কোচ
(নৃগোষ্ঠী)
ইংরেজি :
Couch।
ভারত ও বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য একটি প্রাচীন নৃ-জনগোষ্ঠী। এরা মঙ্গোলয়েড নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। এদের চওড়া মুখমণ্ডল, চ্যাপ্টা নাক ও দীর্ঘ চোয়াল। গায়ের রঙ পীতাভ, শ্যামলা, কালো হয়ে থাকে। আকারে নাতিদীর্ঘ। দেহ মাংসবহুল স্থূল ধরনের।
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ কোচক দেশের নাম পাওয়া যায়। তিব্বত, ভুটান-এ এরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ভুটানের মূল জনগোষ্ঠী ভুটিয়াদের সাথে এদের বেশ মিল আছে। একসময় এই নরগোষ্ঠী ভারতের কোচবিহার (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি বিভাগের একটি জেলা) অঞ্চলে বসবাস করে।
কোচবিহারের সঙ্গে ভুটানের ভুটিয়াদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল। ধর্মের দিক থেকে কোচরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী, আর ভুটিয়ারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এক সময় এরা বাংলাদেশের দিনাজপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারতের আসাম এবং মেঘালয়ে কমবেশি দেখা যেতো। বর্তমানে অন্যান্য পাহাড়ি জাতিসত্তা, বিশেষত রাজবংশীদের (দ্রাবিড় নৃগোষ্ঠীর একটি শাখা) সংমিশ্রণে এরা অনেকাংশেই বিলুপ্তির পথে। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ভারতীয় আদম শুমারি অনুসারে এদের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১০,২০০ জন। বর্তমানে এরা বিপন্ন নৃগোষ্ঠী হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
শ্রীহেমন্তকুমার রায় বর্ম্মা তাঁর কোচবিহারের ইতিহাস গ্রন্থে কোচ জাতির একটি কোচ-প্রবাদ উল্লেখ করে লিখেছেন—
"কোচগণের মধ্যে প্রবাদ আছে, "কোচ, মেচে, লিম্বু, লেপচে" এই চারি ভ্রাতা ভোটানের পাহাড় অঞ্চলে বাস করিত। সেখানে অন্য জাতির সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়ায় তাহারা সমতলে আসিতে থাকে। কোচে ও মেচে দুই ভাই, ছোট ভাইদের জন্য রাস্তায় চিহ্ন রাখিয়া আসে। কিন্তু ছোট ভাই লিম্বু ও লেপচে রাস্তা ভুল করিয়া অন্যত্র চলিয়া যায়। বড় ভাই কোচে সমতলে নামিয়া ভোটান ঘাটের নিকটে শঙ্কোশ নদী ও রায়ডাক নদীর মধ্যবর্ত্তী অঞ্চলে বসবাস করিতে থাকে। কোচগণ শঙ্কোশ নদীকে 'আমাইজ' অর্থাৎ মাতৃদেবী বলে এবং রায়ডাক নদীকে 'আওয়া' অর্থাৎ বাবা বলে। কারণ এই দুই নদীর মধ্যবর্ত্তী স্থানে তাহারা প্রথম বাস করে, এই অঞ্চল বর্ত্তমান জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর পূর্বাংশে এবং আসামের উত্তর পশ্চিমাংশে অবস্থিত। পরবর্ত্তীকালে কোচগণ অন্যান্য স্থানে বাস করিতে আরম্ভ করে। বর্ত্তমানে কোচগণ প্রধানত গারো পাহাড়ের পশ্চিম দক্ষিণ অঞ্চল, গোয়ালপাড়া ও আলিপুরদুয়ার অঞ্চলে বসবাস করে। কোচবিহার জেলায় কোচ জাতি বসবাস করে না। আরও প্রবাদ আছে যে কোচগণ পূর্বে ভোটানের 'বথ হাচু' অর্থাৎ বথ পাহাড়ে বাস করিত। ভোটিয়াদের সঙ্গে যুদ্ধ হওয়ায় তাহারা আসামের কোকরাঝারের পূর্বদিকে বউকুমারী পাহাড়ে চলিয়া যায় ও সেখানে বাস করিতে থাকে। প্রবাদ যে সেখানে তাহাদের একটি রাজ্য স্থাপিত হয়। সেই রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিল 'কোচরানগর'। বর্ত্তমানে রাভাগণও কোচ জাতিভুক্ত বলিয়া দাবি করে।"
খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে কোচরা ছোটো
ছোটো রাজ্যের পত্তন ঘটিয়েছিল। ১১০০ খ্রিষ্টাব্দের ময়মনসিংহের গারো পাহাড় এবং
তৎসংলগ্ন অঞ্চলে কোচরা বিশেষ আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের
দিকে বৃহত্তর ময়মনসিংহের শেরপুর অঞ্চলে দলিপা নামক একজন কোচ রাজা রাজত্ব করতেন।
উত্তরের গারো পাহাড়ের কড়ই বাড়ি, খুটিমারী, বার হাজারী হইতে দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদ
এবং পূর্বে নেতাই নদী হইতে পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তাঁর রাজত্ব বিস্তৃত ছিল।
তাঁর রাজধানী ছিল গড় জরিপা। রাজধানীতে দলিপার ১১ শত একর জমির উপর পরপর সাতটি
মাটির সু-উচ্চ প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত একটি দুর্গ ছিল। ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দের
দিকে দ্বিতীয় ফিরোজশা বাংলার সিংহাসন অধিকার করার পর, তাঁর সেনাপতি মজলিস খাঁ
ময়মনসিংহ অঞ্ল অধিকারের জন্য অগ্রসর হলে, কোচ রাজা দলিপা'র সাথে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে
দলিপা পরাজিত ও নিহত হলে, এই অঞ্চলে কোচ রাজ্যের অবসান ঘটে।
এই মুসলমান শাসনামলের প্রথমদিকে কোচ অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর লোকেরা শান্তিপূর্ণভাবেই
মুসলমান শাসনকে মেনে নিয়েছিল। খ্রিষ্টীয় ১৬ শতকের দিকে মুসলিম শাসক গোষ্ঠীর
অন্তর্কলহের সূযোগে বিশু বা বিশ্বসিংহ নামক একজন কোচ সর্দার রাজা হিসাবে আত্মপ্রকাশ
করেন। ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে নরনারয়ণের নামানুসারে কোচ রাজারা নিজেদের নামের সাথে
নারায়ণ শব্দ ব্যবহার করা শুরু করেন। ১৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে কোচ রাজ্য মোগলদের অধীনে চলে
যায়। এই সময় কোচ রাজ্য মোগলদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়। ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে ইংরজদের
সাথে কোচরাজ্যের সন্ধি চুক্তি হয়। এই সময় ইংরেজরা কোচরাজার কাছ থেকে বার্ষিক ৬৭,০০০
হাজার টাকা কর পেতো।
বাংলাদেশের কোচরা বরাবরই অকৃষিজীবী এবং কিছুটা যাযাবর ধর্মী জীবনযাপন করতো। এদের বেশিরভাগই ছিল মৎস্যজীবী। এই কারণে নদীবিধৌত অঞ্চলেই মূলত তাদের বসবাস করতো। খাল-বিল-নদী-নালায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করাই ছিল তাদের একমাত্র পেশা। স্থানীয়ভাবে ‘কুচিয়া’ বা ‘কুচ্যা’ নামে পরিচিত বাইন ধরনের এক রকমের জলচরপ্রাণী (সরীসৃপ জাতীয়) তাদের অন্যতম শিকারের বস্তু। কুচিয়া শিকার ও ভক্ষণ এই গোষ্ঠীর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ভাত, মদ, মাংস তাদের প্রিয় খাদ্য। তবে খাদ্যের ব্যাপারে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধি-নিষেধও কার্যকর রয়েছে।
কোচরা আংশিক মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার উত্তরাধিকারী। বর্তমানকালে কোচ সমাজে সম্পত্তির উত্তরাধিকার পিতা থেকে পুত্রে বর্তায়। কিন্তু সন্তানেরা এখনও মায়ের গোত্রের অন্তর্গত। স্ত্রীর বাড়িতে স্বামীর বসবাস, ঘরজামাই প্রথা, শ্বশুরবাড়িতে কাজ করা, কন্যাপণ ইত্যাদি প্রথা রয়েছে।
কোচরা অন্যান্য আদিবাসীর মতো সর্বপ্রাণবাদী। বৌদ্ধযুগে এরা যথার্থ বৌদ্ধধর্মের আসক্ত হয় নি। এরা ধর্মবিশ্বাস ও শাস্ত্রীয় ধর্মের বাঁধন উপেক্ষা করে লোকায়ত বিশ্বাসে বিশ্বাসী। প্রেতপূজা কোচদের একটি অন্যতম উপাসনার বিষয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে পুনর্জন্মবাদ ও পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে পূজাপার্বণ প্রচলিত আছে। কোচদের প্রধান দেবতা ঋষি এবং তাঁর পত্নী জগো। এরা ‘লংঠায় রায়’ নামে শিলদেবতার পূজা করে। লংঠায় রায়ের সাত ভাই। ডিরকা, মিরকা, কালোরা, বলোরা, কান্তাবুড়, মহবুড় এবং সোনারায়। সাত বোন হলো− সানকা, মেনকা, রূপারায়, রাউতি, সাউতি, আকালি ও সাকালি। রংঠায় রায়ের সাত ভাই ও সাত বোন কোচদের উপাস্য। সমাজে টোটেম ও টাবুর অপ্রতিহত প্রভাব বিদ্যমান। বিশেষ প্রজাতির প্রাণী কিংবা বিশেষ প্রজাতির বৃক্ষের প্রতি রয়েছে তাদের একধরনের আনুগত্য। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী কোচ সম্প্রদায়ের নিজস্ব কোন ব্রাহ্মণ নেই। এদের মধ্যে ওঝা বা ধর্মগুরু খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। এ সম্প্রদায়ের মূল ধমীয় মতকে এ্যানিমিজম বা জড়বাদ বলে অনেকেই আখ্যায়িত করে থাকে, যদিও এ মন্তব্যে অতিশয়োক্তি রয়েছে।
তথ্যসূত্র:
বাংলা বিশ্বকোষ। দ্বিতীয় খণ্ড। নওরোজ কিতাবিস্তান। ডিসেম্বর ১৯৭৫।
কোচবিহারের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড)। খাঁ চৌধুরী আমানতউল্লা আহমদ, সংকলক। ১৯৩৬।
কোচবিহারের ইতিহাস, কোচবিহার। শ্রীহেমন্তকুমার রায় বর্ম্মা ১৯৮৮।
যে সংগ্রামের শেষ নেই। প্রমোদ গুপ্ত, কলিকাতা।খ ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ।
http://www.prayway.com/unreached/peoplegroups2/1880.html