মিং রাজবংশ
ইংরেজি : Ming Dynasty

চীনের একটি রাজবংশ। ১৩৬৮ খ্রিষ্টাব্দে থেকে ১৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই রাজবংশ চীন শাসন করেছে।

ইউয়ান শাসনের শেষভাগে কুওসিং নামক একজন বিদ্রোহী নেতার অধীনস্থ চু ইউয়ানচাং নামক একজন সেনাপতি  চীনের নানজিং শহর অধিকার করেন। তাঁর অন্য নাম ছিল থাই জু। ১৩৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করে বেজিং আক্রমণ করেন। এই সময়ে ইউয়ান সম্রাট শুন তি-র বাহিনীকে পরাজিত করে বেজিং দখল করেন এবং একই সাথে অভিজাত মঙ্গোলদের বিতারিত করেন। এরপর তাঁর সহযোগী সকল নেতাদের হত্যা করে, নিজের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সুদৃঢ় করেন এবং নিজেকে সম্রাট হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এই সম্রাট থেকে চীনের মিং রাজবংশের সূচনা হয়েছিল। এই সময় তাঁর রাজ্যের রাজধানী ছিল নানজিং ।

১৩৯৮ খ্রিষ্টাব্দে থাই জু'র মৃত্যুর পরে তাঁর চতুর্থ পুত্র ছেং জু সম্রাট হন। কিন্তু থাই জু'র ভ্রাতুষ্পুত্র চিয়ান ওয়েন ছেং জু-কে বিতারিত করে সিংহাসন অধিকার করেন। ১৪২১ খ্রিষ্টাব্দে  তিনি নানজিং থেকে রাজধানী বেজিং-এ স্থানান্তরিত করেন।

চীনা বিশ্বকোষ (http://bengali.cri.cn/) মতে
  'মিং রাজবংশীয় আমলে কেন্দ্রীয় একনায়কত্ব জোরদার করা হয়েছে বটে ,তবে সম্রাটদের মধ্যে কেউ নির্বোধ ,কেউ বালক বলে রাজসভা নিয়মিত বসত না । রাজশক্তি পড়েছে খোজাদের খপ্পরে । দুর্নীতিপরায়ন খোজারা ঘুষ খেতেন এবং সত্যবাদী রাজকর্মচারীদের অন্যায় অত্যাচার করতেন ,ফলে শাসন ব্যবস্থা কলুষিত হয়ে উঠে এবং সামাজিক দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করে । মিং রাজত্বকালের মধ্যভাগে একাধিক কৃষি বিদ্রোহ ঘটে ,কিন্তু সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।'

'মিং রাজবংশীয় আমলে বিখ্যাত রাজনীতিবিদ জাং জু জেং সামাজিক দ্বন্দ্বের তীব্রতা লাঘব করা এবং মিং রাজকীয় শাসন জিইয়ে রাখার জন্য সংস্কার চালান। তিনি শাসন ব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত করা, কৃষি উৎপাদন ও গুটিপোকার চাষ বাড়ানো এবং নদী সংস্কার করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি নানা প্রকারের রাজস্বকে একটিমাত্র রাজস্বে রূপান্তরিত করে জনসাধারণের আর্থিক বোঝা বহুলাংশে কমিয়ে দেন।'

'নানা ক্ষেত্রে পুর্ববর্তী রাজত্বকালের তুলনায় মিং রাজত্বকালের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে । রেশম শিল্প ও চীনামাটি শিল্প বেশ উন্নত ছিল। লোহার আকরিক খনন,তামা ঢালাই , কাগজ তৈরি ও জাহাজ নির্মাণ ইত্যাদি শিল্পের লক্ষণীয় উন্নতি হয়। বিদেশের সংগে চীনের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ছিল ব্যাপক। নৌ পরিব্রাজক জেন হে পরপর সাতবার নৌ-বহর নিয়ে এশিয়া ও আফ্রিকার ৩০টিরও বেশি দেশও অঞ্চল সফর করেছিলেন ।কিন্তু মিং রাজত্বকালের মধ্যভাগে চীন জাপান, স্পেন, পর্তুগাল, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল।'

'মিং রাজবংশীয় আমলে পণ্য-অর্থনীতির বিকাশ ঘটে এবং পুঁজিবাদের অঙ্কুর দেখা দেয়। মিং রাজত্বকালের প্রথমভাগে সারাদেশে ছড়িয়ে ছিল প্রচুর পতিত জমি। সম্রাট জু ইউয়ান জুয়াং গৃহহারাদের মধ্যে সেই পতিত জমি বণ্টন করেন এবং তাদের রাজকর কমিয়ে দেন বা মওকুফ করেন, ফলে কৃষকদের সংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। তামাক, মিষ্টি আলু,  ভুট্টা, চীনাবাদাম ইত্যাদি অর্থকরী ফসলের নতুন জাত বিদেশ থেকে চীনে আমদানী করা হয়। সেই সময়পর্বে চীনামাটি ও বস্ত্রবয়ন সহ চীনের হস্তশিল্পের মান অপেক্ষাকৃত উন্নত ছিল। বিশেষ করে কোনো কোনো কর্মশালার মালিকের ছিল রেশমী কাপড় বোনার বিশ-তিরিশটি তাঁত, রেশমী কাপড় বোনার কঠিন কৌশল ভাড়াটে তাঁতীদের আয়ত্বে ছিল। এই থেকে বোঝা যায় যে, চীনে পুঁজিবাদের চিকন অঙ্কুর গজিয়ে উঠেছে। তখন অজস্র পণ্যদ্রব্য ঘনঘন বিনিময় করা হত। যে সব স্থানে ছিল পণ্যদ্রব্যের প্রাচুর্য ও যাতায়াতের সুবিধা সেই সব স্থানে ছোটো বড় অনেক বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে ওঠে। পেইচিং, নানজিং, সুচৌ, হানচৌ, কুয়াংচৌয়ের মত সমৃদ্ধ শহর একটির পর একটি আবির্ভূত হয়।'

'মিং রাজত্বকালে রাজকর্মচারীপদ পেতে আট পর্ব বিশিষ্ট রাজকীয় পরীক্ষায় অংশ নিতে হত। তখন উপন্যাস রচনায় অভূতপুর্ব সাফল্য অর্জিত হয়। জলাশয়, তিন রাজ্যের কাহিনী, পশ্চিমাঞ্চলের ভ্রমণ আর ফুলদানীতে সাজানো প্লাম ফুলের মত ধ্রুপদী উপন্যাসগুলো তখনই রচিত হয়। এই ছাড়া ভুতত্ববিদ সু ইয়া কের লেখা সু ইয়া কের বৃত্তান্ত, চিকিৎসাবিদ লি শি জেনের লেখা চীনা ভেষজওষুধের তথ্যভাণ্ডার, কৃষিবিদ সু কুয়াং ছির লেখা কৃষিবিদ্যা, হস্তশিল্পী সং ইং সিংয়ের লেখা হস্তশিল্পের স্বর্গ, এবং ইয়ংলে বিশ্বকোষও মিং রাজবংশীয আমলে প্রকাশিত হয়।

'মিং রাজত্বকালের শেষভাগে জমি একত্র করার প্রবণতা ক্রমশই অসহ্য হয়ে ওঠে। রাজপরিবার ও নবাবদের খামার ছড়িয়ে ছিল সারাদেশে। রাজস্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় সামাজিক দ্বন্দ্বও ক্রমশই তীব্র হয়। কিছু সংখ্যক রাজকর্মচারী ও পণ্ডিত সামাজিক দ্বন্দ্ব প্রশমিত করার আশায় খোজা ও অভিজাত সম্প্রদায়ের বিশেষ অধিকার খর্ব করার দাবি জানান। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দেয়ার সময়ে সমসাময়িক রাজনীতির কঠোর সমালোচনা করেন। তাঁরা তৎকালীন দলের সদস্য বলে পরিচিত। কিন্তু তাঁরা ক্ষমতাশালী খোজাদের দ্বারা নিপীড়িত হন, ফলে সমাজ আরো অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে।'

'গ্রামাঞ্চলের সংগ্রামও ক্রমে ক্রমে তীব্র আকার ধারণ করে । ১৬২৭ সালে সানসি প্রদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। রাজকর্মচারী যে রীতিমত রাজস্ব সংগ্রহ করেন তাতে অতিষ্ঠিত হয়ে কৃষকরা বিদ্রোহের পথ ধরতে বাধ্য হন। নানা স্থানে লক্ষ লক্ষ অনাহারী নিয়ে কৃষকদের বিদ্রোহী বাহিনী গঠিত হয় ।১৬৪৪সালে কৃষকদের বিদ্রোহী বাহিনী রাজধানী পেইচিং দখল করে । সম্রাট ছংচেন বাধ্য হয়ে আত্মহত্যা করেন ।

সূত্র :
চীনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয়, পেইচিং। ১৮৮৯:

http://bengali.cri.cn/