অপরাজেয় বাংলা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বরে প্রতিষ্ঠিত, মুক্তিযুক্ত ভিত্তিক একটি
ভাস্কর্য। এর মূল শিল্পী ছিলেন সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালেদ আর নামকরণ করেছিলেন
মুক্তিযোদ্ধা এবং সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী।
ছবি: ফারজানা ফেরদৌসি |
৬ ফুট উঁচু একটি বেদীর উপর ভাস্কর্যটি অবস্থিত। মূল ভাস্কর্যটির উচ্চতা
১২ ফুট, প্রস্থ ৮ ফুট এবং ব্যাস ৬ ফুট। এই ভাস্কর্য নির্মাণে সিমেন্ট , বালু , পাথরকুচি,
ইস্পাত, রড নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহৃত হয়েছে। প্রতি চার ইঞ্চি পুরু ঢালাই কর্মের
মাধ্যমে ধাপে ধাপে ১২ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মূল ভাস্কর্যটি তৈরী হয়েছে ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় আন্দোলনে (ভাষা-আন্দোলন, আয়ুব-বিরোধী আন্দোলন, ৬ দফা ও ১১
দফা নিয়ে আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলন) ঢাকা
বিশ্বদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের অবদানের প্রতীক হিসাবে এই ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়।
এর মূলভাবটি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক। এই ভাস্কর্যে রয়েছে
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তিন জন যোদ্ধা। এর মাঝখানে রয়েছে একজন লুঙ্গি পরিহিত গ্রাম্য যুবক। যার
বাম হাতে রয়েছে একটি হাত গ্রেনেড এবং ডান হাতে তিনি রাইফেল বেল্ট ধরে আছেন। বামদিকে
রাইফেল হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র এবং ডান দিকে রয়েছে সেবার প্রতিক এক নারী,
যার কাঁধে ঝুলছে একটি ফার্স্ট এইড বক্স।
ভাস্কর্যটি ফুটিয়ে তোলার জন্য মাঝে
অবস্থানকারী মডেল হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সৈয়দ
হামিদ মাকসুদ এবং আর্ট কলেজের ছাত্র এবং মুক্তিযোদ্ধা বদরুল আলম বেণু। উল্লেখ্য বদরুল আলম
ভাস্কর আব্দুল্লাহ খালেকের সহকারীও ছিলেন। আর ফাষ্ট এইড বক্স কাঁধে ঝোলানো মূর্তির
মডেল ছিলেন হাসিনা আখতার।
ভাস্কর্যের ইতিহাস
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের
প্রতীক হিসেবে একটি ভাস্কর্য স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলেন ডাকসুর সাংস্কৃতিক
সম্পাদক ম. হামিদ। এই পরিকল্পনা অনুসারে, তৎকালীন শিল্পী আব্দুল
লতিফের নকশায় নির্মিত হয় একটি ভাস্কর্য। কিন্তু রাতের অন্ধকারে ভাস্কর্য
পাকিস্তানি পন্থীরা এই ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলে। পরে এই স্থানে নতুন করে আর একটি
ভাস্কর্য স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আবদুল মতিন চৌধুরী, ডাকসু ভিপি
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক মাববুব জামানসহ ডাকসু নেতৃবৃন্দ সক্রিয়
ভূমিকা রাখেন। এবারের
এই নতুন ভাস্কর্যটির পরিকল্পনা করেছিলেন চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস বিভাগের
শিক্ষক সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালেদ।
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে এর প্রথমে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে তিন ফুট উচ্চতা
সম্পন্ন ভাস্কর্যের মডেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল এবং নির্মাণ ব্যয় বাবদ পঞ্চাশ
হাজার টাকা ধরা হয়েছিল। এই ব্যয়ের অর্ধেক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহন করতে সম্মত হয়
এবং বাকি টাকা ডাকসু সংগ্রহ করার দায়িত্ব নেয়। সার্বিক ভাবে এই প্রশংসনীয় কাজ তদারক
ও সম্পন্ন করার জন্য ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক ম.হামিদ, শিক্ষক কে. এম. সাদউদ্দিন
ও ডঃ.বেলায়েত হোসেনকে নিয়ে তিন সদস্যের কমিটি গঠিত হয়।
ভাস্কর্যটি যে তিনকোনা বেদীর উপরে স্থাপিত, তার নকশা করেন স্থপতি কবি রবিউল
হুসাইন। প্রথম প্রতিকৃতির প্রায় চারগুন আকারের বর্তমান ভাস্কর্য নির্মানের কাজ পান
প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ এবং তার ফার্ম শহীদুল্লাহ এসোসিয়েটস।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়।
এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি
ক্ষমতায় চলে আসে এবং নতুন সরকারের আমলে নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে পাকপন্থী এবং স্বাধীনতা বিরোধীচক্র ভাস্কর্য
ভেঙ্গে ফেলার জন্য জনমত সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়। এই সময় ভাস্কর্য
ভেঙ্গে ফেলার জন্য তাদের স্বপক্ষের কিছু ছাত্র-ছাত্রীর স্বাক্ষরও গ্রহণ করে। কিন্ত তৎকালীন
সব ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মী এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেই
সময় ইসলামী
শিবিরের ভাস্কর্য
ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ গ্রহণকারী কর্মীকে, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা লাঞ্ছিতও করে। পরদিন নির্মাণাধীন
অপরাজেয় বাংলার সামনেই বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় এই ভাস্কর্য স্থাপনের
জন্য ছাত্র আন্দোলন দানা বেধে উঠতে থাকে। পুলিশের ছত্রছায়ায় ইসলামী শিবির ভাস্কর্য
ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করতে থাকে।
শুরু দিকে এর নাম ছিল
‘স্বাধীনতা ভাস্কর্য’।
এই সময় 'দৈনিক বাংলার'
সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী এ বিষয়ে 'অপরাজেয় বাংলা' একটি প্রতিবেদন
লিখেছিলেন। পরে এই নামটি ক্রমে ক্রমে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। এবং শেষ পর্যন্ত এর নাম রাখা হয় 'অপরাজেয় বাংলা'।
১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট' নির্মাণ কাজটি আবার চালু করার
উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য এগারো সদস্যের একটি নতুন কমিটি গঠন করা
হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের
জানুয়ারি মাসে কাজ শুরু হয়। এই সময় ফাষ্ট এইড বক্স কাঁধে ঝোলানো হাসিনা
আখতারের মূর্তিটি ভেঙে যাওয়ার কারণে, ম.হামিদের সহধর্মিনী ফাল্গুনী হামিদ ভাস্কর্য
নির্মাণ স্থলে দাঁড়িয়ে মডেলের ভূমিকায় অংশ নেন। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর এক যুদ্ধাহত
মুক্তিযোদ্ধা আনুষ্ঠানিক ভাবে 'অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন ।