আহসান মঞ্জিল

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক প্রাসাদ। বর্তমানে যেখানে আহসান মঞ্জিল অবস্থিত, সেখানে জালালপুর পরগণার (বর্তমান ফরিদপুর-বরিশাল) জমিদার শেখ ইনায়েত উল্লাহ অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে একটি প্রমোদ ভবন তৈরি করেন। ইনায়েত উল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শেখ মতিউল্লাহ এই প্রমোদভবনটিকে ফরাসি বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেন। ফরাসিরা এই প্রমোদ ভবনটিকে তাঁদের বাণিজ্য কুঠির হিসেবে ব্যবহার করা শুরতু করেন।
 

নওয়াব আবদুল গণি

১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে খাজা আলিমুল্লাহ ফরাসিদের কাছ থেকে ভবনটি ক্রয় করে বসবাস শুরু করেন। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে (মতান্তরে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দ) নওয়াব আবদুল গণি পুরো ভবনটিকে পুনঃনির্মাণ করেন এবং তার পুত্র খাজা আহসান উল্লাহর নামানুসারে এই প্রমোদ ভবনটির নাম করেন আহসান মঞ্জিল।১৮৮৮ সালের ৭ এপ্রিল প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পুরো আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত আহসান মঞ্জিল পুননির্মাণের সময় বর্তমান উঁচু গম্বুজটি সংযোজন করা হয়। সে আমলে ঢাকায় আহসান মঞ্জিলের মতো এত জাঁকালো ভবন আর ছিল না। এর প্রাসাদোপরি গম্বুজটি শহরের অন্যতম উঁচু চূড়া হওয়ায় তা বহুদূর থেকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো।

ইউরোপীয় বৈশিষ্ট্যে নির্মিত এই প্রাসাদটি দুই তলা। সমগ্র আহসান মঞ্জিল দুটি অংশে বিভক্ত। এর পূর্ব পাশের গম্বুজযুক্ত অংশকে বলা হয় প্রাসাদ ভবন (রঙমহল) এবং পশ্চিমাংশের আবাসিক প্রকোষ্ঠাদি নিয়ে গঠিত ভবনকে বলা হয় অন্দর মহল। প্রাসাদ ভবনটি আবার দুটি সুষম অংশে বিভক্ত।
 

মূল প্রাসাদ ভবন বা রঙমহলটি ১২৫·৪ × ২৭·৭৫ মিটার আয়তন এবং ১ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট প্লিন্থের উপর স্থাপিত। ভূমি নকশার জন্য নিচ তলায় মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত উচ্চতা ৫ মিটার এবং দোতলায় ৫·৮ মিটার। প্রাসাদ ভবনটির গম্বুজটি নির্মাণের জন্য প্রথমে কেন্দ্রীয়ভাবে নির্মিত নিচ তলার বর্গাকার কক্ষটির চার কোণায় ইট দিয়ে ভরাট করে গোলাকার রূপ দেয়া হয়েছে। এর উপর দোতলায় নির্মিত অনুরূপ গোলাকার কক্ষের উর্ধাংশে ৮টি স্কুইঞ্চ নির্মাণ করে ছাদের কাছে কক্ষটিকে অষ্টকোণার রূপ দেয়া হয়েছে। এই অষ্টকোণ রূপটিই ছাদের উপর উঠে গম্বুজের পিপায় পরিণত হয়েছে। পরিশেষে অষ্টবাহুর সঁচালো মাথাগুলোকে কেন্দ্রের দিকে ক্রমশ হেলিয়ে চূঁড়াতে নিয়ে মিলিয়ে কুমুদ কলির আকারে গম্বুজটি তৈরি হয়েছে। ভিতর দিকে গম্বুজটির ব্যাস ২০ ফুট। গম্বুজের শীর্ষে শোভা পাচ্ছে একটি কলস-খাদা ফিনিয়াল।  ভূমি থেকে গম্বুজ শীর্ষের উচ্চতা ২৭ মিটার।
 

প্রাসাদটির উত্তর ও দক্ষিণ উভয়দিকের পোর্চের উপর দিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে সম্মুখস্থ বাগানে নেমে গেছে সুবৃহৎ একটি সিঁড়ি।

 

উনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে উপমহাদেশের, বিশেষ করে বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আহসান মঞ্জিলেই গৃহীত হয়েছে। এক সময় সংস্কারের অভাবে প্রাসাদটি তার জৌলুশ হারাতে বসেছিল। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে আহসান মঞ্জিলের সংস্কার, সৌন্দর্যবর্ধন ও জাদুঘরে রূপান্তর করার জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন এ প্রকল্পের নির্বাহী সংস্থা ছিল বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব বাংলাদেশ জাদুঘর ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের ওপর যৌথভাবে ন্যস্ত ছিল। সংস্কার ও সংরক্ষণ কাজ গণপূর্ত অধিদপ্তর কর্তৃক সম্পাদিত হয়। নিদর্শন সংগ্রহ ও প্রদর্শনী উপস্থাপনের মাধ্যমে জাদুঘরে রূপান্তরের কাজ সম্পাদন করে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর আহসান মঞ্জিল জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ও জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

 

এর প্রমোদভবন তথা রঙমহলের ৩১টি কক্ষের ২৩টিতে প্রদর্শনী উপস্থাপন করা হয়েছে। ৯টি কক্ষ লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত ও মি. ফ্রীৎজা কাপ কর্তৃক ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে তোলা আলোকচিত্রের সাথে মিলিয়ে সাজানো হয়েছে। আহসান মঞ্জিলের তোষাখানা ও ক্রোকারিজ কক্ষে থাকা তৈজসপত্র এবং নওয়াব এস্টেটের পুরনো অফিস এডওয়ার্ড হাউস থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষণ করে প্রদর্শনীতে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উক্ত আলোকচিত্রের সাথে মিলিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি এবং সমসাময়িককালের সাদৃশ্যপূর্ণ নিদর্শনাদি ক্রয় ও সংগ্রহ করে গ্যালারিতে উপস্থাপন করা হয়েছে।  নিচে গ্যালারিগুলোর পরিচয় তুলে ধরা হলো।

গ্যালারি ১ : নিচতলার গ্যালারির নকশা
আহসান মঞ্জিলের ইতিহাস, সংস্কার পূর্ব ও সংস্কার পরবর্তী ভবনের আলোকচিত্র নিয়েই গ্যালারি ১। 

গ্যালারি ২
প্রাসাদ ভবনের সঙ্গে সংশিস্নষ্ট উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্যাবলী, আদি স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য এবং বিবর্তিত রূপের চিত্রে সেজেছে এই গ্যালারিটি।

গ্যালারি ৩
এটি প্রাসাদ ডাইনিং রুম। ১৯০৪ সালে তোলা আলোকচিত্রের দৃশ্যানুযায়ী সজ্জিত এ গ্যালারি। এখানে প্রদর্শিত আলমারি, আয়না, কাচ ও চীনামাটির তৈজসপত্র নওয়াবদের ব্যবহৃত মূল নিদর্শন।

গ্যালারি ৪
প্রাসাদ শীর্ষে দৃশ্যমান গম্বুজটি এ গোলাকার বর্গার উপরই নির্মিত। এখানে প্রদর্শিত ঢাল, তলোয়ার, আর্মড ফিগার ইত্যাদি নওয়াবদের ব্যবহৃত মূল নিদর্শন।

গ্যালারি ৫
এটি প্রধান সিঁড়িঘর। এখানে দেখা যাবে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কাঠের সিঁড়ি যা মূলানুরূপ নিদর্শন দিয়ে সজ্জিত।

গ্যালারি ৬
এ গ্যালারিটি আহসানউল্লাহ হাসপাতালের সরঞ্জামাদিতে সজ্জিত। নওয়াবজাদি আখতার বানু কর্তৃক ১৯৩০ সালে টিকাটুলিতে তার পিতার নামে স্থাপিত স্যার আহসানউল্লাহ জুবিলি মেমোরিয়াল হাসপাতালে ব্যবহৃত কিছু চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রদর্শিত হয়েছে এখানে।

গ্যালারি ৭
এই কক্ষটি আগে ছিল নওয়াবদের দরবার হল। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের গঠন বিষয়ক ঘটনাবলীর তথ্য ও চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে এখানে।

গ্যালারি ৮
এটি বিলিয়ার্ড কক্ষ। ১৯০৪ সালে তোলা আলোকচিত্রের সাথে সঙ্গতি রেখে বিলিয়ার্ড টেবিল ও দেয়ালে বিভিন্ন জীবজন্তুর শিং প্রদর্শিত হয়েছে এ গ্যালারিতে।

গ্যালারি ৯
এটি সিন্দুক কক্ষ। নওয়াবদের কোষাগার নামে পরিচিত এ কক্ষটিতে লোহার সিন্দুক ও আলমারি প্রদর্শিত হয়েছে।

গ্যালারি ১০
নওয়াব পরিবারের তিনজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব- নওয়াব স্যার আবদুল গনি, নওয়াব স্যার আহসানউল্লাহ ও নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহকে কেন্দ্র করে এ গ্যালারিটি সজ্জিত। নওয়াবদের প্রতিকৃতি ও সংক্ষিপ্ত জীবনীসহ তাদের বংশ তালিকা উপস্থাপিত হয়েছে এখানে।

গ্যালারি ১১
নওয়াবদের সমসাময়িককালের দেশবরেণ্য রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, ভূস্বামী, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গের প্রতিকৃতি এখানে রাখা হয়েছে।

গ্যালারি ১২
এই গ্যালারিটি নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর সম্মানার্থে। স্যার সলিমুল্লাহর স্মরণে গ্যালারি তার স্মৃতি বিজড়িত নিদর্শন দিয়ে সজ্জিত।

গ্যালারি ১৩
গ্যালারি ১১-এর অনুরূপ এই গ্যালারিটি। নওয়াবদের সমসাময়িককালের বিশিষ্ট মনীষীদের প্রতিকৃতি দিয়ে সজ্জিত। এছাড়া, আহসান মঞ্জিলে প্রাপ্ত নওয়াব পরিবারের ব্যবহৃত হাতির দাঁতের মূল নিদর্শন প্রদর্শিত হয়েছে।

গ্যালারি ১৪
এই গ্যালারিটি হিন্দুস্থানী কক্ষ ১৯০৪ সালে তোলা আলোকচিত্রে কক্ষটিকে ‘হিন্দুস্থানী রুম’ বলা হয়েছে। উক্ত আলোকচিত্রের সাথে মিলিয়ে কক্ষটি সজ্জিত করা হয়েছে।

গ্যালারি ১৫
দোতলার প্রধান সিঁড়িঘর এটি। প্রাসাদের নিত তলা থেকে উপর তলায় ওঠানামার জন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কাঠের সিঁড়ির উপরাংশের দৃশ্য। ১৯০৪ সালের আলোকচিত্রের সাথে মিলিয়ে মূলানুরূপে এ গ্যালারিটি সাজানো হয়েছে।

গ্যালারি ১৬
এটি নবাবদের ব্যবহৃত ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ঘর। ১৯০৪ সালে তোলা আলোকচিত্র অনুযায়ী কক্ষটি সাজানো হয়েছে। আইন ও বিচার, উপন্যাস, ক্রীড়া ইত্যাদি বিষয়ক দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ এবং নওয়াবদের সমসাময়িককালে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা এখানে সংরক্ষিত আছে।

গ্যালারি ১৭
এখানে কার্ড রুম। এটিও ১৯০৪ সালের আলোকচিত্রের সাথে মিলিয়ে সজ্জিত। প্রদর্শিত অধিকাংশ তৈজসপত্র নওয়াবদের সময়ের মূল নিদর্শন।

গ্যালারি ১৮
১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের আলোকচিত্রের সাথে মিলিয়ে সজ্জিত স্টেট বেডরম্নম এখানে। আহসান মঞ্জিলে আগত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট অতিথিদের বিশ্রামের জন্য কক্ষটি ব্যবহৃত হতো। প্রদর্শিত তৈজসপত্র ও অন্যান্য অধিকাংশ নিদর্শন নওয়াবদের ব্যবহৃত।

গ্যালারি ১৯
নওয়াব আবদুল গনি কর্তৃক ঢাকায় প্রথম পানি সরবরাহ বিষয়ক নিদর্শন ও তথ্যাদি দিয়ে কক্ষটি সাজানো হয়েছে।

গ্যালারি ২০
নওয়াব আহসানউল্লহ কর্তৃক ঢাকায় প্রথম বিদ্যুৎ ব্যবস্থার প্রবর্তন বিষয়ক নিদর্শন ও তথ্যাদি দিয়ে সাজানো হয়েছে।

গ্যালারি ২১
এখানে প্রাসাদ ড্রয়িং রুম। বিশিষ্ট অতিথিবৃন্দকে এখানে সম্ভাষণ জানানো হতো। তাছাড়া, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শের জন্যও এ কক্ষটি ব্যবহৃত হতো। প্রদর্শিত অধিকাংশ নিদর্শন নওয়াবদের আমলের।

গ্যালারি ২২
এটি দোতলার গোলঘর। প্রাসাদ শীর্ষে দৃশ্যমান উঁচু গম্বুজটি এ কক্ষের উপর নির্মিত। এখানে প্রদর্শিত অস্ত্রশস্ত্র আহসান মঞ্জিলেই প্রাপ্ত।

গ্যালারি ২৩
এটি বলরুম বা নাচঘর। এ কড়্গে একত্রে পাশাপাশি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নাচ-গানের একটি কাল্পনিক দৃশ্য বৃহদাকার তৈলচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। প্রদর্শিত রূপার অলংকৃত চেয়ার ও ক্রিস্টাল চেয়ার-টেবিল নওয়াবদের ব্যবহৃত নিদর্শন।


সূত্র :
শিশু বিশ্বকোষ। প্রথম খণ্ড। বাংলাদেশ শিশু একাডেমী। আষাঢ় ১৪০২, জুন ১৯৯৫

http://gharbari.blogspot.com/2010/07/awpowd-ixl-hxzpwxok-ywedw-i-rwbonk.html