ঁ (চনি)

বাংলা বর্ণমালার একটি পরাশ্রয়ী বর্ণ। এই বর্ণটি স্বাধীনভাবে কোনো বাংলা শব্দে ব্যবহৃত হয় না। অন্য বর্ণের আশ্রয়ে এই বর্ণটি উপস্থাপিত হয়, তাই একে পরাশ্রয়ী বর্ণ বলা হয়।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ চন্দ্রবিন্দু-কে অনুনাসিক বর্ণ বলা হয়েছে। পাণিনি তাঁর অষ্ট্যাধ্যায়ী ব্যাকরণের অষ্টধ্যায়ের চতুর্থ পাদের ৫৮-৫৯ সূক্তে চন্দ্রবিন্দুকে সানুনাসিক হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এই সূক্তদ্বয়ে দেখানো হয়েছে কি প্রক্রিয়া 'ং' চন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, সংস্কৃত মতে অনুস্বার (ং) একমাত্রা বিশিষ্ট। এই ধ্বনি অর্ধ-মাত্রায় রূপ নিলে তা চন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। পাণিনি উদাহরণ হিসাবে দেখিয়েছেন কিংযুক্তম্>কিঁয্যুক্তম্, সংযন্তা>সঁয্যন্তা, সংবৎসরঃ>সঁব্বৎসরঃ ইত্যাদি।

চন্দ্রবিন্দু যতটা অন্য বর্ণের সহযোগী, তার চেয়ে বেশি বোঝা। কিন্তু এ বোঝা অত্যন্ত মধুর। কারণ, সানুনাসিক ধ্বনি কোনো ভাষার সমগ্র ধ্বনিরূপকে স্নিগ্ধ করে দেয়। বাংলা ও ফরাসি ভাষা শ্রবণে মধুর, তার অন্যতম কারণ হলো, উভয় ভাষাতেই সানুনাসিক ধ্বনি প্রচুর ব্যবহৃত হয়।

চন্দ্রবিন্দু ব্যঞ্জনধ্বনি। কারণ এই ধ্বনি অপর কোনো স্বরধ্বনি ছাড়া উচ্চারিত হয় না। মূলত স্বরবর্ণের সাথে নাসিক্য ধ্বনি যুক্ত করার সময়, আল্‌জিহ্বা ও কোমল তালু জিহ্বামূলে পুরোপুরি নামিয়ে আনা হয় না। এর ফলে, স্বরবর্ণ নাসিক্য না হয়ে সানুনাসিক স্বরধ্বনি (Nasalized vowel)-তে পরিণত হয়। এর ফলে সানুনাসিক ধ্বনি নাক এবং মুখ উভয় দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়। উল্লেখ্য, যে ধ্বনি শুধু নাক দিয়ে প্রবাহিত হয়, তাকে বলা হয় নাসিক্য (Nasal)। এই জাতীয় ব্যঞ্জনধ্বনিগুলো হলো- ঙ, ঞ, ন, ণ, ম, ং। এই ধ্বনিগুলো উচ্চারণকালে যখন রুদ্ধ হয়ে যায়, তখন তার নাসিক্য রূপ পাওয়া যায়। যেমন রঙ বা রং, নঞ্ (নঙ্), আম (আম্),  বোন (বোন্)। কিন্তু এই ধ্বনির সাথে যখনই চন্দ্রবিন্দু যুক্ত হয়, তখন  নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি সানুনাসিক ব্যঞ্জনধ্বনিতে পরিণত হয়। যেমন- ম্ নাসিক্য ধ্বনি। এর সাথে আ, ই, উ ইত্যাদি স্বরধ্বনি যুক্ত করলে, ওই ধ্বনিটি স্বরধ্বনির সাথে নাক এবং মুখ উভয় দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে ম্ ধ্বনিটি ম, মা, মি, মু ইত্যাদি রূপে প্রকাশের সময় সানুনাসিক হয়ে যায়। নাসিক্য ধ্বনি সানুনিসিক হলে, তার সাথে চন্দ্রবিন্দু বসে না। কিন্তু অন্য ব্যঞ্জনধ্বনি সানুনাসিক হলে, তার সাথে চন্দ্রবিন্দু বসে এবং ওই চন্দ্রবিন্দু স্বরধ্বনি বহন করে। যেমন

ক্ +আ=কা [স্বাভাবিক ধ্বনি প্রকৃতি]
কা ধ্বনিকে যদি সানুনাসিক হয়, তা হলে তা হবে-
        ক্ +আঁ [আ...>আঁ অথবা যুগপৎ উচারণে হবে আঁ]। সেক্ষেত্রে এর বিন্যাস হবে
                  ক্‌ +আঁ (ঁ +আ )=কাঁ

যদি চন্দ্রবিন্দুকে আমরা ব্যঞ্জনধ্বনি বলি, তা  হলে প্রতিটি সানুনাসিক স্বরধ্বনিকেই সানুনাসিক ব্যঞ্জনধ্বনি হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ

                      ক্ +অ=ক                  ক্ +আ=কা
                      ঁ্ +অ=অঁ               ঁ্ +আ=আঁ

চন্দ্রবিন্দু ব্যঞ্জনধ্বনির যুক্ত হয় স্বরধ্বনিকে সাথে নিয়ে। তাই এই ধ্বনিটি কোনো ব্যাঞ্জন ধ্বনির সাথে যুক্তরূপ দান করে না। যেমন 'ক +ক' মিলিত হয়ে ক্ক তৈরি করে, তেমন করে চন্দ্রবিন্দু যুক্ত ধ্বনি তৈরি করে না। কিন্তু চন্দ্রবিন্দু ভিন্নরকম বিধিতে ভিন্নরূপে প্রকাশিত হয়। এক্ষেত্রে চন্দ্রবিন্দু যে স্বরধ্বিনর আশ্রয়ে থাকে, তাকে আগে ব্যাঞ্জনধ্বনির সাথে যুক্ত করে দেয়, তারপর নিজে উচ্চারিত হয়।

            ক্‌ +আঁ (ঁ +আ )=ক্ +আ+ঁ।

বানানরীতিতে চন্দ্রবিন্দু
নাসিক্য ধ্বনির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ধ্বনিলিপিতে (IPA=International Phonetic Alphabet) কোনো পৃথক চিহ্ন নেই। তবে সানুনাসিক ধ্বনির ক্ষেত্রে আছে। এর চিহ্ন হলো  ̃। এর আন্তর্জাতিক লিপি সঙ্কেত 0303এই চিহ্নটির মূল আশ্রয়স্থান স্বরবর্ণ। তাই আন্তর্জাতিক ধ্বনিলিপিতে এই চিহ্ন স্বরধ্বনির উপর বসে। যেমন- অ ধ্বনির চিহ্ন ɔ̃ ɔ । কিন্তু অ ধ্বনিটি সানুনাসিক হলে, এর চিহ্ন হবে অঁ =ɔ̃ । এই বিচারে বাংলা উচ্চারণরীতি অনুসারে স্বরবর্ণের সানুনাসিক ধ্বনির চিহ্নগুলো হবে-
              অঁ =ɔ̃
ɔ̃      আঁ =           ইঁ =     উঁ =    
             এঁ =
      অ্যাঁ/এ্যাঁ=æ̃     ওঁ =

যদিও বাংলা বর্ণমালায়, ফন্টের নকশা অনুসারে কখনো কখনো মনে হয়, চন্দ্রবিন্দু ব্যঞ্জনবর্ণের উপরে বসেছে। চোখের দেখায় তা যেখানেই মনে হোক না কেন, এর অবস্থান ব্যঞ্জনবর্ণের সহগ-স্বরধ্বনির উপরেই। দেখে মনে হয়, কারচিহ্ন ব্যতীত ব্যঞ্জনবর্ণে চন্দ্রবিন্দু বর্ণের উপরই বসে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা বসে ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে (উচ্চারণের বিচারে) লুকিয়ে থাকা অ ধ্বনিটির উপর। নিচে 'ক' ধ্বনির বিচারে চন্দ্রবিন্দুর অবস্থান দেখানো হলো।

বাংলা IPA
কঁ =ক্ +অঁ kɔ̃
কাঁ=ক্ +আঁ kã
কিঁ=ক্ +ইঁ k 
কুঁ=ক্ +উঁ kũ
কেঁ=ক্ +এঁ kẽ
ক্যাঁ=ক্ +এ্যাঁ kæ̃
কোঁ =ক্ +ওঁ kõ

যৌগিক স্বরধ্বনিতে চন্দ্রবিন্দু শুরু হয় আদ্য স্বরধ্বনি থেকে এবং আদ্য স্বরধ্বনির সানুনাসিকভাব পরবর্তী স্বরধ্বনিতে সঞ্চালিত হয়। এক্ষেত্রে প্রথম স্বরধ্বনির উপর চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করলে, দ্বিতীয় স্বরধ্বনিতে আর সানুনাসিক চিহ্ন বসানো হয় না। তবে উভয় ধ্বনির উপর সানুনাসিক চিহ্ন বসালেও দোষের হবে না।

বাংলা IPA
কৈঁ =ক্ +ওঁই  kõi/kõ 
কৌঁ=ক্ +ওঁউ kõu/kõũ

কিন্তু যদি পাশাপাশি দুটি স্বরধ্বনি থাকার পরও তা যৌগিক স্বরধ্বনি সৃষ্টি না করে, তা হলে আদ্য সানুনাসিক ধ্বনিচিহ্ন পরবর্তী স্বরধ্বনিতে সঞ্চালিত হয় না। বর্ণ দ্বারা ওই স্বরধ্বনিগুলো প্রকাশের সময়, দ্বিতীয় স্বরধ্বনি সানুনাসিক না হলে, তা স্বাভাবিক চিহ্ন অনুসারেই উপস্থাপিত হবে। যেমন-

বাংলা IPA
ওঁ-উচ্চারণ  -uccaron 

বাংলা বানান রীতিতে চন্দ্রবিন্দু ঠিক কোথায় ব্যবহৃত হবে, এ নিয়ে একটা সময় সংশয় ছিল। কারণ, পুরানো বই পত্রে দেখা গেছে, এই চিহ্নটি ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট বিধি অনুসৃত হয় নাই। ৯০ দশকের দিকে কম্পিউটারে যখন বাংলা ফন্ট উপস্থাপনের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান গবেষণা শুরু করে, তখন প্রথিতযশা কোন ভাষাতাত্ত্বিকদের ছাড়াই তাঁরা এর নিষ্পত্তি করে ফেলেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁরা একেবারেই যে তাঁদের স্মরণাপন্ন হন নি, তা নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে ভাষাতাত্ত্বিকরা অনেক সময়ই একমত হতে পারেন নি। শেষ পর্যন্ত বাংলা ফন্ট নির্মাতারা যাবতীয় বাংলা বর্ণবিন্যাসের প্রক্রিয়াটির ক্রমোন্নয়ন করেছিলেন সহজাত অনুভব থেকে এবং এখনো অনেকে এই কাজটি করে চলেছেন। এঁদের মাধ্যমে চন্দ্রবিন্দু কোথায় উপস্থাপিত হবে তা একরকম নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। পরবর্তী সময়ে ইউনিকোডে-এর মাধ্যমে তা একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। এই বিধিটি হলো

  ১. কারবিহীন ব্যঞ্জনধ্বনির উপরে চন্দ্রবিন্দু থাকবে। যেমন কঁ।
২. যে সকল ব্যঞ্জনবর্ণের ডানদিকে কার চিহ্ন থাকে, সে সকল ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে যুক্ত কার-চিহ্নের উপর চন্দ্রবিন্দু বসবে। যেমন
কাঁ, কীঁ।
৩. যে সকল বর্ণের কার-চিহ্ন ব্যঞ্জনবর্ণের আগে বা নিচে থাকবে, সে ক্ষেত্রে চন্দ্রবিন্দু ব্যঞ্জনবর্ণের উপরে বসবে। যেমন
কিঁ, কুঁ, কূঁ, কেঁ, কৈঁ।
৪. যে সকল কারধ্বনি ব্যঞ্জনবর্ণের উভয় দিকে বসে, সে সকল ব্যঞ্জনবর্ণের ডানদিকের কার-চিহ্নের উপরে চন্দ্রবিন্দু বসবে। যেমন
কোঁ, কৌঁ।

সূত্র :
পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী। শ্রীদেবেন্দ্র কুমার বিদ্যারত্ন সম্পাদিত। বলরাম প্রকাশনী। মহালয়া, ২০০৩।
বঙ্গীয় শব্দকোষ। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্য অকাদেমি। পঞ্চম মুদ্রণ ২০০১।
http://www.langsci.ucl.ac.uk/ipa/diacritics.html


ঁ (চন্দ্রবিন্দু) : হিন্দু মত

১. হিন্দু তন্ত্রমতে চন্দ্রবিন্দুকে বিন্দুরূপার প্রতিরূপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই কারণে শক্তিবিগ্রহের পূর্বে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করা হয়। যেমন-  শ্রীশ্রী শারদীয়া পূজা।
২. হিন্দু মৃত ব্যক্তির নামের আগে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করা হয়। মৃতব্যক্তি স্বর্গগত হয়েছে বা ঈশ্বরপ্রাপ্ত হয়েছে এই বিচারে এই ঈশ্বরের প্রতীক হিসাবে চন্দ্র ব্যবহৃত হয়। যেমন - কৃষ্ণধন মুখোপাধ্যায় (মৃত কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়)।