ঞ্চঙ্গ্যা
অপরাপর নাম : চাঙ্‌মা, চাকামা,  সাকমা।

বাংলাদেশ ও মায়ানমারে মোঙ্গোলীয় মহাজাতির অন্তর্গত একটি জাতিসত্তার নাম। চীন বা তিব্বত থেকে এরা
আরাকানে বসতি স্থাপন  করেছিল। এরাও নিজেদেরকে চীনা বংশোদ্ভূত বলে মনে করে। তবে স্থানীয়ভাবে এদেরকে চাকমাদের একটি বিভাগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের মগ সম্প্রদায় এদেরকে 'দৈংনাক' নামে অভিহিত করে থাকেন। কারণ আরাকান প্রদেশের দৈংনাকপাড়া নামক স্থানে এরা এককালে বসবাস করত। এবং বাসস্থানের নাম অনুসারে তাদেরকে  দৈংনাক বলা হয়। আবার আরাকানের পূর্বনাম ছিল রোয়াং। এ কারণে বান্দরবানের তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে রোয়াঙ্গাও বলা হয়।

এরা আরাকানের স্থানীয় মগদের দ্বারা লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ভোগ করেই জীবনযাপন করতো। ১৪১৮-১৯ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানের শাসনকর্তা জালালুদ্দিনের অনুমতি ক্রমে তাঁরা বান্দরবনে বসতি স্থাপন করে। তারা চাকমাজাতির অংশ হলেও বাংলাদেশে তাদের আগমন চাকমাদের অনেক পরে।

 

তঞ্চঙ্গ্যাদের মোট ১২টি গোষ্টী আছে। এদেরকে বলা হয় গছা। এদের নাম- মো গছা, কার্বুয়া গছা, ধন্যা গছা, মংলা গছা, মলং গছা, লাং গছা., অঙ্য গছা, লাপোস্যা গছা, ওয়া গছা, তাশ্বী গছা ও মুলিমা গছা। এদের ভিতর ৭টি গছা ( মো গছা, কার্বুয়া গছা, ধন্যা গছা, মংলা গছা, মলং গছা, লাং গছা., অঙ্য গছা) বাংলাদেশে বাস করে। অবশিষ্ট ৫টি গছা একসময় বাংলাদেশে ছিল, পরে আরাকানে চলে গিয়েছিল। কথিত আছে ধন্যা গছা এবং লাপোস্যা গছার ভিতরে 'উয়া পৈ' নামক একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে বিবাদের সৃষ্টি হয়। পরে উভয় গছার ভিতরে সংঘর্ষ হলে, উভয় পক্ষের বহু লোক মারা যায়। এরপর চাকমা রাজা (১৮১৪-১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দ)-র কাছে উভয় পক্ষ বিচার নিয়ে আসে। এই সময় ধন্যা গছার লোকেরা কৌশলে রাজাকে খুশি করার জন্য চট্টগ্রামে একটি পাকাগৃহ নির্মাণ করে দেন। উপহারে খুশি হয়ে, রাজা ধন্যা গছার লোকদের পক্ষে রায় দেন। এরপর অভিমান করে লাপোস্যা গছার লোকেরা আরাকানে চলে যায়। এই সূত্রে এই কলহ তঞ্চঙ্গ্যাদের অন্যান্য গছাদের ভিতর ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত আরও চারটি গছাও আরাকানে চলে যায়। এদের ভিতর একটি দল ঊনিশ শতকের পরে চট্টগ্রামে ফিরে আসে। এরা কোনো বিশেষ গছার লোক ছিল না। সম্ভবত অন্য গছা অর্থে এদের নামকরণ হয় অঙ্য গছা। 

আদিতে এরা জড়োপাসক ছিল। পরবর্তীকালে তারা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে। তবে প্রথাগত বৌদ্ধ ধর্মাচরণের পাশাপাশি এরা নিজস্ব কিছু দেবদেবীকেও মান্য করে। এরা বৃক্ষ, ঝর্ণা, পাথর, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা ইত্যাদিকে দেবদেবী জ্ঞানে পূজা করে থাকে। এদের পূজাপার্বণে পশুপাখি বধ করার নিয়ম রয়েছে। সাধারণত উৎসর্গীকৃত পশুর মাংস তারা দেবতাদের উদ্দেশ্যে অরণ্য-অভ্যন্তরে রেখে আসে। কলেরা, বসন্ত কিংবা মহামারীর সময়ে তারা এক বিচিত্র ধরনের পূজার আয়োজন করে থাকে। এই পূজার নিয়মানুসারে এরা নির্দিষ্ট দিনে একটি শূকর হত্যা করে। পরে গ্রামসুদ্ধ সব বাড়িতে সাদা সুতা টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়। এই সুতা যাতে না ছিঁড়ে যায়, সে সম্পর্কে তারা খুব সতর্কতা অবলম্বন করে। এরপর এরা নিহত শূকরের রক্ত সকল বাড়িতেই ছিটিয়ে দেয়। এই সময়ে এরা অন্য বাড়িতে যাওয়া আসা বন্ধ রাখে। এছাড়া এদের পূজার প্রকৃতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাকমাদের মতো। চাকমাদের ধানফাং, গাঙ-পূজা ভাদ্যা, থান মানা, টাঙোন, হাজারাবাতি ইত্যাদি পূজাঅর্চনা এরা করে থাকে। চাকমাদের পূজা পরিচালনা করেন ভিক্ষু বা রড়ি কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যাদের পূজাঅর্চনা পরিচালনা করেন ওঝা বা বৈদ্য।

তঞ্চঙ্গ্যাদের ভিতরে বিবাহ প্রথায় বৈধ-অবৈধ মান্য করা হয়। তঞ্চঙ্গ্যা পুরুষদের কাছে যে সকল নারী নিষিদ্ধ, তারা হলো সহদরা, সৎবোন (পিতা ভিন্ন মাতা এক বা মাতা ভিন্ন পিতা এক),  আপন মা, সৎমা, খালা, ফুফু, ভাগ্নি, ভাইঝি, মামি, চাচি, সহোদর ভাইয়ের স্ত্রীর বোন, স্ত্রীর বড় বোন, শাশুড়ি,  স্ত্রীর জ্ঞাতি (মামি, চাচি, খালা, ফুফু, ভাইঝি ইত্যাদি)। এই জাতীয় কোনো বিবাহ হলে, তাকে বলা হয় 'গরবা করুম'।


 

সূত্র :
পার্বত্য চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতি।