বালিয়াহাটি জমিদার বাড়ির সম্মুখভাগের পুকুর ও সিংহদ্বার [২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ] |
বালিয়াটি জমিদার বাড়ি
বাংলাদেশের মাণিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলায় অবস্থিত বালিয়াটি জমিদার বাড়ি।
মাণিকগঞ্জ
জেলা সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার উত্তরে এ গ্রাম।
পুরাকীর্তির ইতিহাসে বালিয়াটি জমিদার বাড়ি এক অনন্য সৃষ্টি। খ্রিষ্টীয় উনিশ শতকের দিকে এই
বাড়ি নির্মিত হয়।
একটি নিম্নবিত্ত
সাহা পরিবার থেকেই বালিয়াটি জমিদার বংশের উদ্ভব।
বালিয়াটির জমিদারদের পূর্বপুরুষ গোবিন্দ রায় সাহা ছিলেন একজন ধনাঢ্য লবণ ব্যবসায়ী।
এই বাড়ির উত্তর পশ্চিম অংশে লবণের একটা বড় গোলাবাড়ি ছিল।
এই কারণে এই বাড়ির নাম রাখা হয়েছিল গোলাবাড়ি।
সেকালে গোলাবাড়ির চত্বরে বারুনির
মেলা বসত এবং
এর
পশ্চিম
দিকে তাল পুকুরের ধারে
আয়োজন করা হতো
রথ উৎসব। এখানে
বসতো রথের মেলা।
পর্যাপ্ত
জায়গার অভাবে বর্তমানে এই স্থানে রথ মেলা হয় না।
এই রথ
উৎসব এখনো হয় বালিয়াটি গ্রামের
পুরান বাজারের কালী মন্দিরের পাশে।
তাঁর বংশের উত্তরাধিকারদের কেউ একজন জমিদারি লাভ করেন। এরাই পরে এই বাড়ি নির্মাণ করেন— গোবিন্দ রায়ের পরবর্তী বংশধর দাধী রাম, পণ্ডিত রাম, আনন্দ রাম ও গোলাপ রাম। এই পরিবারে স্মরণীয় অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ছিলেন— নিত্যানন্দ রায় চৌধুরী, বৃন্দাবন চন্দ্র, জগন্নাথ রায়, কানাই লাল, কিশোরি লাল, যশোর্ধ লাল, হীরা লাল রায় চৌধুরী, ঈশ্বর চন্দ্র রায় চৌধুরী, হরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী প্রমূখ। এরাই ঢাকার জগন্নাথ মহাবিদ্যালয় (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এদেরই বংশধর বাবু কিশোরীলাল রায় ।
আনুমানিক ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে বালিয়াটি জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তন হয়। ১৩০০ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ এই বাড়ির জমিদারগণ গৃহপ্রবেশ করে বলে জানা যায়। এই জমিদার বাড়িটি ৫.৮৮ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত।
জমিদার বাড়ির সামনেই রয়েছে একটি বড় পুকুর। বাড়িটির সম্মুখভাগে চারটি সুবিন্যস্ত সিংহদ্বার সমৃদ্ধ চারটি বিশাল প্রাসাদ পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যমত্ম এমন সুদৃশ্যভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বর্তমানে এই পুকুরের ঘাটগুলো জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। এখানে ৭টি প্রাসাদতূল্য ইমারতে মোট ২০০টি কক্ষ আছে।
বর্তমানে জমিদার বাড়ির প্রবেশদ্বার নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয় লোকদের মতে, এর মূল প্রবেশদ্বার কাঠের তৈরি ছিল। এই রাজবাড়ির প্রথম সারিতে চারটি প্রাসাদ রয়েছে। এর সবগুলোর নির্মাণ শৈলী মোটামুটি একই রকম। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মিশ্রণ এই প্রাসাদগুলো তৈরি করা হয়েছে। ফ্লোরাল টপ সহ কোরেন্থিয়ান ধাচের পিলার আছে চারটা প্রাসাদেই। এর মাঝখানের দুটি প্রাসাদ দুই তলা এবং দুই পার্শ্বের দুটো প্রাসাদ তিন তলা। এরমধ্যে ১টি প্রাসাদে আগে কলেজ ছিল, বর্তমানে তা এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে।
অন্দরমহলে রয়েছে একটি পুকর। |
একটি প্রাসাদকে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এর দ্বিতীয় তলায় একটি রংমহল রয়েছে। এখানে জমিদারদের ব্যবহৃত নির্দশনাদি দর্শনার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে। নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে জমিদারদের ব্যবহৃত অসংখ্য সিন্দুক, ছোট বড় আয়না, ঝাড়বাতি, লণ্ঠন, শ্বেত পাথরের ষাঁড়, শ্বেত পাথরের টেবিল, পালঙ্ক, আলনা, কাঠ এবং বেতের চেয়ার সহ আরও অনেক নিদর্শন। মজলিস কক্ষে মূল্যবান ঝাড়বাতি রয়েছে। মজলিস কক্ষটির দেয়ালে হাতে আঁকা ছবি আছে।
এর অন্দর মহলে রয়েছে তিনটি অট্টালিকা। এখানে ছিল অতিথিদের থাকার জায়গা, রন্ধনশালা, সহিস আর পরিচারকদের থাকার ঘর। অন্দরমহলে রয়েছে একটি বড় পুকুর। পুকুরের চারপাশের অনেকগুলো ঘাট বাধানো আছে।
১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই জমিদার বাড়িটি অধিগ্রহণ করেন এবং বর্তমানে এর সংস্কার কাজ চলছে।
গ্রন্থনা :
শুক্লা হালদার
চিত্র : সঞ্জীব দেবনাথ