বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গীত-সংকলন গীতবিতানে-এ গৃহীত স্বদেশ পর্যায়ের প্রথম গানটি হলো- 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি'। এই গানের প্রথম দশ পংক্তি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের 'প্রথম ভাগ' (প্রজাতন্ত্র) -এর ৪ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সঙ্গীত "আমার সোনার বাংলা"র প্রথম দশ চরণ'।
ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তন কর্তৃক পরিবেশিত জাতীয় সঙ্গীতের শ্রবণ নমুনা
মূল গানটির স্বরলিপি পাওয়া যায়, বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত স্বরবিতান ষট্চত্বারিংশ (৪৬) খণ্ডের ৩য় গান হিসাবে গৃহীত হয়েছে। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৯-১৬। নিচে গানটির প্রথম দশ পংক্তি তুলে ধরা হলো।
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি ॥ ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে, মরি হায়, হায় রে— ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি ॥ কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো— কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে। মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো, মরি হায়, হায় রে— মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি ॥ |
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর গীতবিতান কালানুক্রমিক সূচী গ্রন্থে এই গানটির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন- "বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ৭ই আগষ্ট ১৯০৫-কলিকাতার টাউন হলে যে সভা হয়, সেই সভা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের নতুন সঙ্গীত- আমার সোনার বাংলা বাউল সুরে গীত হয়েছিল। জাতীয় সঙ্গীতাবলীর মধ্যে এই সঙ্গীতটি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করে। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ ৭ই সেপ্টেম্বর (১৩১২ সনের ২২শে ভাদ্র) তারিখের সঞ্জীবনী পত্রিকায় এই গানটি রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং তারপর বঙ্গর্শন (নব পর্যায়) মাসিকপত্রের আশ্বিন (১৩১২ সন) সংখ্যায়ও উহা প্রকাশিত হয়েছিল।" -গল্পভারতী, ১৩৭৮ বৈশাখ, পৃষ্ঠা ১০২৩। বঙ্গভঙ্গ-রদ আন্দোলনে এ গানটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। মূল গানটির প্রথম ১০ ছত্র- বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গৃহীত হয়েছে। এই গানের সুর নিয়ে একসময় কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এর সুর নির্ধারিত হয়েছিল। এই বিষয়ে- অধ্যাপক সন্জিদা খাতুন তাঁর - তাঁর আকাশ-ভরা কোলে গ্রন্থের "আমার সোনার বাংলা" নামক প্রবন্ধে লিখেছেন- |
||
"বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে "আমার
সোনার বাংলা"-র সুর আর স্বরলিপি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। তখন ক্যাবিনেট
ডিভিশনের এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু রায় দেন, যে সুর গেয়ে দেশকে স্বাধীন করা
হয়েছে, তাই আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের সুর। ঘটনা এই যে, সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া
রেকর্ড থেকে যে সুর শুনে শিল্পীরা গানটি তুলেছিলেন, সে সুর থেকে নিজেরাই
খানিকটা সরে যান। আর সেই সুরই গাওয়া হয়ে আসছে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা কাল থেকে
এ পর্যন্ত।" "বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত আমাদের ভুলের অপরাধকে মুছে দিয়েছিল। আজও সেই সুরে "আমার সোনার বাংলা" গেয়ে চলেছি আমরা।" |
একটি বাউল গানের সুর ভেঙে
রবীন্দ্রনাথ এই গানটি রচনা করেছিলেন। আর মূল গানটি তিনি পেয়েছিলেন সরলাদেবী'র
(রবীন্দ্রনাথের বোন স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা) কাছ থেকে। সরলাদেবী তাঁর জীবনের
ঝরাপাতা (দ্বিতীয় দে'জ সংস্করণ এপ্রিল ২০০৯, বৈশাখ ১৪১৬) গ্রন্থে এ বিষয়ে
লিখেছেন—
'কর্তাদাদামহাশয় চূঁচড়ায় থাকতে তাঁর ওখানে মাঝে মাঝে থাকবার অবসরে তাঁর বোটের মাঝির
কাছ থেকে অনেক বাউলের গান আদায় করেছিলুম। যা কিছু শিখতুম তাই রবিমামাকে শোনাবার
জন্যে প্রাণ ব্যস্ত থাকত—
তাঁর মত সমজদার আর কেউ ছিল না। যেমন যেমন আমি শোনাতুম—অমনি
অমনি তিনি সেই সুর ভেঙ্গে, কখনো কখনো তার কথাগুলিরও কাছাকাছি দিয়ে গিয়ে একখানি
নিজের গান রচনা করতেন। "কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ", যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে"
"আমার সোনার বাংলা" প্রভৃতি অনেক গান সেই মাঝিদের কাছ থেকে আহরিত আমার সুরে বসান"।'
মূল গানটি গগন হরকরার বাউল গান। গানটি হলো—
আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের
মানুষ যে রে। হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে লাগি সেই হৃদয় শশী, সদা প্রাণ হয় উদাসী, পেল মন হত খুসী দিবানিশি দেখিতাম নয়ন ভরে। আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে নিবাই কেমন করে (মরি হায় হায় রে) ও তার বিছাদে প্রাণ কেমন করে দেখ্-না তোরা হৃদয় এসে দেখ্-না তোরা হৃদয় চিরে। দিব তার তুলনা কি, যার প্রেমে জগত্ সুখী, হেরিলে জুড়ায় আঁখি, সামান্যে কি দেখিতে পারে তারে। তারে যে দেখেছে সেই মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে (মরি হায় হায় রে) ও সে না জানি কি কুহক জানে, অলক্ষে মন চুরি করে, কটাক্ষে মন চুরি করে কুল মান সব গেল রে, তবু না পেলাম তারে, প্রেমের লেশ নাই অন্তরে। তাইতে মোরে দেয় না দেখা সে রে। ও তার রসদ কোথায়, না জেনে তায়, গগন ভেবে মরে (মরি হায় হায় রে) ও সে মানুষের উদ্দিশ যদি জানিস কৃপা করে বলে দে রে আমার সুহৃদ হয়ে (ব্যাথায় ব্যাথিত হয়ে) বলে দে রে। |
|
সূত্র : |
প্রভাতকুমার রায় তাঁর
গীতবিতান কালানুক্রমিক সূচি গ্রন্থে, গানটি রবীন্দ্রনাথের ৪৪ বছর বয়সের রচনা
হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
স্বরবিতান ষট্চত্বারিংশ (৪৬) খণ্ডে মুদ্রিত স্বরলিপিতে রাগ ও তালের উল্লেখ
নেই। বাউল গানের সুরে এর সুর নিবদ্ধ। তাই গানটিকে বাউলাঙ্গ হিসাবে গ্রহণ করা যায়।
গানটি ৩।৩ মাত্রা ছন্দে 'দাদরা' তালে নিবন্ধ। গ্রহস্বর-মা।
লয়-মধ্য।