ছিটমহল (বাংলাদেশ-ভারত)
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশের কিছু অংশ ভারতের ভিতরে এবং ভারতের কিছু অংশ বাংলাদেশের ভিতরে ছিল। এই অঞ্চলগুলো সাধারণভাবে বাংলাদেশ ভারতের ছিটমহল নামে অভিহিত হতো। বাংলাদেশ ও ভারতের সরকারি হিসেব মতে, বাংলাদেশের ভিতরে ৫১টি ছিটমহল এবং ভারতের ভিতরে ১১১টি ছিটমহল ছিল। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুলাই রাত্রি ১২টার পরে আনুষ্ঠানিকভাবে উভয় দেশের ছিটমহলগুলো মূল দেশের ভৌগোলিক সীমার সাথে যুক্ত হয়।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪-১৫ আগষ্টে সমগ্র ভারতবর্ষ বিভাজিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্র তৈরি হয়। এর ভিতর পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের নামকরণ করা হয় পূর্ব-পাকিস্তান। মূলত অখণ্ড বঙ্গদেশের পূর্বাঞ্চল নিয়ে পূর্ব-পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ভারত বিভাজনের সময় কুচবিহারের রাজা ছিলেন জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ। কথিত আছে রংপুরের রাজার সাথে দাবা খেলার হারজিতের সূত্রে রংপুর-কুচবিহার রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের কিছু কিছু অংশ ছোটো ছোটো ছিটমহলের সৃষ্টি হয়েছিল। পরে রংপুর ও দিনাজপুরের এই ছিটমহলগুলোর কার কোনটি এবং তার আয়তন ইত্যাদি নিয়ে উভয় জমিদারের ভিতরে বাক বিতণ্ডা হয়। ভারত বিভাজনের সময় কুচবিহার ভারতের সাথে যুক্ত হলে, এই বিতর্ক থেকেই যায়। এই সময় পূর্ব পাকিস্তানের কিছু ভূখণ্ড আর পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পড়ে ভারতের কিছু ভূখণ্ড। যা পরে ছিটমহল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম এবং কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি ও ভুরুঙ্গামারী থানার কিছু জমি ভারতীয় সীমান্তবর্তী জেলা কুচবিহারের অন্তর্গত হয়েছিল। জমিগুলো বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। অন্যদিকে কুচবিহার জেলার কিছু জমি বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার বোদা ও দেবীগঞ্জ, নীলফামারীর ডিমলা, লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা ও পাটগ্রাম এবং কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলার অন্তর্গত। এসব জমিও ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভাজনের পরে উভয় দেশই এসব ভূমির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গঠন করা হয় র‌্যাডক্লিফ মিশন। শেষ পর্যন্ত এ মিশন চূড়ান্ত মিমাংসায় আসতে ব্যর্থ হয়।

১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে কুচবিহার ভারতের সাথে যুক্ত হলে, ছিটমহল সমস্যা চূড়ান্তরূপ ধারণ করে। সে সময় ভৌগোলিক আয়তনের বিচারে, ভারতীয় ছিটমহলের জমির পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ১৫৮ একর এবং বাংলাদেশের ছিটমহলের জমির পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ১১০ একর। ভারতীয় ছিটমহলগুলোর অধিকাংশই পড়েছিল বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। এ সবের মধ্যে লালমনিরহাটে ৫৯, পঞ্চগড়ে ৩৬, কুড়িগ্রামে ১২ ও নীলফামারিতে চারটি ভারতীয় ছিটমহল ছিল। অপরদিকে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অবস্থান ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। এর মধ্যে ৪৭টি ছিল ভারতের কুচবিহার ও চারটি জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত ছিল।

১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে পাকিস্তান দাবি করেছিল যে, দহগ্রাম পূর্ব পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডের সাথে সরাসরি ভাবে যুক্ত রয়েছে। কিন্তু মানচিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, এটি পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত হতে প্রায় ৮৫ মিটার পশ্চিমে অবস্থিত। তখন থেকে এটি দুই দেশের মধ্যকার বিরোধের অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুন ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর মধ্যে বেরুবাড়ি ছিট মহল নিয়ে একটি চুক্তি হয়। কিন্তু সেটি ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের আদেশে ব্যর্থ হয়ে যায়।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে, ছিটমহল সমস্যাটাই ভারত-বাংলাদেশের সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী  এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এই বিষয়ে একটি চুক্তি করেন। ইন্দিরা মুজিব নামক এই চুক্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে ভারতীয় ছিটমহল এবং ভারতে বাংলাদেশের ছিটমহলগুলো অতি সত্বর বিনিময় করতে হবে।’ চুক্তিতে আরো বলা হয়, ‘ভারত দক্ষিণ বেরুবাড়ী ইউনিয়ন নং-১২ এর দক্ষিণ দিকের অর্ধাংশ ও পার্শ্ববর্তী ছিটমহলগুলোর অধিকারী হবে, যে এলাকার পরিমাণ ২.৬৪ বর্গমাইল। বিনিময়ে বাংলাদেশ দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমলের অধিকারী হবে। বাংলাদেশের পানবাড়ী মৌজার সঙ্গে দহগ্রামকে সংযুক্ত করার জন্য ভারত বাংলাদেশকে ‘তিন বিঘা’ নামে (১৭৮×৮৫) মি. এলাকা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেবে।’ এই চুক্তি অনুসারে তিন বিঘা করিডোর’ এর বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতকে দেয়- বেরুবাড়ী ছিটমহল। কিন্তু বিনিময়ে ভারত তিনবিঘা কড়িডোর ব্যবহারে তেমন সুবিধা দেয় নি।

১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহল পাটগ্রাম উপজেলার একটি স্বতন্ত্র ইউনিয়ন ‘দহগ্রাম ইউনিয়ন’ হিসেবে পরিগণিত হয় এবং ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ আগস্ট এখানে ইউনিয়ন পরিষদের  উদ্বোধন ঘটে।

১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তিন বিঘা করিডোরের অনুমোদন দিলে, ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ তৎকালীন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও ভারতীয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও আবার একটি চুক্তি করেন। এই চুক্তির মাধ্যমে এক ঘন্টা পরপর কড়িডোর খুলে রাখার সিদ্ধান্ত হয়।

২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পশ্চিমবঙ্গের চারবার নির্বাচিত এমএলএ দীপক সেনগুপ্ত ছিটমহলবাসীর সমস্যা সমাধানে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেন। এই বিষয়ে চূড়ান্ত ফলাফলের আগেই ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর সন্তান দীপ্তিমান সেন এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে থাকেন।

২০১১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ছিটমহল সমস্যা সমাধানে বিশেষ উদ্যোগ নেন। এই বৎসরে ছিটমহল-সহ উভয় দেশের অন্যান্য বিষয়ের সমাধানের জন্য মনমোহন সিং ঢাকা আসেন। এই সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিষয়ে তৎপরতা এবং মনোমোহন সিং-এর আন্তরিকতা থাকা সত্বেও   পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসহযোগিতার কারণে তা কার্যকর হয় নি। তবে ঢাকাতে অনুষ্ঠিত হাসিনা-মনমোহন বৈঠকে স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশীদের যাতায়াতের জন্য তিনবিঘা করিডোর বর্তমানে ২৪ ঘন্টা খোলা রাখার ব্যবস্থা চালু হয়।

দ্বিতীয়বারের মতো শেখ হাসিনা ক্ষমতা লাভের পর, তিনি পুনরায় ছিটমহল সমস্যা বিয়ে তৎপরতা শুরু করেন। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মে ভারতের লোকসভায় ’৭৪-এর স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুমোদন লাভ করে। শেষ পর্যন্ত এই বৎসরের ১লা আগষ্ট থেকে এই বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়।

এই নিষ্পত্তি অনুসারে, চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশ ভারতের অভ্যন্তরে থাকা ১১১টি ছিটমহলের অধিকার লাভ করে। এর ফলে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত হয় ১৭১৬০.৬৩ একর। পক্ষান্তরে ভারত লাভ করে ৫১টি ছিটমহল। এগুলোর আয়তন ৭১১০.০২ একর।


সূত্র :