১০০০.
তাল: তিলক কামোদ, তাল: ঝাঁপতাল
অগ্নি-ঋষি! অগ্নি-বীণা তোমায় শুধু সাজে;
তাই ত তোমার বহ্নি-রাগেও বেদন-বেহাগ বাজে॥
দহন-বনের গহন-চারী ─
হায় ঋষি ─ কোন্ বংশীধারী দেশি
নিঙড়ে আগুন আনলে বারি, অগ্নি-মরুর মাঝে।
সর্বনাশা কোন্ বাঁশি সে বুঝতে পারি না যে॥
দুর্বাসা হে! রুদ্র তড়িৎ হানছিলে বৈশাখে,
হঠাৎ সে কার শুন্লে বেণু কদম্বের ঐ শাখে।
বজ্রে তোমার বাজ্ল বাঁশি,
বহ্নি হল কান্না-হাসি,
সুরের ব্যথায় প্রাণ উদাসী ─ মন সরে না কাজে।
তোমার নয়ন-ঝুরা অগ্নি-সুরেও রক্তশিখা রাজে॥ভাবসন্ধান: এই গানটির ভাবসন্ধানের জন্য এর প্রেক্ষাপট হিসেবে বিশেষভাবে জড়িয়ে আছে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং তাঁর রচিত 'দ্বীপান্তরের ফাঁসী' নামক গ্রন্থটি। উল্লেখ্য, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ((১৮৮০-১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী। তাঁর পরিকল্পনায় এবং তাঁরই তত্ত্বাবধানে তৈরিকৃত বোমা নিয়ে- ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্লকুমার চাকী ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে এপ্রিল, রাত সাড়ে বারটায় বিহারের মুজাফ্ফরপুর ইউরোপীয়ান ক্লাবের সামনে একটি গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করেন। এই বোমা হামলার উদ্দেশ্য ছিল কুখ্যাত ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করা। ভুলক্রমে করে বিপ্লবীদের নিক্ষিপ্ত বোমার আঘাত গাড়িতে বসা মিসেস কেনেডি ও তার কন্যা মৃত্যুবরণ করেন। ক্ষুদিরাম বসু হত্যাকাণ্ডের স্থল থেকে প্রায় ২৫ মাইল দূরে ওয়েইনি স্টেশনে ধরা পড়েন। এই সময় অপর বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকীকেও ধরার চেষ্টা করা হলে, তিনি নিজের রিভলবারের গুলিতে আত্মঘাতী হন। এরপর পুলিশি তদন্ত শুরু হয় এবং এর সাথে যাঁরা যুক্ত ছিলেন তাঁদেরকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা চলে। এটি 'আলীপুর বোমা মামলা' নামে পরিচালিত হয়। এই বোমা হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং উল্লাসকর দত্তকে ফাঁসী দেওয়া হয়। পরে আপিলে উভয়েরই তাঁর মৃত্যুদণ্ড রহিত করা হয় এবং ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে আন্দামানে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়। প্রায় এক দশক পর ব্রিটিশ-ভারতীয় সরকার রাজনৈতিক বন্দীদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে বারীন ঘোষকে কলকাতায় এনে মুক্তি দেওয়া হয়। এই সময় প্রকাশিত হয় তাঁর "দ্বীপান্তরের বাঁশী" নামক কাব্যগ্রন্থ।
কাজী নজরুল বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং তাঁর কাব্যগ্রন্থকে সম্মান দেখিয়ে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লেখেন। এ চিঠিটি ছিল মূলত সদ্য কারামুক্ত বারীন্দ্রকুমার ঘোষের উদ্দেশ্যে লেখা একটি কবিতা। কবিতাটির প্রথম দুটি চরণ ছিল-
অগ্নি-ঋষি অগ্নিবীণা তোমায় সাজে;
তাই তো তোমার বহ্নি-রাগে বেদন-বেহাগ বাজে।
নজরুল ইসলাম তাঁর রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অগ্নিবীণা' উৎসর্গ করেছিলেন বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে। উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন- বাঙ্লার অগ্নি-যুগের আদি পুরোহিত সাগ্নিক বীর শ্রীবারীন্দ্রকুমার ঘোষ শ্রীশীচরণারবিন্দেষু'। এরপর 'অগ্নি-ঋষি অগ্নিবীণা তোমায় সাজে...' কবিতাটি যুক্ত করেন। এই উৎসর্গ-কবিতার শেষে উল্লেখ করেছেন- 'তোমার অগ্নি-পূজারী, স্নেহমহিমান্বিত শিষ্য কাজী নজরুল ইসলাম'।
অবশ্য এই কবিতাটি 'অগ্নি-ঋষি' শিরোনামে উপাসনা পত্রিকার 'শ্রাবণ ১৩২৮' সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। নজরুল ইসলাম কবে এ্ই কবিতাটিতে সুরারোপ করে গানে পরিণত করেছিলেন, তা জানা যায় নি।
দীপান্তরে থাকা অবস্থায় বারীন ঘোষ, আধ্যাত্মিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হন। এই গ্রন্থের কবিতাগুলোতে পাওয়া যায়- শ্রীকৃষ্ণ পূজারী বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে। নজরুল এই গানের ভিতরে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন কৃষ্ণপূজারী বারীন্দ্রকুমার ঘোষের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও বিপ্লবী অগ্নিঋষি হিসেবে।
গানটির প্রথম পংক্তিতে বিনয়ী নজরুলকে খুঁজে পাই। যিনি তাঁর গুরুর কাছে যেন কৈফিয়ত দিচ্ছেন- অগ্নিবীণায় তাঁর অধিকার নেই, এই বীণা বাজানোর অধিকার একমাত্র এই বিপ্লবীকেই মানায়। একমাত্র তিনিই পারেন অগ্নিতেজদীপ্ত সুরের ভিতরে বেদনামথিত বেহাগ সুর আনতে। বিদ্রোহ এবং মিলন-বিরহ কিম্বা হিংসা এবং প্রেমের বৈপরিত্য সত্তার ভিতর দিয়েই নজরুল বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে অর্ঘ নিবেদন করেছেন।
বারীনকুমার ঘোষ- তাঁর 'দ্বীপান্তরের বাঁশী' গ্রন্থের 'বাঁশীর ফুঁক' অংশে লিখেছিলেন- '...কত যে কি বাজি তা' কি আমিই বলতে পার? তা'র বাজনার ছেদ নাই, বিরাম নাই, আমারও বাজা অফুরন্ত। এই চোখের জলের করুণ সজল বাজা, ঐ হাসির ফোয়ারায় উচ্ছল পাগল বাজা; এই মরণের রুধির রক্ত তাতাথেই গান, ঐ জীবনের মৃদুল মধুর বিজলি শিহর ভরা দক্ষিণা সুর...।'দ্বীপান্তরের বাঁশী'তে নজরুল দেখেছেন বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে ঋদ্ধ অগ্নিঋষির বংশীধারী কৃষ্ণের স্নিগ্ধ রূপ। যে অগ্নিঋষি ছিলেন দুর্বাসার মতো ক্রোধান্বিত, যিনি কাল-বৈশাখির ধ্বংসের উন্মাদনায় ব্রিটিশ উপনিবেশে আঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন। সহাসাই তিনি সব ছেড়ে দিয়ে অহিংস বৈষ্ণব হয়ে গেলেন। তাঁর প্রতিহিংসার আগুন হয়ে গেল কান্না-হাসির স্নিগ্ধ অভিব্যক্তি। বিশ্বকল্যাণের সুর বাজে তাঁর বাঁশীতে। তবু এই বৈষ্ণব কবির সুরে নজরুল খুঁজে পান বিপ্লবের অগ্নিশিখা।
১. প্রকাশ ও গ্রন্থভুক্তি:
- নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ, (নজরুল ইনস্টিটিউট, মাঘ ১৪১৮। ফেব্রুয়ারি ২০১২) -এর ১০০০ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ৩০৬।
- গ্রন্থ : অগ্নি-বীণা (উৎসর্গ)।
- পত্রিকা : মাসিক 'উপাসনা', ১৩২৮ বঙ্গাব্দ।
২. রেকর্ড সূত্র : পাওয়া যায় নি।
৩. রচনাকাল : গানটির রচনাকাল সম্পর্কে জানা যায় না।
৪. প্রাসঙ্গিক পাঠ :
- গানটির সুর ও তালের নির্দেশ একমাত্র পত্রিকাতেই পাওয়া গেছে।
[নজরুল সঙ্গীত নির্দেশিকা। ব্রহ্মমোহন ঠাকুর (নজরুল ইন্সটিটিউট, জ্যৈষ্ঠ ১৪১৬। মে ২০০৯) -এর ২ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ১।]
- ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে পবিত্রগঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লেখেন। এ চিঠিটি ছিল মূলত সদ্য কারামুক্ত বারীন্দ্রকুমার ঘোষের উদ্দেশ্যে লেখা একটি কবিতা। কবিতাটির প্রথম দুটি চরণ ছিল-
অগ্নি-ঋষি অগ্নিবীণা তোমায় সাজে;
তাই তো তোমার বহ্নি-রাগে বেদন-বেহাগ বাজে।
সম্ভবত এই কবিতাটিকে তিনি গানে পরিণত করেন। গানটি অগ্নি-ঋষি শিরোনামে উপাসনা পত্রিকার 'শ্রাবণ ১৩২৮' সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। গানটিতে আন্দামানে অবস্থানকালে বারিন্দ্র কুমার ঘোষের লেখা "দ্বীপান্তরের বাঁশী" বইটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
[সূত্র: মাহবুবুল হক, নজরুল তারিখ অভিধান, পৃষ্ঠা-১৩, ৩০।]৫. সুরকার:
৬. স্বরলিপিকার :
৭. সঙ্গীত বিষয়ক তথ্যাবলী :
রাগ: তিলক কামোদ।
তাল: ঝাঁপতাল।
পর্যায়:
সুরের অঙ্গ:
গ্রহস্বর: