বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত পতাকা হলো বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। এই পতাকার সূচনা হয়েছিল ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে। তৎকালীন রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতির লক্ষ্য করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ অনুভব করেছিল যে, খুব শীঘ্রই পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি দেশ সম্পৃক্ত হতে চলেছে এবং এর জন্য কঠিন লড়াই করতে হবে। এরই সূত্র ধরে ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ছাত্রনেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে একটি সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। এবং এই সিদ্ধান্ত অনুসারেই ১৫ ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে একটি ব্রিগেড গঠন করা হয়েছিল। এই বাহিনীর নাম দেওয়া হয়েছিল 'জয়বাংলা'। প্রথাগতভাবে তখন এই বাহিনীর জন্য একটি পতাকা তৈরির পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছিল। এই পতাকার নকশা কি হবে, তা নিয়ে ছাত্রনেতাদের মধ্যে বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আ.স.ম আবদুর রব এবং শেখ মণি'র মত ছিল এর জমিনটা হবে সবুজ রঙের, যা শ্যামল বাংলার প্রতীক হিসাবে কাজ করবে। শাহজাহান সিরাজ লাল রঙের পক্ষে ছিলেন। কাজী আরেফ পতাকায় 'বাংলাদেশের মানচিত্র' যুক্ত করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এই আলোচনার এক পর্যায়ে ছাত্রনেতা খসরু কালি, তুলি ও কাপড় জোগাড় করে ফেলেন। ছাত্রনেতাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক, পতাকার বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য এস.এম হল থেকে শিবনারায়ণ দাস আসেন এবং একটি পতাকা তৈরি করেন। এই পতাকাটি তৈরি হওয়ার পর, তা নিরাপত্তাজনিত কারণে ঘরে লুকিয়ে রাখা হয়।

প্রথম পতাকার নমুনা

পরে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাভবনের পশ্চিম গেটে দোতলা ছাদের  উপরে এই পতাকাটি প্রথম ওড়ানো হয়েছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু দিকে এই পতাকা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে পটুয়া কামরুল হাসান পতাকা থেকে মানচিত্র বাদ দেন। কারণ, মানচিত্রের কারণে পতাকা বিকৃত হতে পারে— এই আশঙ্কা থেকে বঙ্গবন্ধু ওই নির্দেশ দিয়েছিলেন।    

বর্তমানে যে জাতীয় পতাকা আমরা দেখি, তা পতাকা বিধি (১৯৭২) দ্বারা নির্দেশিত করা হয়েছে। সংবিধান মতে- 'প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকা হইতেছে সবুজ ক্ষেত্রের উপর স্থাপিত রক্তবর্ণের একটি ভরাট বৃত্ত' থাকবে। পতাকা বিধি মতে — পতাকার রঙ হবে গাঢ় সবুজ (প্রুসিয়ান গাঢ় সবুজ এইচ-২ আর,এস, হাজারে ৫০ ভাগ) এবং ১০:৬ অনুপাতে আয়তাকার হবে। সবুজের ভিতরে একটি লাল (প্রুসিয়ান উজ্জ্বল কমলা রং এইচ-২ আর.এস ৬০ হাজারের ভাগ) বৃত্ত থাকবে। পতাকার লাল বৃত্তের ব্যাসার্ধ হবে পতাকার মোট দৈর্ঘ্যের এক-পঞ্চমাংশ। বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুর অবস্থান হবে পতাকার দৈর্ঘের ৯/১০ অংশ থাকে টানা লম্বের এবং প্রস্থের মাঝখান দিয়ে টানা অনুভূমিক রেখার ছেদবিন্দুতে।
    ভবনের আকারভেদে পতাকা হবে ১০X৬ ফুট, ৫X৩ ফুট, ২১/২X১১/২ ফুট।
    গাড়িতে ব্যবহৃত পতাকা হবে ১২১/২X৭১/২ ইঞ্চি।
    টেবিলে ব্যবহৃত পতাকা হবে ১০X৬ ইঞ্চি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস, বিজয়দিবস, ঈদ-ই-মিলাদুননবী এবং সরকার কর্তৃক নির্দেশিত অন্য কোনো দিন— বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম সত্তার প্রতীক হিসাবে এই পতাকা উড়ানো হয়। ভাষা শহিদ দিবস বা এই জাতীয় শোক নির্দেশক দিনে এই পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিদেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন ও কনসুলার অফিসে— কর্মদিবসের শুরু থেকে সূর্যাস্তের পূর্বকাল পর্যন্ত এই পতাকা উড্ডীয়ন অবস্থায় রাখা হয়। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদের পূর্ণ সদস্য, প্রধান বিচারপতি, সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার, চিপ হুইপ, সংসদের বিরোধী দলের নেতা, বিদেশে অবস্থানরত দূতাবাস প্রধান তাঁদের গাড়িতে এই পতাকা বহন করতে পারবে।