পুঠিয়ার রাজবাড়ি
বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলায় অবস্থিত একটি রাজবাড়ি। রাজশাহী শহর থেকে ত্রিশ কিলোমিটার পূর্বে এবং রাজশাহী-নাটোর মহাসড়ক থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দক্ষিণে এই রাজবাড়িটি অবস্থিত। পুঠিয়ার জমিদারি মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে 'রানী হেমন্তকুমারী দেবী' এই রাজবাড়ি তৈরি করেছিলেন। এই রাজবাড়িটি পরিখা দ্বারা পরিবেষ্টিত। পরিখাগুলো বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন— শিব সরোবর বা শিবসাগর, গোপালচৌকি, বেকিচৌকি, গোবিন্দ সরোবর ও মরাচৌকি। এছাড়া রাজবাড়ি এলাকার মধ্যস্থলে রয়েছে শ্যামসাগর নামে একটি বিশাল পুষ্করিণী।   


পঞ্চরত্ন শিবমন্দির
পুঠিয়া রাজবাড়ি ও তার পার্শবর্তী মৌজায় মোট চৌদ্দটি মন্দির এখনো পূর্ণ অবয়বে রয়েছে। মন্দিরগুলোর মধ্যে দুটি পঞ্চরত্ন, একটি দোচালা, একটি মিশ্ররীতির ত্রি-মন্দির, একটি অষ্টকোণা একরত্ন, দুটি সমতলছাদ বিশিষ্ট এবং বাকিগুলো পিরামিড আদলের চৌচালা ছাদ সংবলিত। মন্দিরগুলো নির্মাণে ইট ও চুন-সুরকি ব্যবহৃত হয়েছে। অলঙ্করণ হিসেবে অধিকাংশ মন্দিরেই হিন্দু ধর্মীয় ও তদানীন্তন সামাজিক বিষয়বস্তু অবলম্বনে উৎকীর্ণ পোড়ামাটির ফলক শিল্পের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।পুঠিয়া রাজবাড়ি এলাকায় প্রবেশপথের পূর্ব পাশের শিব সরোবরের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত সুউচ্চ এই মন্দিরটি পুঠিয়ার মন্দির স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। সুউচ্চ (১১ইঞ্চি-৮ইঞ্চি) ও সুবিশাল এক বর্গাকার (৬৫ বর্গইঞ্চি) মঞ্চের উপর এক কক্ষ বিশিষ্ট এই মন্দিরটির প্রতিটি রত্নের উপরিভাগ ক্রমান্বয়ে সজ্জিতাকারে স্থাপিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কতকগুলো সুঁচালো চূড়ায় আচ্ছাদিত। কেন্দ্রীয় কক্ষের অভ্যন্তরে কৃষ্ণপ্রস্তরে নির্মিত একটি বিশালাকৃতির শিবলিঙ্গ স্থাপিত রয়েছে। কেন্দ্রীয় কক্ষ ও তার চারিদিকের প্রদক্ষিণ বারান্দার চার কোণের অভ্যন্তরস্থ উপরিভাগ অর্ধবৃত্তাকৃতির গম্বুজে ও চার বলয় চৌচালা ছাদে আচ্ছাদিত। প্রদক্ষিণ বারান্দার চারিধার মোগল রীতির খাঁজখিলান পথে উন্মুক্ত। মন্দিরটির সুউচ্চ মঞ্চে আরোহণের জন্য উত্তর ও দক্ষিণ পাশে দুটি সিঁড়িপথ বিদ্যমান। ১৮২৩-১৮৩০ সনে রাজা জগন্নারায়ণের স্ত্রী রানি ভুবনময়ী এটি নির্মাণ করেন। এটি নির্মাণে সে সময় তিন লক্ষ মুদ্রা ব্যয় হয়েছিল বলে জানা যায়। পূর্বে মন্দিরায়তনের দ্বারের নিকট একটি জলঘড়ি ছিল যা বর্তমানে নেই। জনৈক আচার্য ব্রাহ্মণ তা পরিচালনা করতেন বলে জানা যায়। মন্দিরটির নির্মাণ কৌশল ও অলঙ্করণ অপূর্ব। এই মন্দিরের সৌন্দর্য উপভোগের লোভ স্বয়ং লর্ড কারমাইকেলও সংবরণ করতে না পেরে একদা তিনি এ মন্দির দর্শনের জন্য সকলের অগচোরে পুঠিয়ায় প্রবেশ করেছিলেন বলে জানা যায় (সূত্র: বিমলাচরণ মৈত্রেয়, পুঠিয়া রাজবংশ, কলকাতা: প্যারিস আর্ট প্রেস, ১৯৫৩)।


পঞ্চরত্ন বড় গোবিন্দ মন্দির
রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে পূর্ব অংগনের (মন্দিরাঙ্গন) মধ্যস্থলে এই মন্দিরটি অবস্থিত।একটি সুউচ্চ বর্গাকার মঞ্চের উপর স্থাপিত মন্দিরটির ভূমি নকশা পঞ্চরত্ন শিবমন্দিরের মতই। তবে মন্দিরটির বহির্দেয়ালগাত্রের সম্পূর্ণ অংশ দিনাজপুরের কান্তনগরের নবরত্ন মন্দিরের ন্যায় পোড়ামাটির ফলক দ্বারা অপূর্ব অলঙ্করণে সজ্জিত। অলঙ্করণ বিষয়বস্তু হিসেবে রামায়ণ-মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনাবলী উপস্থাপনের পাশাপাশি মুসলিম স্থাপত্য অলঙ্করণের বীমূর্ত বিষয়বস্তুসহ তদানীন্তন সমাজ ব্যবস্থারও একটা প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে। ভূমি নকশা অনুযায়ী মন্দিরটি মূল গর্ভগৃহকে কেন্দ্র করে মূলত পাঁচটি বর্গাকার ও চারটি স্বল্প আয়তনের আয়তাকার কক্ষে বিভক্ত। চারদিকের আয়তাকার কক্ষ চারটি প্রকৃতপক্ষে বারান্দা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বর্গাকার কক্ষ সমূহের অন্তরস্থ উপরিভাগ অর্ধবৃত্তাকৃতির গম্বুজ ও আয়তাকার কক্ষ বা বারান্দা সমূহের উপরিভাগ খিলানছাদে (ছই আকৃতির) আচ্ছাদিত হলেও বহির্ভাগ সমতল করে কেন্দ্রীয় কক্ষ এবং চার কোণার ক্ষুদ্র কক্ষ চারটির উপরে পাঁচটি রতন্ স্থাপিত হয়েছে। রত্ন সমূহের উপরিভাগ পিরামিড আদলের চৌচালা ছাদে আচ্ছাদিত। মন্দিরের চারদিকের বারান্দাসমূহ তিনটি করে অর্ধবৃত্তাকার খাঁজখিলান পথে উন্মুক্ত। মন্দিরটি কে, কখন নির্মাণ করেছিলেন তা সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে মন্দিরটির পশ্চিম বহির্দেয়ালগাত্রের শীর্ষভাগে স্থাপিত একটি ভগ্ন শিলালিপিতে প্রেমনারায়ণস্য দৃষ্টে পুঠিয়া রাজবংশ গ্রন্থের লেখক বিমলাচরণ মৈত্রেয় অনুমান করেছেন যে, হয়তোবা মন্দিরটি রাজা প্রেমনারায়ণ কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। তাঁর এই অনুমান যথার্থ হলে মন্দিরটি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে নির্মিত বলে ধরে নেয়া যেতে পারে।    


ছোট আহ্নিক মন্দির
এটি পাঁচ আনি রাজবাড়ির পূর্ব ভিটায় বর্তমান থানা ভূমি অফিসের (মহারানি হেমন্তকুমারীর বাসভবন) উত্তর-পশ্চিম কোণায় অবস্থিত। দোচালা এই মন্দিরটির গৃহমুখ পঞ্চরত্ন বড় গোবিন্দ মন্দিরের ন্যায় হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে উৎকীর্ণ পোড়ামাটির ফলকে সজ্জিত। মন্দিরটির সঠিক নির্মাণ তারিখ জানা যায় না। তবে এটি পঞ্চরত্ন বড় গোবিন্দ মন্দিরের সমসাময়িক অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে কিংবা ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নির্মিত বলে অনুমিত হয়।


দোলমন্দির
রাজবাড়ির সম্মুখ মাঠের উত্তর প্রান্তে রাস্তা সংলগ্ন (পুঠিয়া বাজারে) এই মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরটি ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে চারটি স্তরে নির্মিত। প্রতিটি স্তরই খিলান সারি দ্বারা উন্মুক্ত। সর্ব্বোচ্চ স্তরের ক্ষুদ্র কক্ষটি শীর্ষদণ্ড সংবলিত শিরাল গম্বুজে আচ্ছাদিত এবং এই কক্ষে রাধা-কৃষ্ণের দোল খাওয়ানোর ব্যবস্থা ছিল বলে জানা যায়। মন্দির গাত্রের এক শিলালিপি অনুসারে এটি রাজা ভুবনেন্দ্রনারায়ণ কর্তৃক ১৭৭৮ সনে নির্মিত হয়। বর্তমানে মন্দিরটি সংস্কার করা হয়েছে।

পুঠিয়া রাজবাড়ি সত্যসত্যই বাংলাদেশে বিদ্যমান অন্যান্য রাজবাড়িগুলোর চেয়ে মোটামুটি সুরক্ষিত এবং নজরকাড়া স্থাপত্যে সজ্জিত। এক সাথে পূর্ণ অবয়বে বিদ্যমান এত মন্দিরের সমারোহ বাংলাদেশের অন্যকোন রাজবাড়িতে পরিলক্ষিত হয় না। ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত এসব নান্দনিক স্থাপত্যের সৌন্দর্য অবলোকনে প্রতিদিনই পুঠিয়ায় প্রত্নপিপাসু, দেশী-বিদেশী পর্যটক ও সাধারণ দর্শনার্থীদের সমাগম ঘটে।তাই বলা যায় পুঠিয়ার মাঝে লুকিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিকাশের এক অমিত সম্ভাবনা।


লেখিকা : ইসমাত আরা রুচি