শ্রবণ নমুনা: গিরীন চক্রবর্তী |
৭২৬.
সিনেমা: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন।
তাল: দ্রুত-দাদ্রা
কারার ঐ লৌহ-কপাট
ভেঙ্গে ফেল্ কর্ রে লোপাট রক্ত-জমাট
শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী!
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ ! ধ্বংস-নিশান
উঠুক প্রাচী-র প্রাচীর ভেদি'॥
গাজনের বাজনা বাজা !
কে মালিক? কে সে রাজা? কে দেয় সাজা
মুক্ত-স্বাধীন সত্য কে রে?
হা হা হা পায় যে হাসি, ভগবান প'রবে ফাঁসি? সর্বনাশী —
শিখায় এ হীন্ তথ্য কে রে?
ওরে ও পাগ্লা ভোলা, দেরে দে প্রলয়-দোলা
গারদগুলা
জোরসে ধ'রে হ্যাঁচকা টানে।
মার্ হাঁক হায়দরী হাঁক্ কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক ডাক ওরে ডাক
মৃত্যুকে ডাক জীবন-পানে॥
নাচে ঐ কাল-বোশেখী,
কাটাবি কাল ব'সে কি?
দে রে দেখি ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি'।
লাথি মার, ভাঙ্রে তালা ! যত সব বন্দী-শালায় —
আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা, ফেল্ উপাড়ি॥
ভাবসন্ধান: কারগারের ওই লৌহকপাট এবং শৃঙ্খলিত রক্ত-জমাট ভয়ঙ্কর আসন ভেঙে ফেলার জন্য ঈশানরূপী (মহাদেবের অষ্ট মূর্তির একটি) তরুণদের আহবান করা হয়েছে এই গানে। কবি কামনা করছেন, বিদ্রোহী তরুণদের হাতে ধ্বনিত হোক মহাদেবের প্রলয়ঙ্করী শিঙা, পূর্বদেকের (প্রাচী-র) আলোক-প্রতিবন্ধী প্রাচীর ভেদ করে উত্তোলিত হোক ধ্বংসের পতাকা। এই ধ্বংসের ভিতর দিয়ে জেগে উঠবে স্বাধীনতার নতুন পতাকা, স্বাধীনতার নতুন সূর্য আলো ছড়াবে জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
কবি পাগলা ভোলারূপী (মহাদেব) তরুণদের ডেকে বলছেন, প্রচণ্ড ধ্বংসের দোলা সব কারাগারকে আন্দোলিত করুক আর হ্যাঁচকা টানে সেগুলোকে ধ্বংস করুক। হায়দরী হাঁক (যুদ্ধের সময় হযরত আলী যে হাঁক দিতেন) হেঁকে আর যুদ্ধের দুন্দুভি (বড় ঢাক বিশেষ) বাজিয়ে বন্দীরূপী মৃত্যুর আলয়কে ধ্বংস করে, মুক্তজীবনের আকাঙ্ক্ষাকে উজ্জীবিত করুক। কবি তরুণদের ডেকে বলছেন, বিধ্বংসী কালবৈশাখীর মতো আন্দোলন সমাসন্ন, এখন বসে বসে কাল কাটানোর অবসর নেই। এখন অটল কারাগারের ভিত্তিকে নড়িয়ে দিতে হবে। কবি কামনা করছেন, যত কারাগার আছে, পদাঘাতে তার সবগুলোর তালা খুলে যাক, আগুনের লেলিহান শিখায় ধ্বংস হয়ে যাক সকল বন্দীকারাগার, সমূলে উৎপাটিত হোক পরাধীনতার জগদ্দল পাথর।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কারাবরণের সূত্রে এই গানটি রচিত হলেও, এই গানের ভিতর দিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের আহ্বান করা হয়েছে। এই বিদ্রোহের ভিতর দিয়ে পরাধীনতার বন্দী দশা ধ্বংস হবে এবং স্বাধীনতার জয় পতাকা প্রতিষ্ঠিত হবে, পূর্ণ হবে মুক্তির সাধ।
১. প্রকাশ ও গ্রন্থভুক্তি:
২. রেকর্ড সূত্র :
১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি গানটির ১ম রেকর্ড প্রকাশ করে। রেকর্ড নম্বর- জি.ই. ৭৫০৬। শিল্পী ছিলেন গিরীন চক্রবর্তী। রেকর্ডটির পরিচালক ছিলেন নিতাই ঘটক।
এরপর
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে এই গানটির দ্বিতীয় রেকর্ড প্রকাশ করে
এইচ.এম.ভি। রেকর্ড নম্বর- এন. ৩১১৫২। এই গানটিরও শিল্পী ছিলেন গিরীন
চক্রবর্তী। সিনেমা- চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। [
শ্রবণ নমুনা]
৩. রচনাকাল: 'ভাঙার গান' শীর্ষক গানটি সম্পর্কে কমরেড মুজফ্ফর আহমদ 'কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা'-তে লিখেছেন—
"আমার সামনেই দাশ-পরিবারের শ্রী সুকুমাররঞ্জন দাশ 'বাঙ্গলার কথা'র জন্য একটি কবিতা চাইতে এসেছিলেন। শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী তাঁকে কবিতার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তখন জেলে। ... অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নজরুল তখনই কবিতা লেখা শুরু ক'রে দিল। সুকুমাররঞ্জন আর আমি আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে নজরুল আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তার সেই মুহূর্তে রচিত কবিতাটি আমাদের পড়ে শোনাতে লাগল। ... নজরুল 'ভাঙার-গান' লিখেছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের কোনো এক তারিখে। 'ভাঙার গান' বাঙ্গলার কথা'য় ছাপা হয়েছিল।"
ড. মুজফ্ফর আহমদ-এর বিবৃতি অনুসারে বলা যায়, গানটি নজরুল ইসলামের ২২ বৎসর বয়সের রচনা।
৪. প্রাসঙ্গিক পাঠ: ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় 'বাঙ্গলার কথা' নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। স্বদেশী ভাবপুষ্ট লেখা প্রকাশের জন্য, ব্রিটিশ-ভারতের পুলিশ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন দাশ-কে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেয়। এই সময় পত্রিকার হাল ধরেন তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী। বাসন্তী দেবী তাঁর পত্রিকায় একটি কবিতা পাঠানোর জন্য সুকুমাররঞ্জন দাশকে নজরুল ইসলামের কাছে পাঠান। সেই সূত্রে নজরুল ইসলাম এই কবিতাটি রচনা করে সুকুমাররঞ্জন দাশ-এর হাতে অর্পণ করেন। তিনি (চিত্তরঞ্জন দাশ) এই গানটি হুগলী জেলে স্বদেশী আন্দোলনের সাথে জড়িত বন্দী এবং অন্যান্য বন্দীদের সাথে গাইতেন বলে জানা যায়। অবশ্য এই কবিতার 'যত সব বন্দী-শালায়' অংশটি 'বন্দী-শালা' পড়ে হট্টগোল করে। পরে অবশ্য তাঁরা তাঁদের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। উল্লেখ্য, তৎকালীন ভারত সরকার গানটিকে নিষিদ্ধ করেছিল।
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে 'চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন' চলচ্চিত্রে, এইচ.এম.ভি থেকে গানটির রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল।
৫. সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম।
৬. স্বরলিপিকার:
রশিদুন্ নবী। [নজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি, বিংশ খণ্ড, ৫ সংখ্যক গান (নজরুল ইন্সটিটিউট, বৈশাখ ১৪০৭। মে ২০০০)। পৃষ্ঠা: ৪২-৪৫]।
কাজী অনিরুদ্ধ। [সুনির্বাচিত নজরুল গীতির স্বরলিপি, প্রথম খণ্ড, ১১ সংখ্যক গান (সাহিত্যম, মহালয়া ১৩৮২ বঙ্গাব্দ। অক্টোবর ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ)। পৃষ্ঠা: ৪২-৪৫]।
নিতাই ঘটক। [শ্রেষ্ঠ নজরুল স্বরলিপি, ৮২ সংখ্যক গান (হরফ প্রকাশনী, আশ্বিন ১৪০৬। সেপ্টেম্বর ১৯৯৯)। পৃষ্ঠা: ১৯৪-১৯৭]।
৭.
সঙ্গীত বিষয়ক তথ্যাবলী:
তাল: দ্রুত-দাদরা।
পর্যায়: ভাঙার গান। দেশাত্মবোধক গান (স্বদেশী)।
গ্রহস্বর: সা