১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে উয়ারী গ্রামের একদল শ্রমিক মাটি খননকালে একটি পাত্রে সঞ্চিত কিছু রৌপ্য মুদ্রা পায়। স্থানীয় স্কুলশিক্ষক জনাব মোহাম্মদ হানিফ পাঠান সেখান থেকে ২০-৩০টি মুদ্রা সংগ্রহ করেন। এগুলো ছিলো বঙ্গভারতের প্রাচীনতম রৌপ্যমুদ্রা। এ বিষয়ে তৎকালীন সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকাতে "প্রাচীন মুদ্রা প্রাপ্তি" শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। জনাব পাঠান এবং তাঁর ছেলে জনাব হাবিবুল্লা পাঠান তখন থেকে এই এলাকার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সংগ্রহ ও গবেষণার কাজে হাত দেন।
রৌপ্যমুদ্রা ও পাতিল |
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দ হাবিবুল্লাহ উয়ারীর পার্শ্ববর্তী বটেশ্বর নামক গ্রামের স্থানীয় শ্রমিকদের ফেলে যাওয়া দুটি 'ত্রিকোণাকার ও এক মুখ চোখা' লৌহ নির্মিত অস্ত্র সংগ্রহ করেন। এ বিষয়ে জনাব মোহাম্মদ হানিফ পাঠান, ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের দৈনিক আজাদ পত্রিকার ৩০ জানুয়ারির 'রবি বাসরীয়' সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধটির নাম ছিল – "পূর্ব পাকিস্তানে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা"।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে উয়ারী গ্রামের জনৈক কৃষক জাড়ু, মাটি খননকালে রৌপ্য মুদ্রার একটি ভাণ্ড পান। ওই ভাণ্ডে প্রায় চার হাজারের মতো মুদ্রা ছিল। ওজন ছিলো প্রায় নয় সের। পরে জাড়ু মুদ্রাগুলো আশি টাকা সের দরে জনৈক রৌপ্যকারের কাছে বিক্রি করে দেন। এই তথ্যটুকু ছাড়া এই মুদ্রাগুলোর কোনো নমুনা পাওয়া যায় নি। ১৯৭৪-১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে জনাব হাবিবুল্লাহ পাঠান ঢাকা জাদুঘরের অবৈতনিক সংগ্রাহক ছিলেন। এই সময় তিনি এই অঞ্চলে প্রাপ্ত ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা, পাথরের গুটিকা, লৌহ কুঠার ও বল্লম জাদুঘরে অর্পণ করেন।
বিভিন্ন ধরনের পুথি |
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে উয়ারী
গ্রামের শাহবুদ্দিন মাটির নিচ থেকে ব্রোঞ্জের তৈরি ৩৩টি পাত্র উদ্ধার
করেন। টাকার লোভে এই পাত্রগুলো মাত্র ২০০ টাকায় এক ভাঙ্গারির কাছে
বিক্রি করে দেন শাহাবুদ্দিন। এই নমুনাগুলোও চিরতরে হারিয়ে গেছে। এরপর
জনাব হাবিবুল্লাহ পাঠান অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে
–
প্রাচীন প্রত্নসামগ্রী খুঁজে দেবার জন্য স্থানীয় শিশু-কিশোরদেরকে
নিয়োগ দেন। এই সূত্রে তিনি বিষ্ণুপট্ট, ব্রোঞ্জের তৈরি ধাবমান অশ্ব,
উচ্চমাত্রায় টিনমিশ্রিত পাত্র, শিব, নৈবেদ্য পাত্র, রেলিক
কাসকিট (Relic casket)-এর
ভগ্নাংশ, পাথরের বাটখারা, নব্যপ্রস্তর যুগের বাটালি, লৌহকুঠার, বল্লম,
পাথরের তৈরি সিল, ত্রিরত্ন, কচ্ছপ, হস্তী, সিংহ, হাঁস, পোকা, ফুল,
অর্ধচন্দ্র , তারকা, রক্ষাকবচ (Amulate),
পোড়ামাটির কিন্নর, সূর্য ও বিভিন্ন জীব-জন্তুর প্রতিকৃতি, রিংস্টোন,
ব্রোঞ্জের গরুড়, কয়েক সহস্র স্বল্প মূল্যবান পাথর ও কাচের গুটিকা
ইত্যাদি সংগ্রহ করতে সমর্থ হন।
প্রাপ্ত
তাবিজ
এতসব
প্রাচীন নমুনা সংগ্রহের সূত্রে দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকরা উৎসাহিত
হয়ে উঠেন। পরে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে শুরু হয় খননকাজ। এই খননকাজে
নেতৃত্ব দেন উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জনাব সুফি মোস্তাফিজুর
রহমান। এই দলের উপনেতা ছিলেন জনাব মিজানুর রহমান। আর এই খননকাজেই
সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন সে সময়ের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীবৃন্দ। সেই সাথে উল্লেখ করার মতো ছিল
–
স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা। পরে এই কাজের জন্য সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতার হাত
বাড়িয়ে দিয়েছিল মুঠোফোন ফোন কোম্পানী 'গ্রামীণ ফোন'। ২০১০
খ্রিষ্টাব্দের ৯ জানুয়ারি তারিখে, এই খনন কাজে
প্রথমবারের মতো আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দিতে এগিয়ে আসে বাংলাদেশ সংস্কৃতি বিষয়ক
মন্ত্রণালয়। বর্তমানে এই প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ক্ষেত্রটি
'উয়ারী-বটেশ্বর' নামেই পরিচিত।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এই অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয় প্রাচীন
দুর্গ-নগর, বন্দর, রাস্তা, পার্শ্ব-রাস্তা, পোড়ামাটির ফলক,
স্বল্প-মূল্যবান পাথর, কাচের পুঁতি এবং উপমহাদেশের প্রাচীনতম
ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা। এই খনন ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে উল্টো-পিরামিড
আকৃতির স্থাপত্যকর্ম। প্রাথমিকভাবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল এই
দুর্গটি এটি প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরানো। এই অঞ্চলে
প্রাপ্ত কিছু বস্তুর কার্বন-১৪ পরীক্ষার প্রেক্ষিতে ধারণা করা হয়
–
উয়ারীর বসতির সময় ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ। উল্লেখ্য উয়ারী গ্রামে
৬৩৩ মিটার দীর্ঘ বাহুবিশিষ্ট বর্গাকৃতি গড় ও পরিখা পাওয়া গেছে। আরেকটি
বহির্দেশীয় (৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট) গড় ও পরিখা সোনারুতলা গ্রাম
থেকে শুরু করে বটেশ্বর হানিয়াবাইদ, রাজারবাগ ও আমলাব গ্রামের ওপর
দিয়ে আঁড়িয়াল খাঁ নদের প্রান্তসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত। এটিকে স্থানীয়
লোকজন "অসম রাজার গড়" বলে থাকেন।
২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ-এপ্রিলে জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের খননের সূত্রে–
উয়ারী গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে ১৮ মিটার দীর্ঘ, ৬ মিটার প্রশস্ত ও ৩০
সেন্টিমিটার পুরু একটি প্রাচীন পাকা রাস্তা। রাস্তাটি নির্মাণে ব্যবহৃত
হয়েছে ইটের টুকরা, চুন, উত্তর ভারতীয় কৃষ্ণ মসৃণ মৃৎপাত্রের টুকরা,
তার সঙ্গে রয়েছে ল্যাটারাইট মাটির লৌহযুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. সুফি
মোস্তাফিজুর রহমান এটিকে আড়াই হাজার বছর পুরনো বলে দাবি করেছেন।
এসম্পর্কে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক
দিলীপ কুমার চক্রবর্তীর অভিমত, এতো দীর্ঘ ও চওড়া রাস্তা এর আগে পুরো
গাঙ্গেয় উপত্যকায় দ্বিতীয় নগরায়ণ সভ্যতায় কোথাও আবিষ্কৃত হয়নি।
গাঙ্গেয় উপত্যকায় দ্বিতীয় নগরায়ণ বলতে সিন্ধু সভ্যতার পরের
নগরায়ণের সময়কে বোঝায়। ফলে যেটি আবিষ্কৃত হয়েছে বলা হচ্ছে তা তধু
বাংলাদেশেই নয়, সিন্ধু সভ্যতার পর ভারতবর্ষের সবচেয়ে পুরোন রাস্তা
হিসেবে বিবেচনায় আসে।
গ্রিক ভূগোলবিদ টলেমি তাঁর
Geographia
গ্রন্থে এই অঞ্চলে 'সৌনাগড়া' নামক একটি অঞ্চলের
নামোল্লেখ করেছিলেন। টলেমির এই নামটি হয়তো সুবর্ণগ্রাম বা সোনারগাঁও।
বঙ্গদেশের এই অঞ্চলের পলিবিধৌত নতুন ভূমিতে যে বসতি স্থাপিত হয়েছিল,
তার বিস্তৃত অংশ ছিলো
– বর্তমান সময়ের
সাভার, কাপাসিয়া, বর্ষী, শ্রীপুর, টোক, বেলাব, মরজাল, পলাশ, শিবপুর,
মনোহরদী, উয়ারী-বটেশ্বর। আর এই অঞ্চলের যোগাযোগ ও কৃষিকাজের জন্য
মূখ্য ভূমিকা রেখেছিল–
লক্ষা, ব্রহ্মপুত্র, আড়িয়াল খাঁ, প্রভৃতি নদ-নদী। এর ভিতরে পুরাতন
ব্রহ্মপুত্র ও আঁড়িয়াল খাঁ নদের মিলনস্থলের অদূরে ছিল–
কয়রা নামক একটি শুষ্ক নদীখাত। এর দক্ষিণতীরে মাটির উঁচু ভূখণ্ডে
অবস্থিত উয়ারী-বটেশ্বর। সে সময়ের ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা
করে বলা যায়–
এই অঞ্চলের বহির্বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে এই অঞ্চল ব্যবহৃত হতো।
টলেমির বিবরণ থেকে জনাব দিলীপ কুমার চক্রবর্তীর অনুমান করেছেন
–
আদি ঐতিহাসিক যুগে উয়ারী-বটেশ্বর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও রোমান
সাম্রাজ্যের মালামাল সংগ্রহ ও বিতরণের সওদাগরি আড়ত (Entry
port) হিসেবে কাজ করতো। এই
বিচারে অনেকে মনে করছেন যে, টলেমি-কথিত 'সৌনাগড়া' ছিল একালের
'উয়ারী-বটেশ্বর'।
বৌদ্ধ মন্দিরের পদ্ম |
২০১০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে নবম ধাপের খনন কাজ শুরু হয়। এই সময় উয়ারী থেকে চার কিলোমিটার দূরে, শিবপুর উপজেলায় ধুপিরটেকে আবিষ্কৃত হয়েছে – একটি বৌদ্ধমন্দির। এই মন্দির চত্বরে আটটি পাপড়িযুক্ত একটি পদ্ম প্রায় অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এই কারণে এই মন্দিরটিকে বৌদ্ধ পদ্মমন্দির বলা হয়। ধারণা করা হয়, এই মন্দিরটি প্রায় ১,৪০০ বছর আগের ইটে নির্মিত হয়েছিল। প্রাচীন এই মন্দিরটি বর্গাকার (১০.৬ মিটার x ১০.৬ মিটার)। এর দেয়াল কাদামাটির গাঁথুনির। ৮০ সেন্টিমিটার প্রশস্ত এই দেয়ালের ভিত্তিমূল এক মিটার। মূল দেয়ালের উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমে ৭০ সেন্টিমিটার দূরত্বে সমান্তরালভাবে ৭০ সেন্টিমিটার প্রশস্ত আরও একটি দেয়াল রয়েছে। মূল দেয়ালের চারদিকে ইট বিছানো ৭০ সেন্টিমিটার প্রশস্ত একটি প্রদক্ষিণ পথ রয়েছে। এই পথের বাইরের দিকে মূল দেয়ালের সমান্তরাল ৬০ সেন্টিমিটার প্রশস্ত আরও একটি দেয়াল রয়েছে। তবে পূর্বদিকে মূল দেয়াল ও বাইরের দেওয়ালের মধ্যকার দূরত্ব ৩.৫ মিটার। পূর্বদিকে প্রদক্ষিণ পথ ও একটি বারান্দা রয়েছে। এপর্যন্ত বৌদ্ধমন্দিরটিতে দুটি নির্মাণ যুগ শনাক্ত করা হয়েছে। আদি নির্মাণ যুগের ইট বিছানো মেঝের অংশবিশেষ উন্মোচিত হলেও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করতে আরও সময় লাগবে। তবে পরবর্তী নির্মাণ যুগে পূর্ব-দক্ষিণ কোণে ইট বিছানো একটি বেদি পাওয়া গেছে।