আজটেক সভ্যতা
দক্ষিণ আমেরিকার একটি প্রাচীন সভ্যতা। ১৪২৫ থেকে ১৫২১ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বর্তমান মেক্সিকো
অঞ্চলে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। পশ্চিমে মেক্সিকো উপত্যকা থেকে পূর্বে মেক্সিকো উপসাগর এবং দক্ষিণে বর্তমান গুয়াতেমালা পর্যন্ত প্রসারিত আজটেক সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল ১৫২১ খ্রিষ্টাব্দে স্প্যানিশদের দ্বারা।

আমেরিকার অন্যান্য জাতির লোকদের মতই, বেরিং প্রণালী পার হয়ে এশিয়া থেকে, আমেরিকা মহাদেশে পা রেখেছিল। কালক্রমে নানাভাগে বিভক্ত হয়ে, এরা  আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করে। মেক্সিকোর উর্বর মাটির কারণে এখানে আগত মানুষ কৃষিকাজে আকৃষ্ট হয়। ১০০ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে টিওটিহুকান
(Teotihuacán) নামক একটি জাতি কৃষিভিত্তিক সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটিয়েছিল। ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের পরে মেক্সিকোর উত্তরাঞ্চল থেকে আগত টলটেক (Toltec) জাতির লোকেরা মধ্য মেক্সিকোতে আসা শুরু করে। টলটেক জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং টিওটিহুকানদের শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে একসময় এই অঞ্চলের শাসক হয়ে যায় টলটেকরা। এরা ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই অঞ্চলে নতুন সভ্যতার পত্তন ঘটায়।

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে স্থানীয়
নাহুৎল (Nahuatl) ভাষার কিছু মানুষ মধ্য মেক্সিকো টেনোচতিৎলান (Tenochtitlán) নামক স্থানে এসে  বসবাস শুরু করে। কথিত আছে, নাহুৎল ভাষাভাষীর একটি বড় দল মেক্সিকো উপত্যকায় প্রবেশের পর, একটি স্থানে একটি ক্যাকটাসের উপর ঈগলের নখরবন্দি অবস্থায় একটি সাপ দেখতে পায়। নাহুৎল পুরোহিতরা ওই স্থানে বসতিস্থানের জন্য নির্বাচন করে। ধীরে ধীরে নাহুৎলদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ফলে একটি ক্ষুদ্র আস্তানা গ্রামে পরিণত হয়। এখানে সুযোগ্য নেতৃত্বের দ্বারা এরা একটি নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার পত্তন ঘটায়। আশপাশের অন্য জাতের লোকদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সেনাবাহিনী তৈরি করে। ফলে টেনোচতিৎলান-কেন্দ্রিক একটি রাজতন্ত্রের সূচনা হয়। এই সময় থেকে এদের জাতীয় প্রতীক হয় সাপ ও ঈগল।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আশপাশের অঞ্চলের উপর টলটেকরা আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করলে,  আশপাশের জাতিগুলো টলটেকদের উপর সম্মিলিত আক্রমণ করে। এই আক্রমণে নাহুৎলারা নেতৃত্ব দিয়েছিল।
টলটেকরা এই আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হলে, নাহুৎলরা মধ্য মেক্সিকোতে শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলে। পরবর্তী সময়ে নাহুতলরাই আজটেক সভ্যতা গড়ে তোলে।

কালক্রমে আজটেকদের রাজধানী টেনোচতিৎলান মধ্য মেক্সিকোর সবচেয়ে বড় বাণিজ্যে-কেন্দ্রে পরিণত হয়। ঐতিহাসকরা মনে করেন, প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ নিয়ে টেনোচতিৎলান শহরে বসবাস করতো।

১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে স্প্যানিশ হার্নান কোর্টেস প্রায় ৫০০ জনের এক স্প্যানিশ বাহিনী নিয়ে স্বর্ণের সন্ধানে এ অঞ্চলে এসে পৌছায়। এরপর আজটেকদের রাজধানী টেনোচতিৎলান দখলের উদ্যোগ নেয়। এই সময় আজটেকদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতি ছিল ট্লাক্সালান। আজটেকদের পদানত করার জন্য, স্প্যানিশদের সাথে ট্লাক্সালান আঁতাত করে। এই সময় ৪০০০ ট্লাক্সালান যোদ্ধা স্প্যানিশ বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। আজটেক বাহিনীর তুলনায় এ সংখ্যা ছিল নগণ্য। তাই ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই নভেম্বর আজটেকদের সম্রাট দ্বিতীয় মন্টেজুমা স্প্যানিশদের আক্রমণ না করে, অনুপ্রবেশ করার সুযোগ দেয়। এই অঞ্চলে স্বর্ণের সন্ধান পায় এবং বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ স্পেনে পাঠানো শুরু করে। এত কিছুর পরে, হার্নান কোর্টেস শঙ্কিত ছিল এই ভেবে যে, আজটেকরা সুযোগ বুঝে তাদের বিতারিত করতে পারে। স্প্যানিশ নেতা আজটেক সম্রাট দ্বিতীয় মন্টেজুমাকে গ্রেফতার করে এবং স্প্যানিশ রাজার বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করে। এর প্রায় ছয় মাস পর, এক ধর্মীয় সমাবেশে ২০০ জন গুরুত্বপূর্ণ আজটেক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। ফলশ্রুতিতে আজটেক সৈন্যবাহিনী স্প্যানিশদের টেনোচতিৎলান শহর থেকে বের করে দেয়ার জন্য লড়াই শুরু করে। তারা শহরের সেতুগুলো ধ্বংস করে ও স্প্যানিশদের বিতাড়িত করে হ্রদের দিকে নিয়ে যায়। অতিরিক্ত স্বর্ণের ভারে স্প্যানিশ বাহিনীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ লোক পানিতে ডুবে মারা যায় ।

এরপর হার্নান কোর্টেস পালিয়ে যায় এবং বিপুল পরিমাণে আদিবাসীদের একত্রিত করে আক্রমণ করে। ধাতব অস্ত্র ও গোলাবারুদে সমৃদ্ধ সম্মিলিত বাহিনীর সাথে যুদ্ধে আজটেকরা পরাজিত হয়। এরপর স্প্যানিশরা পুরো সাম্রাজ্য দখল করে নেয়। এর ভিতর দিয়ে আজটেক সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। টেনোচতিৎলান শহরের ধ্বংসাবশেষের উপরে স্প্যানিশরা মেক্সিকো সিটি তৈরি করে। উল্লেখ্য বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভবন মন্টেজুমার প্রাসাদের উপরই তৈরি হয়েছে।

আজটেকের অর্থনীতি
আজটেক সাম্রাজ্য ছিল কৃষিপ্রধান। আজটেকরা বসবাস করতো মেক্সিকো উপত্যকার পাঁচটি হ্রদের সংযোগস্থলে। এই অঞ্চল চাষের জন্য উর্বর হলেও যথেষ্ট পরিমাণ জমি এখানে ছিল না। তাই তারা পাহাড়ের পাহাড়ের ঢাল কেটে সেখানে চাষাবাদ শুরু করে। এদের সবচেয়ে বড় কৌশল ছিল ভাসমান কৃত্রিম দ্বীপ। তারা খাগড়া বুঁনে বিশাল আস্তরণ তৈরি করে ও তার উপর মাটি স্তূপ করে এ কৃত্রিম দ্বীপ বানাতো। পরে এগুলো তারা হ্রদের পানিতে ছেড়ে দিত। এ কৃত্রিম দ্বীপে তারা শস্য, শাক-সবজি ইত্যাদি চাষ করতো প্রায় সার বছর ধরে।

এই কারণে এদের ধর্মের প্রধান দেবতা ছিল ভূমি, বৃষ্টি ও সূর্য। এরা এই দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য মানুষ বলি দিত। তারা বিশ্বাস ছিল সূর্যকে প্রতিদিন সন্তুষ্ট করতে না পারলে, সূর্য পরের দিন আর সূর্য উঠবে না। সাধারণত এদের পুরোহিত বা রাজশক্তির দ্বারা শনাক্তকৃত অপরাধীদের বলি দেওয়া হতো। এই বলির জন্য কোনো রাজ-কশাই ছিল না। মূলত আজটেক যাজকরাই একাজ সম্পন্ন করত।

কৃষিকাজের বাইরে মেয়েরা তুলা থেকে সূতা এবং সূতা দিয়ে তারা কাপড় তৈরি করতো। তারা কাপড়ে রঙ করে ও সেলাই করে বিভিন্ন নকশা অঙ্কন করত। এছাড়া আজটেকরা আগুনে পুড়িয়ে বিভিন্ন ধরণের মাটির পাত্রও তৈরি করতে পারত। পাত্রগুলো সাদা বা লাল রঙের হতো এবং এগুলোতে সাদা-কালো নকশা আঁকা হত।

আজটেকদের বাহন
আজটেকদের কোন চাকাযুক্ত বাহন ছিল না। ভার বহনের জন্য এরা কোনো জন্তু ব্যবহার করতো না। স্থল পথে প্রয়োজনীয় দ্রব্য নিজেরাই বহন করতো। স্থলপথে এরা ডিঙি নৌকা ব্যবহার করতো। দস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে, বড় ব্যবসায়ীদলের সাথে সৈন্যবাহিনী থাকত। সাম্রাজ্যের বাইরে কোন কোন বণিক গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করত।

আজটেকদের গণিত
এদের সংখ্যা ছিল ২০-ভিত্তিক। তবে এই সংখ্যা প্রকাশের জন্য ছিল বিশেষ বিশেষ ছবি। একটি পতাকার ছবি দ্বারা কোন কিছুর পরিমাণ ২০টি বোঝানো হত, একটি দেবদারু গাছের ছবি দ্বারা তার ২০ গুণ অর্থাৎ ৪০০ বোঝানো হতো। একটি থলের ছবি দ্বারা তারও ২০ গুণ অর্থাৎ ৮০০০ বোঝানো হত।

আজটেক দিনপঞ্জি
আজটেক সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে আজটেক দিনপঞ্জি। এ দিনপঞ্জি ছিল একটি সুবিশাল পাথরের উপর খোদাই করা। এর ভর ছিল ২২ মেট্রিক টন এবং ব্যাস ৩.৭ মিটার (১২ ফুট)। এ দিনপঞ্জি দিয়ে তারা পুরা মহাবিশ্বের প্রতীক হিসেবে চিন্তা করত, যার কেন্দ্রে ছিল সূর্য। সূর্যের চারপাশে বিভিন্ন দিন ও বিভিন্ন স্বর্গ চক্রাকারে সাজানো থাকতো।


তথ্যসূত্র: