ছায়ানট : আরম্ভ কথা
ওয়াহিদুল হক
ছায়ানট এখন বাঙালিত্ব চর্চার এক পীঠস্থান, যে বাঙালিত্বের মধ্য দিয়ে বিশ্বমানবতায়
পৌঁছাতে চায় ছায়ানট। এই চেষ্টার অংশ হিসেবে সে বাঙালির সঙ্গীতকে প্রচার প্রসার
প্রতিষ্ঠা ও
সর্বাঙ্গে তনি্নষ্ঠ চর্চার ভূমিকা পালনকে তুলে নিয়েছিল এবং এখনো তাই নিয়ে আছে৷
কিন\’ গোড়া থেকেই সংস্কৃতির সবটাই ছায়ানটের দৃষ্টি জুড়ে ছিল এবং সংস্কৃতি জন্ম দেয়
জাতীয়তার, দেশের, রাষ্ট্রের, রাজনীতির এবং পরম গুর\”ত্বের সমাজ-সুনীতির৷ ছায়ানটের
কাজটা এই সব কিছুর_ উদার-বিসত্মার এবং গভীর_ একাধারে ব্যাস্টিক ও সামষ্টিক
চরিতার্থতার সাধনা৷ কথাটা ভালো করে বোঝা যাবে এর আরম্ভটির প্রতি নজর দিলে৷ তখন
পাকিসত্মানের কাল৷ পূর্ব পাকিসত্মানের বাঙালিরা, বাঙালি বলে পৃথক জাতিসত্তা হিসেবে
রাষ্ট্রকতর্ৃক ছিল অস্বীকৃত৷ অখণ্ড পাকিসত্মানে পাঞ্জাবিরা পাঞ্জাবি ছিল, সিন্ধিরা
সিন্ধি, পখতুন পাঠানরাও ছিল তাদের আত্মপরিচয়ের গৌরব ধারণ করে৷ শুধু বাঙালির ওপর
ধার্য হয় বাঙালিত্বকে প্রাদেশিকতা জ্ঞানে ত্যাগ করে, নির্বিশেষ পাকিসত্মানি হওয়ার
দায়৷ এই চেষ্টায় ফলল বিষফসল৷ সব জাতিতে সব সময়েই কিছু দাস মনোভাবের দালাল থাকে৷
তাদের প্রকোপে বাঙালি শব্দটাই গেল ভুলে বাঙালি৷ ‘৪৭ থেকে ‘৫৪;
পাকিসত্মানের ২৩ বছরের আয়ুর মধ্যে ৭ বছর ধরে নিজের থেকেই আত্মপরিচয় মুছে নির্বিশেষ
পাকিসত্মানি হওয়ার চেষ্টা চালালো প্রচুর বাঙালি, বিশেষ করে তাদের অগ্রসর শ্রেণীর
মানুষ৷
ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন নামে একটা বড়সড় বাড়ি উঠেছে আজ ঢাকা মহানগরীর শঙ্কর মোড়ে৷ এটাই
কি বাংলাদেশের বিখ্যাত সেই ছায়ানট? হঁ্যা, এটাই বটে, কিন\’ এটাই কেবল নয়৷ এই
অট্টালিকায় লাখ ইট থাকতে পারে, ছয়তলাজুড়ে থাকতে পারে অযুত বর্গফুট মেঝে৷ কিন\’ এই
দৃশ্যমান স্পষ্ট অসত্মিত্বটি, ছায়ানটের ৪৫ বছরের জঙ্গম চলমানতার পূর্ণ ছবির ছোটই
একটা অংশ বটে৷ ছায়ানট, সংস্কৃতি-ভবন কথাটি ব্যবহার করেছে সেই অদৃশ্য দিকটায় ইঙ্গিত
করেই৷ দেখে তো ওকে সকলে একটা সঙ্গীত বিদ্যালয়ই ভেবে এসেছে বারবার, বুলবুল একাডেমির
মতো৷ কিন\’ সঙ্গীত তো সংস্কৃতির গুর\”ত্বপূর্ণ অংশ হলেও, ছোটই একটা এলাকা৷ ছায়ানট
এখন বাঙালিত্ব চর্চার এক পীঠস্থান, যে বাঙালিত্বের মধ্য দিয়ে বিশ্বমানবতায় পেঁৗছাতে
চায় ছায়ানট৷ এই চেষ্টার অংশ হিসেবে সে বাঙালির সঙ্গীতকে প্রচার প্রসার প্রতিষ্ঠা ও
সর্বাঙ্গে তনি্নষ্ঠ চর্চার ভূমিকা পালনকে তুলে নিয়েছিল এবং এখনো তাই নিয়ে আছে৷
কিন\’ গোড়া থেকেই সংস্কৃতির সবটাই ছায়ানটের দৃষ্টি জুড়ে ছিল এবং সংস্কৃতি জন্ম দেয়
জাতীয়তার, দেশের, রাষ্ট্রের, রাজনীতির এবং পরম গুর\”ত্বের সমাজ-সুনীতির৷ ছায়ানটের
কাজটা এই সব কিছুর_ উদার-বিসত্মার এবং গভীর_ একাধারে ব্যাস্টিক ও সামষ্টিক
চরিতার্থতার সাধনা৷
কথাটা ভালো করে বোঝা যাবে এর আরম্ভটির প্রতি নজর দিলে৷ তখন পাকিসত্মানের কাল৷ পূর্ব
পাকিসত্মানের বাঙালিরা, বাঙালি বলে পৃথক জাতিসত্তা হিসেবে রাষ্ট্রকতর্ৃক ছিল
অস্বীকৃত৷ অখণ্ড পাকিসত্মানে পাঞ্জাবিরা পাঞ্জাবি ছিল, সিন্ধিরা সিন্ধি, পখতুন
পাঠানরাও ছিল তাদের আত্মপরিচয়ের গৌরব ধারণ করে৷ শুধু বাঙালির ওপর ধার্য হয়
বাঙালিত্বকে প্রাদেশিকতা জ্ঞানে ত্যাগ করে, নির্বিশেষ পাকিসত্মানি হওয়ার দায়৷ এই
চেষ্টায় ফলল বিষফসল৷ সব জাতিতে সব সময়েই কিছু দাস মনোভাবের দালাল থাকে৷ তাদের
প্রকোপে বাঙালি শব্দটাই গেল ভুলে বাঙালি৷ ‘৪৭ থেকে ‘৫৪; পাকিসত্মানের ২৩ বছরের আয়ুর
মধ্যে ৭ বছর ধরে নিজের থেকেই আত্মপরিচয় মুছে নির্বিশেষ পাকিসত্মানি হওয়ার চেষ্টা
চালালো প্রচুর বাঙালি, বিশেষ করে তাদের অগ্রসর শ্রেণীর মানুষ৷
উল্টো ফল ফললো অচিরে৷ প্রথমে যা ছিল জিন্নাহ্র উদর্ুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার
আস্ফালনে৷ পাকিসত্মান সরকার পিছু হটল৷ ৫৬-এর প্রথম পাকিসত্মান সংবিধান মেনে নিল
অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে৷ কাজে পরিণত হয়নি তা কখনো৷ বাংলা স্বাধীন হলে
তার সুযোগ হয়েছিল, কিন\’ ‘৭৫-এর আগস্টে পাক-মার্কিন ষড়যন্ত্রকে চূড়ানত্ম সফলতা দিয়ে
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে এবং তাজউদ্দীনসহ চার মুক্তিযুদ্ধ সেনানিকে কারাভ্যনত্মরে
হত্যা করা হলে বাংলাকে রাষ্ট্রকার্যে, শিক্ষায়, ব্যবসায়-বানিজ্যে, সমাজ-জীবনে
যথাবিহিত প্রতিষ্ঠা দেওয়ার ব্যাপারটি সেনা অধিগ্রহণ ও স্বৈরশাসন তাকে তুলে দেয়৷
সংস্কৃতির মূল ঘটনা ভাষা, ভাষার যোগে এক হয়ে তবেই জাতি-রাষ্ট্র গঠিত হয়, স্বাধীন
স্বরাট৷ বাংলা ভাষা আবার মার খাওয়ায় বাঙালির স্বাধীনতা এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ
অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়৷ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পেঁৗছায় যে, যে কোনো দুষ্টমতি
বন্দুকধারী একার ইচ্ছায় এই রাষ্ট্র ও ১৫ কোটি দেশবাসীর মালিক হয়ে বসতে পারে৷
রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ র\”দ্ধ হলে রাষ্ট্রদেহ তার ইম্মিউন (প্রতিষেধ) ক্ষমতা
সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলে৷ এখন যেমন আবার ভাষা আন্দোলন হওয়াটা জর\”রি হয়ে পড়েছে৷
তার সঙ্গে সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ৷ ‘৬৫ থেকে ‘৭০-এ ছায়ানট নেতৃত্বে যে সংস্কৃতি
জাগরণ হয়েছিল, তার বহুগুণিত প্রতিধ্বনি এখনই প্রয়োজন৷
বাংলা তক্ষণি, ‘৫৬তেই, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কার্যকর হল না বটে, পাকিসত্মান-বিদায়
নাটকের প্রথম পর্ব অভিনীত হয়ে গেল তার আগে ‘৫৪তে৷
পাকিসত্মান সৃষ্টির মূল ওয়াসওয়াসা তথ্য উস্কানি ছিল মুসলিম লীগের, নায়ক ছিল লোভের
স্বপ্নে মশগুল বাঙালি চাষী-তাঁতী ও উঠতি মুষ্টিমেয় মধ্যবিত্ত মুসলিম
স্বাতন্ত্র্যবাদী৷ কিন\’ সে স্বপ্ন বাসত্মবায়নের রূপকার ছিল আবার ঐ মুসলিম লীগ৷ সেই
মুসলিম লীগকে বাংলার মানুষ চাপামাটি কবর দেয় ‘৫৪-এর নির্বাচনে৷ সেখান থেকে আজ অবধি
সেই কবরেই সে আছে৷ কিন\’ তার নষ্ট-দুষ্ট আত্মা নানাতর নতুন দুরাত্মাদের জন্ম দিয়ে
চলেছে বারে বারে৷ ইসলামি জাতীয়তাবাদের বেশ ধরে এ হাজির হয়েছে বাংলায় অযুত সহস্র
নরহত্যাকে সিদ্ধতা দিতে৷ মুক্তিযুদ্ধকে ভুলিয়ে দিতে, জাতিকে নিপাট বিস্মৃতি-পাথারে
ডুবিয়ে মারতে৷
কেবল মুসলিম লীগ তথা পাকিসত্মানের প্রাণ ভোমরাই যে জখম হয়েছিল চুয়ান্নয়, তা নয়৷
সাহিত্যে শিল্পে সঙ্গীতে মনন চর্চায় বান ডেকেছিল তখন৷ ঐ ধারা চলতে থাকলে দূরের
পাকিসত্মানকে তুচ্ছ করে বাঙালি নিজের কাজ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারত৷ সে কাজ আত্মশক্তি
অর্জনের কাজ, স্বাধীনতার যোগ্যতা অর্জনের কাজ৷ কেন্দ্রীয় পাক জুলুমবাজি দুর্বল হলে,
বাঙালি-সিন্ধি-পখতুনরা মাথা জাগাতে আরম্ভ করলে, পাকিসত্মানের প্রয়োজন পড়ল যে স্বল্প
গণতন্ত্র চর্চা জিন্নাহ আরম্ভ করে গিয়েছিলেন, তার মাথায় বাড়ি মেরে সেনা অধিগ্রহণ
করবার৷ আয়ুব অত্যনত্ম সফল সেনা একনায়ক ছিলেন৷ যার বুদ্ধিদীপ্ত শাসনে বাঙালি
প্রথমবারের মতো পয়সার মুখ দেখে, চাকরিতে, ব্যবসায়ও জায়গা পেতে আরম্ভ করে৷ কিন\’
তাতে পাকিসত্মানের নাগপাশ আরো কঠিন হয়ে জড়ায়৷ বাঙালিদের ভিতর দালালের সংখ্যা বেড়ে
যায় ভীতিকর হারে এবং একুনে পাকিসত্মানেরই আয়ু সঙ্কুচিত হয়ে আসে৷ সেই তখন থেকে
বাঙালির অংশবিশেষের ঐহিক উন্নতি আর তার সাংস্কৃতিক ধস যেন হাত ধরাধরি করে চলতে
শিখেছে৷ আয়ুব বাঙালির জন্য কোটা নির্ধারণ করে দেন ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগে, যা
পাকিসত্মানিরা বাঙালি শোবয় খাড়া করে নিয়ে যেত৷ তবু বাংলায় যত সচ্ছলতার হাওয়া বয় ততই
তার গলায় গোলামির জিঞ্জির কষে বসতে থাকে৷ আয়ুব বাঙালির বেয়াদবিকে চিরকালের জন্য দূর
করার জন্য অনেক যত্নে একের পর এক পদক্ষেপ নেন৷ পাকিসত্মান আর্ট কাউন্সিল করে তাতে
মুনীর চৌধুরীর মতো প্রতিভাবান বাঙালিকে নেতৃত্বের সুযোগ পাইয়ে দেন৷ রাইটার্স গিল্ড
তথা লেখক সংঘ গড়ে তাতে প্রায় সব বাঙালি লেখক-সাহিত্যিককে একটাই জোয়াল তুলে দেন
কাঁধে৷ বাংলা মুখপত্র বার হয় তার ‘পরিক্রম’, দপ্তরে বসে বর্ধমান একাডেমিস্থ বাংলা
একাডেমীর আউট-হাউসে৷ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী৷
লেখক সংঘের সম্পাদক করা হয় হাসান হাফিজুর রহমানকে৷ তার উত্সাহে মহাজৌলুসে সংঘ তিন
কবির মহোত্সব করে_ ইকবাল, রবীন্দ্রনাথ ও নজর\”ল৷ পাকিসত্মান জন্মাবধি ইকবালকে
বাঙালির গলা দিয়ে নামাতে চেষ্টা করে আসছিল৷ এই প্রথম বাঙালি তা গিললো_ হাসান
হাফিজুর রহমানের মতো আদর্শবাদী কবি এবং সাহিত্যিকদের আপসহীন নেতার হাতে৷ আয়ুব
ন্যাশনাল বু্যরো অব রিকন্সট্রাকশন করে কবীর চৌধুরীর মতো গ্রহণযোগ্য লেখক-অধ্যাপককে
তাতে আসীন করে বাঙালি লেখককুলের পয়সা ও প্রকাশনার (পাকিসত্মানবাদী) সুব্যবস্থা
করেন৷ পাকিসত্মানের দুই অংশের মধ্যে লেখক শিল্পীদের আনা নেওয়ায় জোয়ারই যেন সৃষ্টি
হয়৷
চুয়ান্নয় সম্মিলিত বাঙালির যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ নির্বাচনী জয় পেয়ে বঙ্গশাদর্ুল
(শেরে বাংলা) ফজলুল হকের নেতৃত্বে বাংলায় স্বায়ত্তশাসনপন্থী এক সরকার গঠন করেছিল৷
অচিরে ফজলুল হক সাহেবকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করে, পরবতর্ী সরকারেরও উচ্ছেদ ঘটিয়ে বাংলায়
কেন্দ্রীয় শাসন ঘোষণা করে পাকিসত্মান সরকার৷ ঐ শাসনকে বাঙালি যাতে মেনে নেয় সে জন্য
সেবারে পাকিসত্মান বাঙালিকে ঘুষ দিয়েছিল ঢাকায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নৃত্যগীত
মহোত্সব, পূর্ব পাকিসত্মান প্রেসক্লাব, ঢাকা স্টেডিয়াম৷ ওসবে ভবী ভোলেনি, বাঙালি
বাঙালিতায়, সৃজনশীলতায় ও বামপন্থায় ঝুঁকতেই থাকে৷ ছাপ্পান্নয় বাঙালির সরকার আবার
ফিরে এলে একটা স্বাধীনতার আবহে বাঙালি যেন ভাসতে থাকে৷ আয়ুবের সেনা অধিগ্রহণ আসে
ঠিক তারই প্রতিষেধক হিসেবে এবং আয়ুব সে কাজে সুপার সাফল্য পেয়েছিলেন৷ ষাট সনের
শেষে, তার দশক জোড়া মার্শাল লয়ের দাপটে বাঙালির উড়বার সাধ হাওয়া হয়ে যায়_ সারা দেশে
একটা পেয়ারা পাকিসত্মান হাওয়া বইতে আরম্ভ করে৷ চুয়ান্নর সব সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক
অর্জন স্মৃতিমাত্র বলেও সমাজের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না৷ রাষ্ট্রভাষা মতিন নামে
ভাষা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা আমাদের আজিমপুর গরিব পাড়ার ফ্ল্যাট থেকে আয়ুব খান
জিন্দাবাদ বলে চিরদিনের জন্য সম্পর্ক চুকিয়ে বেরিয়ে যান৷ মওলানা ভাসানীসহ
বামপন্থীদের একাংশ ‘চীনের বন্ধু আমার বন্ধু’ বলে আয়ুবের প্রকাশ্য দালালি আরম্ভ করে৷
আয়ুব আর পাকিসত্মান বাঙালির কপাল থেকে সরবে কোনোকালে, এমন কোনো আশার আলো কোথাও ছিল
না৷ এহেন সফল আত্মপ্রসন্ন আয়ুব প্রথম ধাক্কা খেলেন ঢাকার গভর্নর্স হাউসে (এখনকার
বঙ্গভবনে)৷ তার লেখক সংঘের মহাসমাবেশে আয়ুব কথার তোড়ে বলেছিলেন, বাঙালি তো পশুর
অধিক কিছু নয়৷ ছোটখাটো, চোখে প্রায় পড়ে না, সুফিয়া কামাল বলে উঠলেন, আপনি তো তাহলে
পশুরাজ(হায়ওয়ানোকে বাদশা)৷ আয়ুব অত্যনত্ম রেগে গেলেন, সমাবেশ গেল ভেঙে৷ কে জানত
ছায়ানটের ইতিহাস সুফিয়া কামালেরও ইতিহাস হয়ে যাবে৷ অচিরে বাঙালির আয়ুব ভীতি ভাঙল৷
প্রতিবাদী বাঙালি ভেবেছে আর ভেবেছে কিন\’ আয়ুববিরোধী কোনোই বিক্ষোভ সংগঠন করতে
পারেনি৷ এমনই চণ্ড শাসন ছিল আয়ুবের৷ সেই একষট্টির গোড়া থেকেই বিশ্বের সর্বত্র সাজ
সাজ রব উঠেছে_ সমাগত ঐ রবীন্দ্র-শতবার্ষিকী৷ বাঙালি ভাবে পূর্ব পাকিসত্মানেও তো
শতবার্ষিকী উদযাপন করতেই হবে৷ বাধা আসবে নিশ্চিত৷ তবু না করে তো পারা যাবে না৷ নানা
কৌশল ভাবা হল৷
শতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য কয়েকটি কমিটি হল৷ সমসত্ম আগ্রহী কমর্ীরা ঠিক করল বিচারপতি
মুর্শেদকে সভাপতি করে যে কমিটি, তারাই করবে প্রথম অনুষ্ঠান৷ বিচারপতি মুর্শেদকে
বাংলাদেশের প্রশাসন কেন, স্বয়ং আয়ুবও ঘাঁটাতে চাইবেন না৷ কিন\’ মুর্শেদ একা কীভাবে
অনুষ্ঠান করবেন, শিল্পী কোথায়, কমর্ী কোথায়?
পূর্বাঞ্চল কমিটি বলে গোপীবাগকেন্দ্রিক একটা কমিটি হয়েছিল৷ খবর দিল আনোয়ার জাহিদ৷
হঁ্যা, এখনকার চূড়ানত্ম সামপ্রদায়িক নেতা (?) এবং এরশাদের ঝাড়বরদার, স্বঘোষিত৷ ঐ
কমিটির সেও এক যুগ্ম সম্পাদক ছিল মনে পড়ে৷ তার টানে নয়, মোখলেসুর রহমান সিধু ভাই
আছেন, এবং তার সঙ্গে আছে তর\”ণ একঝাঁক কমর্ী৷ সেই ভরসায় আমি সে দলের যাবতীয়
অনুষ্ঠানের দায়িত্বে প্রবেশ করি৷
বাংলাদেশের (তখন পূর্ব পাকিসত্মান) তখন সবচেয়ে বড় সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ছিল বুলবুল
ললিতকলা কেন্দ্র৷ ওদের সাহায্য আমাদের চাই-ই চাই৷ উদ্বোধনী সম্মেলনে আমরা ১০০
শিল্পী চাই৷ কিন\’ পাই কোথায়? তাছাড়া ওখানে আছেন ভক্তিময় দাশগুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ থেকে
আসা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষক, মোহরদি-বীরেনদাদের বন্ধু৷ তাঁর নৃত্যনাট্যেও অভিজ্ঞতা
প্রচুর৷ এর ওপর শানত্মিনিকেতন প্রত্যাগত আতিকুল ইসলাম সেখানে যোগ দিয়েছেন সমপ্রতি
শিক্ষক হিসেবে৷ আর আছে সেখানে ভক্তিদার উজ্জ্বল ছাত্র সুগায়ক জাহিদুর রহিম বাবু৷
সমস্যা ছিল বুলবুল একাডেমি অর্থাত্ বাফা পাকিসত্মান কেন্দ্রীয় এবং পূর্ব
পাকিসত্মানের সরকার উভয় থেকে মোটা অনুদান পেত (৫+৩=৮ লাখ বছরে)৷ ঐ অনুদান চালু
রাখতে হলে বুলবুল একাডেমি কিছুতে স্বনামে শতবার্ষিকীতে কোনোই অবদান রাখতে পারবে না৷
মাহমুদ নূর\”ল হুদা বাফার প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি ছিলেন৷ অচ্ছেদ্য প্রীতির বন্ধন ছিল
তার সঙ্গে৷ কিন\’ প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম সব একা হাতে সামলাতেন আহমদ হোসেন, যুগ্ম
সম্পাদক, সম্ভবত আনিসুজ্জামানের সঙ্গে৷ এই আরেক মানিকজোড় পাই সংস্কৃতিচর্চার
ক্ষেত্রে৷ আমি আহমদকে বলি, তোমাদের ছেড়ে কী করে হবে এত বড় জিনিস? জায়গা, শিক্ষক সবই
দিতে হবে তোমাদের, কিন\’ প্রকাশ্যে নয়৷ তোমরা অফিসিয়ালি করলে না, আবার সব তোমরাই
করলে, কেমন হয়?
আহমেদ অত বড় একটা ঝুঁকি নিয়েছিল সেদিন৷ গানের ছেলেমেয়েদের বড় একটা অংশ ছিল বাফার৷
নাচেরও এবং ভক্তিদা আর আতিকের অকুণ্ঠ শ্রম ও উত্সাহ কোনোদিন ভোলার নয়৷ মহড়া চলল
পরিকল্পনামতো৷ কাজ তো কম নয়৷ মুর্শেদ কমিটির একদিন, প্রেস ক্লাব কমিটির দুদিন৷
পুর্বাঞ্চল কমিটির সাত দিনের অনুষ্ঠান৷ তিন সাড়ে তিনশ গান, দুটি নাটক, দুটি
নৃত্যনাট্য, একটা চিত্রপ্রদর্শনী, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী একাধিক, নাচের মহড়া, সঙ্গে
তো তার গানেরও মহড়া৷
ওদিকে আমাদের জহুর ভাই, জহুর হোসেন চৌধুরী, সরকারি মহলে নিত্য যোগাযোগ রেখেই
চলেছিলেন৷ যাতে কোনো হঠাত্-বিপদ না ঘটে যায়৷ জহুর ভাইয়ের হাস্য পরিহাসের মুগ্ধ
রসিক বয়স্য ছিলেন আয়ুব খাঁ এবং তাঁর যাতায়াত সোহবত ছিল পাক পাওয়ার ব্লকের প্রায়
সকলের সঙ্গে, এমনই অপ্রতিরোধ্য ছিলেন তিনি৷ সম্ভবত তিনি ছিলেন পূর্বাঞ্চল কমিটির
সহ-সভাপতি৷ ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সঙ্গে৷ কিন\’ রবীন্দ্রনাথকে
কেন্দ্র করে এ দেশে সরকারের নাকের ওপর বড় একটা কিছু ঘটে যাবে, এ হতে পারে না৷ পূর্ব
পাকিসত্মান সরকারের চিফ সেক্রেটারি আজফর যেন জানি দোসত্ম ছিলেন জহুর ভাইয়ের৷ আসল
ঘটনা সেয়ানে-সেয়ানে কোলাকুলি৷ শেষ মুহূর্ত পর্যনত্ম অর্থাত্ উত্সবের পাঁচ-ছয় দিন
আগে পর্যনত্ম সরকারি সিদ্ধানত্ম ছিল খোদ জহুর ভাইকেই জেলে ঠেলা এবং সঙ্গে ব্যাপক
ধরপাকড়৷ কি হল শেষে, সরকার ধরল আনোয়ার জাহিদকেই৷ আর কারও কিছু হলো না৷
শতবার্ষিকীর বড় অবদান যা কিনা বাংলাদেশের জন্য শত বছরের পথ বেঁধে দিয়েছিল, তার দুই
দিক৷ রাজনৈতিক তথা পাকিসত্মান ও সামপ্রদায়িকতাকে প্রত্যাখ্যান৷ দুই, রবীন্দ্র
আবাহনের মধ্যে দিয়ে তাকে অ্যাকাডেমির বাইরে এনে বাঙালির সংস্কৃতিসমগ্রের অনিঃশেষ
উত্সমুখ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠাদানের মধ্য দিয়ে সামপ্রদায়িক ভিত্তিতে দেশকর্তনে
পচতে থাকা ঘায়ের প্রতিষেধ নির্মাণ_ সুস্থতা ও সুন্দরের, শুভ ও সহিষ্ণুতার পথে ফেরা৷
সমাজ বিকাশের লক্ষ্যে, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সুবিচারের লক্ষ্যে ইতিবাচক
সাংস্কৃতিক চর্চারম্ভ৷ দেশে দেশমুখিতার মানসিকতা সৃষ্টির আয়োজন৷ দেশের সব চার\” ও
কার\” শিল্পের জন্য সমাজে সমাদর প্রতিষ্ঠা করা৷ বাইরে থেকে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী
উত্সব ছিল কেবলই কতক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের সমাহার৷ ভিতরটায় তার ছিল এসব সম্ভাবনার
হাতছানি ও প্রবণতা সৃষ্টিতে ভরা৷
ঢাকার অনুষ্ঠানমালা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও সারা দেশে শতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান চলতে থাকে
মাসাধিক কাল ধরে৷ আমার মনে পড়ে সন্জীদা খাতুনের পিছনে বসে দুই গণ্ডা অনুষ্ঠানে অংশ
নিয়েছিলাম৷ সব চুকে যেতে দেখা গেল কমর্ীদের উত্সাহ মোটেও ফুরায়নি৷ সিধু ভাইয়ের
প্রাণিত নেতৃত্বে আমরা জয়দেবপুরে গেলাম একটা সমাপনী সম্মিলনের জন্য৷ শরতের বেলা পড়ে
এসেছে, লম্বা হয়ে পড়ে থাকা গাছের ছায়াতে ভাওয়াল এস্টেটের ম্যানেজার বাড়ির আঙিনায়
আমরা শতেক কমর্ী কঠিন শপথ নিলাম আর ঘরে ফেরা নয়৷ তাহলে? সিধু ভাইয়ের নেতৃত্বে
কর্তব্য নির্ধারণী সভা বসল৷ সকলে একমত৷ শতবার্ষিকীর খুলে দেয়া পথে যাব আমরা৷
বাঙালিকে সংস্কৃতির পথে ফেরাব আমরা, লড়াইয়ের পথে ফেরাব৷ আমরা রবীন্দ্রধ্বজ কিছু
সংশপ্তক৷ সভাপতির জন্য হাতড়াতে হল না কারো৷ একবাক্যে সবাই নাম করল সুফিয়া কামালের৷
সম্পাদক হলেন ফরিদা হাসান, চা বাগান খ্যাত লুত্ফর রহমানের জ্যেষ্ঠা কন্যা৷ তার
স্বামী বানিয়াচঙ্গের জমিদার বংশের সয়ীদুল হাসান সরকারি চাকুরে হলেও সংস্কৃতি ও
দেশমনস্ক অভিজাত র\”চির মানুষ ছিলেন৷ তাই যেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অংশেই তাকে শহীদ
হতে হয়েছিল? সংগঠনের নাম তারই প্রসত্মাবানুযায়ী হল ছায়ানট৷ রাগের নাম, নজর\”লের
কাব্যগ্রন্থের নাম৷ কিন\’ সেই জন্যেই কি সবাই নামটা পছন্দ করে মেনে নিয়েছিল? মনে
অন্য কোনো ভাবনা ছিল নিশ্চয়৷ তখনো পাকিসত্মানের আয়ু বাকি ১০ বছর৷ লোকে বলে এই পুরো
সময়টা ছায়ানট যেন ছায়ায় ছায়ায় তার সংস্কৃতি রণনৃত্য নেচে গিয়েছে৷ সরকার পরিষ্কার
বুঝেছে ঘটনা কী ঘটে যাচ্ছে; কিন\’ কিছু তারা করতে পারছে না তার রোধকল্পে৷ গান দিয়ে
দ্বার খোলাব৷ বলেছিলেন রাজা, রানী সুদর্শনার বন্ধ দরজায় ঠেকে গিয়ে৷ ছায়ানট গানে
গানে স্বাধীনতার দরজা পর্যনত্ম সমাজকে নিয়ে যেতে থাকলেও তার ওপর সরাসরি হামলা সরকার
কখনও করতে পারেনি, সন্জীদা খাতুনকে সুদূর (তখন) রংপুরে শাসত্মিমূলক বদলিতে পাঠানো
ছাড়া৷
ছায়ানটের প্রথম বছরটি নিতানত্ম অকাজে যায়৷ সম্পাদকের সঙ্গে কমর্ীবাহিনীর কোনোরূপ
বনিবনাও না হওয়ায়৷ ছায়ানট নেমেছে মরণপণ যুদ্ধে, কর্মকর্তা চাইছেন অপেরা পার্টি৷
কিছুদিন কাজকর্ম বন্ধ একেবারে৷ কামর\”ন্নাহার লাইলী তখন অগি্নবষর্ী নেত্রী, ছাত্র
আন্দোলন ছেড়ে জাতীয় রাজনীতিতে আপন গুণে জায়গা করে নিচ্ছেন৷ আর কামাল লোহানী, আমাদের
শতবার্ষিকী উত্সবে শ্যামা নৃত্যনাট্যের বজ্রসেন_ দুজনে ধরে একদিন আমাকে প্রেস
ক্লাবে৷ আমি ধরি আহমেদুর রহমানকে, দু’জনে মিলে যাই সিধু ভাইয়ের কাছে৷ সিদ্ধানত্ম হয়
সম্পাদক কিছু না, আমরা কাজে নামব৷
কাজ আরম্ভ হয়েছিল পুরোনো গানের আসর দিয়ে৷ বাঙালিকে তার ইতিহাসের সঙ্গে অন্বিত করতে
হবে৷ পঞ্চদশ শতকের বিদ্যাপতির গান থাকল সে আসরে৷ তারও চেয়ে পুরোনো চর্যাপদের গান
করে ছায়ানট এই ধারায় কিন\’ অনেক পরে৷ পুরোনো গানের আসর পরিচালনায় এগিয়ে আসেন আব্দুল
আহাদ যার প্রশিক্ষণে রেকর্ডে গান করেছেন পঙ্কজ মলি্লক, হেমনত্ম মুখোপাধ্যায়ের মতো
শিল্পীরা৷ পশ্চাত্পট অাঁকেন নিতুন কুণ্ডু৷ দেবদাস চক্রবতর্ীর পরামর্শ নিয়ে৷
মঞ্চজোড়া নৃত্যরত রবি-বাউল, অবনীন্দ্রনাথের মূল জলরঙ ছবি থেকে নিয়ে৷ অনুষ্ঠানটি
মানুষ টানে, স্থায়ী প্রভাব ফেলে সমাজে৷ কিন\’ এই অনুষ্ঠান থেকেই প্রকট হতে থাকে
ছায়ানটের একটি অর্ধশতাব্দী-জোড়া দুর্বলতার দিক৷ কাজ করে গেছে ছায়ানট, কিছু তার
সাক্ষ্যপ্রমাণ সংরক্ষণ কার্যে ছায়ানটের সেই আরম্ভের অনীহা এখনো কাটল না৷ অথচ এখানে
প্রথম থেকে যুক্ত ছিলেন যশস্বী বহু লেখক-সাংবাদিক৷ এর মূলে অবশ্য ছিল একটি
প্রায়-দুঃসাধ্য চেষ্টা৷ প্রচার বিমুখতা৷ এবং অবশ্য সর্বাঙ্গীণ আন্দোলনমুখিনতাও৷
কাগজপত্র কিছুই তেমন করে সংরক্ষিত হত না৷ কবে ছায়ানটের প্রথম সভা হল, প্রথম কমিটিতে
কারা ছিলেন_ এসব জানানোর মতো কোনো কাগজ নেই৷ ছায়ানট এবং ফাইল দুটি পরস্পর সংহারক
শব্দ যেন৷
বলে নেওয়া ভালো যে, সেই প্রথম কালে ছায়ানট কোনো অনুদান গ্রহণ করেনি কোনো ব্যক্তি,
সংস্থা কিংবা প্রতিষ্ঠান থেকে যার জন্য অডিটোপযোগী হিসাব সংরক্ষণ করতে হবে৷
ছায়ানটের দেড় কুড়ি বয়স হওয়া পর্যনত্মও কোনো বেতনভুক হিসাবরক্ষক কিংবা কোনোই
কর্মচারী ছিল না৷ কর্মকর্তা একজন নিযুক্ত হয়েছেন মাত্রই বর্তমান বছরে_ যার আছে মোটে
বর্ধিষ্ণু এক সহযোগী বাহিনী৷ সংগঠনের এই ৪৫ বছর বয়সে৷ ছায়ানটের পরিচালনার এবং
যাবতীয় কর্ম ও প্রযোজনার ব্যাপারটি অর্থাত্ সংগঠনের প্রায় ষোলআনা কাজ পনেরআনা সময়
ধরে স্বেচ্ছাশ্রমভিত্তিক ছিল৷ এখনো পর্যনত্ম সেটাই ছায়ানটের প্রধান শক্তি এবং হয়তো
দুর্বলতাও৷ ছায়ানট একটা আন্দোলন ছিল সর্বার্থে যা সদ্যই, সময় ও কাজের চাপে, ধীরে
ধীরে, যেন নিয়তিনির্দিষ্টভাবেই প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে চলেছে৷
সেই প্রথম অনুষ্ঠান থেকেই ছায়ানটের প্রধান শক্তি ছিল এক দৃঢ়সংবদ্ধ নিবেদিতচিত্ত
কমর্ীবাহিনী৷ নেতৃত্বের ব্যাপারটি ছায়ানটে চিরকাল গৌণ ছিল৷ কমর্ীরা ছিলেন এক
লক্ষ্য৷ লক্ষ্য বাঙালি সংস্কৃতির সচেতন চর্চার প্রসার ও সমাজের দুর্যোগ-দুর্দশায়
সাধ্যমতো সাড়া দিতে গিয়ে সমাজকে গভীর করে জানা৷
যা হোক, আমরা গোড়ার কথায় ফিরে যাই৷ ছায়ানট সঙ্গীত ক্ষেত্রেই প্রধানত কাজ করবে, এমন
কিছু তখনো ঠিক হয়নি৷ তবে আমাদের কমর্ীদের মধ্যে সন্জীদা প্রথম থেকে যুক্ত থাকায় এ
যেন একটা ভবিতব্য দাঁড়িয়েই যায়৷ সন্জীদা রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীত করতেন পঞ্চাশ দশকের
গোড়া থেকেই৷ ছাপান্নতে বিয়ে করে সংসার পত্তন করার পর তার সংগঠন মনস্ক স্বামীর সঙ্গে
মিলে তিনি গীতালি নামে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত বিদ্যালয় গড়ে তোলেন৷ রবীন্দ্রনাথের
শানত্মিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ করার সময়ে তিনি
রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রায় সব পুরোধা শিল্পী ও শিক্ষকদের সংসর্গে আসায় তার জীবনে
সঙ্গীত পেয়েছে পাকা আসন৷ তিনিও পেয়েছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত-আচার্যাণী হিসেবে বিরল
অধিকার৷ আমাদের অনেকেই আগ্রহে প্রবণতায় জীবন-অভ্যাসে বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রোথিতমূল
মানুষ হলেও সংস্কৃতির কোনো এলাকায় ছায়ামানুষও ছিলাম না কেউ, সন্জীদা ছাড়া৷ কিন\’
সন্জীদা সঙ্গীতগুণে গুর\”ত্ববহ হলেও ছায়ানটের প্রথম বড় কাজ হয় বাষট্টিতে
দক্ষিণোপকূলে আঘাত-হানা গর্কি অথবা সুনামির কারণে সৃষ্টি দুর্যোগ মোকাবিলা করা৷
ত্রাণ নিয়ে যেতে হবে দক্ষিণে এবং ছায়ানট সরকারি পয়সা মেগে নেবে না কখনো৷ জন্মমাত্র
ঐ ধরনের জেদ ছিল দলটির৷ ভিক্ষা মিছিল করল ছায়ানট, পরপর তিনদিন৷ রাসত্মার পথচারী
থেকে, রিকশাচালক আর ভিখারিদের কাছ থেকে পাঁচ পয়সা দশ পয়সা করে নিয়ে জমল পঞ্চাশ
হাজার৷ মিছিলে আকর্ষণের বিষয় ছিল ভিক্ষা সঙ্গীত_ ভিক্ষা দাও গো পুরবাসী৷ আমার
স্মৃতিতে কী কবে মজুদ হয়ে গিয়েছিল সেই একটি পঙক্তি৷ তাই অবলম্বন করে সিধু ভাইয়ের
বাসায় (ততদিনে তা ছায়ানটের কার্যালয়) রাত জেগে লেখা হল, বাধা হল সে গান_ ইমন-কল্যাণ
রাগে এবং হল তার মহড়া৷ জীবনে আরেকটি গানবাঁধার সুযোগ পেয়েছিলাম৷ সেও দুর্যোগ
উপলক্ষে ১৯৭০-এর প্রলয়পারা জলোচ্ছ্বাসে দেশবাসীকে ত্রাণে উত্প্রাণিত করেছিল
ছায়ানট৷ ঈদের রমরমা বাজারে দক্ষিণের শোকবার্তা পথ খুঁজে পায়নি বাঙালির প্রাণে৷
নগ্নপদ শোক শোভাযাত্রা হয়েছিল, মাইল তিনেক লম্বা, বার করেছিল ছায়ানট৷ সম্ভবত
বাঙালির বিবেক জাগ্রত করার এই মিছিলে কালো ব্যানারে লেখা ছিল, কাঁদো বাঙালি কাঁদো৷
সুরকার সমর দাস বললেন, ভাই একটা গান লিখে দেন৷ মিছিল বেরোবার আগে প্রেসক্লাবে
জমায়েতের অবকাশে গান লেখা হল, সুর করা হল, সমর দাস হারমোনিয়াম গলায় বেঁধে মিছিলের
আগে আগে গেলেন, গাইতে গাইতে৷ সত্তরের প্রলয়ের কথা পরে হবে৷
চর শরতের ত্রাণের শেষ পর্যায়ে শহিদুল্লাহ কায়সার এসে যোগ দেন৷ ফেরার পথে দেখি
আমাদের টাকা কিছু বেঁচে গেছে৷ সম্পাদক হিসেবে লোহানী সেই টাকা দিয়ে এল বিধ্বসত্ম
আবুর হাট স্কুলগৃহ পুনর্নির্মাণ করতে৷ লোহানী আমাদের বজ্রসেন, ওর শরীরটা যেন তৈরি
ছিল রিলিফের কাজের উপযোগী করে, খুব জনপ্রিয় হত সে দুঃখী মানুষের মধ্যে তার জমাটি
স্বভাবের জন্য৷ এটাই তো দামি ত্রাণ৷ চর শরতের অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লেগেছে বারে
বারে৷ সত্তর সন পর্যনত্ম প্রতি দুর্যোগে ছায়ানট ত্রাণ নিয়ে হাজির হত উপদ্র\”ত
এলাকায়৷
সঙ্গীতবিদ্যায়তন
যাক, ঢাকায়ই ফিরি চর শরত থেকে৷ বর্ষা গিয়ে শীত নামে৷ তেমন কিছু অনুষ্ঠানও দাঁড়াচ্ছে
না৷ অনুষ্ঠান করতে গেলে শিল্পী লাগে৷ শিল্পী তৈরি করতে হবে৷ আমাদের ধারা অনুষ্ঠান
করতে প্রয়োজন প্রচুর শিল্পী৷ অনত্মত দশজন একক শিল্পী, বিশজন সম্মেলক গাইয়ে লাগবে৷
কোনো ব্যবস্থা নেই৷ শতবার্ষিকীর ডাকে যা পাওয়া গিয়েছিল, সে কেন প্রতিমাসে ঘটবে? এসব
মাথার ভিতর কামড়াচ্ছিল শীত সকালে নির্জন নিমর্ীয়মাণ অবজার্ভার ভবনে বসে৷ তার কাঁচা
ক্যান্টিন ঘর থেকে গান ভেসে আসে ভৈরবী৷ বিষণ্ন কিন\’ মধুর৷ যেন মতিঝিলেই একটা উদাস
প্রানত্মর গড়ে দিচ্ছে৷ এ গান কেন আমার দেশে জীবনত্ম কেউ গাইবে না, পাড়ায় পাড়ায়,
পায়ে পথ চলতে চলতে৷ কেমন করে এ স্বপ্ন সফল হবে?
এই সময়ে সন্জীদার কর্মস্থল ছিল বাংলা একাডেমী৷ বাংলা একাডেমীর একাধিক বারান্দা কাজে
লাগিয়ে আরম্ভ হয় ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তনের নিয়মিত ক্লাস৷ সে আমলের ছাত্র আহসান
মুর্শেদ৷ ক্লাস আরম্ভ হওয়ার আগে সন্জীদা ও আমি যাই সোহরাব ভাই ও বজলুল করিম ভাইয়ের
কাছে৷ তারা রাজি হন ক্লাস নিতে৷ মতি মিঞা একা খেয়াল ও প্রাচীন বাংলা গান এবং
বেহালা-সেতার শেখাতে আরম্ভ করলেন, সোহরাব ভাই নজর\”ল গীতি, বজলুল করিম তবলা ও
সন্জীদা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্লাস নিতে আরম্ভ করল৷ আমরা যখন অধ্যাপক টার্নার সাহেবের
ইংলিশ প্রিপারেটরী স্কুলে জায়গা পাই তখন ঘটা করে, এক পহেলা বৈশাখে আমরা যেন,
উসত্মাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবকে নিয়ে নতুন করে ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তনের উদ্বোধন
করাই৷ এখানে নতুন শিক্ষক আসেন খুরশীদ খাঁ, সেতারে৷ ছাত্রী হয় সেলিনা, ইফ্ফাত,
সাদিয়া৷ ছাত্র মাহমুদুর রহমান বেনু উত্তর-জীবনে ছায়ানট-প্রাণ বলে নিজেকে প্রমাণ ও
প্রতিষ্ঠা করে৷
বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠায় ছায়ানট কমিটি খুব উত্সাহী ছিলেন না৷ শিল্পী তৈরি আরম্ভ হতেই
ছায়ানটের শ্রেষ্ঠ অবদান তার অনুষ্ঠানগুলোও আরম্ভ হয়ে যায়৷ কিন\’ ছায়ানট কেন যে
পাকিসত্মান দিবসের অনুষ্ঠান করে না, ইকবালজয়নত্মী না করে কেবলই রবীন্দ্রজয়নত্মী করে
এমন কি আরম্ভ করে দেয় বলধা বাগানে শারদোত্সব এবং মুক্ত আঙিনায় বসনত্মোত্সব_ এ
নিয়ে ছায়ানটের পায়াভারি বেশ কিছু সদস্যের কটু এবং পৌনঃপুনিক সমালোচনা ছিল৷
গণতন্ত্র মাথায় থাকুন, কাজ তো করি আমরা৷ সন্জীদা, আমি, নতুন যুক্ত হওয়া জিয়াউদ্দিন_
খুলনার, জহির কুমিল্লার এবং রোজবু, মাক্কিবু, জুয়েলার মা৷ আমরা এবং সিধু ভাই এক মতে
থাকলে কোনো কাজ করতে কিংবা না করতে আমরা পারিই তো৷ কমিটি যাই বলুন ইকবালজয়নত্মী
আমরা করব না এবং ভাবতেই থাকব আরো কি কিছু ঋতু-ভিত্তিক উত্সব করা যায় না_
বর্ষামঙ্গল, নবান্ন? আরম্ভ থেকেই ছায়ানট অলঙ্কারবর্জিত কর্মীপ্রধান সংগঠন৷ যা করি
তার সবকিছুতে আমি সরাসরি গিয়ে সুফিয়া খালার সঙ্গে আলাপ করি, অনুমতি নেই৷ ইংলিশ
প্রিপারেটরীতে নিয়মিত বসবার জায়গা পেয়ে ছাত্রছাত্রী বাড়তে থাকে, অনুষ্ঠান বাড়তে
থাকে৷ বাড়তে বাড়তে এক সময়ে ছেষট্টি, সাতষট্টি থেকে, বারো মাসে তের পার্বণ যেমন,
ছায়ানট এক বর্ষাকালে ডজনাধিক অনুষ্ঠান করতে আরম্ভ করে৷
দাঙ্গা প্রতিরোধ
তার আগের বড় ঘটনা চৌষট্টির দাঙ্গা এবং একলা ছায়ানটের তা প্রতিরোধ৷ চৌষট্টির
জানুয়ারিতেই কাশ্মিরে কোনো মসজিদ থেকে হজরত মুহম্মদের কেশদামের কথিত এক গুচ্ছ চুরি
যায় এবং একে ঘিরে ধুমিয়ে ওঠে সামপ্রদায়িক দাঙ্গা৷ ভারতে৷ আয়ুব-মন্ত্রী খুলনার খান এ
সবুর৷ তার বাড়ির হাতায় তিনশ ধোপা কাপড় কাচতো৷ জায়গাটা আটকা পড়েছিল৷ কাশ্মিরে কেন
হযরত-চিহ্ন চুরি গেল, তার দায়ে ধোপারা হলো কচুকাটা৷ দেশের আর কোথাও কিছু হলো না,
ঢাকা শহরে দাঙ্গার উদ্যোগ শুর\” হয়ে গেলো৷ গোড়াতেই এর উত্সাদন-কল্পে ছায়ানটের ডাকে
ঢাকার সুধী সমাজ রাসত্মায় নামে, শানত্মি মিছিল বেরোয়, দীর্ঘ এবং ফলপ্রসূ৷ মিছিল এবং
সক্রিয় প্রতিরোধে ঢাকায় আর কিছু হয়নি৷ ওয়ারী এলাকার প্রায় দেড়শত হিন্দু পরিবারকে
কয়েকদিনের জন্য সিধু ভাইয়ের প্রশসত্ম বাড়িতে স্থানানত্মর করে ছায়ানট এবং ‘বলপূর্বক’
ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক হেমনত্ম কুমার ঘোষ, অর্থাত্ আমাদের মানিকদা ও তার পরিজন
ডলিদি এনুদিকেও স্থানানত্মর করা হয়৷ রোজবুর ভাই আবু রাইফেল কাঁধে রাত জেগে সকলকে
পাহারা দেয়৷ বাহাত্তর ঘণ্টা কাফর্ুর ছত্রিশ ঘণ্টা গেলে আমি আর আহমেদুর রহমান দুইজন
মোটরসাইকেলে, কাফর্ু ভেঙে, প্রতু্যষে প্রেসক্লাবে উপস্থিত হয়ে জানতে পারি
সাভার-কালিয়াকৈর ও ডেমরা অঞ্চলে প্রচুর মানুষ মারা গেছে৷
এখনো হাজার হাজার মানুষ নানা জায়গায়, নিরাপত্তার আশায় জড় হয়ে মানবেতর জীবনযাপন
করছে৷ রেজা আলীর একটা পিকআপে কয় মণ চাল-ডাল চাপিয়ে আমরা রওনা হয়ে যাই অকুস্থলে৷
সাভারে অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের আঙিনায় দশ হাজার মানুষ যেখানে হাগছে সেখানেই
খাচ্ছে_ আবালবৃদ্ধবনিতা আতঙ্কগ্রসত্ম সকলে৷ এটা আপনাদের দেশ, উঠে দাঁড়ান, আতঙ্কিত
হবেন না_ এইমত কথা বলতে গিয়ে গলায় আটকে গেল_ নিজের কাছেই বড় মিথ্যা, বড় শূন্যগর্ভ
শোনাল৷ সেখান থেকে পালাতে গিয়ে দেখি ইদ্রিস কাকা৷ বললেন এখানে কী দেখছ, যাও
আশুলিয়া, জিরাবো৷ গেলাম জিরাবো গ্রাম আর টঙ্গী শিল্পাঞ্চলের মাঝখানে নিম্নাঞ্চল,
বর্ষায় ডুবে গিয়ে সাগর হয়৷ শীতে আদিগনত্ম প্রানত্মর৷ সেই প্রানত্মরে ছড়িয়ে পড়ে আছে
শত শত লাশ৷ ঘুরে দেখা গেল সবাই মৃত নয়৷ গাড়ি সংগ্রহ করে প্রায় দু’শ ঢাকায় পাঠানো
হলো মেডিকেল হাসপাতালে৷ সেখানে তখন চলছে চিকিত্সক ধর্মঘট৷ অসাধ্য করলো ছাত্র
ইউনিয়নের মেডিকেল ছাত্ররা৷ তখন যে দাঙ্গা-ত্রাণ কাজে জড়িয়েছিল ছায়ানট, তার জের
চলছিল তিন মাস৷ সেই ত্রাণেই সারোয়ার আলী রেজা আলীরা আমাদের অনেক কাছে চলে আসে৷
চৌষট্টির সেই সারোয়ার আজ ছায়ানট ভবনের ট্রাস্টি৷
দুর্গতি-রোধ, দুর্গতকে ত্রাণ সেই তখন থেকে ছায়ানটের কাজ৷
ধর্মস্থলে সংস্কৃতি ভিত্তি
পঁয়ষট্টিতেই পাক-ভারত যুদ্ধে বাধে৷ বাংলা যেন পাকিসত্মানের অংশ নয়,_ এই ভাব প্রকট
করে তুলে কেন্দ্রীয় পাকিসত্মান সরকার এদেশে কোনোই প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ
করে না৷ পক্ষানত্মরে, বাঙালি এ যুদ্ধে তার মাতৃভূমি আক্রানত্ম এরূপ কোনোই প্রমাণ না
পেয়ে বরফ-শীতল নির্লিপ্ত থাকে৷ এই নির্লিপ্তি ভাঙাবার জন্য পাকিসত্মান বিমানবাহিনী
ঢাকা আজিমপুর এতিমখানায় ও লালমনিরহাটে বোমা ফেলে ও প্রচার করে যে ভারতীয়রা বাংলা
আক্রমণ করেছে৷ এ ষড়যন্ত্র বাঙালিকে আরো দূরে ঠেলে৷ ফলে ছেষট্টিতেই শেখ মুজিবুর
রহমান বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের সনদ ছয় দফা প্রকাশ করেন৷ এক টানে তিনি যেন রাজনীতির
কথা পাকিসত্মানের ভিত্তিমূল-স্বরূপ ধর্মকে সরিয়ে সংস্কৃতি তথা বাঙালিত্বকে প্রোথিত
করেন৷ এদেশের মানসিকতা থেকে পাকিসত্মান দ্র\”ত অপহৃত হতে থাকে৷ এদেশের, এ মানুষের
কর্মে-বচনে-জীবনে সংস্কৃতিকে মূল আশ্রয় করার সাধনা ছিল ছায়ানটের৷ ক্ষেত্র বেছে নেয়
সে জন্য প্রধানত সঙ্গীতকে৷ কেবলি সঙ্গীত নয়৷ ছায়ানট যে আমন্ত্রণলিপি পাঠাতো
অনুষ্ঠানের, তাতে দেশের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের চিত্রণ-লিপ্যন থাকতো বঙ্গসুষমায় মাখা৷
নিতুন কুণ্ডু, এদেশে সেরিগ্রাফ মাধ্যমের প্রথম শিল্পী, ছায়ানটের একটি আমন্ত্রণলিপি_
শারদোত্সবের_ করেন তার একেবারে প্রথম দিককার সেরিগ্রাফ দিয়ে৷ চাপ চাপ রঙ_নীল হলুদ
ফুটে উঠেছে কাগজ ছাড়িয়ে৷ হাতে লাগছে তার ধার_ চোখে বুলিয়ে দিচ্ছে তা শরতের অমল
মহিমা৷
সংস্কৃতি-ভিত্তিক জাতীয়তার আন্দোলনে শেখ মুজিবের (তিনি তখনো বঙ্গবন্ধু হননি)৷
যুগানত্মর-আনা অবদানের পাশাপাশি ছায়ানট সাজায় তার যোগ্য নৈবেদ্য_ দেশমাতৃকার পায়ে
পহেলা বৈশাখের নববর্ষ আবাহন_ নিশাবসানের শুভ্রতায় রমনা প্রানত্মরের উদারতায়,
আশিস্বিসত্মারি এক বোধিদ্র\”মমূলে৷ অচিরেই তা জাতীয় উত্সবে পরিণত হয়৷
দেশ ছয় দফা থেকে অমোঘ পদসঞ্চারে গণঅভু্যত্থানের দিকে চলেই যেতে থাকে৷ ছায়ানট এখন
নিয়মিত চারটা বড় অনুষ্ঠান করে, তার মধ্যে একটি মাত্র মিলনায়তনে, তিনটি উন্মুক্ত
প্রকৃতির কোলে, হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতাধন্য হয়ে৷ পহেলা বৈশাখ, শারদোত্সব, কেবল
বর্ষামঙ্গলটি হয় চার দেওয়ালে ঘেরা ছাদে-ঢাকা জায়গায়৷
টেলিভিশন ও ছায়ানট
ঢাকায় পাকিসত্মান টেলিভিশনের প্রথম কেন্দ্রের উদ্বোধন হয় ১৯৬৪’র পঁচিশে ডিসেম্বর৷
বেসরকারি এই পাইলট প্রজেক্ট প্রধান হয়ে আসেন কট্টর বাঙালি জামিল চৌধুরী_ সন্জীদার
বন্ধু ও ছায়ানট বন্ধু নুর\”ন্নাহার-সাইফুদ্দৌলাদের ভগ্নীপতি৷ জামিল চৌধুরী তার
প্রোগ্রাম প্রধান করে নেন সকলের প্রিয় কলিম শরাফীকে৷ অনুষ্ঠান বিভাগের সকল
কর্মকাণ্ড চালাতেন মেডিকেল শিক্ষা ত্যাগ করে ড্রামা সার্কল নাটকের দলে যোগ দেওয়া
মনির\”ল আলম৷ আমরা সকলে তাকে ডাক্তার বলে ডাকতাম৷ টেলিভিশনের শিল্পী চাহিদা পূরণ
সহজে হয়নি৷ ডাক্তার প্রায়ই এসে ছায়ানটের নতুন জায়গা অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ের
বারান্দায় বসে থাকতেন_ শিল্পী ধরার আশায়৷ ছায়ানট নীতিগতভাবে পাকিসত্মান রেডিওর
সঙ্গে কোনো সহযোগিতা করেনি৷ টেলিভিশন নতুন মাধ্যম এবং ঢাকা টেলিভিশন সম্পূর্ণত
বাঙালি কর্মকর্তা ও কুশলী দ্বারা পরিচালিত হতো বলে, ছায়ানট এদের সঙ্গে সহযোগিতায়
যায়৷ এই সহযোগিতার নীতিতে ছায়ানটকে ঠকতে হয়নি, ঢাকা টেলিভিশন ছিল সুকানত্মর ‘বাংলার
মাটি দুর্জয় ঘাঁটি’৷ তার পিছনে ছায়ানট ও জামিল চৌধুরীর ভূমিকা বড় ছিল বৈকি৷
চৌষট্টি সনে আরম্ভ হওয়া এ সহযোগিতা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বাদে, পঁচাত্তরের পনেরই
আগস্ট পর্যনত্ম অটুট ছিল৷ সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা ছিল রামপুরায়
বিটিভির নতুন ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের৷ তার উদ্বোধনী ভীষণ রচনার ভার আমাকে দেন৷
সেই ভাষণটি আর তার দেওয়া হয়নি৷ সেদিনই প্রতু্যষকালে তিনি ব্যক্তি থেকে ইতিহাসে
পরিণত হন৷ বাঙালিকে যেমন বারে বারে ফিরতে হবে শহীদ মিনারের বেদিমূলে, তেমনি যেতে
হবে তাকে মুজিব-স্মৃতিতেও ফিরে ফিরে, তার দেশ, তার মানুষ, তার সংস্কৃতির যোগ্য
উজ্জীবন ও বিকাশের স্বার্থে৷
প্রলয় সুনামি
সত্তরের ১২ নভেম্বর সুনামি বা গর্কি অর্থাত্ সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আঘাত করে দক্ষিণ
উপকূলের সবটাতে৷ সেবারে শীতেই ছিল, চৌষট্টির দাঙ্গার মতো,_ রোজার ঈদ৷ শপিং-পাগল
শহরবাসী বাঙালি লক্ষই করলো না দক্ষিণে লক্ষ মৃতু্য একদিনের সমুদ্রাঘাতে৷ চেতনা এবং
বিবেক ফিরে আবার কয়েক মাইল লম্বা নগ্নপদ মৌন মিছিলে৷ বুলবুল একাডেমি (আতিকুল
ইসলাম) ও চলচ্চিত্র শিল্পী সংসদকে (হাসান ইমাম) সঙ্গে করে ছায়ানট প্রতিষ্ঠা করে
দুর্যোগ নিরোধ আন্দোলন৷ স্টেডিয়ামে আয়োজিত চলচ্চিত্র শিল্পীদের ফুটবল খেলা জনতার
আগ্রহাধিক্যে পণ্ড হয়ে যায়৷ তার আগেই ষোল হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হয়ে যায়৷
ওদিকে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে যতই উপদ্র\”ত এলাকার খবর বাড়ছে৷ দু’লাখ, চার লাখ৷ সরকারি
হিসাব পাঁচ লাখে এসে থামলেও সংবাদপত্রে কর্মরত আমরা বুঝেছিলাম কম হলেও দশ লক্ষ
মানুষ, নারী পুর\”ষ শিশু মরেছে ডুবে কিংবা অনাহারে, পানীয় জলের অভাবে৷ কিংবা
সমুদ্রে ভেসে গিয়ে৷ ষোল হাজার টাকার সামান্য ত্রাণ নিয়ে চলে যাই আমরা ভোলার চর
শশীভূষণে, তেঁতুলিয়া কিংবা বুড়া গৌরাঙ্গ নামের নদীমোহনা তথা সমুদ্রেরই পারে৷
দলনেতা পটুয়া কামর\”ল হাসান, তার ১৯৩৭ সনের মি. বেঙ্গল হওয়া সত্তরে মর্চে পড়া শরীরে
নবযৌবন-উদগমে বাঁধ-না-মানা উত্সাহে চরের সমসত্ম গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকিট
বিলি করে আসেন৷ সূর্যাসত্মের পরে ক্লানত্ম ঢলে পড়া দেহ নিয়ে সকল ছেলেদের নিয়ে নোঙর
করা লঞ্চে ফিরে গিয়ে দেখেন মঞ্চ মাঝনদীতে, মাইল দূরে৷ বিদ্রোহ ছড়ায় মুহূর্তে৷ নানা
খেলায় মাতিয়ে ওদের ভোলাতে হয়, কিন\’ খিদে তাতে কিছু কমে না৷ বঙ্গোপসাগর উপকূলে
পৃথিবীর সবচাইতে উঁচু-নিচু জোয়ার-ভাটা হয়৷ আমরা গ্রাম থেকে ফিরতে জল নেমে গেছে আঠার
ফিট৷ লঞ্চকে নোঙর তুলে মাঝদরিয়ায় যেতে হয়েছে৷ চাঁদ উঠলে জল বাড়বে, লঞ্চ আসবে কূলে৷
সাত সকালে যেন মেলা বসে যায়৷ গ্রামবাসী আসছে৷ স্বেচ্ছাসেবীরা দোকান নিয়ে বসেছে চাল
ডালের, কাপড়ের, নারকেল-কাতার৷ লুঙ্গি পরা, কোমরে গামছা বাঁধা হাসান ইমামের গোরা রং
যেন ফেটে পড়ছে৷ হাসানের ওই রূপ জীবনে ভুলবো না৷ দূরে নামলো এক হেলিকপ্টার৷ উচ্চ
রাজকর্মকর্তা ছুটে এলেন সেখান থেকে৷ ব্যসত্ম হাসানকে দেখে মুগ্ধ, সেই কিনা সমসত্ম
অপারেশনটা চালাচ্ছে৷ সবিনয়ে অফিসার জানায় পাকিসত্মানের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী
আছেন হেলিকপ্টারে৷ একটু কথা বলতে চান৷ বারবার তিনবার হাসান তাকে ভাগায়, মারতে যায়
শেষে৷ মিনিস্টার চুলায় যাক, আমরা এখানে ব্যসত্ম, দেখতে পাচ্ছেন না৷ মিনিস্টার
আব্দুল মালেক, সেই যে শতবার্ষিকীতে অপূর্ব গেয়েছিল ফাহমিদা মালিক, তার বাবা, আমাদের
বন্ধু শানত্মিনিকেতন-ফেরত বীথির কাকা, করাচি ফেরার পথে ঢাকায় গভর্নর আহসানকে বলে
যান কেউ কিসসু করছে না৷ শশীভূষণের ওই দলটি ছাড়া৷ ওদের যত পারো কাজে লাগাও৷ আমরা
ঢাকায় ফিরতেই পাই গভর্নর হাউসের এত্তেলা৷ সময় খারাপ, তাই যেতে হয়৷ মিটিং সরকারের
সচিবদের সঙ্গে৷ জানাই, এমন জায়গায় যেতে চাই যেখানে সরকার পেঁৗছাতে পারে না৷ ত্রাণ
সচিব, যোগাযোগ সচিব পদের লোকদের সঙ্গে আলাপ করে জায়গা ঠিক করেন পটুয়াখালির গলাচিপা
থানার চর বিশ্বাস ইউনিয়নই তেমন জায়গা৷ নয়টা চর, ভাসছে সমুদ্রজলে৷ আমরা বলি চললাম,
কিন\’ কী নিয়ে যাব? সে ভাববেন না, ক্যাশ খরচ কিছু নিয়ে যান, বলে চেক বই বাড়ান তারা৷
আমি কম্পিত হসত্মে লিখি তিন লাখ৷ শেষ পর্যনত্ম পঞ্চাশ লাখ লেগেছিল সেই অপারেশনে৷
সরকারি ত্রাণসামগ্রী ছাড়াই৷
কাজল নদীর পাড়ে আমরা তাঁবু ফেলি কুড়িটা ছোট্ট একটা নাক-জাগানো জায়গায়৷ ওখানে ডাম্প
করি আমাদের ত্রাণসামগ্রী যা বয়ে নিয়ে এসেছে তিনটা কোস্টার একটা লাইটারেজ জাহাজ৷ ভরে
উঠলো জায়গাটা৷ দুশো স্বেচ্ছাসেবী এসেছে৷ তারা কোলাহলে মাতল, সাবান চাই, এই বেলা
মাংস চাই পাতে৷ ওই লঞ্চে করেই পঞ্চাশ জনকে ফেরত পাঠাই৷ আর জলের ধার ঘেঁষে বাঁশ পুতে
দড়ি দিয়ে বেঁধে তাতে ঝুলাই তিনশ’, হঁ্যা তিনশত হারিকেন বাতি৷ ভয়টা ডাকাতির৷ ডাকাতরা
যাতে উল্টে ভয় পায় আমাদের৷ অপার অন্ধকার সমুদ্রবক্ষে ওই আলোর মালা শঙ্খ ঘোষের কবিতা
মনে আনে৷
থাকি ওখানে তিন মাস৷ সাপ্তাহিক রেশন চালু করি৷ এবং চার হাজার ঘর বানাই৷ চৌষট্টি
হাজার হাত বেড়া লেগেছিল তাতে৷ এবং চৌষট্টি হাজার পঞ্চাশ ফুটি বাঁশ৷ এই বাজারটা করি
আমি৷ সঙ্গে ছিল নৃত্যশিল্পী ঝুমুর বর, হাজী আমানুল্লাহ, পরে সাংসদ এবং বাফার
সম্পাদক৷ কিন\’ হাসান ইমাম না হলে এই নির্মাণসামগ্রী সাইটে পেঁৗছাতো না৷ হাসান ঘুরে
ঘুরে কীভাবে দুই ফুটবল মাঠ সমান একটা ফ্ল্যাট অর্থাত্ ডাম বার্জ সংগ্রহ করে
আইডব্লুটিসি থেকে৷
ঐ আমার জীবনে বড় বাজার করা আর বড় কাজ৷ দুর্যোগ নিরোধ আন্দোলনের অর্থাত্ ছায়ানট
বাফা চলচ্চিত্র শিল্পীদের মিলিত প্রচেষ্টায়৷ এর পাশাপাশি আরম্ভ করি আমরা কৃষি
পুনর্বাসনের কাজ৷ ৪০টা ট্রাক্টর চাই আমাদের সে কাজে৷ ছয়টার বরাদ্দ পাই৷ কৃষি সচিব
এইচ আর মালিকের আনুকূল্যে৷ এইগুলো যাবে কী করে ঐ দুর্গম এলাকায়? বুদ্ধি করি আমি
হেলিপ্টারে স্লিংয়ে ঝুলিয়ে নিয়ে যাব৷ দৌড়-ঝাপ করতে আরম্ভ করি, চর কাজল থেকে ঢাকায়
এসে৷ এসে গেছে মার্চ, একাত্তরের মার্চ৷ পয়লা তারিখে নির্ধারিত পার্লামেন্ট অধিবেশন
ভেঙে দিল ইয়াহিয়া৷ এই অধিবেশনেই মুজিবের ক্ষমতা নেওয়ার কথা ছিল পাকিসত্মানের
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে৷ দেশ জ্বলে উঠল৷
ছয়ানটের স্বাধীনতা ঘোষণা
এক ফাঁকে চর থেকে এসে হাসান ইমাম, আতিক আর আমি আরম্ভ করে দিই বিক্ষুব্ধ শিল্পী
সমাজ, ফেব্রচ্ছারি শেষে৷ এই সংগঠনের শিল্পীরা ঢাকার মোড়ে মোড়ে অনুষ্ঠান করতে থাকে
গণসঙ্গীত, দেশোদ্দীপনার গানের, প্রতিদিন৷ মার্চের দুই কিংবা তিন তারিখে প্রভাতে
ছায়ানট শহীদ মিনারে স্বদেশ পর্যায়ের গান করে ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’৷ গানে
গানে আমরা বলি ‘ভাই ছেড়ে ভাই কদিন থাকে’ _ বাঙালির জাতীয় চেতনা জাগবার মন্ত্র৷ গান
শেষে আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় রাষ্ট্রিক স্বাধীনতার আহ্বান জানাই, পাকিসত্মানের সকল
বাংলাভাষীর জন্য৷ বিকেলে আর্মি গুলিতে নিহত গিফারি কলেজের ছাত্র নেতা ইকবাল
ফার\”কের লাশ আনা হয় পল্টনে, জনসভায়৷ আসেন বঙ্গবন্ধু, বলেন আমার যা বলার সাত তারিখে
বলব৷
সেই তার ৭ মার্চের বক্তৃতা যার পরে বাঙালির স্বাধীন হওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না৷
মুক্তিযুদ্ধের নভেম্বর পর্যনত্ম শেষ ছয় মাসে মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা
(অর্থাত্ ছায়ানট) দুই শয়ের অধিক সঙ্গীতানুষ্ঠান করে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে,
শরণাথর্ী শিবিরে, পশ্চিমবঙ্গের শহরে শহরে৷ জয় প্রকাশ নারায়ণ একাত্তরের ২০
সেপ্টেম্বর দিলি্লতে বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর আনত্মর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করলে
স্বাধীন বাংলা সরকার আমাদের শিল্পী সংস্থাকে ভার দেয় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার৷
মুসত্মাফা মনোয়ার, হাসান ইমাম ও আমি ৩০ জনের এক দল নিয়ে দিলি্ল যাই এবং শাহরিয়ার
কবির রচিত জীবনত্মিকা ‘রূপানত্মরের গান’ গেয়ে শোনাই৷ মুসত্মাফা মনোয়ারের দৃশ্যপট ও
আলোক সম্পাতে হাসান ইমামের সূত্রধারণে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা অসাধারণ রক্ত চঞ্চল
করা গান করে৷ তখন পুজোর মরশুম, চারদিকে মণ্ডপে মণ্ডপে সে সব গান বারে বারে গাইতে হয়
দলকে৷ তাদের গানের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার, ভারতীয় গণনাট্য সংঘের যুগল প্রতিষ্ঠাতা
জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র এবং বিনয় রায় (সলির চৌধুরীর দুই গুর\”) কর্তৃক তাদের গানের
উচ্ছ্বসিত প্রশংসা৷ আমিও পাই আমার মতো করে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার তাদের স্নেহভারাতুর
বন্ধুতা৷ এবং ছায়ানটে তাদের উদ্ভাবিত গণনন্দিত গণসঙ্গীতকে প্রধান বিষয় না করে
রবীন্দ্রসঙ্গীতকে, সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে, চর্চাপ্রচারপ্রসারের মূল
বিষয় করে তোলার ১০ বছরব্যাপী প্রয়াসকে তারা অকুণ্ঠ সমর্থন দেন৷
প্রতিবিপ্লব প্রতিরোধ
বাহাত্তরের জানুয়ারি জুড়েই আমরা দেশে ফিরলাম৷ মনস্কাম পূর্ণ ছায়ানট এখন কী করবে?
তার প্রধান শত্র\” পাকিসত্মান অপমানকর পরাজয়ের পর লেজ গুটিয়ে তার আপন জায়গায় চলে
গেছে৷ এবারে আগের চেয়ে কঠিন কাজটি সমাধা করতে হবে৷ বিপ্লবোত্তর প্রতিবিপ্লবকে
সংস্কৃতির অস্ত্রে মোকাবেলা করা হবে৷ শত্র\” একই৷ মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারনা দিয়ে
সমাজসমীকরণকে ধর্মধাপ্পার আড়ালে চাপা দিয়ে সামপ্রদায়িকতা দিয়ে সদ্য অর্জিত
জাতিসত্তার চেতনাকে অসাড় করে বিজয়কে পূর্ণ নস্যাত্ করার ষড়যন্ত্র৷ এবার ষড় করবে
বাঙালি৷ বাঙালির বির\”দ্ধে৷ এ লড়াইয়ে জিততে সময় লাগবে বেশি৷ এবং লাগবে অনেক বেশি
নিষ্ঠা ঐকানত্মিকতা, শ্রেণীচেতনা উদ্ভাসিত দেশপ্রেম৷ সন্জীদার নেতৃত্বে চলছে
ছায়ানটের সংস্কৃতি আন্দোলনজাত অর্জনের পূর্ণ সংহতকরণের কাজ৷ যার একটা পর্যায়ের শেষ
সংস্কৃতি-ভবন নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠায়৷ আরম্ভ কথারও এইখানে শেষ৷
উপসংহার
বাহাত্তর থেকে চলে আসি আমরা তিরিশ বছর পেরিয়ে দুহাজার এক সালে উপসংহারের জন্য৷
নিজস্ব একটা বসবার জায়গার অভাবে ছায়ানট সংস্কৃতির প্রধান একটা ক্ষেত্রে এতকাল ধরে
হাত দিতে পারেনি৷ সেটা শিক্ষার ক্ষেত্র৷ ছায়ানটের সবচাইতে শ্লাঘাকর প্রবর্তনা ছিল
নববর্ষ আবাহন পহেলা বৈশাখের প্রভাতে৷ সাতষট্টি থেকে তিন বছরেই এটি জাতীয় উত্সবে
পরিণত হয়৷ যে অশ্বত্থ তলায় নববর্ষ প্রতু্যষে ছায়ানটের সঙ্গীত সভা বসে, তা এই গাছটির
মতো বেড়ে বেড়ে সমসত্ম দেশ ছায়৷ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে চণ্ডশক্তি একে উত্খাতের
শত চেষ্টায়ও ফল না পেয়ে, রফা করে নিজেরাই এ দিন পালন করে৷ এতে করে পহেলা বৈশাখ
প্রতু্যষে লক্ষাধিক লোকের সমাগত আরম্ভ হলে, গ্রেগরীয় শতাব্দীর অনত্মিম এক চৌদ্দই
এপ্রিলে সংস্কৃতি ও স্বাধীনতার শত্র\”রা বোমা হামলা করে ছায়ানট মঞ্চে৷ মঞ্চ
পর্যনত্ম পেঁৗছায় না সে আক্রমণ৷ মারা যায় অনত্মত দশজন শ্রোতা দর্শক, দেহ ছিন্নভিন্ন
হয়ে গিয়ে৷ ছায়ানট শিক্ষা আন্দোলন, সংগঠন করে এর পুনরাবৃত্তি রোধের কথা ভাবে৷
নালন্দার আরম্ভ কোনো ম্যানিফেস্টো দিয়ে হয়নি৷ শিশুচিত্তে উন্মেষক একটি বীজতলা
প্রতিষ্ঠান পত্তন করে ছায়ানট এ সময়ে৷ তার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এ আন্দোলন গড়ে
উঠবে৷ সন্জীদা খাতুনের সভাপতিত্বে আরম্ভ হল নালন্দা প্রতিষ্ঠান৷ মোমেনা বেগম ও
সিদ্দিক বেলাল দম্পতির সকল সমর্পণ প্রতিভাদীপ্ত কাজে নালন্দা পূর্ণ বিকাশের
দ্বারপ্রানত্মে পৌছালে ছায়ানট নালন্দাকে সাঙ্গীকৃত করে নেয়৷ ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে
এখন নালন্দা চলছে গত আগস্ট থেকে৷ ছায়ানটের সমন্বিত শিক্ষা কর্মচির বাসত্মাবয়ন
হিসেবে৷
এর পর ছায়ানট কোন নব সত্তায় তার বিসত্মার খুঁজবে? দৃশ্য শিল্পক্ষেত্রে ছায়ানট পা
বাড়াবে যে কোনদিন৷ জল্পনা চলছে রূপমমৃতম নাম ধরে৷