মস্কোর
ঘণ্টা
রাশিয়ার রাজধানী
মস্কো নগরীর ইভান বেল টাওয়ারে অবস্থিত একটি বিশাল আকারের ঘণ্টা। এর প্রকৃত নাম জার
বেল (Tsar Bell)।
একে পৃথিবীর সপ্তমাশ্চার্যের একটি হিসেবে পরিচিত। উল্লেখ্য এই ঘণ্টাটি একবারও বাজে
নি।
বর্তমানে যে ঘণ্টাটি দেখতে পাওয়া যায়, এটি মস্কোর বৃহৎ শ্রেণির ঘণ্টা তৈরির প্রচেষ্টার তৃতীয় ঘণ্টা। খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দীর দিকে বেশি শব্দ উৎপাদনের জন্য রাশিয়ায় বড় ধরনের ঘণ্টা তৈরি করা হতো। এর উদ্দেশ্য ছিল শত্রু আক্রমণ বা অগ্নিকাণ্ডের সতর্ক সঙ্কেত দেওয়ার জন্য। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম একটি বিশাল ঘণ্টা তৈরি করে ইভান ত্যা গ্রেড বেল টাওয়ারে স্থাপন করা হয়। এর ওজন ছিল ১৮,০০০ কিলোগ্রাম। এটি বাজানোর জন্য যে বস্তু ব্যবহার করা হতো, তা চালাতো ২৪জন জওয়ান। ক্রেমলিনের এক অগ্নিকাণ্ডে এই ঘণ্টাটি নষ্ট হয়ে যায় ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। এরপর দ্বিতীয় ঘণ্টা তৈরি করা হয় ১৬৫৫ খ্রিষ্টাব্দে। এই ঘণ্টাটি প্রথমটির জায়গাতেই স্থাপন করা হয়। ১৭০১ খ্রিষ্টাব্দে এটিও অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর রাশিয়ার সম্রাট জার পিটার দ্যা গ্রেটের ভাতিজি সম্রাজ্ঞী আন্নার (Empress Anna Ivanovna) নির্দেশে এই ঘণ্টাটি তৈরি করা হয়েছিল। এই কারণে রাশিয়ায় একে বলা হয় Tsarsky Kolokol বা Tsar Kolokol III।
সম্রাজ্ঞী আন্না প্রথম এই ঘণ্টা তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিলেন ফ্রান্সের এক কারিগরকে। কিন্তু এই ঘণ্টা তৈরি অসম্ভব বিবেচনায়, উক্ত কারিগর তা তৈরি করতে অস্বীকার করেন। পরে সম্রাজ্ঞী ১৭৩৩ খ্রিষ্টাব্দে এটি তৈরির দায়িত্ব দেন তৎকালীন বিখ্যাত রুশ কারিগর ইভান মতরিন আর ছেলে মিখাইল মতরিনকে। উল্লেখ্য এই কারিগর পূর্বে একটি ব্রোঞ্চের কামান তৈরি করে, খ্যাতি লাভ করেছিলেন। প্রায় দুই বৎসর ধরে এই ঘণ্টা তৈরির কাজ অব্যাহত গতিতে চলে, কিন্তু একটি অগ্নিকাণ্ড ঘটে এবং অসমাপ্ত ঘণ্টাটি নষ্ট হয়ে যায়। এরপর মিখাইল মতরিন প্রায় দুইশত কারিগরের সাহায্য নিয়ে ১৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দে এই ঘণ্টা তৈরির উদ্যোগ নেন। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। কথিত আছে ঘণ্টাটি তৈরি করার পরে একটি মাটির গর্তে যখন শীতল করা হচ্ছিল, সে সময়ে ক্রেমলিনে পুনরায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। রাজকর্মচারীরা দ্রুত আগুন নেভাতে গিয়ে, প্রচুর শীতল পানি ব্যবহার করে। দ্রুত শীতল হওয়ার সময় ঘণ্টার একটি অংশ ভেঙে যায়। কারো কারো মতে ঘণ্টা তৈরির পর যখন তা স্বাভাবিকভাবে শীতল করার প্রক্রিয়া চলছিল, সে সময় প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। ফলে দ্রুত শীতল হওয়ার সময় ঘণ্টার একটি অংশ ভেঙে যায়। অন্য মতে রাশিয়ার জারের সাথে সুইডিশদের একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে জয়লাভের পর, জার পিটার দ্যা গ্রেট মস্কোতে ফিরে এসে নগরীর সমস্ত ঘণ্টা বাজানোর আদেশ দেন। সেই সময় রাজসৈন্যরা বহু চেষ্টা করেও এই ঘণ্টা বাজাতে ব্যর্থ হন। ফলে সম্রাট ক্ষিপ্ত হয়ে, ঘণ্টাটিকে ভেঙে গর্তে নিক্ষেপ করার আদেশ দেন। সেই সময় সৈন্যরা এর একাংশ ভেঙে ফেলে এবং ভাঙা টুকরো সহ মূল ঘণ্টাটিকে একটি গর্তে নিক্ষেপ করেন।
১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সের রাজা নেপোলিয়ান মস্কো অধিকার করেন এবং বিজয়ী ট্রফি হিসেবে এই ঘণ্টাটি ফ্রান্সে নেওয়ার আদেশ দেন। কিন্তু বিশাল আকার এবং ওজনের জন্য এই আদেশ কার্যকর করা সম্ভব হয় নি। ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসী স্থপতি অগুস্তে মন্তফ্রেন্দ ঘণ্টাটিকে একটি গ্রানাইড ভিত্তিস্থম্ভে স্থাপন করেন। এই সময় তিনি এর ভাঙা টুকরোটিকে মূল ঘণ্টার পাশেই রেখে দেন।
ব্রোঞ্চের তৈরি এই তৃতীয় ঘণ্টাটির উচ্চতা ৬.১৪ মিটার (২০.১ ফুট), ব্যাস ৬.৬ মিটার (২.২ ফুট), ওজন ২,০১,৯২৪ কিলোগ্রাম। এর পুরুত্ব ৬১ সেন্টিমিটার। ভাঙা খণ্ডটির ওজন ১১,৫০০ কিলোগ্রাম।