে বললে, ‘আমি ঝাঁপিয়ে যে
সব জন্তু পাঠাব, তা কি তোরা মারতে পারবি? তোরা ঝাঁপে যা, আমি খাপে থাকি।’
বাঘিনী বললে, ‘তাই তো, সে সব ভয়ানক জন্তু কি আমরা মারতে পারব? চল বাছারা, আমরা
ঝাঁপে যাই।’
এই বলে বাঘিনী তার ছানাগুলোকে নিয়ে বনের অন্য ধারে গিয়ে ভয়ানক ‘হাল্লুম-হাল্লুম’
করে জানোয়ারদের তাড়াতে লাগল। মজন্তালী জানোয়ারদের ডাক শুনে, একটা গাছের তলায় বসে
ভয়ে কাঁপতে লাগল।
খানিক বাদে একটা সজারু সড়-সড় করে সেই দিক পানে ছুটে এসেছে, আর মজন্তালী তাকে দেখে
‘মাগো’ বলে সেই গাছের একটা শিকড়ের তলায় গিয়ে লুকিয়েছে, এমন সময় একটা হাতি সেইখান
দিয়ে চলে গেল। সেই হাতির একটা পায়ের এক পাশ সেই শিকড়ের উপরে পড়েছিল, তাতেই বেচারা
মজন্তালীর পেট ফেটে গিয়ে, বেচারার প্রাণ যায় আর কি!
অনেকক্ষণ ঝাঁপাঝঁপি করে বাঘেরা ভাবল, ‘মজন্তালী মশাই না
জানি এতক্ষণে কত জন্তু
মেরেছেন, চল একবার দেখে আসি।’ তারা এসে মজন্তালীর দশা দেখে বললে, ‘হায়-হায়!
মজন্তালী মশায়ের এ কি হল?’
মজন্তালী বললে, ‘আর কি হবে? তোরা যে সব ছোট-ছোট জানোয়ার পাঠিয়েছিলি, দেখে
হাসতে-হাসতে আমার পেটই ফেটে গিয়েছে!’
এই বলে মজন্তালী মরে গেল।
পিঁপড়ে আর হাতি আর বামুনের চাকর
এক পিঁপড়ে ছিল আর তার পিঁপড়ী ছিল, আর তাদের দুজনের মধ্যে ভারি ভাব ছিল। একদিন
পিঁপড়ী বললে, ‘দেখ পিঁপড়ে, আমি যদি তোমার আগে মরি, তবে কিন্তু তুমি আমাকে গঙ্গায়
নিয়ে ফেলবে। কেমন পিঁপড়ে, ফেলবে তো?’
পিঁপড়ে বললে, ‘হ্যাঁ পিঁপড়ী, অবশ্যি ফেলব। আর আমি যদি তোমার আগে মরি, তবে কিন্ত
তুমি আমাকে গঙ্গায় নিয়ে ফেলবে। কেমন পিঁপড়ী, ফেলবে তো?’
পিঁপড়ী বললে, ‘তা আর বলতে, অবশ্যি ফেলব।’
এমনি দুজনের কথাবার্তা হয়েছে, তারপর একদিন পিঁপড়ী মরে গেল। তখন পিঁপড়ে অনেক কাঁদল,
তারপর ভাবল, ‘এখন পিঁপড়ীকে তো নিয়ে গঙ্গায় ফেলতে হয়।’
এই ভেবে সে পিঁপড়ীকে কাঁধে করে নিয়ে গঙ্গায় চলল। সেখান থেকে গঙ্গা অনেক দূরে, যেতে
অনেক দিন লাগে। পিঁপড়ে পিঁপড়ীকে কাঁধে নিয়ে সমস্ত দিন চলল। তারপর যখন সন্ধ্যা হল,
তখন সে দেখল যে রাজার হাতিশালে এসেছে-সেই যেখানে তাঁর সব হাতি থাকে। পিঁপড়ের বড্ড
পরিশ্রম হয়েছিল, তাই সে পিঁপড়ীকে নিয়ে সেইখানে বসে বিশ্রাম করতে লাগল। সেইখানে মস্ত
একটা হাতি বাঁধা ছিল, সেটা রাজার পাটহস্তী। হাতিটা শুঁড় নাড়ছিল, আর ফোঁস-ফোঁস করে
নিঃশ্বাস ফেলছিল, আর তাতে পিঁপড়ীকে সুদ্ধ পিঁপড়েকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কাজেই
পিঁপড়ে রেগে বললে, ‘খবরদার!’ হাতি কিন্তু তা শুনতে পেল না। সে আবার নিঃশ্বাস ফেললে,
আবার তাতে পিঁপড়েকে উড়িয়ে নিল। তাই পিঁপড়ে আরো রেগে খুব চেঁচিয়ে বলল, ‘এইয়ো!
খবরদার! ভালো হবে না কিন্তু! হতভাগা, পাজী!’
হাতি ভাবলে, ‘ভালোরে ভালো, ওখান থেকে কে আমায় চিঁ-চিঁ করে গাল দিচ্ছে? আমি তো
কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।’ এই বলে সে তার পা দিয়ে সে জায়গাটা ঘষে দিলে!
পিঁপড়ের তো এখন ভারি বিপদ! সে ভাবলে, ‘মাগো, এই বুঝি পিষে গেলুম!’ কিন্ত তারপরেই
সে দেখলে যে সে পিষে যায়নি, হাতির পায়ের তলায় যে ছোট-ছোট গর্ত থাকে, তারই একটায়
ঢুকে সে বেঁচে গিয়েছে, আর পিঁপড়ীকেও ছাড়েনি।
তখন আর তার আনন্দ দেখে কে? সেই গর্তের ভিতরে বসে সে হাতির পায়ের মাংশ খুঁড়ে খেতে
লাগল। যতক্ষণ না সে পিঁপড়ীকে নিয়ে একেবারে হাতির মাথার ভিতরে গিয়ে ঢুকেছিল, ততক্ষণে
সে খুঁড়তে ছাড়েনি।
হাতির কিন্তু তাতে ভারি অসুখ হল। সে খালি মাথা নাড়ে, আর চ্যাঁচায় আর পাগলের মতন
ছুটোছুটি করে। সকলে বললে, ‘হায়-হায়! হাতির কি হল?’ তারা কেউ জানে না যে, হাতির
মাথায় পিঁপড়ে ঢুকেছে। যদি জানত আর হাতির পায়ের তলায় খুব করে চিনি মাখাত, তাহলে সে
চিনির গন্ধে পিঁপড়ে তখুনি বেরিয়ে আসত। কিন্তু তারা তো আর তা জানে না! তারা বদ্যি
ডাকল, ওষুধ খাওয়াল, আর তাতে হাতি মরে গেল।
সেদিন রাত্রে রাজামশাই স্বপ্ন দেখলেন যে, তাঁর হাতি যেন এসে তাঁকে বলছে, ‘মহারাজ
তোমার জন্য আমি অনেক খেটেছি। আমাকে নিয়ে গঙ্গায় ফেলবে।’
সকালে ঘুম থেকে উঠেই রাজামশাই হুকুম দিলেন, ‘আমার হাতিকে নিয়ে গঙ্গায় ফেলতে হবে।’
তখুনি তিনশো লোক সেই হাতির পায়ে মোটা দড়ি বেঁধে, তাকে ‘হেইয়ো! হেইয়ো!’ করে
টেনে নিয়ে গঙ্গায় চলল। ভয়ানক বড় হাতি, তাকে টানা মুশকিল। সেই লোকগুলি তাকে নিয়ে
খানিক দূরে যায়, আর দড়ি ছেড়ে দিয়ে বসে হাঁপায়।
এমন সময় হয়েছে কি-সেইখান দিয়ে এক বামুনঠাকুর যাচ্ছেন, তাঁর সঙ্গে এক চাকর। সেই
লোকগুলিকে বসে হাঁপাতে দেখে সেই চাকরটা বললে, ‘ইদুরের মতো একটা হাতি, তাকে টানতে
গিয়ে তিনশো লোক হাঁপাচ্ছে! আমি হলে ওটাকে একলাই নিয়ে যেতে পারি।’
এ কথা শুনেই তো সেই তিনশো লোক লাফিয়ে উঠল। তারা বললে, ‘কি এত বড় কথা! আমরা
তিনশো লোক যা পারছিনে, তুই একলাই তা করতে পারবি? আচ্ছা, এর বিচার না হলে তো আমরা
আর তার হাতি টানছি না। চল্ বেটা, রাজার কাছে চল্, দেখব তুই কেমন জোয়ান?’
তাতে সেই চাকর বললে, ‘আচ্ছা চল্ না! আমি কি তোদের মত জোয়ান?’
তখন মাঠে হাতি ফেলে রেখে তারা সকলে রাজার কাছে এসে বললে, ‘দোহাই রাজামশাই, এর
বিচার করুন! আমরা তিনশো লোক আপনার হাতি টেনে হাঁপিয়ে গেলুম, আর এই বেটা বলছে
কিনা, সে একলাই সেটা নিয়ে যেতে পারে। এর বিচার না হলে আমরা আপনার হাতি ছোঁব না।’
একথা শুনেই রাজামশাই বামুনের চাকরকে বললেন, ‘কি রে, সত্যি কি তুই ঐ হাতি একলা নিয়ে
যেতে পারিস?’
চাকর জোড়হাতে নমস্কার করে বললে, ‘মহারাজের যদি হুকুম হয়, তবে পারি বইকি! কিন্ত আগে
আমাকে পেট ভরে চারটি খেতে দিতে হবে।’
রাজা বললেন, ‘দাও তো ওকে এক সের চাল আর ডাল তরকারি। আগে পেট ভরে খেয়ে নিক, তারপর
হাতি নিয়ে যেতে হবে।’
তাতে সে চাকর হেসে বললে, ‘এক সের চাল তো ঝাড়ুওয়ালা খায়-তাতে কি হাতি টানা চলে?’
রাজা বললেন, ‘তবে তুই কি চাস?’
চাকর বললে, ‘মহারাজ, বেশি আর কি চাইব?-এই মণ দুই চাল, দুটো খাসী আর এক মণ দই হলেই
চলবে।’
রাজা বললেন, ‘আচ্ছা তাই পাবি, কিন্ত খেতে হবে সব।’
চাকর বললে, ‘যে আজ্ঞে মহারাজ!’
বামুনের চাকর সেই দু মণ চালের ভাত আর দুটো খাসী, আর এক মণ দই নিয়ে পেট ভরে খেয়ে
তো আগে খুব এক চোট ঘুমিয়ে নিল।
তারপর নিজের গামছাখানি দিয়ে সেই হাতিটাকে জড়িয়ে, বেশ করে একটি পুঁটলি বাঁধল। তারপর
পুঁটলিকে লাঠির আগায় ঝুলিয়ে, সেই লাঠিসুদ্ধ সেই পুঁটুলি কাঁধে ফেলল। তারপর গণ্ডা
দশেক পান মুখে গুঁজে গান গাইতে গাইতে গঙ্গায় চলল। তা দেখে রাজামশাই হাঁ করে রইলেন,
আর তিনশো লোক হাঁ করে রইল, আর সকলে ছুটে বাড়িতে খবর দিতে গেল!
ততক্ষণে সে চাকর অনেক দূরে চলে গিয়েছে, আর খুব চনচনে রোদ উঠেছে। আরো অনেক দূর
গিয়ে চাকর বললে, ‘উঃ কি ভয়ানক রোদ! আমার গলাটা বড্ড শুকিয়ে গেছে, একটু জল খেতে
পেলে হত।’
বলতে-বলতেই সে দেখল যে খানিক দূরে একটি পুকুর রয়েছে, সেই পুকুরের ধারে গাছপালার
আড়ালে একটি কুঁড়ে ঘর। চাকরটি পুকুরের ধারে তার পুঁটুলিটি রেখে, সেই ঘরের কাছে গিয়ে
দেখলে, সেখানে একটি ছোট মেয়ে বসে আছে।
সে সেই মেয়েটিকে বললে, ‘বাছা, আমার বড্ড তেষ্টা পেয়েছে, একটু জল খেতে দেবে?’ মেয়েটি
বললে, ‘মোটে এক জলা জল আছে। তোমাকে যদি দিই, তবে বাবা মাঠ থেকে এসে কি খাবেন?’
একথা শুনে চাকর রেগে বললে, ‘বটে! তুই একটু জল খেতে দিবিনে? আচ্ছা, দেখি এরপর তোরা
কোত্থেকে জল খাস!’
এই বলে সে সেই পুকুরে নেমে, চোঁ-চোঁ করে জল খেতে লাগল। যতক্ষণ সেই পুকুরে জল ছিল,
ততক্ষণ খালি চোঁ-চোঁ শব্দ শোনা গিয়েছিল! দেখতে-দেখতে সে সেই এক পুকুর জল খেয়ে
শেষ করল! জল খেতে-খেতে তার পেটটা ফুলে আগে ঢাকের মতো হলো, তারপর হাতির মতো হলো,
শেষে একেবারে পাহাড়ের মতো হয়ে গেল। এমনি করে পুকুরের সব জল খেয়ে বামুনের চাকর দেখল
যে, সে জল আর কিছুতেই তার পেটে থাকতে চাচ্ছে না। তখন সে আর কি করবে, তাড়াতাড়ি একটা
বটগাছ গিলে ফেলল। সেই বটগাছ তার গলার মাঝামাঝি গিয়ে ছিপির মতো আটকে রইল-জল আর
বেরুতে পারল না।
তারপর বামুনের চাকর খুব খুশি হয়ে, সেই পুকুরের ধারে শুয়ে বিশ্রাম করতে লাগল। তার
পেটটা তালগাছের চেয়েও উঁচু হয়ে উঠল, যেন একটা পাহাড়! সেই মেয়েটির বাপ তখন মাঠে কাজ
করছিল। সে সেই পাহাড়ের মতো পেট দেখে ভাবল, ‘বাবা, না জানি ওটা কি!’ বলে সে
তাড়াতাড়ি বাড়িতে ছুটে এল।
সে বাড়িতে আসতেই তার মেয়ে বললে, ‘বাবা, দেখ কি দুষ্টু লোক! আমার কাছে জল চেয়েছিল।
ঘরে এক জালা বই জল নেই, ওকে দিলে তুমি এসে কি খাবে? তাই আমি জল দিইনি বলে আমাদের
পুকুরের সব জল খেয়ে ফেলেছে!’
বলতে-বলতে তারা দুজনে সেই চাকরের কাছে এল। সেখানে এসে সে মেয়েটি ভয়ানক নাক সিঁটকিয়ে
বললে, উঃ হুঁহুঁ! কি গন্ধ! দেখ বাবা, একটা পঁচা ইঁদুর না কি পুঁটুলিতে বেঁধে
এনেছে!’ এই বলে সে এক হাতে নাকে কাপড় দিয়ে, আর এক হাতের দু-আঙুলে সেই হাতিসুদ্ধ
পুঁটুলিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। সে পুঁটুলি পড়ল গিয়ে একেবারে সেই গঙ্গায়!
আর মেয়ের বাপ করেছে কি! কষে কোমড় বেঁধে মুখ খামুটি করে মেরেছে বামুনের চাকরের পেটে
এক লাথি! সে কি যেমন তেমন লাথি! লাথির চোটে, সেই বটগাছের চিপিসুদ্ধ তার পেটের সব
জল বেরিয়ে ঘর-বাড়ি, জিনিস-পত্র, মেয়ে-টেয়ে একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে গেল! বাকি রইল খালি
মেয়ের বাপ আর বামুনের চাকর। তখন তারা দুজনে মিলে কোলাকুলি করতে লাগল।
কোলাকুলি শেষ হলে সেই মেয়ের বাপ বললে, ‘আরে ভাই, ‘তোর মতন জোয়ান তো আর কোথাও
দেখিনি! এক পুকুর জল খেয়ে সব শেষ করলি!’
বামুনের চাকর বললে, ‘ভাই, তোর মতন জোয়ানও তো আমি আর কোথাও দেখিনি। এক লাথিতে
আমার পেট হালকা করে দিলি!’
এই কথা নিয়ে তখন তাদের মধ্যে ভারি তর্ক আরম্ভ হল। এ বলে তুই বেশি জোয়ান, ও বলে তুই
বেশি জোয়ান। এখন কার কথা ঠিক, তা কে বলবে!
অনেক তর্ক করে তারা এই ঠিক করলে, ‘চল একটা খুব বড় বাজারে গিয়ে দুজনে কুস্তি লড়ি,
তাহলেই দেখা যাবে কে বেশি জোয়ান!’
এই বলে তারা দুজন কুস্তি লড়তে বাজারে চলেছে, এমন সময় এক মেছুনীর সঙ্গে তাদের দেখা
হল। মেছুনী ঝুড়িতে করে মাছ নিয়ে বাজারে বেচতে যাচ্ছিল। তাদের দুজনকে দেখে জিগগেস
করলে, ‘হ্যাঁ গা, তোমরা কোথা যাচ্ছ?’
তারা বললে, বাজারে যাচ্ছি কুস্তি লড়তে।’
তা শুনে মেছুনী বললে, ‘বাজার তো ঢের দূর বাছা, এত কষ্ট করে তোরা সেখানে যাবি কি
করতে? তার চেয়ে আমার ঝুড়ির ভিতর এসে কুস্তি কর। কুস্তি করতে-করতে যার দিকে ঝুড়ি
ঝুঁকে পড়বে, আমি জানব তারই হার হয়েছে।’
শুনে তারা দুজনে বললে, ‘বাঃ বেশ কথা! কুস্তিও করতে পার, হাঁটতেও হবে না।’
এই বলে তারা মেছুনীর ঝুঁড়িতে ঢুকে কুস্তি আরম্ভ করল, আর মেছুনী সেই ঝুড়ি মাথায় করে
বাজারে চলল।
এমন সময় এক কাণ্ড হয়েছে। সেই দেশে এক সর্বনেশে চিল থাকত। সে গরু, মহিষ, হাতি, ঘোড়া
যা পেত তাই ধরে গিলত। খালি সেই মেছুনীর কাছে সে জব্দ ছিল। মেছুনীর ঝুড়ি ধরতে এলেই,
মেছুনী তাকে এমনি বকুনি দিত যে, সে পালাবার পথ পেত না। কিন্তু তাতে তার রাগ আরো
বেড়ে যেত আর ভাবত যে, যেমন করেই হোক একদিন ঐ ঝুঁড়িটা কেড়ে নিতেই হবে।
সেদিনও সেই চিল খাবার খুঁজতে বেরিয়েছে, দূর থেকে তার পাখার শোঁ-শোঁ শব্দ শোনা
যাচ্ছে।
এক গোয়ালা সাতশো মোষ মাঠে চরাতে এনেছিল। সে সেই শব্দ শুনে ভাবলে, ‘সর্বনাশ! ঐ
সেই চিল আসছে, আমার মোষ খেয়ে ফেলবে। এখন কি করি?’
এই ভেবে গোয়ালা সেই সাতশো মোষ ট্যাঁকে গুঁজে নিয়ে, ভোঁ-ভোঁ করে বাড়ির পানে
ছুটল।
বাড়ির লোক জিগগেস করল, ‘কি হয়েছে? অত যে ছুটে এলে?’
সে বললে, ‘ছুটব না! চিল আসছে যে, আমার মোষ খেয়ে ফেলবে।’
তারা বললে, তবে মোষ কোথায় রেখে এলে?’
সে বললে, ‘রেখে আসব কেন? সঙ্গে এনেছি।’
তারা বললে, ‘তবে কই মোষ?’
সে বললে, ‘এই দেখ না।’
বলে সে ট্যাঁক খুলে দিলে, আর সাতশো মোষ তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল।
তা দেখে তারা খুব খুশি হয়ে বললে, ‘ভাগ্যিস তুমি ট্যাঁকে করে নিয়ে এসেছিলে, নইলে আজ
সব মোষ খেয়ে ফেলত।’
সেই চিল তো খাবার খুঁজতেই বেরিয়েছে, আর মেছুনীর ঝুড়ির ভিতর থেকে দুই পালোয়ান
কুস্তি লড়ছে। মেছুনী খালি তাদের কথাই ভাবছে, চিলের কথা আর তার মনে নেই। ঠিক এমনি
সময় চিল তাকে দেখতে পেয়ে ছোঁ মেরে তার মাথা থেকে ঝুড়ি নিয়ে পালাল।
সেই দেশের রাজার মেয়ে ছাতে বসেছিলেন। দাসী তাঁর চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল।
রাজার মেয়ে আকাশের দিকে চেয়ে দেখছেন, এমন সময় তাঁর চোখে কি যেন পড়ল।
রাজার মেয়ে চোখ বুজে বললেন, ‘দাসী, দেখ দেখ, আমার চোখে কি পড়ছে!’
দাসী কাপড়ের কোণ পাকিয়ে, তাতে থুতু লাগিয়ে, তাই দিয়ে রাজকন্যার চোখের ভিতর থেকে
ভারি চমৎকার একটি ছোট্র কালো জিনিস বার করলে।
রাজকন্যা বললেন, ‘কি সুন্দর! কি সুন্দর! দাসী, এটা কি?’
দাসী বলতে পারলে না সেটা কি। বাড়ির ভিতরের সকলে দেখলে, কেউ বলতে পারলে না সেটা কি।
রাজা এলেন, মন্ত্রী এলেন, তাঁরাও বলতে পারলেন না সেটা কি।
তখন রাজা বড়-বড় পণ্ডিতদের ডাকিয়ে আনলেন।
তাঁদের কাছে এমন সব কল ছিল, যা দিয়ে পিঁপড়েটাকে হাতির মতন দেখা যায়। সেই কলের ভিতর
দিয়ে দেখে তাঁরা বললেন, ‘এটা তো দেখছি একটা ঝুড়ি, তার ভিতরে কতকগুলি মাছ আছে, আর
দুজন লোক কুস্তি লড়ছে।’
এক পিঁপড়ে, আর তার পিঁপড়ী ছিল। পিঁপড়ী বললে, ‘পিঁপড়ে, আমি বাপের বাড়ি যাব, নৌকো
নিয়ে এস।’ পিঁপড়ে একটি ধানের খোস ভাসিয়ে নিয়ে এল। পিঁপড়ী তা দেখে বললে, ‘কি সুন্দর
নৌকো! এস পিঁপড়ে, আমাকে বাপের বাড়ি নিয়ে চল।’ পিঁপড়ে আর পিঁপড়ী ধানের খোসার
নৌকায় উঠে বসে, নৌকো ছেড়ে দিল। খানিক দূরে গিয়ে সেই নৌকো চড়ায় আটকে গেল! তখন
পিপড়ে বললে, পিঁপড়ী, আমিও ঠেলি, তুমিও ঠেল!’
আমার কথাও ফুরিয়ে গেল!