বাগ্‌ধ্বনি
phone

মানুষের বাগ্‌যন্ত্রজাত ক্ষুদ্রতম ধ্বনি একক হলো বাগ্‌ধ্বনি । মানুষ তার বাগ্‌যন্ত্রকে ব্যবহার করে- যত ধরণের শব্দ তৈরি করতে পারে, একটি ভাষায় তার সবগুলোর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না। একটি ভাষায় যে সকল বাগ্‌ধ্বনি ব্যবহার করা হয়, তার সবই ওই ভাষার বাগ্‌ধ্বনি। প্রতিটি ভাষার মানুষ শৈশব থেকে অনুশীলনের মাধ্যমে ওই ভাষার বাগ্‌ধ্বনিগুলো আয়ত্ত করে। বড় হতে হতে, এই বাগ্‌ধ্বনিগুলো তাদের সহজাত ধ্বনি উচ্চারণ কৌশলের অন্তর্গত হয়ে যায়। এই কারণে একটি ভাষার মানুষ তার নিজের ভাষার কোনো বাগ্‌ধ্বনি যত সহজে উচ্চারণ করে, অন্য ভাষার মানুষের জন্য তা অত্যন্ত কঠিন মনে হয়ে থাকে। বাগ্‌ধ্বনি আয়ত্ত করার পিছনে রয়েছে মানুষের শ্রবণ ক্ষমতা। মানুষ যে ধ্বনি নিজে শুনতে পায় না, বা শনাক্ত করতে পারে না, তা বাগ্‌যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারণও করতে পারে না।

 

বাগ্‌‌ধ্বনিগুলো পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে, যৌগিক বাগ্‌ধ্বনি তৈরি করে। তবে কিছু বিশেষ রীতিতে বাগ্‌ধ্বনিগুলো-

প্রতিটি ভাষার কিছু মূল বাগ্‌ধ্বনি থাকে। এই সকল একটি ভাষায় মূলত কিছু নির্বাচিত স্বন ব্যবহৃত হয়। এই স্বনগুলোর ভিতর কিছু স্বনের উচ্চারণে একটু হেরফের দেখা যায়। যেমন
শ-এর উচ্চারণ দুই ভাবে হয়। যেমন শীত-এর শ এবং শ্রাবণ-এর শ-এর উচ্চারণ এক নয়। মূলত এখানে শীত-এর শ-ধ্বনিটি মূল ধ্বনি। আর শ্রাবণ-এর শ-এর উচ্চারণ হলো বিচ্যুতধ্বনি। মূল ধ্বনি এবং বিচ্যুত ধ্বনির বিচারে, বাগ্‌ধ্বনিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগ দুটি হলো স্বনিম (phoneme) এবং পূরকধ্বনি বা উপধ্বনি (allophone)

 

প্রতিটি ভাষার নিজস্ব বাগ্‌ধ্বনিসমূহ মিলিত একাধিক মিশ্র বাগ্‌ধ্বনি তৈরি করে। এক্ষেত্রে প্রতিটি ভাষার বাগ্‌ধ্বনিগুলো নিজস্ব রীতিতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাতে ঙ্ ধ্বনি মিশ্র বাগ্‌ধ্বনির আগে বসে না। এরূপ আছে ত্ বা ৎ। বাংলা শব্দের শুরুতে বসে না। জাপানি 津波 (ৎসুনামি, পোতাশ্রয়ের ঢেউ) সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের একটি প্রকরণ। বাংলাতে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয় 'সুনামি' হিসেবে। সাধারণভাবে যে সকল বাগ্‌ধ্বনি বাংলাতে ব্যবহৃত হয় না। বিদেশী শব্দের উচ্চারণের সময়, তা ব্যবহৃত হতে পারে।

একাধিক বাগ্‌ধ্বনি মিলিত হয়ে যখন একটি অর্থপূর্ণ ক্ষুদ্রতম ধ্বনি একক সৃষ্টি করে, তখন তাকে রূপমূল
(morpheme) বলা হয়। আর রূপমূল থেকে কিভাবে বাক্যে ব্যবহৃত শব্দ ব্যবহৃত হয়, শব্দ বা ক্রিয়ামূলের সাথে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে কিভাবে নতুন শব্দ তৈরি হয়, ইত্যাদি নিয়ে ভাষাতত্ত্বে যে তাত্ত্বিক বিষয়ের পর্যালোচনা করা হয়, তাকে বলে রূপতত্ত্ব (morphology)

 

কোনো একজনের পক্ষে পৃথিবীর সকল ভাষার বাগ্‌ধ্বনির প্রকৃতি অনুধাবন করা বোধ করি অসম্ভব। এমন কি কোনো ভাষায় কথা বলার সময়, একটি বাগ্‌ধ্বনিকে একভাবে উচ্চারণ করা হয় না। একজন মানুষই অজস্র বাগ্‌ধ্বনি ব্যবহার করে থাকে। প্রচলিত ধারায়, একটি বাগ্‌ধ্বনির একটি সাধারণ বা গড় মানকে অনুসরণ করা হয়। এই কারণেই প্রমিত বাগ্‌ধ্বনি তৈরি করার প্রয়োজন হয়। এই তৈরিকরণে ব্যক্তি বিশেষের উচ্চারণকে প্রাধান্য না দিয়ে সমগ্র ভাষার জন্য নির্বাচিত ধ্বনিরূপকে স্বীকার করে নেওয়া হয়। এই সূত্রে তৈরি হয়, প্রমিত বা্গধ্বনিরীতি। এটি প্রয়োজন হয়, একটি বৃহত্তর ভাষাভিত্তিক জাতীয় ঐক্যের জন্য। একটি আঞ্চলিক রূপে যে বাগ্‌ধ্বনিসমূহ ব্যবহৃত হয়, তা অন্য অঞ্চলে ব্যবহৃত নাও হতে পারে। কিন্তু প্রমিত বাগ্‌ধ্বনি দিয়ে সকল অঞ্চলের ভাষার ভিতরে ঐক্যে পৌঁছানো সম্ভব।

 

ভাষাতাত্ত্বিকরা বাগ্‌ধ্বনির বৈশিষ্ট্যসমূহ বিচার করে কতকগুলো শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। এই ভাগগুলো দিয়ে মূলত ভাষাসমূহে কথনপ্রকৃতিকে বিভাজিত করেছেন। এই ভাগগুলো হলো

১. যখন অঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণকালে রুদ্ধ হয়, তখন তা অঘোষ ধ্বনিতে পরিণত হয়। যেমন- বাক্‌। এখানে ক্‌ অঘোষ।
২. যখন স্বরধ্বনি যুক্ত হয়ে অঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনি উৎপন্ন হয়, তখন তার ধ্বনিরূপ হয়- অঘোষ-ঘোষ। যেমন- বাক্য। এই শব্দটি বাংলাতে উচ্চারিত হয়- 'বা্ক্‌কো' হিসাবে। এখানে প্রথম 'ক্‌' হলো অঘোষ, কিন্তু দ্বিতীয় 'কো' ধ্বনিটি হবে অঘোষ-ঘোষ।
৩. ঘোষ ধ্বনি হিসাবে যে ধ্বনিগুলিকে পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, এগুলোর মধ্যে কিছু ধ্বনি অবাধে প্রকাশিত হয়, যেমন ঞ (মিঞা), হ- হাত। মূলত এই ধ্বনিগুলোর প্রকাশ স্বরধ্বনির মতোই অবাধ। অন্যান্য ঘোষধ্বনিগুলো গভীরভাবে অনুরণিত হয়, স্বরধ্বনিসহযোগে।