বেতিয়া
শহিদ স্মৃতিসৌধ
বাংলাদেশের কুমিল্লার জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার
বেতিয়ারায় স্থাপিত শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে স্থাপিত স্মৃতিসৌধ।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই নভেম্বর, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বেতিয়ারায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে
সম্মুখযুদ্ধে ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিস্ট পার্টির নয়জন গেরিলা যোদ্ধা শহীদ হন।
এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা
বাহিনীর ৭৮ জনের একটি গেরিলা দলে। দলটি ১০ই নভেম্বর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার
জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের বেতিয়ারা এলাকায় জমায়েত হয়। ১১ই নভেম্বর ভোরে পাকবাহিনীর
সাথে যুদ্ধে শহিদ হন নয়জন। পরের দিন শহীদদের মরদেহ বেতিয়ারার ধানখেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
পড়ে ছিল। সাত দিন পর স্থানীয় লোকজন ধানখেত থেকে তাঁদের গলিত লাশ উদ্ধার করে
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে একটি গর্ত খুঁড়ে মাটিচাপা দেন। পরে সেখানে
স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়। ২৮ নভেম্বর চৌদ্দগ্রামের এ জগন্নাথদীঘি অঞ্চল শত্রুমুক্ত হওয়ার পর, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল হোসেন
জিবুর উদ্যোগে ডা. সবুর চৌধুরী, মাস্টার মুজিবুর রহমান, মাস্টার আলী আকবর, মো.
ফরাজী, আব্দুল মালেক, মতি মিয়া ও আতা খানের সার্বিক সহযোগিতায়, চাঁদা তুলে এবং
ইসলামী শরিয়া মতে মাওলানা আবেদ আলীর মাধ্যমে শহিদের নামাজে জানাজা করা হয়। সে
সময়ে শহিদদের গণকবরের ওপর স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজের পতাকা
উত্তোলন করে, এর পাশেই একটি অস্থায়ী শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ওই গণকবরের পাশে স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধনের মাধ্যমে
'বেতিয়ারা' শহিদ দিবস পালন করেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী সরকারের
উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম সদস্য বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি প্রয়াত
কমরেড মণি সিংহ।
১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পুনরায় নির্মাণকালে ভারতীয় ঠিকাদারি
প্রতিষ্ঠান 'ইরকন কোম্পানি' শহিদদের গণকবরের উপর দিয়ে সড়ক নির্মাণ করার প্রস্তাব
করলে, -ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন-র যৌথ উদ্যোগে গঠিত বেদিয়া
স্মৃতিসৌধ রক্ষার জন্য প্রতিবাদ করে। এই সময় বিশেষ গেরিলা
বাহিনী'র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, যুদ্ধকালীন সময়ে গেরিলা বাহিনীর বৃহত্তর
কুমিল্লা জেলা ইউনিট প্রধান এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কুমিল্লা জেলা কমিটির
সাবেক সম্পাদক (বর্তমানে প্রয়াত) কমরেড আব্দুল হাফেজ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি
কুমিল্লা জেলা কমিটির তৎকালিন সম্পাদক হেদায়েত উল্লাহসহ জেলা ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ
এবং এলাকার সাধারণ লোকজনের বলিষ্ঠ প্রতিবাদে- সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান
'ইরকন' গণকবরের স্থানটি অক্ষত রেখে সড়ক নির্মাণ করে এবং এরা গণকবরের পাশে
স্মৃতিসৌধের স্থান হিসেবে একটি বেদি নির্মাণ করে দেয়।
জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বেতিয়ারা অংশের ডান পাশে ২৮৯
নম্বর দক্ষিণ বেতিয়ারা মৌজার সাবেক ৬৩২ নম্বর দাগে বেতিয়ারা স্মৃতিসৌধটি ছোট
আকারে স্থাপন করা হয়। কিন্তু স্মৃতিসৌধটি সংরক্ষণ ও সড়ক সম্প্রসারণের প্রয়োজনে
তা স্থানান্তর জরুরি হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের মূল সড়কের
সঙ্গে স্মৃতিসৌধে যাতায়াতের সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য ১১ দশমিক শূন্য নয় শতক জমি
চিহ্নিত করা হয়েছে।
পর্বর্তী সময়ে কোনো অযত্ন অবহেলায় আগের স্মৃতিসৌধটি ভেঙে পড়তে থাকে।
২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে তৎকালীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও
সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবালের নির্দেশে বেতিয়ারায় পরিকল্পিত স্মৃতিসৌধ নির্মাণের
উদ্যোগ নেয়া হয়। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা
আনোয়ারুল ইকবালের নির্দেশে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, জেলা পরিষদ এবং সড়ক ও জনপথ
বিভাগের কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন করে ওই জায়গা চিহ্নিত করেন। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ
নিয়ে জটিলতা এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের অনুমতি পেতে বিলম্ব হয়। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রস্তাবিত
স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়।