শিরোমণি স্মৃতিসৌধ
বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধে খুলনার বীরত্বগাথার স্মৃতিবিজড়িত স্মৃতিসৌধ ।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে মিত্রবাহিনীর আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি
বাহিনী যখন সীমান্ত ছেড়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে থাকে, সেই পাকিস্তানি পাকিস্তানি
ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান প্রায় ৪ সৈন্যসহ তার অধীনস্থ ট্যাঙ্ক ও আর্টিলারি বহর নিয়ে
যশোর সেনানিবাস ত্যাগ করে খুলনায় অবস্থান নেয়। অন্যান্য পাকিস্তানি সেনাপতিদের মতো
ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানও মনে করেছিল যে, মার্কিন সপ্তম নৌবহর শেষ পর্যন্ত তাদের
উদ্ধার করবে। এই কারণে, ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান মংলা নৌবন্দরের দিকে অগ্রসর হয়।
হায়াত খান ব্যাপক শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে। তারা
যশোর রোডে মিত্র বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন পুতে রাখে। এছাড়াও
গিলাতলা, দৌলত পুর প্রভৃতি স্থানে ঘাটি গড়ে এবং খুলনার
শিরোমণিতে প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করে।
মিত্রবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল
দলবীর সিং, আর মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ মঞ্জুর ও
সেক্টর কমান্ডার আব্দুল জলিল। পাকিস্তান বাহিনীর এ দূর্ভেদ্য ঘাটি দখল করতে
মুক্তিবাহিনীর ৮ম ও ৯ম সেক্টর ও ভারতীয় বাহিনীর ৯ম পদাতিক ডিভিশনের সৈন্যদের নিয়ে
গঠিত হয় যৌথকমান্ড। এই যুদ্ধের শুরুতে মিত্রবাহিনী কিছু ভুল করে বসে। ফলে ভারতীয়
বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়।
প্রথম দিকে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী টানা গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এই সময় পাকিস্তানি
বাহিনী প্রায় নিশ্চুপ থাকে। এই সময় মিত্রবাহিনীর মেজর মহেন্দ্র সিং এর নেতৃত্বে এক
বিশাল সাজোয়া বহর খুলনার দিকে নিশ্চিন্তে অগ্রসর হয় এবং পাকিস্তানী বাহিনীর ফায়ারিং
রেঞ্জের আওতায় ঢুকে পড়ে। পাকিস্তানী বাহিনী ব্যাপক গোলাবর্ষণ শুরু করলে মিত্রবাহিনী
ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় ও পিছু হটে আসে। এছাড়া ফুলতলা দিয়ে ভারতীয় বাহিনী প্রবেশের সময়
মিত্রবাহিনীর সেনাদের পাকিস্তানি সেনা মনে করে ভারতীয় বিমান বাহিনী বোমা বর্ষণ করে।
এর ফলে প্রচুর ভারতীয় সৈন্য হতাহত হয়।
এবার রণকৌশল পরিবর্তন করা হয়। যেহেতু বাংলাদেশের সেনাপতিরা এই অঞ্চলর ভূপ্রকৃতি
সম্পর্কে ভারতীয়দের চেয়ে ভালো জানে, তাই মিত্রনবাহিনী মেজর এম এ মঞ্জুরের কাছে
আক্রমণের দায়িত্ব দেয়।
এই সময় তার সাথে ছিলো সাব কমান্ডার মেজর হুদা।
এই সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল দলবীর সিং নিজ বাহিনী আক্রমণকারী অগ্রবর্তী
দলকে সহায়তা দান করতে থাকে।
মেজর এম এ মঞ্জুর তার বাহিনীকে ছোটো ভাগে ভাগ করে, পর্যায়ক্রমে পাকিস্তানী বাহিনীকে
চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং ছোটো আক্রমণ চালাতে থাকে। ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর ছড়ানো
ছিটানো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং তারা খুলনার শিরোমণি স্থাপিতে প্রধান
ঘাটিতে সরে আসতে বাধ্য করে। এর ফলে আক্রমণের স্থান ছোটো হয়ে যায়। ১৬ই ডিসেম্বর
পাকিস্তান সেনাবাহিনি ঢাকায় মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু খুলনার
পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। ১৬ই ডিসেম্বর রাতে, মুক্তিযোদ্ধাদের
গেরিলা দলের ব্যাপক আক্রমণের কবলে পড়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ট্যাংক বহরসহ চার
হাজার পাকিস্তানী সৈন্য।
ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ট্যাঙ্ক 'শেরম্যান' এ ১১জন আর্মড কোরের সদস্য
থাকলেও, ঐ ট্যাঙ্কের আড়ালে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা আগ্নেয়াস্ত্র ও বেয়োনেট নিয়ে এগিয়ে
যায়। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা আকস্মভাবে পাকিস্তানির বাহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ করতে
থাকে। ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে পাকিস্তানি ট্যাংক
বহরের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে ট্যাংকগুলো থেকে গানম্যানদের টেনে বের করে এনে হত্যা করা হয়।
এদিকে খুলনাগামী মহাসড়কে পাকিস্তানি সৈন্যদের পুতে রাখা এন্টি ট্যাঙ্ক মাইন
এড়াতে পূর্বপাশের রাস্তার খাদ ধরে ‘আড়’ ভাবে এগিয়ে যায়।
যৌথ
বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণ এবং ব্যাপক গোলা বর্ষণের ফলে ট্যাংক
বহর বিপর্যস্ত হয়। অবশেষে পাকিস্তানী বাহিনি ১৭ই ডিসেম্বর খুলনা সার্কিট
হাউজ মাঠে আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীনতার
পরে মিত্রবাহিনীর বীরোচিত জয়ের স্মরণে স্থাপন করা হয় 'শিরোমণি স্মৃতিসৌধ'।