সঞ্জীবনী সভা (হাম্চূ পামুহাফ)
ব্রিটিশ ভারতের স্বাদেশিক চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি গুপ্তসমিতি। এই সভার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই সভা সম্পর্কে- রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'জীবনস্মৃতি'তে লিখেছেন-'
জ্যোতিদাদার উদ্যোগে আমাদের একটি
সভা৬ হইয়াছিল, বৃদ্ধ রাজনারায়ণবাবু৭ ছিলেন তাহার
সভাপতি। ইহা স্বাদেশিকের সভা। কলিকাতায় এক গলির মধ্যে এক পোড়ো বাড়িতে সেই
সভা বসিত।৮ সেই সভার সমস্ত অনুষ্ঠান রহস্যে আবৃত ছিল। বস্তুত,
তাহার মধ্যে ঐ গোপনীয়তাটাই একমাত্র ভয়ংকর ছিল। আমাদের ব্যবহারে রাজার বা
প্রজার ভয়ের বিষয় কিছুই ছিল না। আমরা মধ্যাহ্নে কোথায় কি করিতে যাইতেছি,
তাহা আমাদের আত্মীয়রাও জানিতেন না। দ্বার আমাদের রুদ্ধ, ঘর আমাদের অন্ধকার,
দীক্ষা আমাদের ঋক্মন্ত্রে, কথা আমাদের চুপিচুপি—
ইহাতেই সকলের রোমহর্ষণ হইত, আর
বেশি-কিছুই প্রয়োজন ছিল না। আমার মতো অর্বাচীনও এই সভার সভ্য ছিল। সেই সভায়
আমরা এমন একটি খ্যাপামির তপ্ত হাওয়ার মধ্যে ছিলাম যে, অহরহ উৎসাহে যেন আমরা
উড়িয়া চলিতাম। লজ্জা ভয় সংকোচ আমাদের কিছুই ছিল না। এই সভায় আমাদের প্রধান
কাজ উত্তেজনার আগুন পোহানো। বীরত্ব জিনিসটা কোথাও বা সুবিধাকর কোথাও বা
অসুবিধাকর হইতেও পারে, কিন্তু ওটার প্রতি মানুষের একটা গভীর শ্রদ্ধা আছে।
সেই শ্রদ্ধাকে জাগাইয়া রাখিবার জন্য সকল দেশের সাহিত্যেই প্রচুর আয়োজন
দেখিতে পাই। কাজেই যে-অবস্থাতেই মানুষ থাক্-না, মনের মধ্যে ইহার ধাক্কা না
লাগিয়া তো নিষ্কৃতি নাই। আমরা সভা করিয়া, কল্পনা করিয়া, বাক্যালাপ করিয়া,
গান করিয়া, সেই ধাক্কাটা সামলাইবার চেষ্টা করিয়াছি।..' |
৬ সঞ্জীবনী সভা, সাংকেতিক নাম – হা
ম্ চু পা মু হা ফ (? ১৮৭৬); দ্র জ্যোতিস্মৃতি, পৃ ১৬৭-৭০ ৭ রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৯০০) ৮ "ঠন্ঠনের একটা পোড়োবাড়িতে এই সভা বসিত" -জ্যোতিস্মৃতি |
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনস্মৃতিতে এ বিষয়ে লিখেছেন
'সভার অধ্যক্ষ ছিলেন বৃদ্ধ রাজনারায়ণ বসু। কিশোর রবীন্দ্রনাথও এই সভার সভ্য ছিলেন।
পরে নবগোপালবাবুকেও সভ্যশ্রেণীভুক্ত করা হইয়াছিল। সভার আসবাবপত্রের মধ্যে ছিল ভাঙা
ছোটো টেবিল একখানি, কয়েকখানি ভাঙা চেয়ার ও আধখানা ছোটো টানাপাখা―
তারও আবার এক দিক
ঝুলিয়া পড়িয়াছিল। ―জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি, পৃ ১৬৬-৬৭ |
এই সভার
প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট তারিখ জানা যায় না। প্রশান্তকুমার পাল তাঁর রবিজীবনী প্রথম
খণ্ডে (ভূর্জপত্র, ১৩৮৯, ১ বৈশাখ। পৃষ্ঠা ৩০৫) 'সঞ্জীবনী সভা' আয়ুষ্কাল সম্পর্কে
লিখেছেন '...অনুমান করা যায় সঞ্জীবনী সভার আয়ুষ্কাল মোটামুটি ছ'মাস -পৌষ ১২৮৩ থেকে
জ্যৈষ্ঠ ১২৮৪ পর্যন্ত বিস্তৃত।' ধারণা করা হয়- এই সভার অনুপ্রেরণায় তিনি একটি গান
রচনা করেছিলেন। গানটি হলো―
তোমারি তরে,
মা, সঁপিনু এ দেহ [জাতীয় সংগীত-৮]
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতি গ্রন্থের
'স্বাদেশিকতা' অংশে আরও একটি গানের উল্লেখ করেছেন।
এই গানটি হলো―
এক
সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন
[জাতীয় সংগীত-৭]
এই গানটির রচয়িতা নিয়ে সংশয় ছিল, পরে এটি রবীন্দ্রনাথের গান হিসাবেই স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।