খেলাঘর
শিশুকিশোর সংগঠন। শিশুকিশোর সংগঠন হলেও বাংলাদেশের বাম ধারার সংগঠনসমূহের সরাসরি তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠেছিল।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২রা মে এই সংগঠনটি তৈরি হয়েছিল- দৈনিক সংবাদ পত্রিকার মাধ্যমে।  উল্লেখ্য, সে সময় দৈনিক সংবাদ পত্রিকায়  কবি হাবিবুর রহমান এর পরিচালনায় একটি পাতা প্রকাশিত হতো, এর নাম ছিল ‘খেলাঘর’। সত্য, জ্ঞান, ঐক্য, কল্যাণ ও আনন্দ- এই পাঁচটি আদর্শ ছিল এই সংগঠনের ভিত্তি। আর লক্ষ্য ছিল এই আদর্শকে শিশুদের ভিতরে ছড়িয়ে দেওয়া।

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে দৈনিক সংবাদের 'খেলাঘর' পাতার  পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধি পায় অভাবিত ভাবে এবং
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাশহরগুলোতে বিচ্ছিন্নভাবে 'খেলা
ঘর'-এর আঞ্চলিক কার্যক্রম শুরু হয়। বিভিন্ন জেলার 'খেলাঘর' সংগঠনগুলো পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে, সারাদেশব্যাপী একটি আন্দোলনের কার্যক্রম হিসেবে গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এই সূত্রে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে জুলাই প্রথম ঢাকাতে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে একটি কার্যকরী পরিষদ গঠিত হয়। এই সময় খেলাঘরের পরিচালক সাংগঠনিকভাবে 'ভাইয়া' নামে স্বীকৃতি পায়। খেলাঘরের প্রথম ভাইয়া হয়েছিলেন আল-কালাম আব্দুল ওয়াহাব।

১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কবি হাবিবুর রহমান ইউসিস-এতে চাকুরিতে যোগ দেন। অবশ্য খেলাঘরের ভাইয়া হিসেবে আল-কালাম আব্দুল ওয়াহাব বহাল থাকেন। কিন্তু যথেষ্ঠ সময় না দেওয়ার ফলে খেলাঘরের কার্যক্রম অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এই বছরের জুন মাসে সংঠনের দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরের বছর ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে সংগঠনের তৃতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৫৯  খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে খেলাঘর একটি নিষ্ক্রিয় সংগঠনে পরিণত হয়। এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য আনোয়ার জাহিদকে (এরশাদ সরকারে তথ্যমন্ত্রী) খেলাঘরের দ্বিতীয় ভাইয়া মনোনীত করা হয়।

১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের আনোয়ার জাহিদ পদত্যাগ করলে, এই বছরের জুন মাসে অস্থায়ী 'ভাইয়া' হন মনজুর আহমেদ।

১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের মনজুর আহমেদ-এর তত্ত্বাবধানে সংগঠনের চতুর্থ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় । এই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে খেলাঘরের কার্যকরী পরিষদের নির্বাচনের দ্বারা ভাইয়া নির্বাচিত হন গোলামুর রহমান।

১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয় সংগঠনের চতুর্থ অধিবেশন। এই অধিবেশনে ভাইয়া নির্বাচিত হন বজলুর রহমান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত খেলাঘরের তৎপরতা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই বজলুর রহমান সংগঠনটি পরিচালনা করেন। তাই এ সময় পর্যন্ত খেলাঘর জাতীয় প্রেক্ষাপটে তেমন সাড়া জাগাতে পারে নি। তবে স্বাধীনতার পূর্বেই ২০টি আসর নিয়ে 

১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই মার্চ সংগঠনের প্রথম প্রাদেশিক সম্মেলন বাংলা একাডেমীতে সম্পন্ন হয়। এই অধিবেশনে 'খেলাঘর'-এর ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। এই সময় তৈরি করা হয় নতুন কার্যকরী পরিষদ।

১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই জুন 'খেলাঘর' শিশু-কিশোরদের রচনা নিয়ে 'সাহিত্য বাসর' চালু করে।

১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই মার্চ বাংলা একাডেমিতে ষষ্ঠ কার্যকরী পরিষদ গঠিত হয়।

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীন বাংলাদেশে খেলাঘরের নতুন কার্যক্রম শুরু হয়। এই বছরে বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয় 'খেলাঘর'-এর সুবর্ণ জয়ন্তী। এই সময় বাংলাদেশ থেকে একটি কিশোর প্রতিনিধি দল সোভিয়েত ইউনিয়নে সফর করে।

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকাস্থ ইঞ্জিয়ার্স ইন্‌স্টিটিশানে অনুষ্ঠিত হয় ৫৪টি শাখার সদস্যদের নিয়ে প্রতিনিধি সম্মেলন। এই অধিবেশনে জেলা কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সূত্রে গঠিত হয় বৃহত্তর চট্টগ্রাম, বৃহত্তর সিলেট, বৃহত্তর বরিশাল ও বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার আহ্বায়ক কমিটি। এই বছরের ১৬ই ডিসেম্বর খেলাঘর 'আন্তর্জাতিক শিশু কল্যাণ সংস্থা’র সেমিনার সদস্য পদ লাভ করে।

১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ ও ২৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসিতে প্রায় পৌনে দুই শত  শাখা আসরের সদস্যদের অংশগ্রহণে খেলাঘরের প্রথম জাতীয় সম্মেলন অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে খেলাঘরের শততম বাসর উদ্‌যাপিত হয়। এই বছরের ১৯শে মার্চ বাংলা একাডেমিতে ১৫টি জেলা সংগঠনের অংশগ্রহণে খেলাঘরের রজতজয়ন্তী পালিত হয়।

১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ ও ১৪ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসিতে প্রায় আড়াই শত শাখা আসরের সদস্যদের অংশগ্রহণে খেলাঘরের দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলন অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জুলাই খেলাঘরের ১৫০তম সাহিত্য বাসরে বর্ণাঢ্য আসর অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল বাংলাদেশ শিশু একাডেমীতে খেলাঘরের তৃতীয়  জাতীয় সম্মেলন অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে প্রায় সাড়ে তিনশত শিশু-কিশোর অংশগ্রহণ করেছিল। এই বছরে পালিত হয় ২০০তম সাহিত্য বাসর।

১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে পালিত হয়  ২২৫তম সাহিত্য বাসর।

১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে শিশু শ্রমিক চান মিয়া হত্যা মামলা শুরু হলে, এই মামলা পরিচালনার দায়িত্ব নেয় খেলাঘর।

১৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ শিশু একাডেমীতে খেলাঘরের চতুর্থ  জাতীয় সম্মেলন অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে পালিত হয় 'সাহিত্য বাসর ৩০০তম উৎসব'।

১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদে- দুই জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তী সময়ে একটি তলবী সভার আহ্বান করা হয়। এই সভায় চলমান কেন্দ্রীয় কমিটিকে বিলুপ্ত করা হয়। এই সময় একটি কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন অধ্যাপিকা পান্না কায়সার। এছাড়া যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন ডাঃ মাখদুমা নর্গিস রত্না, অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী ও ড. প্রদীপ রায়। এই বছরের ৩০শে এপ্রিল থেকে ১লা মে পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্‌স্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সম্মেলন। এই সম্মেলনে যোগদান করেছিল সহাস্রাধিক শিশু-কিশোর। এই সম্মেলনে অধ্যাপিকা পান্না কায়সারকে সভাপতি মণ্ডলীর চেয়ারম্যান এবং প্রণয় সাহাকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ও ২১শে জানুয়ারি বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে দুইদিন ব্যাপী সংগঠনের ৪০ বর্ষ পূর্তি উৎসবের আয়োজন করা হয়। এই উৎসবের উদ্বোধন করেন জাতীয় সংসদের তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। এই অধিবেশনে কবি সুফিয়া কামালকে দেওয়া হয় শহিদ শহীদউল্লাহ কায়সার স্মৃতিপদক।

১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১-২ জুন বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে খেলাঘর জাতীয় সম্মেলন।
১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৭-২৯ মার্চ বাংলাদেশ  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসিতে খেলাঘরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছিলেন কবি শামসুর রহমান।

২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ২৪-২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে মৈত্রীর বন্ধনে 'শান্তিময় বিশ্ব চাই' শীর্ষক মৈত্রী মেলার আয়োজন করেছিল 'খেলাঘর'। এই মেলায় ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের শিশু-কিশোররা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিল।

২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ২রা মে বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে খেলাঘরের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছিলেন ভাইয়া বজলুর রহমান।

২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে সারাদেশের খেলাঘরের শাখা ও জেলা পর্যায়ে  শিশু পার্লামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। সবশেষে, ঢাকার নয়াপল্টনস্থ এফপিএবি  মিলনায়তনে জাতীয় পর্যায়ের শিশু পার্লামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়।

২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্যিক সাংবাদিক সত্যেন সেন জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে দেশব্যাপী প্রতিযোগিতা, সেমিনার ও সবশেষে মণিসিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টে জাতীয় পর্যায়ে জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠিত হয়। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ভাইয়া বজলুর রহমান মৃত্যুবরণ করেন। ৪ঠা আগষ্ট খেলাঘর ভাইয়া বজলুর রহমানের ৬৮তম জন্ম উৎসব পালন করে। ২৯-৩০ আগষ্ট বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে খেলাঘরের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মার্চ ভাইয়া বজলুর রহমানের প্রথম স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়, খেলাঘরের সেগুনবাগিচাস্থ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে। এই বছরে খেলাঘর শিশু খাদ্য ভেজাল প্রতিরোধ এবং লালন ভাস্কর্য ভাংচুরের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে বিশাল প্রতিবাদী সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন। ১৭ই ডিসেম্বর শিল্পকলা একাডেমিতে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আলোচনা ও শিল্পী অজিত রায়কে সম্মাননা প্রদান করা হয়।

২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ৭, ৮ ও ৯ জানুয়ারি খেলাঘর শিশু-কিশোর সাংস্কৃতিক উৎসব, সাহিত্য সংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, গুণীজন সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।  অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, প্রধান অতিথি আব্দুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। এরপর ২৫, ২৬, ২৭, ২৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় শরীরচর্চা কেন্দ্রের মাঠে চারদিন ব্যাপী খেলাঘর জাতীয় শিশু-কিশোর প্রশিক্ষণ ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়। এই ক্যাম্পে ভারতের ৩টি সংগঠনের ২৯ জন প্রতিনিধি যোগ দেন। ২রা মে খেলাঘরে ৫৯তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে মিলন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। একই সাথে বজলুর রহমান স্মৃতিপদক প্রদান করা হয়। এই পদক লাভ করেন শিল্পী কায়য়ুম চৌধুরী, ডাঃ সারোয়ার আলী, শিল্পী মিতা হক, সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু, চিত্তরঞ্জন শীল প্রমুখ।

২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ২ মে খেলাঘরের ৫৯তম জন্মদিনে সম্মাননা প্রদান করা হয়, সাংবাদিক এ বি এম মুসা, এডভোকেট সুলতানা কামাল ও খেলাঘর সংগঠক তবিবুর রহমান। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর উদ্বোধন করেন মুস্তফা নূর-উল-ইসলাম।

তথ্য সংযোজন চলছে...


সংকলন উৎস:
বাংলাদেশের শিশুকিশোর আন্দোলন- এ কে এম বদরুদ্দোজা
বাংলাদেশের শিশুকিশোর আন্দোলন ও ফুলকুঁড়ি আসর- আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ
শিশু আন্দোলন: অতীত ও বর্তমান- মুহাম্মদ অছিয়ার রহমান মন্টু
খেলাঘরের গৌরবের ৬৫ বছর। আবুল ফারাহ্ পলাশ। খেলাঘর জাতীয় শিশু-কিশোর প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ২০১৮।