বাংলা বানান রীতির ক্রমবিবর্তনের ধারা বানান বিধি
 

ভাষাকে ধ্বনি চিহ্নের সমষ্টিগত নাম হলো বর্ণমালা। যে কোনো ভাষার ধ্বনিসমূহ প্রকাশের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট বর্ণমালা এবং সহায়ক চিহ্নসমূহ ব্যবহারের বিধিই হলো- বানানবিধি। শব্দ লেখার জন্য এই বিধি কার্যকর হলেও বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চিহ্নের সাহায্য নিতেই হয়। ব্যাকরণে এই জাতীয় চিহ্ন  'যতি চিহ্ন' হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সামগ্রিকভাবে বানানরীতিকে উপস্থাপন করতে গেলে আমার পদ্ধতির দিক থেকে দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি।

১. শব্দলিখন রীতি
২. বাক্যলিখন রীতি 

বানানবিধি ও বর্ণমালা
সুপ্রচলিত, অল্পপ্রচলিত বা মৃত ভাষার বিচারে যত ধরনের ভাষার পরিচয় পাওয়া যায়, তার সবগুলোর নিজস্ব বর্ণমালা নেই। এই বর্ণমালা একাধিক ভাষায় ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন- দেবনাগরী ব্যবহৃত হয় সংস্কৃত, হিন্দি, নেপালি ইত্যাদি। অনেক ভাষার নিজস্ব লিপি এক সময় ছিল, বর্তমানে তা হারিয়ে গেছে বা হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন 'সিলেটি দেবনাগরী'। বহু প্রাচীন ভাষা বিবর্তিত হয়ে নতুন নতুন ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। একই সাথে ক্রমবিবর্তরনের ধারায় লিপির পরিপর্তন হয়ে নতুন লিপির উদ্ভব হয়েছে। যেমন- ব্রাহ্মীলিপি, কুষাণ লিপি ইত্যাদি।


যে কোনো ভাষার লিখন পদ্ধতিতে বর্ণামালাকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ বর্ণমালা ভেদে শব্দের বানানরীতি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন- অকল্পিত। এটি সংস্কৃত শব্দ। বাংলাতে তৎসম শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বর্ণমালাভেদে এর রূপগুলো

বাংলা বানানরীতি

বাংলা শব্দকে নানা বর্ণমালায় লেখা যেতেই পারে, তবে ওই বর্ণমালায় অবশ্যই বাংলা উচ্চারণের প্রতিনিধিত্বকারী বর্ণচিহ্ন থাকতে হবে। যেমন- আরবি ভাষায় 'প' ধ্বনি নেই। আরবিতে পরম, পবিত্র ইত্যাদি শব্দ লেখা সম্ভব হয় না। রোমান হরফে 'অ' ধ্বনির জন্য সুনির্দিষ্ট চিহ্ন নেই। এর জন্য a, au ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু প্রায়শই a  'আ' হয়ে যায়।

একটি ভাষায় প্রমিত এবং আঞ্চলিক ধ্বনিরীতিতে
যত ধরনের ধ্বনি উচ্চারিত হয়ে থাকে, তার সবগুলো প্রকাশ করার মতো যথার্থ বর্ণ একটি বর্ণমালায় পাওয়া যায় না। তারপরেই ওই ভাষার নিজস্ব বর্ণমালাতে ওই ভাষার ধ্বনি প্রকাশের ক্ষেত্রে যে সুবিধা পাওয়া যাবে, তা অন্য বর্ণমালায় পাওয়া যাবে না। এসব বিচারে বাংলা বানানের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোকে শর্তাধীনে আনা যাবে তা হলো-

বাংলা লিপির ক্রমবিবর্তনের ধারা

যেদিন থেকে বাংলা বর্ণমালায় বাংলা ভাষার বিষয়াি লেখার চেষ্টা করা হয়েছিল, সেদিন থেকেই বানান রীতির সূচনা হয়েছিল বাংলা বর্ণমালায় লিখিত সর্বপ্রাচীন নমুনা হলো- চর্যাগীতি ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে- এই নমুনা লিখিত হয়েছিল খ্রিষ্টীয় ৬৫০ অব্দের দিকে এই নমুনার বিচারে বলা যাবে না, এই সময় থেকেই বাংলা বর্ণে লিখা শুরু হয়েছিল কারণ, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, চর্যাগীতির লিপিকাররা প্রথমে বাংলা লিখনরীতি আবিষ্কার করেন এবং পরে লেখালেখির কাজ শুরু করেন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বিবেচনা করতেই হবে যে, বাংলায় লেখালেখির কাজটা শুরু হয়েছিল আরও অনেক আগেই চর্যাগীতির আগে বাংলা লিখার নমুনা পাওয়া যায় না বলেই, আমরা চর্যাগীতিকেই বাংলা বানানের ক্রমবিবর্তনের প্রথম ধাপ হিসাবে বিবেচনা করতে পারি। তবে চর্যাগীতির লিখিত নমুনা যাই থাক না কেন, সে নমুনাও একটি ক্রমবিবর্তনের ধারায় সৃষ্টি হয়েছিল। [দেখুন: বাংলালিপি]

 

চর্যাগীতির গণ্ডি পেরিয়ে, পরবর্তী সময় পেয়েছি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য-গুচ্ছ, ব্রজবুলি ইত্যাদি এই সকল প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যের বানানরীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল বিবিধ কারণে এই কারণগুলোকে আমরা যেভাবে নির্দেশিত করতে পারি, তা হলো-

 

চ +চ=চ্চ, চ +ছ্= চ্ছ

 

কিন্তু কিছু কিছু যুক্তধ্বনি এমন প্রতীকে পরিণত হয়েছিল, যেগুলো থেকে মূল বর্ণের সন্ধান পাওয়া সম্ভব ছিল না যেমন- ক+ষ=ক্ষ, ঞ +চ =ঞ্চ, হ +ম=হ্ম ইত্যাদি  অবশ্য এই চিহ্নগুলোর চেহারা বর্তমানের চিহ্নগুলোর মতো ছিল না। অবশ্য এই যুক্তবর্ণ সৃষ্টিতে দেবনাগরী লিপির বিশেষ ভূমিকা ছিল।

 

                        চর্যাগীতি              আধুনিক বাংলা

    চীএ                   চিত্ত

    মহাসুহ                মহাসুখ

 

এই জাতীয় প্রাচীন শব্দের ব্যবহার বর্তমানে নেই তাই এই বানানে লিখার রীতিও উক্ত শব্দগুলোর সাথে সাথে লুপ্ত হয়ে গেছে

 

বাংলা বানানের প্রাথমিক আদর্শরূপ 

ষোড়শ শতকে পর্তুগীজ মিশনারিরা বাংলাদেশে ধর্মপ্রচার করতে এসে- ধর্ম প্রচারের জন্য পর্তুগীজ বাংলা শব্দকোষ নামক একটি অভিধান প্রণয়ন করেছিলেন এটিই হলো প্রাচীনতম দ্বিভাষিক বাংলা অভিধান ঢাকার পর্তুগীজ মিশনারীদের অধ্যক্ষ মানোয়েল দ্য আসাসুম্পসাঁও (Manoel da Assumpcao) রোমান অক্ষরে সর্বপ্রথম বাংলা থেকে বাংলা অভিধান রচনা করেছিলেন এর নাম ছিল ‘Vocabulario em idioms Bengala e Partuguez, dividedo em duas parts’ তখনও এদেশে মুদ্রণযন্ত্রের জন্য কোন বাংলা হরফ তৈরি হয় নি এই কারণে, এই বইটি মুদ্রিত হয়েছিল রোমান হরফে উল্লেখ্য বইটি ১৭৪৩ সালে লিসবন শহর থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এই বইটির গুরুত্ব অসমান্য হলেও- বইটি বাংলা হরফে মুদ্রিত না হওয়ার কারণে, বাংলা বানানরীতিতে এর কোনো প্রভাব নেই   

 

বাংলাবর্ণের মুদ্রিতরূপের গোড়া পত্তন ঘটেছিল ১৭৭৮ খ্রিব্দে নাথনিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের A Grammar of the Bengal Language) নামক গ্রন্থের মাধ্যমে কারণ, এই গ্রন্থের জন্যই প্রথম তৈরি করা হয়েছিল ঢালাই করা ধাতব বাংলা ফন্ট উল্লেখ্য এই ফন্টের জন্য ছাঁচ তৈরি করেছিলেন উইলকিনস এবং পঞ্চানন কর্মকার এই ফন্টের সাহায্যে মুদ্রিত বাংলা বর্ণ একটি আদর্শ রূপ লাভ করেছিল বটে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন প্রকাশকদের হাতে এর রূপ পাল্টে গিয়েছিল বিবিধভাবে মুদ্রণযন্ত্রের কল্যাণে বাংলা সরল বর্ণগুলোর আকারে যতটা হেরফের ঘটেছিল, তার চেয়ে বেশি হেরফের ঘটেছিল যুক্তবর্ণের ক্ষেত্রে তখন লেখকরা যা লিখতেন, প্রকাশকরা সে লিখাকে প্রকাশের সময় ধাতব ফন্টের নকশাতে প্রায়ই পরিবর্তন করতেন ফলে, লেখকের বানান ও প্রকাশকের ফন্ট মিলিয়ে ভিন্ন ভিন্ন একটি মিশ্র বানানরীতির সৃষ্টি করেছিল

 

নাথনিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণের শব্দ লিখিত হয়েছিল সংস্কৃত ব্যাকরণের রীতিনীতি অনুসারে উল্লেখ্য, এর আগে বাংলা শব্দ লিখা হতো উচ্চারণ অনুসারে হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণ সংস্কৃত-প্রেমীদের তৃপ্ত করেছিল কিন্তু সেকালের যে সকল বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা সংস্কৃতের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে, বাংলাকে পৃথক ভাষা হিসাবে উপস্থাপন করার কথা ভাবতেন, তাঁরা সন্তুষ্ট হতে পারেন নি এই টান-পোড়নে বাংলা বানানরীতি বিশৃঙ্খল অবস্থায় চলেছিল বহুদিন ধরে অবশ্য, বাংলা বর্ণে বই প্রকাশিত হচ্ছে, এই আনন্দে প্রথম দিকে বাঙালিরা উদ্বেলিত ছিলেন আবার বিশৃঙ্খল বানান রীতির কারণে শিক্ষিত মানুষেরা ধীরে ধীরে হতাশ হয়েও পড়েছিলেন বাংলা বানানরীতির এই অরাজকতা থেকে বের হয়ে আসার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়-ঊনিশ শতকে এই সময় বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বাংলা বানানরীতির পরিবর্তনে বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া শুরু করেন কেউ কেউ আবার পরামর্শ দিয়ে ক্ষান্ত না হয়ে- হাতে-কলমে কাজে নেমে পড়েন

 

ঊনিশ শতকের বাংলা বানান রীতির প্রস্তাবসমূহ

বাংলা বানানের বিশৃঙ্খল দশা থেকে বের হয়ে, একটি সর্বজনগ্রাহ্য আদর্শ বাংলা বানান রীতি প্রণয়নে যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল এবং সেই সূত্রে যে সকল প্রস্তাব উপস্থাপিত হয়েছিল, সেগুলো সম্পর্কে কিছু ধারণা নিচে তুলে ধরা হলো

গোড়াতেই কিছু সংস্কারবাদী মনে করেছিলেন বর্ণগুলোর আদর্শরূপ দরকার একই সাথে বানানের সুনির্দিষ্ট বিধি প্রণয়নের মধ্য দিয়ে, বাংলা বানানের সংস্কার করা সম্ভব এই বিষয়কে মাথায় রেখে, প্রচুর প্রবন্ধ রচিত হয়েছিল এ সকল প্রবন্ধে তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব ইত্যাদি লিখন রীতি, যুক্তবর্ণ সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো আদর্শ বানান রীতি প্রণীত হয় নাই অবশ্য একথা মানতেই হবে যে, প্রাথমিক বিচারে ধাতব লিপি প্রণেতারা কিছু স্বেচ্ছাচারিতা দেখালেও, এদের কল্যাণেই বাংলাবর্ণের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল বিশেষ্য করে ইংরেজি বর্ণের মতো- বিভিন্ন শৈলীর বাংলা বর্ণের সৃষ্টি হয়েছিল

২. বাংলাসহ ভারতীয় ভাষা লিখিত হবে রোমান হরফে- এমন কাজের উদ্যোগ প্রথম গ্রহণ করেছিলেন, স্যার বিলিয়ম জোনস্, ১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে পরে এই উদ্যোগকে কার্যকরী করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন স্যার চার্লস ট্রিবিল্যান, ডাক্তার ডফ, মিস্টর পার্শ্ব, মিস্টর টমাস প্রমুখ

সূত্র : বাঙ্গালা বর্ণমালা সংস্কার অজ্ঞাতনাম{হুমায়ুন আজাদ সম্পাদিত বাঙলা ভাষা (প্রথম খণ্ড)}

 

ইংরেজদের এই প্রচেষ্টাকে তৎকালীন শিক্ষিত বাঙালিরা, বাংলা ভাষা ও জাতির উপর আক্রমণ হিসাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং প্রবল বিরোধিতার কারণে সে প্রচেষ্টা শেষ পযর্ন্ত সফল হয় নি

 

৩. বাংলা বর্ণমালায় বাংলা বই ছাপানোর ক্ষেত্রে তর্ক-বিতর্ক যেমন অব্যাহত গতিতে চলছিল, তেমনি বই ছাপানোর ধারাটাও অব্যাহত ছিল এর মধ্যে একটি প্রচেষ্টা ছিল বাংলা বর্ণমালা নির্ণয় এবং ব্যাকরণ প্রণয়নের প্রচেষ্টা এই প্রচেষ্টায় মুদ্রিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো ছিল- শ্রীরামপুর মিশনের লিপিধারা (১৮১৫), জ্ঞানারুণোদয় (১৮২০), রামমোহন রায়ের গৌড়ীয় ব্যাকরণ (১৮৩৩), শিশুবোধক, বঙ্গবর্ণমালা (১৮৩৫), রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের শিশুসেবধি, বর্ণমালা (১৮৪০), পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশু শিক্ষা প্রথম ভাগ (১৮৪৯) এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথমভাগ (১৮৫৫)

 

১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত নাথনিয়েল ব্র্যাসি হ্যাল হ্যালহেডের ব্যাকরণে বর্ণমালার যে সেটটি নির্দেশিত হয়েছিল, বিদ্যাসাগরের আগে আর কেউ, তাতে হাত দেবার চেষ্টা করেন নি বিদ্যাসাগরের আগে সর্বশেষ বর্ণমালার রূপ দেখতে পাই, পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ-এ  বিদ্যাসাগর এই বর্ণমালার সংস্কার করেন মূলত তিনি এই সংস্কার করেছিলেন, বাংলায় লেখালেখির সময় যে সকল বর্ণ ব্যবহৃত হয়ে থাকে তার বিচারে এ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর বিজ্ঞাপনে লিখেছিলেন - বহূকালাবধি বর্ণমালা ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল কিন্তু বাঙ্গালা ভাষায় দীর্ঘ ৠকার ও দীর্ঘ ৡকারের প্রয়োগ নাই; এই নিমিত্ত ঐ দুই বর্ণ পরিত্যক্ত হইয়াছে আর সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে অনুস্বর ও বিসর্গ স্বরবর্ণ মধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না; এজন্য ঐ দুই বর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ মধ্যে পঠিত হইয়াছে আর চন্দ্রবিন্দুকে ব্যঞ্জনবর্ণস্থলে এক স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া গণনা করা গিয়াছে, , য এই তিন ব্যঞ্জনবর্ণ পদের মধ্যে অথবা পদের অন্তে থাকিলে, , , য় হয়

 

এই গ্রন্থের ষষ্ঠিতম সংস্করণে ৎ সম্পর্কে লিখেছিলেন-বাঙ্গালা ভাষায় তকারের ত, ৎ এই দ্বিবিধ কলেবর প্রচলিত আছে দ্বিতীয় কলেবরের নাম তকার ঈষৎ, জগৎ, প্রভৃতি সংস্কৃত শব্দ লিখিবার সময়, খণ্ড তকার ব্যবহৃত হইয়া থাকে খণ্ড তকারের স্বরূপ পরিজ্ঞানের নিমিত্ত, বর্ণপরিচয়ের পরীক্ষার শেষভাগে তকারের দুই কলেবর প্রদর্শিত হইল

 

পরবর্তী সময়ে অবশ্য বিদ্যাসাগরের বর্ণমালা থেকে ঌ এবং অন্তস্থ-ব বাদ হয়ে গেছে এবং এই ৯ আধুনিক বাংলাতে ব্যবহৃত হয় না তবে অন্তস্থ-ব, ফলা হিসাবে এখনও ব্যবহৃত হয়ে থাকে সংস্কৃত ভাষায় যে সমস্ত শব্দের মধ্যে স্বাধীনভাবে অন্তস্থ-ব ব্যবহৃত হতো- বাংলাতে তা বর্গীয় ব-তে পরিণত হয়েছে যেমন- বঙ্গ, বকুল ইত্যাদি আবার অন্তস্থ-ব ফলা সংস্কৃতিতে যে ধরনের ধ্বনিকে নির্দেশিত করতো, বাংলাতে তা সেইভাবে উচ্চারিত হয় না

 

মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথমভাগ এর

তুলানমূলক তুলনামূলক সারণী

 

মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ (১৮৪৯)

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথমভাগ (১৮৫৫)

স্বরবর্ণ

অঃ

ব্যঞ্জনবর্ণ

ক খ গ ঘ ঙ

চ ছ জ ঝ ঞ

ট ঠ ড ঢ ণ

ত থ দ ধ ন

প ফ ব ভ ম

য র ল ব

শ ষ স হ ক্ষ

ক খ গ ঘ ঙ

চ ছ জ ঝ ঞ

ট ঠ ড ঢ ণ

ত থ দ ধ ন

প ফ ব ভ ম

য র ল ব

শ ষ স হ  ড় ঢ় য়

ং ৎ ঃ ঁ

 

বিদ্যাসাগরের সংস্কারকৃত বর্ণমালা সেকালে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছিল এবং বহুদিন পর্যন্ত এই বর্ণমালাই বাংলা ভাষার জন্য আদর্শ বর্ণমালা হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল তারপরে আমার দেখি যে- ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধান-এ ৠ ঌ ৡ যুক্ত হয়েছিল এই তিনটি বর্ণের জন্য যে শব্দ গৃহীত হয়েছিল, সেগুলো হলো- ৠ, , ঌকার, , ৡকার, ৡভব  

 

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর অভিধানের মুখবন্ধে বানানের অনিয়মের বিষয় উল্লেখ করেছিলেন এই সময় রবীন্দ্রনাথ-সহ অনেকই বানান সংস্কারের বিষয়টির ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন অবশেষে এঁদের অনুরোধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বপ্রথম বানান সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা ভাষাকে মাধ্যমিক শিক্ষার বাহন হিসাবে ঘোষণা দেয় এই সময় বাংলা বানান নিয়মের জন্য একটি সমিতি গঠন করা হয় এই সমিতির সভাপতি ছিলেন রাজশেখর বসু এবং সম্পাদক ছিলেন চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য এই সমিতি বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপকদের কাছে প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে অভিমত সংগ্রহ করা হয় এক্ষেত্রে সমিতির কাছে প্রায় দুই শত অভিমত জমা পরে পরে এই সকল অভিমত বিচার করে, ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ই মে তারিখে ঐ সমিতি একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে পরে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ মে তারিখে এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় নিচে এই বানান রীতির তুলে ধরা হল


কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানান নিয়ম

তৃতীয় সংস্করণ (২০ মে, ১৯৩৬)-এর সংক্ষেপিত মূল বিষয়

           

সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ

রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব

রেফের পরে ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হইবে না, যথা-অর্চনা, মূর্ছা, কর্তা, কার্তিক, বার্তা, কর্দম, অর্ধ, বার্ধক্য, কর্ম, সর্ব সংস্কৃত ব্যাকরণ-অনুসারে রেফের পর দ্বিত্ব বিকল্পে সিদ্ধ; না করিলে দোষ হয় না, বরং লেখা ও ছাপা সহজ হয়

 

সন্ধিতে ঙ্-স্থানে অনুস্বার

যদি ক খ গ ঘ পরে থাকে তবে পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার অথবা ঙ্ বিধেয়, যথা-অহংকার, ভয়ংকর, শুভংকর, সংখ্যা, সংগম, হৃদয়ংগম সংঘটন অথবা অহঙ্কার, ভয়ঙ্কর ইত্যাদি

 

সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম-অনুসারে বর্গীয় বর্ণ পরে থাকিলে পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার বা পরবর্তী বর্গের বর্ণ হয়, যথা-সংজাত, স্বয়ম্ভূ অথবা সঞ্জাত, সয়ম্ভূ বাংলায় সর্বত্র এই নিয়ম-অনুসার ং দিলে উচ্চারণ বাধিতে পারে, কিন্তু ক-বর্গের পূর্বে অনুস্বার ব্যবহার করিলে বাধিবে না, বরং বানান সহজ হইবে 

 

অসংস্কৃত (অর্থাৎ তদ্‌ভব, দেশজ ও বিদেশী) শব্দ

রেফের পরে ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হইবে না, যথা-কর্জ, শর্ত, পর্দা, সর্দার, চর্বি, ফর্মা, জার্মানি

 

হস্‌চিহ্ন

শব্দের শেষে সাধারণতঃ হস্‌চিহ্ন দেওয়া হইবে না, যথা-ওস্তাদ, কংগ্রেস, চেক, জজ, টন, টি-পট, ডিশ, তছনছ, পকেট, মক্তব, হুক, করিলেন, করিস কিন্তু ভুল উচ্চারণের সম্ভাবনা থাকিলে হস্-চিহ্ন বিধেয় হ ও যুক্তব্যঞ্জনের উচ্চারণ সাধারণতঃ স্বরান্ত, যথা-দহ, অহরহ, কাণ্ড, গঞ্জ যদি হসন্ত উচ্চারণ অভীষ্ট হয় তবে হ ও যুক্তব্যঞ্জনের পর হস্-চিহ্ন আবশ্যক, যথা- শাহ্, তখ্‌ত্‌, জেম্‌স্, বল্ড্ কিন্তু সুপ্রচলিত শব্দে না দিলে চলিবে, যথা-আর্ট, কর্ক, গভর্নমেন্ট, স্পঞ্জ মধ্য বর্ণে প্রয়োজন হইলে হস্-চিহ্ন বিধেয়, যথা-উল্‌কি, সট্‌কা যদি উপান্ত্য স্বর অত্যন্ত হ্রস্ব হয়, তবে শেষে হস্-চিহ্ন বিধেয়, যথা-কট্‌কট্, খপ্, সার্

 

বাংলায় কতকগুলি শব্দের শেষ অ-কার উচ্চারিত হয়, যথা-গলিত, ঘন, দৃঢ়, প্রিয়, করিয়াছ, করিত, ছিল, এস কিন্তু অধিকাংশ শব্দের শেষের অ-কার গ্রস্ত অর্থাৎ শেষ অক্ষর হসন্তবৎ, যথা-অচল, গভীর, পাঠ, করুক, করিস, করিলেন এই প্রকার সুপরিচিত শব্দের শেষে অ-ধ্বনি হইবে কি হইবে না তাহা বুঝাইবার জন্য কেহই চিহ্ন প্রয়োগ করেন না অধিকাংশ স্থলে অ-সংস্কৃত শব্দে অন্ত্য হস্-চিহ্ন অনাবশ্যক, বাঙলাভাষার প্রকৃতি অনুসারেই হসন্ত-উচ্চারণ হইবে অল্প কয়েকটি বিদেশী শব্দের শেষে অ উচ্চারণ হয়, যথা-বাই-ল কিন্তু প্রভেদ রক্ষার জন্য অপর বহু বহু শব্দে হস্-চিহ্নের ভার চাপান অনাবশ্যক কেবল ভুল উচ্চারণের সম্ভাবনা থাকিলে হস্-চিহ্ন বিধেয়

 

ই ঈ উ ঊ -যদি মূল সংস্কৃত শব্দে ঈ ঊ থাকে তবে তদ্‌ভব বা তৎসদৃশ শব্দে ঈ ঊ অথবা বিকল্পে ই উ হইবে, যেমন- কুমীর, পাখী, বাড়ী, শীষ, ঊনিশ চূন, পূব অথবা কুমির, পাখি, বাড়ি, শিষ, উনিশ, চুন, পুব কিন্তু কতকগুলি শব্দে কেবল ঈ, কেবল ই, অথবা কেবল উ হইবে, যথা-নীলা (নীলক), হীরা (হীরক); দিয়াশলাই (দীপশলাকা), খিল (কীল), পানি (পানীয়); চুল (চূল), তাড়ু (তর্দু), জুয়া (দ্যূত), ইত্যাদি
 

স্ত্রীলিঙ্গ এবং জাতি, ব্যক্তি, ভাষা ও বিশেষণ বাচক শব্দের অন্তে ঈ হইবে, যথা-কলুনী, বাঘিনী, কাবুলী, কেরানী, ঢাকী, ফরিয়াদী, ইংরেজী, হিন্দী, বিলাতী, দাগী, রেশমী কিন্তু কতকগুলি শব্দে ই হইবে, যথা-ঝি, দিদি, বিবি, কচি, মিহি, মাঝারি, চলতি ইত্যাদি পিসী, মাসী স্থানে বিকল্পে পিসি, মাসি লেখা চলিবে

অন্যত্র মনুষ্যেতর জীব, বস্তু, গুণ, ভাব ও কর্ম বাচক শব্দের এবং দ্বিরাবৃত্ত শব্দের অন্তে কেবল ই হইবে, যথা-বেঙাচি, বেজি, কাঠি, সুজি, কেরামতি, চুরি, পাগলামি, বাবুগিরি, তাড়াতাড়ি, সরাসরি, সোজাসুজি

নবাগত বিদেশী শব্দে ঈ ঈ-ঊ প্রয়োগ-সম্বন্ধে পরে দ্রষ্টব্য

 

জ যএই সকল শব্দে য না লিখিয়া জ লেখা বিধেয়-কাজ, জাউ, জাঁতা, জাঁতি, জুঁই, জুত, জো, জোড়, জোড়া, জোত, জোয়াল

ণ ন অসংস্কৃত শব্দে কেবল ন হইবে, যথা-কান, সোনা, বামুন, কোরান, করোনার কিন্তু যুক্তাক্ষর ণ্ট, ণ্ঠ, ণ্ড, ণ্ঢ চলিবে, যথা-ঘুণ্টি, লণ্ঠন, ঠাণ্ডা রানী স্থানে বিকল্পে রাণী চলিতে পারিবে

ও-কার, ঊর্ধ্ব-কমা প্রভৃতি

সুপ্রচলিত শব্দের উচ্চারণ, উৎপত্তি বা অর্থের ভেদ বুঝাইবার জন্য অতিরিক্ত ও-কার বা ঊর্ধ্ব-কমা যোগ যথাসম্ভব বর্জনীয় যদি অর্থগ্রহণে বাধা হয় তবে কয়েকটি শব্দে অন্ত্য অক্ষরে ও-কার এবং আদ্য বা মধ্য অক্ষরে ঊর্ধ্ব-কমা বিকল্পে দেওয়া যাইতে পারে, যথা-কাল, কালো; ভাল, ভালো; মত, মতো, পড়ো, পড়ো (পড়ুয়া বা পতিত)

 

এই সকল বানান বিধেয় এত, কত, যত, তত, তো, হয়তো; কাল (সময়, কল্য), চাল (চাউল, ছাত, গতি), ডাল (দাইল, শাখা)

 

ং ঙ

বাঙ্গলা, বাঙ্গালা, বাঙ্গালী, ভাঙ্গন প্রভৃতি এবং বাংলা, বাঙলা, বাঙালী, ভাঙন-প্রভৃতি উভয়প্রকার বানানই চলিবে হসন্ত ধ্বনি বিকল্পে ং বা ঙ বিধেয়, যথা-রং, রঙ, সং, সঙ; বাংলা, বাঙলা স্বরাশ্রিত হইলে ঙ বিধেয়, যথা-রঙের, বাঙালী, ভাঙন

 

ং ঙ-এর প্রাচীন উচ্চারণ যাহাই হউক, আধুনিক বাংলা উচ্চারণ সমান, সেজন্য অনুস্বার স্থানে বিকল্পে ঙ লিখিলে আপত্তির কারণ নাই রং-এর অপেক্ষা রঙের লেখা সহজ রঙ্গের লিখিলে অভীষ্ট উচ্চারণ আসিবে না, কারণ রঙ্গ রং-এর উচ্চারণ সমান নয়, কিন্তু রং রঙ সমান

 

১০ শ ষ স

মূল সংস্কৃত শব্দ-অনুসারে তদ্‌ভব শব্দে শ, ষ বা স হইবে, যথা-আঁশ (অংশু), আঁষ (আমিষ), শাঁস (শস্য), মশা (মশক), পিসী (পিতৃঃস্বসা) কিন্তু কতকগুলি শব্দে ব্যতিক্রম হইবে, যথা-মিনসে (মনুষ্য), সাধ (শ্রদ্ধা)
 

বিদেশী শব্দে মূল উচ্চারণ অনুসারে s স্থানে স, sh স্থানে শ হইবে, যথা আসল, ক্লাস, খাস, জিনিস, পেনসিল, মসলা, মাসুল, সবুজ, সাদা, সিমেন্ট, খুশি, চশমা, তক্তাপোশ, পশম, পোশাক, পালিশ, পেনশন, শখ, শৌখিন, শয়তান, শরবৎ, শরম, শহর, শার্ট, শেক্‌স্পিয়ার কিন্তু কতকগুলি শব্দে ব্যতিক্রম হইবে, অর্থাৎ প্রচলিত বানান বজায় থাকিবে, যথা- ইস্তাহার (ইশতিহার), গোমাস্তা (গুমাশ্‌তাহ্), ভিস্তি (বিহিশ্‌তী), খ্রীষ্ট (Christ)

 

শ ষ স এই তিন বর্ণের একটি বা দুইটি বর্জন করিলে বাংলা উচ্চারণ বাধা হয় না, বরং বানান সরল হয় কিন্তু অধিকাংশ তদ্‌ভব শব্দে মূল-অনুসারে শ ষ স প্রয়োগ বহুপ্রচলিত, এবং একই শব্দের বিভিন্ন বানান প্রায় দেখা যায় না এই রীতির সহসা পরিবর্তন বাঞ্ছনীয় নয় বহু বিদেশী শব্দের প্রচলিত বাংলা বানানে মূল-অনুসারে শ বা স লেখা হয়, কিন্তু কতকগুলি শব্দে ব্যতিক্রম বা বিভিন্ন বানান দেখা, যথা- সরবৎ, সরম; শহর, সহর; শয়তান; সয়তান; পুলিস, পুলিশ সামঞ্জস্যের জন্য যথাসম্ভব একই নিয়ম গ্রহণীয়

 

বিদেশী শব্দে s ধ্বনির জন্য ছ অক্ষর বর্জনীয় কিন্তু যেখানে প্রচলিত বাংলা বানানে ছ আছে এবং উচ্চারণেও ছ হয়, সেখানে প্রচলিত বানানই বজায় থাকিবে, যথা-কেচ্ছা, ছয়লাপ, তছরুপ, পছন্দ ইত্যাদি

 

দেশজ বা অজ্ঞাতমূল শব্দের প্রচলিত বানান হইবে, যথা-করিস, ফরসা (ফরশা), সরেস (সরেশ), উসখুস, উসখুশ

 

১১ ক্রিয়াপদ

সাধু ও চলিত প্রয়োগে কৃদন্ত রূপে করান, পাঠান প্রভৃতি অথবা বিকল্পে করানো, পাঠানো প্রভৃতি বিধেয়

চলিত ভাষায় ক্রিয়াপদের বিহিত বানানের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হইল বিকল্পে ঊর্ধ্ব-কমা বর্জন করা যাইতে পারে, এবং লাম বিভক্তি স্থানে লুম বা লেম লেখা যাইতে পারে

 

হ-ধাতু

হয়, হন, হও, হস, হই হচ্ছে হয়েছেক, হন, হও, হ! হল, হলাম হচ্ছিল হচ্ছিল হয়েছিল হব (হবো), হবেয়ো, হতে, হয়ে, হলে, হবার, হওয়া

 

খা-ধাতু

খায়, খান, খাও, খাস, খাই খাচ্ছে খেয়েছে খাত, খান, খাও, খা খেলে, খেলে, খেলাম খেত, খাচ্ছিল খেয়েছিল খাব (খাবো), খাবে খেয়ো, খাস খেতে, খেয়ে, খেলে, খাবার, খাওয়া

 

দি-ধাতু

দেয়, দেন, দাও, দিস, দিই দিচ্ছে দিয়েছে দিক, দিন, দাও, দে দিলে, দিলাম দিত দিচ্ছিল দিয়েছিল দেব (দেবো), দেবে দিও, দিস দিতে, দিয়ে, দিলে, দেবার, দেওয়া

 

শু-ধাতু

শোয়, শোন, শোও, শুস, শুই শুচ্ছে শুয়েছে শুক, শুন, শোও, শো শুল, শুলাম শুত শুচ্ছিল শুয়েছিল শোব (শোবো), শোবে শুয়ো, শুস শুতে, শুয়ে, শুলে, শোবার, শোয়া

 

কর্-ধাতু

করে, করেন, কর, করিস, করি করছে করেছে করুক, করুন, কর, কর্রলে, করলামরত করেছিলরব (করবো), করবেরো, করিসরতে, করে, করলে, করবার, করা

 

কাট্-ধাতু

কাটে, কাটেন, কাট, কাটিস, কাটি কাটছে কেটেছে কাটুক, কাটুন, কাট, কাট্ কাটলে, কাটলাম কাটত কাটছিল কেটেছিল কাটব (কাটবো), কাটবে কেটো, কাটিস কাটতে, কেটে, কাটলে, কাটবার, কাটা

 

লিখ্-ধাতু

লেখে, লেখেন, লেখ, লিখিস, লিখি লিখছে লিখেছে লিখুক, লিখুন, লেখ, লেখ্ লিখলে, লিখলাম লিখত লিখছিল লিখেছিল লিখব (লিখবো), লিখবে লিখো, লিখিস লিখতে, লিখে, লিখলে, লেখবার, লেখা


উঠ্-ধাতু

ওঠে, ওঠেন, ওঠ, উঠিস, উঠি উঠছে উঠেছে উঠুক, উঠুন, ওঠ, ওঠ্ উঠল, উঠলাম উঠত উঠছিল উঠেছিল উঠব (উঠবো), উঠবে উঠো, উঠিস উঠতে, উঠে, উঠলে, ওঠবার, ওঠা

 

করা-ধাতু

করায়, করান, করাও, করাস, করাই করাচ্ছে করিয়েছে করাক, করান, করাও, করা করালে, করালাম করাত করাচ্ছিল করিয়াছিল করাব (করাবো), করাবে করিও, করাস করাত, করিয়ে, করালে, করাবার, করান (করানো)

 

১২ কতকগুলি সাধু শব্দের চলিত রূপ

কুয়া, সুতা, মিছা, উঠান, উনান, পুরান, পিছন, পিতল, ভিতর, উপর প্রভৃতি কতকগুলি সাধু শব্দের মৌখিক রূপ কলিকাতা অঞ্চলে অন্যপ্রকার যে শব্দের মৌখিক বিকৃতি আদ্য অক্ষরে, তাহার সাধুরূপই চলিতভাষায় গ্রহণীয়, যথা-পিছন, পিতল, ভিতর, উপর যাহার বিকৃতি মধ্য বা শেষ অক্ষরে, তাঁহার চলিত রূপ মৌখিক রূপের অনুযায়ী করা বিধেয়, যথা-কুয়ো, সুতো, মিছে, উঠন, উনন, পুরনো

 

নবাগত ইংরেজী ও অন্যান্য বিদেশী শব্দ

cut-এর u, cat-এর a, f, v, w, z প্রভৃতির প্রতিবর্ণ বাংলায় নাই অল্প কয়েকটি নূতন অক্ষর বা চিহ্ন বাংলা লিপিতে প্রবর্তিত করিলে মোটামুটি কাজ চলিতে পারে বিদেশী শব্দের বাংলা বানান যথাসম্ভব উচ্চারণসূচক হওয়া উচিত, কিন্তু নূতন অক্ষর বা চিহ্নের বাহুল্য বর্জনীয় এক ভাষার উচ্চারণ অন্য ভাষার লিপিতে যথাযথ প্রকাশ করা অসম্ভব নবাগত বিদেশী শব্দের শুদ্ধি-রক্ষার জন্য অধিক আয়াসের প্রয়োজন নাই, কাছাকাছি বাংলা রূপ হইলেই লেখার কাজ চলিবে যে সকল বিদেশী শব্দের বিকৃত উচ্চারণ ও তদনুযায়ী বানান বাংলায় চলিয়া গিয়াছে সে সকল শব্দের প্রচলিত বানানই বজায় থাকিবে, যথা-কলেজ, টেবিল, বাইসাইকেল, সেকেনণ্ড

১৩ বিবৃত অ (cut-এর u)

মূল শব্দে যদি বিবৃত অ থাকে তবে বাংলা বানানে আদ্য অক্ষরে আ-কার এবং মধ্য অক্ষরে অ-কার বিধেয়, যথা-ক্লাব (club), বাস (bus), বাল্‌ব্‌(bulb), সার্ (sir), থার্ড (third), বাজেট (budget), জার্মান (German), কাটলেট (cutlet), সার্কস (circus), ফোকস (focus), রেডিয়ম (redium), ফসফরস (phosphorus),  হিরোডোটস (Herodotus)’

১৪ বক্র আ (বা বিকৃত এ cat-এর a)

মূল শব্দে বক্র আ থাকিলে বাংলায় আদিতে অ্যা এবং মধ্যে ‌‌্যা  বিধেয় যথা-অ্যাসিড (acid), হ্যাট (hat)’

এইরূপ বানানে অ্যা-কে য ফলা +আ-কার, মনে না করিয়া একটি বিশেষ স্বরবর্ণের চিহ্ন জ্ঞান করা যাইতে পারে যেমন- হিন্দিতে এই উদ্দেশ্যে ঐ-কার চলিতেছে (hat hOT) নাগরী লিপিতে যেমন অ-অক্ষরে ও-কার যোগ করিয়া ও (Aao) হয়, সেই রূপ বাংলায় অ্যা হইতে পারে

 

১৫ ঈ ঊ

মূল শব্দের উচ্চারণে যদি ঈ ঊ থাকে তবে বাংলা বানানে ঈ ঊ বিধেয়, যথা-সীল (seal), ঈস্ট (east), ঊস্টার (Worcester), স্পূল (spool)

১৬ f v

f v স্থানে ফ ভ বিধেয়, যথা-ফুট (foot), ভোট (vote)’ যদি মূল শব্দে v এর উচ্চারণে f তুল্য হয়, তবে বাংলায় ফ হইবে, যথা-ফন (von)’

১৭ w

w স্থানে প্রচলিত রীতি অনুসারে উ বা ও বিধেয়, যথা-উইলসন (wilson), উড (wood), ওয়ে (way)’

১৮

নবাগত বিদেশী শব্দে অনর্থক য়-প্রয়োগ বর্জনীয় মেয়র, চেয়ার, রেডিয়ম, সোয়েটর প্রভৃতি বানান চলিতে পারে, কারণ য় লিখিলেও উচ্চারণ বিকৃত হয় না কিন্তু উ-কার বা ও-কারের পর অকারণে য়, য়া, য়ো লেখা অনুচিত এডোয়ার্ড, ওয়ার-বণ্ড্ না লিখিয়া এডওআর্ড, ওঅর-বণ্ড লেখা উচিত হার্ডওয়ার বানানে দোষ নাই

১৯ s, sh

      ১০ সংখ্যক নিয়ম দ্রষ্টব্য

২০ st

      নবাগত বিদেশী শব্দে st স্থানে স্ট বিধেয়, যথা-স্টাভ (stove)

 

২১ z

     z স্থানে বা জ বিধেয়

২২ হস্-চিহ্ন

      ৪সংখ্যক নিয়ম দ্রষ্টব্য

 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বানান রীতি প্রকাশের পর ব্যাপক সমালোচিত হলেও শেষ পর্যন্ত এর অনেক অংশই সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিল এই বানান রীতি অনুসরণেই পূর্ববর্তী সময়ের বেশকিছু অভিধানে পুনরায় সংশোধিত হয়ে প্রকাশিত হয় এই অভিধানগুলো হলো- সরল বাঙ্গালা অভিধান/সুবল মিত্র (১৯০৬), চলন্তিকা/রাজশেখর বসু (১৯৩০) অনেকেই এই রীতিকে সাধুবাদ জানালেও রবীন্দ্রনাথ-সহ বহু সাহিত্যিক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই রীতি সকল ক্ষেত্রে মেনে নেন নি

 

অবিভক্ত বাংলায় বাংলা বানানের টান-পোড়নের সময়ে ভারত বিভাজিত হলো বিভাজিত বাংলার পূর্বাঞ্চল নিয়ে তৈরি হলো পূর্ব-পাকিস্তান ‌১‌৯৪৭ থেকে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ব-পাকিস্তানের ইতিহাস ছিল মূলত ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষার দাবী প্রতিষ্ঠিত হলেও- নানা প্রতিকুলতার ভিতর সংগ্রাম করতে করতে ১৯৭১ সালে পূর্ব-পাকিস্তান পরিণত হলো স্বাধীন বাংলাদেশ-এ

 

‌১‌৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পাকিস্তানিদের বাংলা বিকৃত করার প্রচেষ্টার বিপক্ষে যে জনমত গড়ে উঠেছিল, তার সূত্রে কিছু সুপারিশ প্রস্তাবাকারে উপস্থাপিত হয়েছিল ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে এই সুপারিশগুলোকে তৎকালীন বাংলা একাডেমীর পরিষদ শহজ বাংলা না বলে পাকিস্তানি বাংলা বা পাক বাংলা নামে চালানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কার্যকরী হয় নি পরে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা বানান সংস্কারের জন্য, বাংলা একাডেমী বাংলা বানান সংস্কার নামে একটি উপসংঘ গঠন করে এই উপসংঘের সভাপতি ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান এই উপসংঘের সদস্যরা ছিলেন- ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল হাসনাৎ, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুহম্মদ ওসমান গনি, মুহম্মদ ফেরদাউস খান, মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী এই উপসংঘ যে প্রস্তাব রাখেন, তার মূল বিষয় ছিল-

 

সকল শব্দে ঙ-এর পরিবর্তে ং হবে

সকল ক্ষেত্রে ণ বর্জিত হবে

যথা সম্ভব ঈ এবং ঊ বর্জন করা হবে

ঋ-এর স্থানে রি ব্যবহৃত হবে

যুক্ত বর্ণে ঞ- থাকলে, সেখানে ন ব্যবহৃত হবে (অর্থাৎ- অঞ্জন হবে- অনজন)

বিসর্গ, ব-ফলা, ম-ফলা বর্জন করা হবে (অর্থাৎ আত্ম, স্বাধীন লিখা হবে- আত্‌ত, সাধিন)

হসন্ত ব্যবহার করে যুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ ভেঙে লিখতে হবে (অর্থাৎ আনন্দ লিখা হবে- আনন্‌দ)

দ্রষ্টব্য : বাংলা ভাষা : কয়েকটি প্রসঙ্গ/মাহবুবুল হক, বাঙলা একাডেমী পত্রিকা, বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৭৩] 

 

এই সুপারিশে সাথে কমিটির সবাই একমত হতে পারেন নি এবং ব্যক্তিগত লেখায় এই বানান রীতি কেউ প্রয়োগ করার চেষ্টাও করেন নি সব মিলিয়ে এই সুপারিশ ব্যর্থ হয়ে যায় বিশেষ করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুহম্মদ ফেরদাউস খান, মোফাজ্জেল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ এই সুপারিশের বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ করেছিলেন প্রশ্ন জাগে এত সকল বরেণ্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে এবং এদের বিরোধিতায় এই সুপারিশ প্রণীত হয়েছিল কি ভাবে ?

 

১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপর্ষদ বাংলা ভাষার সংস্কার ও সরলায়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করে বুদ্ধিজীবীরা এই প্রস্তাবের পক্ষ-বিপক্ষে বিস্তারিত কথা চালাচালির পরে,  এই সুপারিশও শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায়

 

স্বাধীনতার পর  বাংলাদেশের লেখক বুদ্ধিজীবীরা অনুভব করেছিল, কলকাতা বানান সমিতি কর্তৃক প্রণীত বানান রীতির পরিবর্তন প্রয়োজন ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট এই রিপোর্টের আলোকে জাতী্য় শিক্ষাক্রমের জন্য একটি বানান রীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিল গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা-মন্ত্রণালয় এই উদ্দেশ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছিল এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন- কাজী দীন মুহম্মদ, কমিটি সদস্য-সচিব ছিলেন শফিউল আলম এবং সদস্যরা ছিলেন ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মমতাজউদ্দীন আহমদ, মুহাম্মদ আবদুল জব্বার, সুফী মোতাহার হোসেন।  ১৯৮৪ সালে প্রণীত এই বানানরীতি নিচে তুলে ধরা হলো সূত্র  : বাংলা বানান অভিধান : সংকলক ও সম্পাদক ড. খুরশিদ আলম

 


 

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও টেক্সটবুক বোর্ড (বাংলাদেশ) কর্তৃক প্রণীত বানানরীতি : ১৯৮৪

[জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টে (১ম খণ্ড, ১৯৭৬, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার) বর্ণিত সুপারিশের (অনুচ্ছে ২.২.৫ পাঠ্যপুস্তকের ভাষা ও বানান রীতি ৩৪ পৃঃ) পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক স্তরের বাংলা পাঠ্যপুস্তককে অনুসরণের জন্য বানান রীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও টেক্সটবুক বোর্ড বিগত ১৭.৬.৮৪ তারিখে ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে বিশেষজ্ঞ কমিটি ২২.৮.৮৪ তারিখে তাঁদের সুপারিশ পেশ করেন নিম্নে সুপারিশসমূহ এবং অনুসৃতব্য বানানরীতির কিছু উদাহরণ মুদ্রিত হলো]

 

পাঠ্যপুস্তকের বানানের জন্য বিশেষভাবে নিম্নলিখিত অভিধানসমূহ অনুসরণ করা হবে :

 

(ক) বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (স্বরবর্ণ) সম্পাদক- ডঃ মুহম্মদ এনামুল হক

(খ) ব্যবহারিক শব্দকোষ : কাজী আবদুল ওদুদ

(গ) চলন্তিকা : রাজশেখর বসু

(ঘ) সংসদ বাংলা অভিধান : শৈলেন্দ্র বিশ্বাস

(ঙ) পারস্যে আরাবিক এলিমেন্টস ইন বেঙ্গলি-ডঃ গোলাম মকসুদ হিলালী

 

উপরে উল্লিখত অভিধানসমূহে ব্যবহৃত শব্দের প্রথম বানানটি গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়

 

পাঠ্যপুস্তকে লেখক ও কবির নামের বানান তাঁরা নিজে যেভাবে লিখেছেন বা লেখেন তা অক্ষুণ্ণ রাখা হবে

বানানে ব্যঞ্জনবর্ণ যথাযথ এবং সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হবে তবে কয়েকটি যুক্তবর্ণের চিত্র যেমনভাবে প্রচলিত আছে তেমনি রাখা বাঞ্ছনীয় যেমন-ক্ষ (ক+খ), ট্ট (ট+ট), জ্ঞ (জ+ঞ), ত্র (ত +র), ত্ত (ত+ত) এবং ভ্র (ভ +র) কিন্তু ক্ক, ক্ব, ঙ্গ, ঞ্চ, ঞ্ছ, ঞ্ছ, ঞ্ঝ, ত্ব, ত্ত, ত্ম, ত্থ, দ্দ, দ্ব, ন্দ, ন্ধ, ন্ন, ন্ম, ম্ল, ম্ম, ম্প, ম্ফ, ল্ক, ল্ব, ব্ল, হ্ল, হ্ন, হ্ণ, হ্ম, হৃ, হ্র, হ্ল, ষ্ট, স্ট, স্ন, স্ব, স্র, স্থ, শ্র, শ্ল  প্রভৃতি অন্যান্য যুক্তাক্ষরসমূহে প্রত্যেকটি ব্যঞ্জনবর্ণ যেন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় সেভাবে অক্ষর বিন্যাস করতে হবে তবে প্রথম শ্রেণীতে শেখাবার সুবিধার্থে, ট্ট, ত্র লেখা চলবে

সংস্কৃত শব্দ ছাড়া কোন ক্ষেত্রে ণত্ব বিধান এবং ষত্ব বিধানের নিয়ম পালন করা হবে না এবং বিদেশী শব্দের বানানে ও ষ এর পরে হবে যেমন- ইরানি, জার্মানি, বদরুন ইত্যাদি

তদ্ভব শব্দের মূল্যের কাছাকাছি বানান ব্যবহার করা হবে যেমন-রানী

স্ত্রীবাচক শব্দের শেষ বর্ণে প্রয়োজনবোধে ঈ (ী) কার হবে যেমন- মুরগী, গাভী, হরিণী

বিশেষণবাচক আলি প্রত্যয়যুক্ত শব্দে ই (ি) কার হবে যেমন-রূপালি, সোনালি

পদাশ্রিত নির্দেশ টি তে ই (ি) কার হবে

অক্ষয়, ক্ষেত, ক্ষেত্র ইত্যাদি বানানে বানানের মূল অবয়বে ক্ষ হবে

১০ ইসলামী ধর্মীয় শব্দের বেলায় জিমের জন্য জ (যেমন-জুম্মা, মসজিদ) এবং যোয়াদ ও যোয়া-র ক্ষেত্রে য (যেমন-আযান, ওযু, রমযান, নামায, রোযা, যাকাত, হযরত) ব্যবহার করা হবে অন্যত্র আরবি, ফারসি শব্দের ক্ষেত্রে তদ্ভব রীতি অনুযায়ী বাংলা বানান লেখা হবে যেমন-(জাদু, জাদুঘর, জমি, জাদুকর)

১১ আরবি (সিন) এর জন্য বাংলায় ব্যবহার করতে হবে

১২ কুরআন শব্দের বানান বিভিন্ন রকম না লিখে কুর্আন লেখা হবে

১৩ পাঠ্যপুস্তক সর্বত্র মুহম্মদ (সাঃ) এর নামের সঙ্গে প্রথম বন্ধনী দিয়ে শ্রদ্ধাসূচক (সাঃ) লেখা হবে এছাড়া ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তবর্গের নামের শেষে সম্মানসূচক (আঃ) অথবা (রাঃ) লেখা হবে

১৪ বিদেশী শব্দের শেষে ই (ি) অথবা ঈ (ী) থাকলে ই (ই) কার হবে যেমন- জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ইত্যাদি

১৫ ভাষা ও জাতির নামের শেষে ই (ি) অথবা (ী) থাকলে সর্বত্র ই (ি) কার হবে যেমন-জাপানি, তুর্কি, ফরাসি, জার্মানি, ইংরেজি ইত্যাদি

১৬ ইংরেজি s স্থলে স হবে ইংরেজি শব্দের শেষে CEAN, TION, SSION প্রভৃতি অংশ যদি শন-এর মতো উচ্চারিত হয় তবে বাংলা বানান দিয়ে লিখতে হবে যেমন-ইনস্টটিউশন, ওশান, সেশন ইত্যাদি তেমনি Polish শব্দ পুলিশ রূপে লেখা হবে  

১৭ বাক্য অনুষঙ্গে ক্রিয়ার কাল নির্দেশের জন্য বানান প্রয়োজন মতো উচ্চারণভিত্তিক হবে যেমন-তুমি দেখ (অনুজ্ঞাবাচক বর্তমান), তুমি দেখো (অনুজ্ঞাবাচক ভবিয্যৎ)

১৮ সাধারণত জিজ্ঞাসা অর্থে কি শব্দে ই (ি) কার হবে তবে, সর্বনাম পদে বস্তু বা বিষয় বুঝাতে প্রয়োজন মতো কী-ঈ (ী) কার ব্যবহার করা হবে যেমন- তুমি কি করছ (জিজ্ঞাসাবাচক), তুমি কী খাচ্ছ ? (বস্তুবাচক সর্বনাম)

১৯ ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে উ (ু) অথবা ঊ (ূ) কার যুক্ত হলে এই স্বরবর্ণটি নিচে বসবে যেমন- (*উদাহরণ দেওয়া গেলো না*)

২০ অনিবার্য কারণ ছাড়া হসন্ত ও ঊর্ধ্বকমা ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই

২১ বেশী, তৈরী, দেরী এসব শব্দের বানানে ই (ি) কার ব্যবহার হবে

২২ সংস্কৃত শব্দের প্রাকৃত অথবা বাংলা রূপে ঈ (ী) কার স্থলে (ি) কার ব্যবহার করতে হবে যেমন-পাখি, বাড়ি, হাতি ইত্যাদি

২৩ রেফের পরে দ্বিত্ববর্ণ বর্জন করতে হবে যেমন-কর্ম, ধর্ম, চর্ম ইত্যাদি

২৪ পূর্বাহ্ন, সায়াহ্ন, চিহ্ন, অপরাহ্ন প্রভৃতি শব্দে হ +ন (ণ) বর্ণদ্বয় যুক্তভাবে না লিখে প্রয়োজন মতো পাশাপাশি অথবা উপরে-নিচে লিখতে হবে যেমন- পূর্বাহণ, অপরাহণ, চিহণ

২৫ পাঠ্যপুস্তকে কোনো লেখক এবং কবির রচনা সংকলনের সময় সে রচনায় বানানের ক্ষেত্রে উল্লোখিত নীতিমালা প্রযুক্ত হবে

 

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট অনুসারে সুপারিশকৃত বানান রীতিও সফল হয় নি তাই ১৯৮৮ সালে পাঠপুস্তক বোর্ড জাতীয় কর্মশিবিরের আয়োজন করে এই কর্মশিবিরে অংশগ্রহণ করে বিশিষ্ট ভাষা-বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিক্ষা-প্রশাসক, শিক্ষাক্রম-বিশেষজ্ঞ, বাংলা একাডেমী, বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ, ইসলামী ফাউন্ডেশান ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রতিনিধিরা এই কমিটি তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরর বানানরীতির অক্ষুণ্ণ রেখে অ-তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে ধ্বনি বৈশিষ্ট্য অনুসারে বানান রীতি প্রণয়ন করেন পরে কর্মশিবিরের সুপারিশ অনুসারে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অভিন্ন বানানরীতির অনুসরণে পাঠ্য বইয়ের বানান নামে একটি পুস্তক প্রকাশ করেন ড. আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় এই বইটি প্রণয়ন করেছিলেন হায়াৎ মামুদ নিচে এই সুপারিশ তুলে ধরা হলো

 

০১.

রেফের পর কোথাও ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না যেমন-কর্ম, কার্য, শর্ত, সূর্য

০২.

সন্ধিতে প্রথম পদের শেষে ম্‌থাকলে ক-বর্গের পূর্বে ম্ স্থানে ং লেখা হবে যেমন : অহংকার, ভয়ংকর, সংগীত অন্যান্য ক্ষেত্রে ক, খ, গ, ঘ এবং ক্ষ-র পূর্বে নাসিক্যবর্ণ যুক্ত করার জন্য সর্বত্র ঙ্ লেখা হবে যেমন-অঙ্ক, আকাঙ্ক্ষা, সঙ্গে ইত্যাদি প্রত্যয় ও বিভক্তিহীন শব্দের শেষে অনুস্বার ব্যবহৃত হবে যেমন : রং তবে শব্দে অব্যয় বা বিভক্তিযুক্ত হলে কিংবা পদের মধ্যে বা শেষে স্বরবর্ণ থাকলে ঙ হবে যেমন- বাঙালি, ভাঙা, রঙিন, রঙের

০৩.

হস্‌চিহ্ন ও ঊর্ধ্বকমা যথাসম্ভব বর্জন করা হবে যেমন- করব, চট, দুজন

০৪.

যে শব্দের বানানে হ্রস্ব ও দীর্ঘ উভয় স্বর অভিধানসিদ্ধ, সেক্ষেত্রে এবং অ-তৎসম ও বিদেশী শব্দের বানানে শুধু হ্রস্ব স্বর প্রযুক্ত হবে যেমন- পাখি, বাড়ি, হাতি

০৫.

ক্ষ-বিশিষ্ট সকল শব্দে ক্ষ অক্ষুণ্ণ থাকবে যেমন-অক্ষয়, ক্ষেত, পক্ষ

০৬.

কয়েকটি স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ঈ-কার হবে যেমন-গাভী, রানী, হরিণী; কিঙ্করী, পিশাচী, মানবী

০৭.

ভাষা ও জাতির নামের শেষে ই-কার থাকবে যেমন-ইংরেজি, জাপানি, বাঙালি

০৮.

বিশেষণবাচক আলি-প্রত্যয়যুক্ত শব্দে ই-কার হবে যেমন- সোনালি, রূপালি, বর্ণালি

০৯.

পদাশ্রিত নির্দেশক টি-তে ই-কার হবে যেমন-লোকটি

১০.

অর্থভেদ বোঝাবার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী হ্রস্ব ও দীর্ঘস্বর ব্যবহার করা হবে যেমন- কি (অব্যয়), কী (সর্বনাম); তৈরি (ক্রিয়া), তৈরী (বিশেষণ), নিচ (নিম্ন অর্থে), নীচ (হীন অর্থে); কুল (বংশ অর্থে), কূল (তীর অর্থে)

১১.

বাংলায় প্রচলিত কৃতঋণ বিদেশী শব্দ বাংলা ভাষার ধ্বনিপদ্ধতিতে লিখিত হবে যেমন-কাগজ, জাহাজ, হাসপাতাল ইত্যাদি তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হবে যেমন-

 

(ক)

ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত নিম্নলিখিত শব্দের আরবি (যোয়াদ) ও (যাল)-এর জন্য (ইংরেজি z ধ্বনির মত) ব্যবহৃত হবে যেমন- আযান, এযিন, ওযু, কাযা, নামায, মুয়াযযিন, যাকাত, যিকির, যোহর, রমযান, হযরত

 

(খ)

অনুরূপ শব্দে আরবি (সোয়াদ) ও (সিন)-এর জন্য স এবং (শিন)-এর জন্য শ হবে যেমন- সালাম, মসজিদ, সালাত, এশা

 

(গ)

ইংরেজি এবং ইংরেজির মাধ্যমে আগত s ধ্বনির জন্য স ও sh, -sion, -ssion, -tion প্রভৃতি ধ্বনির জন্য শ এবং st ধ্বনির জন্য স্ট যুক্তবর্ণ লেখা হবে

 

(ঘ)

ইংরেজি বক্র a ধ্বনির জন্য শব্দের প্রারম্ভে এ অপরিহার্য যেমন-এলকোহল, এসিড

 

(ঙ)

Christ Christian শব্দের বাংলা রূপ হবে খ্রিস্ট ও খ্রিস্টান এ নিয়মে খ্রিস্টান হবে

১২.

পূর্ববর্তী নিয়মের (ক) থেকে (ঘ) পর্যন্ত বর্ণিত বিধি ব্যাতিক্রম বলে গণ্য হবে তাছাড়া সংস্কৃত শব্দ ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষেত্রে ণত্ব বিধি অনুসরণ করা হবে না তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, নাসিক্যধ্বনি যুক্ত করার জন্য চ- বর্গের পূর্বে কেবল ঞ (যেমন : অঞ্চল, অঞ্জলি, বাঞ্ছা), ট-বর্গের পূর্বে কেবল ণ (যেমন : কাণ্ড, ঘণ্টা) এবং ত-বর্গের পূর্বে কেবল ন (যেমন : তন্তু, পান্থ) লেখা হবে অনুরূপভাবে, শিসধ্বনি যুক্ত করার জন্য চ-বর্গের অঘোষধ্বনির পূর্বে কেবল শ (যেমন : নিশ্চয়, নিশ্ছদ্র), ট-বর্গের অঘোষধ্বনির পূর্বে কেবল ষ (যেমন : কষ্ট, কাষ্ঠ), এবং ত বর্গের অঘোষধ্বনির পূর্বে কেবল স (যেমন : অস্ত্র, আস্থা) ব্যবহৃত হবে

১৩.

পদান্তে বিসর্গ থাকবে না যেমন-ক্রমশ, প্রধানত, মূলত

বানানরীতি

১০

 

১৪.

ক্রিয়াপদের বানানে পদান্তে ও-কার অপরিহার্য নয় যেমন-করব, হল ইত্যাদি এত, মত, কোনো প্রভৃতি শব্দে ও-কার আবশ্যক নয় তবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞায় ও-কার রাখা যাবে যেমন- করো, কোরো, বলো, বোলো

১৫.

ব্যঞ্জনবর্ণের ঊ-কার (ূ), ও ঋ-কারের (ৃ) একাধিক রূপ পরিহার করে এই কারগুলো বর্ণের নিচে যুক্ত করা হবে যেমন- শুভ, রূপ, হৃদয়

১৬.

যুক্তব্যঞ্জন স্বচ্ছ করার জন্য প্রথম বর্ণের ক্ষুদ্রাকারে এবং দ্বিতীয় বর্ণের পূর্ণরূপে লিখতে হবে যেমন- অঙ্ক, সঙ্গে, স্পষ্ট

১৭.

যেসব যুক্তব্যঞ্জন বাংলা উচ্চারণে নতুন ধ্বনি গ্রহণ করে-যেমন : ক্ষ (ক্ +ষ), জ্ঞ (জ্ +ঞ), হ্ম বা হম (হ্ +ম) সেগুলোর রূপ অক্ষ্ণ্ণ থাকবে তাছাড়া নন্দনতাত্ত্বিক বিচারে ঞ্চ (ঞ্ +চ), ঞ্ছ (ঞ্ +ছ), ঞ্জ (ঞ্ +জ), ট্ট (ট্ +ট),  ট্র (ট্ +র), ত্ত (ত্ +ত), ত্থ (ত্ +থ), ত্র (ত্ +র), ভ্র (ভ্ +র), হ্ন (হ্ +ন), ষ্ণ (ষ +ণ) ইত্যাদি যুক্তবর্ণের প্রচলিত রূপও অক্ষুণ্ণ রাখা হবে তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে যুক্তব্যঞ্জন গঠনের রূপ ব্যাখ্যা করা হবে

১৮.

সমাস পদ এক সাথে লিখিত হবে যেমন- জটিলমূলক, বিজ্ঞানসম্মত সংবাদপত্র অর্থগতভাবে একক হলেও তা একসঙ্গে লেখা হবে যেমন- ষোলকলা প্রয়োজনবোধে শব্দের মাঝখানে হাইফেন দেয়া যেতে পারে যেমন- কিছু-না-কিছু, লজ্জা-শরম, সঙ্গত-পাঠ-নির্ধারণ ইত্যাদি

১৯.

বিশেষণবাচক পদ (গুণ, সংখ্যা বা দূরত্ব ইত্যাদি-বাচক) হলে সেটি আলাদা বসবে যেমন- এক জন, কত দূর, সুন্দর ছেলে ইত্যাদি

২০.

নঞর্থক শব্দ পৃথকভাবে বসবে যেমন-ভয়ে নয়, হয় না, আসে নি, হাতে নেই

২১.

হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর নামের পরে প্রথম বন্ধনীর মধ্যে (স), অন্য নবী ও রসূলের নামের পরে বন্ধনীর মধ্যে (আ), সাহাবীদের নামের পরে (রা) এবং বিশিষ্ট মুসলিম ধার্মিক ব্যক্তির নামের পরে (র) লিখতে হবে

২২.

লেখক ও কবি নিজেদের নামের বানান যেভাবে লেখেন বা লিখতেন, সেভাবে লেখা হবে

২৩.

বাংলাদেশের টাকার প্রতীকচিহ্নের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য অঙ্কের বইতে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য বইতে তার মূল্য-নির্দেশক সংখ্যার পূর্বে টাকার চিহ্নটি ব্যবহার করা হবে

২৪.

পূর্ববর্ণিত নিয়মাবলীর বহির্ভূত শব্দের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত অভিধানগুলোতে প্রদত্ত প্রথম বানান গ্রহণ করা যেতে পারে

চলন্তিকা : রাজশেখর বসু ব্যবহারিক শব্দকোষ : কাজী আবদুল ওদুদ বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, দুখণ্ড : জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস বাঙ্‌লা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দ-সংকলন: হরেন্দ্রচন্দ্র পাল পারস্যে-এরাবিক এলিমেন্টস ইন বেঙ্গলি: গোলাম মকসুদ হিলালী

 

এরপর ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমী বাংলা বানান রীতিকে প্রমিত করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে এই কমিটির সভাপতি ছিলেন, ড. আনিসুজ্জামান এবং সদস্য-সচিব ছিলেন বশীর আলহেলাল এছাড়া সদস্য হিসাবে ছিলেন- মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, জামিল চৌধুরী ও নরেন বিশ্বাস এই কমিটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সুপারিশমালা এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান রীতিকেও বিবেচনা করেছিল।     

 


বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম

 

তৎসম শব্দ

১.০১.

তৎসম অর্থাৎ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত অবিকৃত সংস্কৃত শব্দের বানান যথাযথ ও অপরিবর্তিত থাকবে কারণ এইসব শব্দের বানান ও ব্যাকরণগত প্রকরণ ও পদ্ধতি নির্দিষ্ট রয়েছে

১.০২.

যে-সব তৎসম শব্দে ই, ঈ বা উ, ঊ উভয়ই শুদ্ধ, সেসব শব্দে কেবল ই বা উ এবং তার কার চিহ্ন ি ু ব্যবহৃত হবে যেমন: কিংবদন্তি, খঞ্জনি, চিৎকার, ধমনি, ধূলি, পঞ্জি, পদবি, ভঙ্গি, মঞ্জরি, মসি, লহরি, সরণি, সূচিপত্র, ঊর্ণা, ঊষা

১.০৩.

রেফ-এর পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না যেমন: অর্চনা, অর্জন, অর্থ, অর্ধ, কর্দম, কর্তন, কর্ম, কার্য, গর্জন, মূর্ছা, কার্তিক, বার্ধক্য, বার্তা, সূর্য

১.০৪.

ক খ গ ঘ পরে থাকলে পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার লেখা যাবে যেমন: অহংকার, ভয়ংকর, সংগীত, শুভংকর, হৃদয়ংগম, সংঘটন বিকল্পে ঙ্ লেখা যাবে ক্ষ-এর পূর্বে সর্বত্র ঙ্‌হবে যেমন-আকাঙ্ক্ষা

২.০১.

ই ঈ উ ঊ

সকল অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের -কার চিহ্ন ি ু ব্যবহৃত হবে ৷ এমনকি স্ত্রীবাচক ও জাতিবাচক ইত্যাদি শব্দের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে ৷ যেমন: গাড়ি, চুরি, দাড়ি, বাড়ি, ভারি, শাড়ি, তরকারি, বোমাবাজি, দাবি, হাতি, বেশি, খুশি, হিজরি, আরবি, ফারসি, ফরাসি, বাঙালি, ইংরেজি, জাপানি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, সিন্ধি, ফিরিঙ্গি, সিঙ্গি, ছুরি, টুপি, সরকারি, মাস্টারি, মালি, পাগলামি, পাগলি, দিঘি, কেরামতি, রেশমি, পশমি, পাখি, ফরিয়াদি, আসামি, বে-আইনি, ছড়ি, কুমির, নানি, দাদি, বিবি, মমি, চাচি, মাসি, পিসি, দিদি, বুড়ি, ছুঁড়ি, নিচে, নিচু, ইমান, চুন, ভুব, বুখা, মুলা, পুজো, উনিশ, উনচল্লিশ

অনুরূপভাবে, -আলি প্রত্যয়যুক্ত শব্দে ই-কার হবে যেমন: খেয়ালি, বর্ণালি, মিতালি, সোনালি, হেঁয়ালি 

তবে কোনো কোনো স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ঈ-কার দেওয়া যেতে পারে৷ যেমন: রানী, পরী, গাভী

 

সর্বনাম পদরূপে এবং বিশেষণ ও ক্রিয়া-বিশেষণ পদরূপে কী শব্দটি ঈ-কার দিয়ে লেখা হবে যেমন- কী করছ? কী পড়ো? কী খেলে? কী আর বলবো? কী যে করি! এটা কী বই? কী করে যাব? কী বুদ্ধি নিয়ে এসেছিলে? কী আনন্দ! কী দুরাশা!

অন্য ক্ষেত্রে অব্যয় পদরূপে ই-কার দিয়ে কি শব্দটি লেখা হবে।  যেমন- তুমিও কি যাবে? সে কি এসেছিল? কি বাংলা কি ইংরেজি উভয় ভাষায় তিনি পারদর্শী

পদাশ্রিত নির্দেশক টি-তে ই-কার হবে যেমন: ছেলেটি, লোকটি, বইটি

২.০২.

ক্ষ

ক্ষীর, ক্ষুর ও ক্ষেত শব্দ খির, খুর ও খেত না লিখে সংস্কৃত মূল অনুসরণে ক্ষীর, ক্ষুর ও ক্ষেত-ই লেখা হবে তবে অ-তৎসম শব্দ খুদ, খুদে, খুর, খেপা, খিধে ইত্যাদি লেখা হবে

২.০৩.

মূর্ধন্য ণ, দন্ত্য ন

তৎসম শব্দের বানানে ণ, ন-য়ের নিয়ম ও শুদ্ধতা রক্ষা করতে হবে এ-ছাড়া তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র কোনো শব্দের বানানে ণত্ব বিধি মানা হবে না যেমন- অঘ্রান, ইরান, কান, কুরআন, গুনতি, গোনা, ঝরনা, ধরন, পরান, সোনা, হর্ন

 

তৎসম শব্দে ট ঠ ড ঢ-য়ের পূর্বে হয় যেমন- কণ্টক, লুণ্ঠন, প্রচণ্ড।  কিন্তু তত্সম ছাড়া অন্যান্য সকল শব্দের ক্ষেত্রে ট ঠ ড ঢ-য়ের আগেও কেবল ন হবে অ-তৎসম শব্দে যুক্তাক্ষরের বানানের জন্য ৪.০১ দ্রষ্টব্য

২.০৪.

, ,

তৎসম শব্দে শ, , স-য়ের নিয়ম মানতে হবে এ-ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে সংস্কৃতের ষত্ব-বিধি প্রযোজ্য হবে না

 

বিদেশী মূল শব্দে শ, স-য়ের যে প্রতিষঙ্গী বর্ণ বা ধ্বনি রয়েছে বাংলা বানানে তাই ব্যবহার করতে হবে যেমন- সাল (=বত্সর), সন, হিসাব, শহর, শরবত, শামিয়ানা, শখ, শৌখিন, মসলা, জিনিস, আপস, সাদা, পোশাক, বেহেশ্‌ত, নাশতা, কিশমিশ, শরম, শয়তান, শার্ট, স্মার্ট তবে, পুলিশ শব্দটি ব্যতিক্রমরূপে শ দিয়ে লেখা হবে তৎসম শব্দে ট, ঠ বর্ণের পূর্বে ষ হয় যেমন- বৃষ্টি, দুষ্ট, নিষ্ঠা, পৃষ্ঠা কিন্তু বিদেশী শব্দে এই ক্ষেত্রে স হবে যেমন: স্টল, স্টাইল, স্টিমার, স্টুডিয়ো, স্টেশন, স্টোর, স্ট্রিট৷ কিন্তু খ্রিষ্ট যেহেতু বাংলায় আত্তীকৃত শব্দ এবং এর উচ্চারণও হয় তত্সম কৃষ্টি, তুষ্ট, ইত্যাদি শব্দের মতো, তাই ষ্ট দিয়ে খ্রিষ্ট শব্দটি লেখা হবে

২.০৫.

আরবি-ফারসি শব্দে সে, ‘সিন্ সোয়াদ বর্ণগুলির প্রতিবর্ণরূপে স, এবং শিন্ -এর প্রতিবর্ণরূপে শ ব্যবহৃত হবে যেমন- সালাম, তসলিম, ইসলাম, মুসলিম, মুসলমান, সালাত, এশা, শাবান (হিজরি মাস), শাওয়াল (হিজরি মাস), বেহেশ্‌ত

এই ক্ষেত্রে স-এর পরিবর্তে ছ লেখার কিছু কিছু প্রবণতা দেখা যায়, তা ঠিক নয় তবে যেখানে বাংলায় বিদেশী শব্দের বানান সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে স ছ-য়ের রূপ লাভ করেছে সেখানে ছ ব্যবহার করতে হবে যেমন: পছন্দ, মিছিল, মিছরি, তছনছ

২.০৬.

ইংরেজি ও ইংরেজির মাধ্যমে আগত বিদেশী s বর্ণ বা ধ্বনির জন্য স এবং sh, -sion, -ssion, -tion প্রভৃতি বর্ণগুচ্ছ বা ধ্বনির জন্য শ ব্যবহৃত হবে তবে question ইত্যাদি শব্দের বানান অন্যরূপ, যেমন-কোএস্‌চ্‌ন হতে পারে

২.০৭.

,

বাংলায় প্রচলিত বিদেশী শব্দ সাধারণভাবে বাংলা ভাষার ধ্বনিপদ্ধতি অনুযায়ী লিখতে হবে যেমন: কাগজ, জাহাজ, হুকুম, হাসপাতাল, টেবিল, পুলিশ, ফিরিস্তি, হাজার, বাজার, জুলুম, জেব্রা

কিন্তু ইসলাম ধর্ম-সংক্রান্ত কয়েকটি বিশেষ শব্দে যে ,  যাল, ‘যোয়াদ, ‘যোয়া রয়েছে, যার ধ্বনি ইংরেজি z-এর মতো সেক্ষেত্রে উক্ত আরবি বর্ণগুলির জন্য য ব্যবহার হওয়া সঙ্গত যেমন- আযান, এযিন, ওযু, কাযা, নামায, মুয়ায্‌যিন, যোহর, রমযান তবে কেউ ইচ্ছা করলে এই ক্ষেত্রে য-এর পরিবর্তে জ ব্যবহার করতে পারেন জাদু, জোয়াল, জো, ইত্যাদি শব্দ জ দিয়ে লেখা বাঞ্ছনীয়

২.০৮.

, অ্যা

বাংলায় এ বা ে-কার দ্বারা অবিকৃত এ এবং বিকৃত বা ব্যাঁকা অ্যা এই উভয় উচ্চারণ বা ধ্বনি নিষ্পন্ন হয়৷ তত্সম বা সংস্কৃত ব্যাস, ব্যায়াম, ব্যাহত, ব্যাপ্ত, জ্যামিতি, ইত্যাদি শব্দের বানান অনুরূপভাবে লেখার নিয়ম আছে

অনুরূপ তৎসম এবং বিদেশী শব্দ ছাড়া অন্য সকল বানানে অবিকৃত-বিকৃত নির্বিশেষে এ বা ে-কার হবে৷ যেমন- দেখে, দেখি, যেনো, কেন, কেনো (ক্রয় করো), গেল, গেলে, গেছে

বানানরীতি

১২

 

বিদেশী শব্দে অবিকৃত উচ্চারণের ক্ষেত্রে এ বা ে-কার ব্যবহৃত হবে৷ যেমন- এন্ড (end) , নেট, বেড, শেড

বিদেশী শব্দে বিকৃত বা ব্যাঁকা উচ্চারণে অ্যা বা (য-ফলা+আ-কার) ব্যবহৃত হবে৷ যেমন- অ্যান্ড, অ্যাবসার্ড, অ্যাসিড, ক্যাসেট, ব্যাক, ম্যানেজার, হ্যাট

তবে কিছু তদ্ভব এবং বিশেষভাবে দেশী শব্দ রয়েছে যার (য-ফলা+আ-কার)-যুক্ত রূপ বহুল-পরিচিত যেমন- ব্যাঙ, চ্যাঙ, ল্যাঙ, ল্যাঠা এ-সব শব্দে (য-ফলা+আ-কার) অপরিবর্তিত থাকবে

২.০৯.

বাংলা অ-কারের উচ্চারণ বহুক্ষেত্রে ও-কার হয়৷ এই উচ্চারণকে লিখিত রূপ দেওয়ার জন্য ক্রিয়াপদের বেশ কয়েকটি রূপের এবং কিছু বিশেষণ ও অব্যয় পদের শেষে, কখনো আদিতে অনেকে যথেচ্ছভাবে ো-কার ব্যবহার করছেন৷ যেমন: ছিলো, করলো, বলতো, কোরছ, হোলে, যেনো, কেনো (কীজন্য), ইত্যাদি ও-কারযুক্ত বানান লেখা হচ্ছে৷ বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া অনুরূপ ো-কার ব্যবহার করা হবে না৷

 

বিশেষ ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে এমন অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়াপদ এবং বিশেষণ ও অব্যয় পদ বা অন্য শব্দ যার শেষে ো-কার যুক্ত না করলে অর্থ অনুধাবনে ভ্রান্তি বা বিলম্ব ঘটতে পারে৷ যেমন: ধরো, চড়ো, বলো, বোলো, জেনো, কেনো (ক্রয় করো), করানো, খাওয়ানো, শেখানো, করাতো, মতো, ভালো, আলো, কালো, হলো৷

২.১০.

,

তৎসম শব্দে ং এবং ঙ যেখানে যেভাবে ব্যবহার্য ও ব্যাকরণসম্মত সেইভাবে ব্যবহার করতে হবে এ-সম্পর্কে পূর্বে ১.০৪. অনুচ্ছেদে কিছু নিয়মের কথা বলা হয়েছে তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র শব্দের বানানের ক্ষেত্রে ওই নিয়মের বাধ্যবাধকতা নেই তবে এই ক্ষেত্রে প্রত্যয় ও বিভক্তিহীন শব্দের শেষে সাধারণভাবে অনুস্বার (ং) ব্যবহৃত হবে যেমন: রং, সং, পালং, ঢং, রাং, গাং তবে শব্দে অব্যয় বা বিভক্তি যুক্ত হলে কিংবা পদের মধ্যে বা শেষে স্বরচিহ্ন থাকলে ঙ হবে৷ যেমন- বাঙালি, ভাঙা, রঙিন, রঙের বাংলা ও বাংলাদেশ শব্দ-দু'টি ং দিয়ে লিখতে হবে৷ বাংলাদেশের সংবিধানে তাই করা হয়েছে

২.১১.

রেফ ও দ্বিত্ব

তৎসম শব্দের অনুরূপ বানানের ক্ষেত্রে যেমন পূর্বে বলা হয়েছে, অ-তৎসম সকল শব্দেও রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না যেমন: কর্জ, কোর্তা, মর্দ, সর্দার

২.১২.

বিসর্গ (ঃ)

শব্দের শেষে বিসর্গ (ঃ) থাকবে না যেমন- কার্যত, মূলত, প্রধানত, প্রয়াত, বস্তুত, ক্রমশ, প্রায়শ পদমধ্যস্থ বিসর্গ (ঃ) থাকবে তবে অভিধানসিদ্ধ হলে পদমধ্যস্থ বিসর্গ বর্জনীয় যেমন: দুস্থ, নিস্পৃহ

২.১৩.

-আনো প্রত্যয়ান্ত শব্দ

আনো প্রত্যয়ান্ত শব্দের শেষে ো-কার যুক্ত করা হবে যেমন- করানো, বলানো, খাওয়ানো, পাঠানো, নামানো, শোয়ানো

২.১৪.

বিদেশী শব্দ ও যুক্তবর্ণ

বাংলায় বিদেশী শব্দের বানানে যুক্তবর্ণকে বিশ্লিষ্ট করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যুক্তবর্ণের সুবিধা হচ্ছে তা উচ্চারণের দ্বিধা দূর করে তাই ব্যাপকভাবে বিদেশী শব্দের বানানে যুক্তবর্ণ বিশ্লিষ্ট করা অর্থাৎ ভেঙে দেওয়া উচিত নয় শব্দের আদিতে তো অনুরূপ বিশ্লেষ সম্ভবই নয় যেমন: স্টেশন, স্ট্রিট, স্প্রিং তবে কিছু কিছু বিশ্লেষ করা যায় সেপ্‌টেম্‌বর, অক্‌টোবর, মার্ক্‌স, শেক্‌সপিয়ার, ইস্‌রাফিল

২.১৫.

হস্-চিহ্ন

হস্-চিহ্ন যথাসম্ভব বর্জন করা হবে যেমন- কাত, মদ, চট, ফটফট, কলকল, ঝরঝর, তছনছ, জজ, টন, হুক, চেক, ডিশ, করলেন, বললেন, শখ, টাক, টক

তবে যদি ভুল উচ্চারণের আশঙ্কা থাকে তাহলে হস্-চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে৷ যেমন: উহ্, যাহ্, ওয়াক্‌ফ

যদি অর্থের বিভ্রান্তির আশঙ্কা থাকে তাহলেও তুচ্ছ অনুজ্ঞায় হস্-চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে যেমন: কর্, ধর্, মর্, বল্

২.১৬.

ঊর্ধ্ব-কমা

ঊর্ধ্ব-কমা যথাসম্ভব বর্জন করা হবে যেমন- করল (=করিল), ধরত, বলে (=বলিয়া), হয়ে, দু জন, চার শ, চাল (=চাউল), আল (=আইল)

 

          বিবিধ

৩.০১.

যুক্ত-ব্যঞ্জনবর্ণগুলো যতদূর সম্ভব স্বচ্ছ করতে হবে অর্থাৎ পুরাতন রূপ বাদ দিয়ে এগুলোর স্পষ্ট রূপ দিতে হবে সেজন্য কতকগুলো স্বরচিহ্নকে বর্ণের নিচে বসাতে হবে যেমন- (ইউনিকোড বাংলায় মাইক্রোসফটে দেখানো সম্ভব হলো না) তবে ক্ষ-এর পরিচিত যুক্তরূপ অপরিবর্তিত থাকবে

বানানরীতি

১৩

 

৩.০২.

সমাসবদ্ধ পদ

সমাসবদ্ধ পদগুলি একসঙ্গে লিখতে হবে, মাঝখানে ফাঁক রাখা চলবে না যেমন- সংবাদপত্র, অনাস্বাদিতপূর্ব, পূর্বপরিচিত, রবিবার, মঙ্গলবার, স্বভাবগতভাবে, লক্ষ্যভ্রষ্ট, বারবার, বিষাদমণ্ডিত, সমস্যাপূর্ণ, অদৃষ্টপূর্ব, দৃঢ়সঙ্কল্প, সংযতবাক, নেশাগ্রস্ত, পিতাপুত্র

বিশেষ প্রয়োজনে সমাসবদ্ধ পদটিকে একটি, কখনো একটির বেশি হাইফেন (-) দিয়ে যুক্ত করা যায় যেমন- মা-মেয়ে, মা-ছেলে, বেটা-বেটি, বাপ-বেটা, ভবিষ্যৎ-তহবিল, সর্ব-অঙ্গ, বে-সামরিক, স্থল-জল-আকাশ-যুদ্ধ, কিছু-না-কিছু

৩.০৩.

বিশেষণ পদ

বিশেষণ পদ সাধারণভাবে পরবর্তী পদের সঙ্গে যুক্ত হবে না যেমন- সুনীল আকাশ, স্তব্ধ মধ্যাহ্ন, সুগন্ধি ফুল, লাল গোলাপ, ভালো দিন, সুন্দরী মেয়ে কিন্তু যদি সমাসবদ্ধ পদ অন্য বিশেষ্য বা ক্রিয়াপদের গণ বর্ণনা করে তাহলে স্বভাবতই সেই যুক্তপদ একসঙ্গে লিখতে হবে যেমন- কতদূর যাবে, একজন অতিথি, তিনহাজার টাকা, বেশিরভাগ ছেলে, শ্যামলা-বরন মেয়ে তবে কোথাও কোথাও সংখ্যাবাচক শব্দ একসঙ্গে লেখা যাবে যেমন-দুজনা

৩.০৪.

নাই, নেই, না, নি, এই নঞর্থক অব্যয়পদগুলো শব্দের শেষে যুক্ত না হয়ে পৃথক থাকবে যেমন- বলে নাই, যাই নি, পাব না, তার মা নেই, আমার ভয় নাই

তবে শব্দের পূর্বে নঞর্থক উপসর্গরূপে না উত্তরপদের সঙ্গে যুক্ত থাকবে যেমন-নারাজ, নাবালক, নাহক

অর্থ পরিস্ফুট করার জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুভূত হলে না-এর পরে হাইফেন ব্যবহার করা যায় যেমন- না-বলা বাণী, না-শোনা কথা, না-গোণা পাখি

৩.০৫.

উদ্ধৃতি মূলে যেমন আছে ঠিক তেমনি লিখতে হবে কোনো পুরাতন রচনায় যদি বানান বর্তমান নিয়মের অনূরূপ না হয়, উক্ত রচনার বানানই যথাযথভাবে উদ্ধৃত করতে হবে যদি উদ্ধৃত রচনায় বানানের ভুল বা মুদ্রণের ত্রুটি থাকে, ভুলই উদ্ধৃত হবে তবে উদ্ধৃত অংশকে যদি ইনসেট করা হয় তাহলে ঊর্ধ্ব-কমার চিহ্ন ব্যবহার করতে হবে না তাছাড়া কবিতা যদি মূলচরণ-বিন্যাস অনুযায়ী উদ্ধৃত হয় এবং কবির নামের উল্লেখ থাকে সে-ক্ষেত্রেও উদ্ধৃত-চিহ্ন দেয়ার দরকার নেই ইনসেট না হলে গদ্যের উদ্ধৃতিতে প্রথমে ও শেষে উদ্ধৃতি-চিহ্ন দেয়া ছাড়াও প্রত্যেক অনুচ্ছেদের প্রারম্ভে উদ্ধৃতি-চিহ্ন দিতে হবে প্রথমে, মধ্যে বা শেষে উদ্ধৃত রচনায় কোনো অংশ যদি বাদ দেয়া হয় অর্থাৎ উদ্ধৃত করা না হয়, বাদ দেয়ার স্থানগুলোকে তিনটি বিন্দু বা ডট্ (অবলোপ-চিহ্ন) দ্বারা চিহ্নিত করতে হবে গোটা অনুচ্ছেদ, স্তবক বা একাধিক ছত্রের কোনো বৃহৎ অংশ বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে তিনটি তারকার দ্বারা একটা ছত্র রচনা করে ফাঁকগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে

কোনো পুরাতন রচনার অভিযোজিত বা সংক্ষেপিত পাঠে অবশ্য পুরাতন বানানকে বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী পরিবর্তিত করা যেতে পারে

৪.০১

ণত্ব-বিধি

অ-তৎসম শব্দের যুক্তাক্ষরের বানানের ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যগণ একমত হতে পারে নি একটি মতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দে যুক্তক্ষরে ণ্ট ণ্ঠ ণ্ড হবে যথা-ঘণ্টা, লণ্ঠন, গুণ্ডা অন্যমতে, বলা হয়েছে যে, এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ন্ট, ন্ঠ, ন্ড ব্যবহৃত হবে যথা-ঘন্টা, প্যান্ট, প্রেসিডেন্ট, লন্ঠন, পান্ডা, লন্ডভন্ড

 


পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি গৃহীত

বাংলা বানান বিধি

 

বাংলা বানান সংস্কারের জন্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে একটি মুদ্রিত সুপারিশ পত্র প্রকাশ করেছিল এই সুপরিশপত্রটি রচিত হয়েছিল এর কয়েক বছর আগের প্রকাশিত একটি সুপরিশপত্রকে ভিত্তি করে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসের এই সুপারিশপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার ঐ বৎসরে ১৬ ডিসেম্বর তারিখে একটি আলোচনা সভা করা হয়েছিল এবং এই সুত্রে বিভিন্ন সূত্র থেকে মতামত আকাদেমির দফতরে জমা পড়েছিল প্রকাশিত সুপরিশপত্র এবং বিভিন্ন মতামতের ভিত্তি করে একটি চূড়ান্ত সুপারিশপত্র প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের ২ তারিখে এর সংস্করণটির দ্বিতীয় মুদ্রণ হয় ঐ বৎসরের জুন মাসে এবং তৃতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয় ঐ বৎসরের ডিসেম্বর মাসে ২০০১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে এর একটি পরিমার্জিত সংস্করণ অর্থাৎ দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় এরপর এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ৩ জুলাই তারিখে আর চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের অগাস্ট মাসে এর পঞ্চম সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে।  নিচে পঞ্চম সংস্করণে প্রকাশিত বানানবিধি তুলে ধরা হলো

 

বাংলা লেখার রীতিতে অ-যুক্ত বর্ণের (ক গ র) বা যুক্তবর্ণের বা (   , র্ক, গ্র) বিন্যাসে একই বর্ণের একাধিক চেহারা প্রচলিত (যেমন গ গু, র রূ; ক্ +র=ক্র, ক্ +ত=ক্ত) ভাষাবিজ্ঞানে একে বলা হয় allograph, সমান্তরালভাবে, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে, বর্ণের ভিন্নরূপ বর্ণমালা-লিখনে বা ভাষা-শিক্ষায়, প্রয়োগগত সমতাবিধানের জন্য সেগুলিকে যথাসম্ভব একই চেহারায় নিয়ে আসার ভাবনাচিন্তা বিজ্ঞানসম্মতভাবে নানা দিকে শুরু হয়েছে আধুনিক মুদ্রণে যেহেতু আর পূর্ব-থেকে-প্রস্তুত-করা ঢালাই হরফে প্রয়োগ বা ব্যবহার অপরিহার্য নয়, তাই হরফের সমতাবিধান বর্তমানে সম্ভব ও সংগত কেবল সামান্য অভ্যাসেই তা চোখে মানানসই ও ব্যবহারে সন্তোষজনক হতে পারে

 

১ ব্যঞ্জনবর্ণে স্বরচিহ্ন যোগ

১.১ অ-কারেএ স্বতন্ত্র চিহ্ন নেই হসন্তহীন ব্যঞ্জন মাত্রই অ-স্বরবর্ণযুক্ত বর্ণ (ক চ ট =ক্ +অ  চ্+অ  ট্ +অ) আ-কার ই-কার এবং ঈ-কার (া, ি, ী)-এর ক্ষেত্রে বলা যায়, এগুলি যথাক্রমে আ, ই এবং ঈ এই তিনটি পূর্ণ স্বরবর্ণের বিকল্প রূপ যা ব্যঞ্জনবর্ণে যুক্ত হয় এই চিহ্ন তিনটির অন্য কোনো বিকল্প নেই ফলে এগুলির রূপ পরিবর্তনের প্রশ্ন ওঠে না

১.২ তবে মাঝে মাঝে কেউ কেউ মনে করেন, বা প্রস্তাব করেন যে, ই-কার (ি), এ-কার (ে) এবং ঐ-কার (ৈ) যেহেতু সংশ্লিষ্ট বর্ণের পরে উচ্চারিত হয়, অথচ লেখায় সেই বর্ণের আগে বসে (কি=ক+ই, কে=ক্+এ, কৈ=ক্+ঐ) তাই এই তিনটি স্বরচিহ্ন সংশ্লিষ্ট ব্যঞ্জনের পরে লিখতে হবে

ইংরেজির উচ্চারণানুগ বানানরীতি (=ba, be, bi, bo) বাংলা কেন, কোনো আধুনিক ভারতীয় ভাষার লিখনরীতিতেই নেই ধ্বনিবিজ্ঞানে যাকে পারস্পর্য (linearity) বলে, তা বাংলা লিখনরীতির মূল চরিত্র রূপে বা ঐতিহাসিক পরিণতি হিসেবে আসে নি তাছাড়া, অন্যান্য স্বরচিহ্ন-যোগের ক্ষেত্রেও উচ্চারণগত পরম্পরা প্রতিফলিত হয় না তাই ই-কার, এ-কার, ঐ-কারের বর্তমান অবস্থান পরিবর্তন করা সংগত হবে না

১.৩ ওই একই যুক্তিতে ও-কার (ো) এবং ঔ-কারের (ৌ) দ্বিধাবিভক্ত রূপের সরলীকরণ করে নাগরী হরফের মতো (-ao, -, aO) একমাত্রিক নতুন রূপদানও বাংলা লিখনরীতিতে সংগত হবে না

১.৪ ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে স্বরচিহ্নযোগে স্বরচিহ্নের যে সব রূপান্তর দেখা যায়, সেগুলি এই রকম :

হ্রস্ব উ-কারের তিনটি রূপ : প্রধান রূপ হলো নীচে (ু), যেমন-কু, চু, টু আর একটি পাওয়া যায় অতিনির্দিষ্ট রূপ : শুধু র আর র-ফলার ক্ষেত্রে ডান পাশে (  ) চিহ্ন, যেমন-রু, ত্রু, শ্রু তৃতীয়টি হলো দু-একটি যুক্ত ব্যঞ্জনের নীচে (  ) চিহ্ন, যেমন : স্তু (ন্ +ত্ +উ), স্তু (স্ +ত্ +উ) উদাহরণ : কিন্তু, জন্তু, বস্তু

 

কখনও দেখা যায়, উ-কারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যঞ্জনটিরও সাধারণ চেহারা বদলে যাচ্ছে, যেমন- গু, শু,    হু    

এই জাতী্য় অসংগতির একমাত্র প্রতিকার হল : বর্ণ ও স্বরচিহ্নযোগের স্বচ্ছতার প্রয়োজনে ওই অতিনির্দিষ্ট রূপগুলি বর্জন করা তার বদলে সর্বত্র একক ও যুক্ত ব্যঞ্জনের নিচে স্বরচিহ্নের প্রধান রূপটি যোগ করেই যুক্তচিহ্ন তৈরি করা যেমন- কু  গ  তু  র  শ  স হ ;  গ্র  ধ্র ন্ত ব্র শ্র  স্ত

 

১.৫ দীর্ঘ ঊ-কারের ক্ষেত্রেও একাধিক রূপ প্রচলিত প্রধান হল, ব্যঞ্জনবর্ণের নীচে (ূ) চিহ্ন (বূ মূ), আর অপ্রধান রূপটি হল র বা র-ফলাযুক্ত ব্যঞ্জনের পাশে হাতল (  ) চিহ্ন (রূ ভ্রূ) এই সূত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই একই চিহ্ন হ-এর গায়ে যুক্ত হলে তা ঋ-কারের চিহ্ন বোঝায় (হৃ)

সুতরাং সিদ্ধান্ত : সর্বত্র একক ও যুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণের নীচে পরিচিত ও প্রধান (ূ) চিহ্ন ব্যবহার করা হবে যেমন : ক ধ্র ভ্র শ্র র

১.৬ যোজ্য চিহ্ন হিসেবে ঋ-এর দুটি ভিন্ন রূপ আছে, (ৃ) আর হ-এর সঙ্গেই কেবল হাতল-চিহ্ন (  ), যার কথা আগেই ঊল্লেখ করা হয়েছে

সুতরাং সিদ্ধান্ত : সর্বত্রই ব্যঞ্জনবর্ণের নীচে পরিচিত ও প্রধান (ৃ) চিহ্ন হবে; যেমন : কৃ, গৃ, পৃ, 

 

১.৭ মান্য বাংলা উচ্চারণে অ্যা (Q) অন্যতম স্বতন্ত্র স্বরধ্বনি হলেও এর কোনো নিজস্ব বর্ণরূপ নেই বিশ্বভারতী-প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনায় আদ্য অ্যা উচ্চারণ বোঝাতে মাত্রাযুক্ত এ-চিহ্ন (ে) ব্যবহৃত হয়ে থাকে (খেলা, বেলা) কিন্তু তা অন্যত্র গৃহীত হয়নি আমাদের সিদ্ধান্ত : অজ্ঞাতমূল ও বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে শুধু অ্যা, আর অন্যত্র এ গোটা বর্ণ হিসেবে, এবং চিহ্ন হিসেবে যথাযোগ্য স্থানে,  , এ-কার (ে) চিহ্নই ব্যবহৃত হবে কোথায় কোন্‌টি ব্যবহৃত হবে পরবর্তী সূত্রে তা বিস্তারিত বলা হয়েছে

১.৮ বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে অ্যা ধ্বনি দিয়ে উচ্চারণ শুরু এমন শব্দের প্রথম বর্ণে সর্বত্রই অ্যা ব্যবহারযোগ্য (সাধারণভাবে অ্যা-বোঝাতে কোথাও এ্যা নয়, য়্যা নয়) যেমন :

অ্যাংলো, অ্যাকাউন্ট, অ্যাকাডেমি, (আকাদেমি ইংরেজি-ভিন্ন অন্য সূত্র থেকে গৃহীত একটি পৃথক শব্দ, তার বানানও ভিন্ন) অ্যাক্ট অ্যাক্টর অ্যাটাক অ্যাডভোকেট, অ্যাথলিট, অ্যানাটোমি অ্যান্টিসেপটিক অ্যান্ড অ্যান্ডরুজ অ্যাপ্লিকেশন অ্যাবসার্ড অ্যাব্রাহাম, অ্যাভিনিউ অ্যালকোহল অ্যালজেবরা অ্যালুমিনিয়াম অ্যাসপিরিন অ্যাসপ্যারাগাস অ্যাসবেস্টস ইত্যাদি

 

১.৯ ব্যঞ্জনপরবর্তী উচ্চারণে       অনুরূপক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য যেমন : ক্যাচ ক্যানভাস ক্যাপটন ক্যাবিনেট ক্যাম্প ক্যাসেট গ্র্যাজুয়েট গ্ল্যান্ড, চ্যানেল ট্যাক্স ট্যাক্সি ট্র্যাজেডি ড্যাম ড্যাম্প ড্যাশ ন্যান্সি প্যাক প্যান্ট প্র্যাকটিস ফ্যাক্ট ফ্যাক্টর ব্যাংক ব্যাক ব্যাগ ব্যাট ব্যাবিলন ব্যারন, ব্যালাড ব্যালান্স ব্র্যাকেট ব্র্যান্ডি, ব্ল্যাকবোর্ড, ভ্যান ম্যাট্রিকুলেশন  র্‌্যাকেট র্‌যামপোর্ট শ্যাডো স্যান্ডউইচ হ্যাট হ্যান্ড হ্যারিকেন হ্যালো ইত্যাদি

 

১.১০ বিদেশি শব্দ ছাড়া অন্য যে-সব অর্ধ-তৎসম তদ্ভব ও অজ্ঞাতমূল শব্দ অ্যা বা     দিয়ে লেখা যাবে তার সংক্ষিপ্ত তালিকা

অ্যাদ্দিন ক্যাবলা খ্যাংরা খ্যাঁক খ্যাঁকশিয়াল খ্যাঁচাখেঁচি খ্যাঁটি খ্যাঁদা খ্যাপা গ্যাঁজলা গ্যাঁট গ্যাঁড়া গ্যাঁড়াকল ঘ্যানঘ্যান ঘ্যানরঘ্যানর চ্যাং চ্যাংড়া চ্যালা চ্যালাকাঠ ছ্যাঁক ছ্যাঁচড়া ছ্যাঁচা জ্যাঠা জ্যালজেলে ট্যাংরা ট্যাঁক ট্যাটন ট্যারা ঠ্যাং ঠ্যাকনা ঠ্যাকা ঠ্যাকার ঠ্যাঙা ঠ্যাঙ্যানি ঠ্যাঁটা ঢ্যাঁড়স ঢ্যাঙা ত্যাঁদড় ত্যানা ত্যালাকুচো থ্যাঁতলা থ্যাঁতা থ্যাবড়া ধ্যাতানি ধ্যাবড়া ন্যাওটা ন্যাংচা ন্যাকড়া ন্যাকরা ন্যাকা ন্যাড়া ন্যাবা প্যাঁচ প্যাঁচা প্যাঁটরা প্যাঁদানি ফ্যাকাশে ফ্যাচাং ফ্যান ফ্যালনা ব্যাং ব্যাঙাচি ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমি ভ্যাপসা শ্যাওড়া শ্যাওলা স্যাঁতস্যাঁত স্যাঁতসেতে স্যাঙাত হ্যাংলা হ্যাঁচকা হ্যাদে ইত্যাদি

১.১১ বলা বাহুল্য, তৎসম শব্দে যেখানে  আছে সেখানে এই চিহ্ন যথারীতি বজায় থাকবে যেমন : খ্যাত ব্যাঘাত ব্যাপ্ত ব্যায়াম ব্যাস ব্যাসার্ধ ইত্যাদি

১.১২ কিন্তু উচ্চারণে অ্যা ধ্বনি থাকলেও নীচের শব্দগুলির ক্ষেত্রে এ বা এ-কার দেওয়াই সংগত হবে এই জাতীয় শব্দ তদ্ভব শব্দভাণ্ডারে আরও আছে যেমন :

একলা একা দেখা বেড়া বেলা ভেলা মেলা যেন যেমন হেন ইত্যাদি

১.১৩ অ্যা-উচ্চারণযুক্ত ক্রিয়াপদের ক্ষেত্রে এ-কার যুক্ত বানানই বিধেয়

খেলা গেছে গেল ঠেকা ঠেলা ঠেসাঠেসি দেখা ফেলা বেলা (লুচি ‘—’) বেড়ানো হেলানো হেলাফেলা ইত্যাদি

১.১৪ তবে সাহিত্যে গৃহীত ঔপভাষিক শব্দের বা সংলাপের ক্ষেত্রে উচ্চারণানুগ বলে এইসব ক্রিয়াবাচক বিশেষ্যের দৃষ্টান্তে -  লেখাই বাঞ্চনীয় যেমন-

ক্যারদানি ক্যালানো ঘ্যাঁতানো ঘ্যাঁসটানো জ্যাবড়ানো ঝ্যাঁটানো ধ্যাতানো ধ্যাবড়ানো প্যাঁদানো ভ্যাপসানো হ্যাদানো ইত্যাদি

 

২ অ-যুক্ত ও ব্যঞ্জনবর্ণ এবং ব্যঞ্জনচিহ্ন

 

২.১ ং/ঙ/ঙ্গ শব্দের মধ্যে এই তিনটি বর্ণ যেখানে উচ্চারণে একই প্রকার মনে হয় (বাংলা বাঙলা বাঙ্গলা), সেইসব ক্ষেত্রে কেউ কেউ এই তিনটির মধ্যে একটিকেই গ্রহণ করে বাকিগুলিকে বর্জন করতে চান কেউ কেউ অসতর্কভাবেও তাই করে থাকেন এসব ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট বিধি অনুসরণ বাঞ্ছনীয়

 

ঙ্‌গ, যা সাধারণত ঙ্গ বর্ণে লেখা ও ছাপা হয়ে এসেছে, সেটি প্রকৃতপক্ষে যুক্তবর্ণ (ঙ্ +গ) সুতরাং তার বিকল্পে কেবল ঙ্ অথবা ং হতে পারে না, যদি তাতে গ-এর উচ্চারণ থাকে যথা, দাঙ্‌গা (দাঙ্গা) শব্দে গ-এর উচ্চারণ আছে কিন্তু ভাঙ্‌গা/ভাঙ্গা রাঙ্‌গা/রাঙ্গা বানান সঠিক নয়, কারণ তাতে গ-এর উচ্চারণ নেই তাই সে দুটি হবে ভাঙা রাঙা

 

২.২ এই সূত্রে উল্লেখ্য যে, বাংলা বর্ণমালার নাসিক্য বর্ণের সঙ্গে সমবর্গীয় অন্যান্য বর্ণ যুক্ত হলে যুক্তবর্ণের যে রূপ হয়, তার কয়েকটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব আছে (যেমন ঙ্‌গ-ঙ্গ) সেই স্বচ্ছতা সহজেই আনা যায় এবং সহজেই অভ্যাসে সেগুলি ব্যবহার্য হয়ে উঠতে পারে তাই ঙ্গ চিহ্নটির বদলে এর স্বচ্ছ রূপ ঙ্‌গ ব্যবহৃত হবে অনুরূপভাবে, স্বচ্ছতা আনবার জন্য            ব্যবহৃত হওয়া বিধেয়    

 

সমবর্গীয় নাসিক্যব্যঞ্জনের সঙ্গে যুক্ত হলে এই বিধিতে যুক্তবর্ণের যে রূপ হবে তার পূর্ণ তালিকা :

                        ঙ্‌ক ঙ্‌খ ঙ্‌গ ঙ্‌গ      ‌            (ঙ্ + ক খ  গ  ঘ)

                        ঞ্‌চ  ঞ্‌ছ ঞ্‌জ ঞ্‌ঝ            (ঞ্ + চ ছ জ ঝ)

                        ণ্ট ণ্ঠ ণ্ড  ণ্ঢ ণ্ণ                     (ণ্ +ট ঠ ড ঢ ণ)

                        ন্ত ন্‌থ ন্দ ন্‌ধ ন্ন                  (ন্ +ত থ দ ধ ন)

                        ম্প ম্ফ ম্ব ম্ভ ম্ম                   (ম্ + প ফ ব ভ ম)

এই গুলির মধ্যে ঙ্গ (ঙ্‌গ), ঞ্চ (ঞ্‌চ), ঞ্জ (ঞ্‌জ), ণ্ড (ণ্‌ড), ন্থ (ন্‌থ), ন্‌ধ (ন্ধ) প্রভৃতির প্রচলিত যুক্তবর্ণে যে স্বচ্ছতার অভাব ছিল বর্ণমালার যৎসামান্য সংস্কার সেই স্বচ্ছতা আনা সম্ভব

২.৩ ত/ত্/ৎ তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে ত্-এর বিকল্পে ৎ বর্ণটি কয়েক ক্ষেত্রে অপরিহার্য যেমন : অকস্মাৎ এতৎ কুৎসিত চিৎকার ফুৎকার বিপৎসংকেত ভবিষ্যৎ যৎ সত্যাজিৎ হঠাৎ ইত্যাদি

২.৪ তবে অ-তৎসম অনেক শব্দের ক্ষেত্রে সমতাবিধানের প্রয়োজনে ৎ-উচ্চারণের জন্য শুধু ত-এরই ব্যবহার সংগত মনে হয় যেমন:  

আড়ত আদত ইজ্জত ইল্লত ওত (-পাতা) কতবেল কিতকিত করাত কাত কাতরানো কাতলা কানাত কেয়াবাত কৈফিয়ত ঘোঁতঘাত চিতপাত ছাত জরুরত জহরত তফাত তাত (<তপ্ত) ধাত (<ধাতু) নফরত নাতনি নাতবউ নিতবর নেহাত পাতলা পুরুত পেতনি ফইজত ফাতনা ফেরত ফোঁতফোঁত বজ্জাত বনাত বরাত বসত বাত বাতলানো মজুত মতলব মহরত মাত মাতলামো মৌত মৌতাত শরবত সহবত সাঁতরানো হজরত হাজত হাতড়ানো হুজ্জত ইত্যাদি

 

২.৫  কিছু কিছু ধ্বান্যাত্মক শব্দে ৎ-এর ব্যবহার স্বাভাবিক মনে হয় যেমন : কড়াৎ, ছলাৎ, ঝনাৎ, মড়াৎ, হড়াৎ ইত্যাদি

২.৬ বাংলা মুদ্রণের সূচনা থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত, বিশেষত গত অর্ধশতকে, মুদ্রণ ও হরফের পরিবর্তনের ফলে বাংলা যুক্তব্যঞ্জনের আকৃতিগত কিছু হেরফের ঘটে গেছে সাম্প্রতিককালে নানা মুদ্রণে সেই কারণে সমতার অভাবও দেখা যায় তাই বাংলা যুক্তব্যঞ্জনের চিহ্নগুলির আকৃতিগত পরিবর্তনের ও সমতাবিধানের সুবিধার্থে বিভিন্ন প্রস্তাব বিবেচনার পর কয়েকটি সুপারিশ গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়েছে ও সেইগুলি কার্যকর করা হয়েছে কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রথাগত রূপ বজায় রাখাই সমীচীন বেল স্থির হয়েছে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলি পরবর্তী ধারাগুলিতে লিখিত হল

২.৭ যুক্তব্যঞ্জন রূপটি স্বচ্ছ থাকলে অর্থাৎ তার ব্যঞ্জনগুলির চেহারা আলাদা-আলাদাভাবে স্পষ্ট চেনা গেলে শিক্ষার্থী তা সহজে শিখতে পারে, মুদ্রণের দিক থেকেও কাজের সুবিধা হয়

প্রচলিত বেশ কয়েকটি অস্বচ্ছ যুক্তবর্ণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ বা প্রায়স্বচ্ছ রূপান্তর গ্রহণীয় সেগুলি মোটামুটি নীচের মতো, যদিও এগুলি হয়তো চূড়ান্ত রূপ নয় লিপিরূপ-বিশেষজ্ঞরা এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত সুষম ও সুন্দর রূপ নির্মাণ করতে পারেন

                        যুক্ত ব্যঞ্জন                       প্রচলিত               গ্রহণীয়

                        ক্+ ত                            ক্ত                    

                        ক্‌+র                              ক্র                    

                        গ্ +ধ                             গ্ধ

                        ঙ্ +ক                             ঙ্ক

                        ঙ্ +গ                             ঙ্গ

                        ঞ্ +চ                            ঞ্চ

                        ঞ্ +ছ                            ঞ্ছ

                        ঞ্ +জ                           ঞ্জ

                        ঞ্ +ড                            ণ্ড

                        দ্ +ধ                             দ্ধ

                        ন্ +থ                             ন্থ

                        ব্ +ধ                             ব্ধ

                        ষ্ +ক                             ষ্ক

                        ষ্ +ট                             ষ্ট

                        ষ্ +ঠ                             ষ্ঠ

                        ষ্ +ণ                             ষ্ণ

                        য্ +প                             ষ্প

                        ষ্ +ম                             ষ্ম

                        স্ +থ                             স্থ

                        হ্ +ম                             হ্ম

২.৮ কয়েকটি ক্ষেত্রে যুক্তব্যঞ্জন-চিহ্নের প্রচলিত রূপ অস্বচ্ছ হলেও সেগুলি বজায় রাখা আপাতত অনিবার্য মনে হয় কেন-না সে-সব ক্ষেত্রে তাদের উচ্চারণ পৃথক ও পরম্পর (sequential) না-হয়ে অন্য একটি উচ্চারণ চলে এসেছে যেমন : জ্ +ঞ =জ্ঞ (গঁ-, গগঁ) জ্ঞান-এর উচ্চারণ জ্‌ঞান বা জ্‌‌নান নয়, সে-উচ্চারণ গ্যান; তেমনই বিজ্ঞান-এর উচ্চারণ বিগ্‌গ্যান এরকমভাবেই উচ্চারণ পালটে গেছে ক্ষ (ক্‌+ষ) চিহ্নটির, যা প্রতিবেশ অনুসারে কখনও শুধু খ, কখনও-বা ক্‌খ- যেমন : ক্ষত বিক্ষত তাই ক্ষ জ্ঞ-এর প্রচলিত রূপই থাকবে

 

২.৯ আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে যুক্তবর্ণের প্রচলিত অস্বচ্ছ বা প্রায়স্বচ্ছ রূপ পালটাতে গেলে অহেতুক জটিলতা বাড়বে মনে করে সেগুলির প্রচলিত রূপ বজায় রাখাই সমীচীন সেগুলি এই :

            ট্ট (ট্ +ট)   ত্ত (ত্ +ত)   ত্থ (ত্ +থ)  ত্র (ত্ +র)  ভ্র (ভ্ +র)  হ্ন (হ্ +ন)

২.১০ অ-তৎসম, বিশেষত বিদেশি ঋণশব্দের বানানে প্রয়োজন হতে পারে বলে এই যুক্তব্যঞ্জনবর্ণগুলিও গ্রাহ্য :

                        ক্ +ট =ক্ট

                        ন্ +ট =ন্ট

                        ন্ +ট =ন্ঠ

                        ন্ +ড =ন্ড

                        ন্ +ঢ =ন্ঢ

                        স্ +ট =স্ট

তবে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ণ্ট ও ন্ট,  ণ্ঠ ও ন্ঠ এবং ণ্ড ও ন্ড এর পার্থক্য চিনিয়ে দেওয়া জরুরি ণ-এর সঙ্গে যুক্ত ট ঠ ড ঢ কেবল তৎসম শব্দে রক্ষিত অ-তৎসম শব্দে ট-বর্গে মূর্ধন্য ণ যোগ বাধ্যতামূলক নয় কিন্তু মুদ্রণে প্রায়ই এ পার্থক্য রক্ষিত হয় না এ সম্বন্ধে সতর্কতা বাঞ্ছনীয়

২.১১ ভাষায় নতুন নতুন শব্দগ্রহণের ক্ষেত্রে নতুন যুক্তব্যঞ্জনের সম্ভাবনাও ক্রমবর্ধমান স্বচ্ছতা রক্ষা করে এই জাতীয় যুক্তব্যঞ্জন গঠিত হতে পারে যথা :

                        ল +ট =ল্ট

                        ল +ফ =ল্ফ

২.১২ এবং -এর উচ্চারণ যেখানে পৃথকভাবে যথাক্রমে ব্ এবং জ্ রূপে করা হয় সেখানে ব-ফলা এবং য-ফলার বদলে আলাদা ভেঙে লেখাই উচিত, নইলে উচ্চারণ-বিভ্রমের সম্ভাবনা থাকে তাই লিখতে হবে : উদ্‌বাস্তু উদ্‌বিগ্ন উদ্‌বেগ উদ্‌বেল উদ্‌বোধন উদ্‌যুক্ত উদ্বাস্তু উদ্বিগ্ন উদ্বেগ উদ্বেল উদ্বোধন উদ্যুক্ত ইত্যাদি নয়

২.১৩ উদ্যোগ যদি উদ্‌জোগ রূপে উচ্চারণ করা হয়, তবে উদ্‌যোগ আকারে লেখা হবে ব-ফলা য-ফলার আলাদা ব ও জ উচ্চারণ না থাকলে ব-ফলা য-ফলাই থাকবে, যেমন অদ্বৈত বিদ্বান উদ্যম উদ্যান ইত্যাদি

 

বানান-বিষয়ে সিদ্ধান্ত

৩. তৎসম শব্দে

৩.১ সংস্কৃত শব্দভাণ্ডারের অন্তর্গত যাবতীয় শব্দই বাংলা ভাষায় ঋণশব্দ বা তৎসম রূপে পরিচিত তবে বাংলায় তার ব্যবহার সংস্কৃত ব্যাকরণের সূত্রে এবং বাংলা ব্যাকরণের প্রচলিত রীতি বা সূত্রেও সম্পন্ন হয় সেক্ষেত্রে এই জাতীয় বাংলা শব্দ ও  তৎসম অভিন্নার্থক সংস্কৃত তৎসম শব্দ বলতে আদি বৈদিক যুগের শব্দ এবং পরবর্তী যুগের নির্মিত সংস্কৃত শব্দ উভয়কেই বোঝায়, এমনকি দেশি বা অজ্ঞাতমূল বাংলা শব্দের কৃত্রিম সংস্কৃতায়িত শব্দও তৎসম-রূপে পরিগণিত যেমন, প্রোথিত শব্দের মূল প্রোথ্ কল্পিত ধাতু, <পোঁতা শব্দের শব্দের পুননির্মাণ মাত্র

৩.২ সংস্কৃত ভাষার শব্দ যা ঋণশব্দ বা তৎসম রূপে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে তার বানান সংস্কৃত ব্যাকরণ সূত্রানুযায়ী পূর্বনির্ধারিত, সেগুলির ইচ্ছাকৃত পরিবর্তনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না কিন্তু সংস্কৃত ব্যাকরণেই বহু শব্দের বিকল্প বানান থাকায় বাংলা ভাষার ধ্বনি ও উচ্চারণরীতির কারণে তার একটিকে সর্বদা-ব্যবহার্যরূপে গ্রহণ করা যেতে পারে তাছাড়া বাংলা ব্যাকরণসম্মত প্রত্যয়-ব্যবহারে, সমাস-ব্যবহারে বা সন্ধি-সূত্রানুসারে কোনো কোনো বানান বাংলায় দীর্ঘকাল যাবৎ ঈষৎ স্বতন্ত্রতা লাভ করেছে সেগুলিকেও তৎসম শব্দানুরূপ মান্যতা দেওয়া যেতে পারে উল্লেখ্যযোগ্য যে, বাংলা আকাদেমি-প্রকাশিত সর্বশেষ সংস্করণ বানান অভিধানে তৎসম শব্দগুলি স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত করা হয়েছে এই সব বহু আলোচনা পর্যালোচনা ও বিবেচনার পর নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত পর্যায়ক্রমে সূত্রবদ্ধ করা হলো

 

৪. হ্রস্ব-দীর্ঘ স্বরচিহ্ন

৪.১ তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে যেখানে হ্রস্ব ই উ/ই-কার উ-কার এবং দীর্ঘ ঈ ঊ/ঈ-কার ঊ-কার দুটি রূপই প্রচলিত ও গৃহীত, সেখানে সাধারণভাবে হ্রস্ব বিকল্পটিকেই গ্রহণ করা পূর্বোক্ত কারণেই যুক্তসংগত তাই : অঙ্গুরি-অঙ্গুরী অন্তরিক্ষ-অন্তরীক্ষ উষা-ঊষা উর্ণনাভ-ঊর্ণনাভ কুটির কুটীর ইত্যাদি উদাহরণ-যুগ্মকের প্রথম বিকল্পটি বাংলা লেখা ও মুদ্রণে একমাত্ররূপে গৃহীত হতে পারে এইরকম একটি তালিকা নীচে দেওয়া হল :

অঙ্গুরি অঙ্গুলি অবনি আকুতি আবলি (=দীপাবলি) উষসী উষা ক্ষৌণি চিৎকার তুলিকা ত্রু টি দরি দ্রোণি ধমনি ধরণি ধূলি নাড়ি পঞ্জি পদবি পল্লি পাটি পুত্তলি পুরন্ধ্রি পেশি বেণি বেদি ভৃঙ্গি ভেরি রজনি শ্রেণি সরণি সারণি সুরভি সূচি ইত্যাদি বাংলা আকাদেমি প্রকাশিত সর্বশেষ সংস্করণ বানান অভিধানে এই জাতীয় শব্দ তারকাচিহ্নিত করা আছে

উল্লেখ্য, হ্রস্ব বিকল্প না-থাকলে তালিকা-বহির্ভূত তৎসম শব্দের বানানে দীর্ঘ স্বরচিহ্নই লিখতে হবে

 

৪.২ সংস্কৃত ইন্ প্রত্যয়ন্ত শব্দ

সংস্কৃত ইন্-প্রত্যয়ান্ত শব্দগুলি (অধিকারিন্ অধিবাসিন্ অভিমুখিন্ আততায়িন্ একাকিন্ কৃতিন্ গুণিন্ জ্ঞানিন্ তন্ত্রিন্ দ্বেষিন্ ধনিন্ পক্ষিন্  বিদ্রোহিন্ মন্ত্রিন্ রোগিন্ শশিন্ সহযোগিন্ ইত্যাদি) কর্তৃকারকের একবচনে দীর্ঘ ঈ-কারান্ত হয় এবং এই দীর্ঘ ঈ-কারান্ত রূপেই এগুলি বাংলা শব্দে পরিণত-অধিকারী অধিবাসী অভিমুখী আততায়ী একাকী কৃতী গুণী জ্ঞানী তন্ত্রী দ্বেষী ধনী পক্ষী বিদ্রোহী মন্ত্রী রোগী শশী সহযোগী ইত্যাদি সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মে সমাসবদ্ধ কিংবা সংস্কৃত-প্রত্যয়যুক্ত হলে এইসব শব্দের দীর্ঘ ঈ-কার আবার হ্রস্ব ই-কারে ফিরে যায় যেমন : গুণিজন পক্ষিকুল মন্ত্রিসভা শশিভূষণ, বা একাকিত্ব কৃতিত্ব সহযোগিতা ইত্যাদি কিন্তু বাংলা বানান-ব্যবহারে এই নিয়মেরও প্রচুর ব্যতিক্রম দেখা যায় যেমন : আগামীকাল আততায়ীদ্বয় ধনীসমাজ পরবর্তীকাল প্রাণীবিদ্যা যন্ত্রীদল হস্তীদল ইত্যাদি

এই জাতীয় অসামাঞ্জস্য দূর করা প্রায় অসম্ভব তবু বাংলা বানানে অনুরূপ শব্দে সমতাবিধানের জন্য বিধিসম্মত সিদ্ধান্ত হল :

 

সমাসবদ্ধ শব্দের ক্ষেত্রে সংস্কৃত মূল শব্দটিকে দীর্ঘ ঈ-কারান্ত বাংলা শব্দ ধরে নেওয়া হোক অর্থাৎ, সমাস হলেও তার দীর্ঘ ঈ-কারের ব্যত্যয় না ঘটানো তাই অনুগামীবৃন্দ আগামীকাল পরবর্তীকাল মন্ত্রীগণ মন্ত্রীসভা শশীভূষণ যশস্বীগণ ইত্যাদি রূপই গ্রহণযোগ্য হবে

তৎসম ত্ব ও তা প্রত্যয় যোগ করা হলে এইসব শব্দের হ্রস্ব ই-কারান্ত (অর্থাৎ ইন্ ও বিন্-এর ন্ লোপের পর যা থাকে) মূল প্রাতিপদিক রূপেই লিখা হবে যেমন, তেজস্বিতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রতিযোগিতা মন্ত্রিত্ব মেধাবিত্ব সহমর্মিতা স্থায়িত্ব ইত্যাদি এর উদ্দেশ্য, সংস্কৃত ব্যাকরণের সূত্রে ভিন্নতা ঘটানো নয়- বাংলা শব্দ রূপে অজস্র তৎসম শব্দকে স্বীকৃতি দেওয়া, অথচ সংস্কৃত ব্যাকরণসূত্রকেও মান্যতা দেওয়া

একই কারণে লিঙ্গান্তরের ক্ষেত্রেও (-ইন +ঈ>) নী-যোগের আগে ইন্-প্রত্যয়ান্ত শব্দে এই নিয়ম পালিত হবে, যেমন : তেজস্বিনী প্রতিদ্বন্দ্বিনী প্রতিযোগিনী

অবশ্য অ-তৎসম প্রত্যয় যুক্ত হলেও উপরের মন্ত্রীগণ-সংক্রান্ত বিধি প্রযোজ্য হবে যেমন, মন্ত্রীগিরি

তবে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মের অভ্যাসবশত মন্ত্রিসভা শশিভূষণ ইত্যাদি লেখা চলতে পারে সেক্ষেত্রে সমাসবদ্ধ সম্পূর্ণ শব্দটি তৎসমরূপে গণ্য

৪.৩ কোনো কোনো তৎসম শব্দে বাংলা প্রত্যয় ই লাগিয়ে বিশেষণ করা যায় যেমন : আগমনি উত্তরপ্রদেশি উদয়পুরি কৃত্তিবাসি জনকপুরি জনসংঘি তৃণমূলি দক্ষিণি দেশি পশ্চিমি প্রণামি প্রসাদি (-ফুল) বয়সি বিদেশি বিহারি মণিপুরি রামপ্রসাদি স্বদেশি হিন্দুস্থানি ইত্যাদি (পণ্ডিত থেকে বিশেষ্য পণ্ডিতি-তেও হ্রস্ব ই-কার প্রযোজ্য) এই প্রত্যয় অর্থ বা প্রয়োগের দিক থেকে সংস্কৃত ইন্ বা বিন্ প্রত্যয়ের সমতুল্য নয় তাই এ ধরনের নানা শব্দে দীর্ঘ ঈ-কার দেবার প্রয়োজন নেই বিশেষ্য রূপে প্রযুক্ত হলে এই জাতীয় শব্দে লিঙ্গান্তরের ক্ষেত্রে বাংলা নি প্রত্যয় ব্যবহৃত হতে পারে যেমন : বয়সিনি বিদেশিনি

৪.৪ পূর্বে ছিল না পরে হয়েছে এই অর্থে সংস্কৃত নিয়মে অভূত তদ্‌ভাবে চ্বি প্রত্যয় যোগ করলে প্রত্যয়-পূর্ব শব্দের সঙ্গে ঈ-কার যুক্ত হয় যেমন : সমীকরণ বশীকরণ ইত্যাদি এবং পূর্বপদে হ্রস্ব উ থাকলে দীর্ঘ ঊ হয় : যথা লঘূকরণ

বর্তমানে  প্রচলিত বাংলা লেখায় এই নিয়ম সর্বত্র ও সর্বদা অনুসৃত হয় না

বর্তমানে প্রচলিত বাংলা লেখায় এই নিয়ম সর্বত্র ও সর্বদা অনুসৃত হয় না সুতরাং এই-ধরনের নতুন শব্দ তৈরির ক্ষেত্রে পদ্ধতি হবে : মূল শব্দ +করণ ভবন  এসব ক্ষেত্রে প্রথম পদের শেষ স্বর অপরিবর্তিত থাকবে উদাহরণ : অন্ধকরণ আর্দ্রভবন (hydration) চারুকরণ (beautification) নগদকরণ (encashment) বন্ধ্যাকরণ বহুকরণ (multiplication) বিরাষ্ট্রীয়করণ মেরুকরণ (polarisation) রাষ্ট্রায়ত্তকরণ রাষ্ট্রীয়করণ শদ্ধকরণ ইত্যাদি সেইকরণও গ্রাহ্য হবে

 

৫ বিসর্গ (ঃ) চিহ্নের রক্ষা/বর্জন

৫.১ বিসর্গান্ত বাংলা তৎসম শব্দের অন্ত্যবিসর্গ প্রায়শই উচ্চারিত হয় না বলে দীর্ঘকাল ধরে বাংলা লেখায় মুদ্রিত শব্দেও অন্ত্যবিসর্গের প্রায়শই উচ্চারিত হয় না বলে দীর্ঘকাল ধরে বাংলা লেখায় মুদ্রিত শব্দেও অন্ত্যবিসর্গের প্রয়োগ প্রায় দেখাই যায় না সংস্কৃত তস্ বা শস্ প্রত্যয়ান্ত শব্দগুলিতে অন্ত্যবিসর্গের প্রয়োগ তাই কালক্রমে বর্জিত হতে বসেছে সেই কারণে সেই জাতীয় শব্দে বর্তমানে অন্ত্যবিসর্গের প্রয়োগ সম্পূর্ণ বর্জিত হতে পারে যেমন, অন্ততঃ উভয়তঃ ক্রমশঃ প্রথমতঃ প্রায়শঃ ফলতঃ বস্তুতঃ বহুশঃ সর্বতঃ শব্দগুলি বিসর্গহীন রূপে যথাক্রমে অন্তত উভয়ত ক্রমশ প্রথমত প্রায়শ ফলত বস্তুত বহুশ সর্বত লেখা বিধেয় এই একই সূত্রানুসারে বিসর্গান্ত দুটি শব্দের বিসর্গসন্ধির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পদটির অন্ত্যবিসর্গ বর্জিত হবে

                        অহঃ +অহঃ          >          অহরহ (অহরহঃ নয়)

                        ইতঃ +ততঃ          >          ইতস্তত (ইতস্ততঃ নয়)

                        পুনঃ +পুনঃ          >          পুনঃপুন (পুনঃপুনঃ নয়)

                        মুহঃ +মুহঃ           >          মুহুর্মুহ (মুহুর্মুহুঃ নয়)

তবে বিসর্গসন্ধির প্রথম শব্দের অন্ত্যবিসর্গ যেখানে সংস্কৃত সন্ধিসূত্রে অবিকৃত থাকে, বাংলায় তা যথাযথ রক্ষিত হবে যথা

                        অতঃ      +পর >   অতঃপর

                        অধঃ       +পাত>  অধঃপাত

                        অন্তঃ      +করণ>  অন্তঃকরণ

                        তপঃ      +ক্লিষ্ট>   তপঃক্লিষ্ট

                        তেজঃ     +পুঞ্জ>   তেজঃপুঞ্জ

                        বয়ঃ       +সন্ধি>   বয়ঃসন্ধি

                        মনঃ       +কষ্ট>    মনঃকষ্ট

                        মনঃ       +পূত>   মনঃপূত

                        যশঃ       +প্রার্থী>  যশঃপ্রার্থী

                        শিরঃ      +পীড়া>  শিরঃপীড়া

 

৫.২ মনমোহন এই বানান কোনো কোনো নামে, বিশেষত অবাঙালি নামে দেখা গেলেও, বাংলা বিশেষণ ও নামশব্দ হিসেবে তৎসম মনোমোহন-ই গ্রহণীয় তবে মন শব্দটিকে বাংলা শব্দ ধরে তাকে পূর্বপদ হিসেবে রেখে সমাস করলে ও-কার যোগ হবে না যেমন, মনপছন্দ মনপবন মনভোমরা মনমাঝি মনমেজাজ ইত্যাদি ক্বচিৎ সন্ধির ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য যেমন, মনান্তর

৫.৩ ছন্দ শব্দটিকে অনুরূপ বাংলা শব্দ ধরে নিয়ে সমাসের পূর্বপদে বিসর্গসন্ধিজাত ও-কার বর্জনীয় হতে পারে যেমন, ছন্দগুরু ছন্দবিজ্ঞান ছন্দমুক্তি ছন্দলিপি ছন্দস্পন্দ

অনুরূপভাবে চক্ষু শব্দটিকে বাংলা শব্দ ধরে নিয়ে সমাসে সংস্কৃত ব্যাকরণসিদ্ধ চক্ষুরোগ-এর বদলে চক্ষুরোগ বানান বিধেয় তবে বহুপ্রচলিত ঐকিক শব্দ হিসাবে চক্ষুষ্মান বানান পরিবর্তনের প্রশ্ন ওঠে না অনুরূপভাবে, জ্যোতির্ময় জ্যোতিষ্মান ইত্যাদি

 ৫.৪ দুঃস্থ নিঃস্তব্ধ নিঃস্পৃহ বয়ঃস্থ মনঃস্থ ইত্যাদি শব্দের সংস্কৃত ব্যাকরণসম্মত বিকল্প প্রচলিত আছে : দুস্থ নিস্তব্ধ নিস্পৃহ বয়স্থ মনস্থ বিসর্গহীন এই বিকল্প রূপগুলিই সর্বদা ব্যবহার্য হবে এখানে অবশ্য স্মরণীয় যে, অন্তঃস্থ আর অন্তস্থ দুটি ভিন্নার্থক শব্দ, প্রথমটির অর্থ ভিতরকার (অন্তঃ +স্থ) এবং দ্বিতীয়টির অর্থ শেষের (অন্ত +স্থ) তাই ভিতরকার অর্থে অন্তঃস্থ শব্দটির বিসর্গ রক্ষিত হবে

 

সূত্র: