বর্গীর হাঙ্গামা
(১৭৪১-৫০ খ্রিষ্টাব্দ)

নবাব আলীবর্দী খানের শাসনামলে বঙ্গদেশে মারাঠা দস্যুদের আক্রমণকে বর্গীর হাঙ্গামা নামে অভিহিত করা হয়। ১৭৪১ খ্রিষ্টাব্দের (১১৪৮ বঙ্গাব্দ) দিকে, বঙ্গদেশে মারাঠা সৈন্যরা এই আক্রমণ শুরু করেছিল এবং ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় প্রতি বৎসরই তারা আক্রমণ করতো। মূলত বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, বর্ধমান অঞ্চল এই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল। এরা জনবসতিগুলোতে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন করতো। প্রতি বৎসর এই ঘটনা ঘটতে থাকলে, স্থানীয় লোকদের একটি বিরাট অংশ এই আক্রমণের ভয়ে পূর্ব-বাংলার দিকে  পালিয়ে যাওয়া শুরু করে। এছাড়া বহুমানুষ তখন কলকাতায় আশ্রয় নেওয়া শুরু করেছিল। ফলে এই সময় পশ্চিমবঙ্গের ওই সকল অঞ্চলে জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল আশঙ্কাজনকভাবে।

এর সূত্রপাত হয়েছিল পেশোয়া বালাজী বিশ্বনাথের শক্তিশালী মারাঠী সাম্রাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন থেকে। মোগল সাম্রাজ্যের প্রভাব হ্রাস হওয়ার পর, বালাজী প্রথমে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হন। বালাজী বিশ্বনাথের মৃত্যুর পর, তাঁর পুত্র পেশোয়া বাজীরাও এই বিষয়ে যত্নবান হন। হায়দ্রাবাদের নিজাম মারাঠী আক্রমণ থেকে নিজ রাজ্য রক্ষার জন্য, নাগপুরের স্বাধীন মারাঠী রাজা রঘুজী ভোঁসলেকে বাংলা আক্রমণে উৎসাহিত করেন। রঘুজী ভোঁসলে সাতরায় তাঁর আধিপত্য বিস্তারে ব্যর্থ হলে বাংলা আক্রমণের উদ্যোগ নেন। এই সময় পরাজিত রুস্তম জঙ্গও প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রঘুজী ভোঁসলে -কে প্ররোচিত করেন।

১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দে আলীবর্দী খাঁ উড়িষ্যা অভিযানে ব্যস্ত থাকার সময়ে, মারাঠী সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে পুনরায় মারাঠী সৈন্যরা বাংলা আক্রমণ করে এবং বিনা বাধায় বর্ধমান পর্যন্ত অগ্রসর হ। এরপর তিনি কাটোয়া দখল করে নেন। এরপর মারাঠী সৈন্যরা আলীবর্দীর খাঁর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে,  দ্রুত মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে মুর্শিদাবাদ শহর ও জগৎশেঠর কোষাগার লুণ্ঠন করে। এই সময় আলীবর্দীর খাঁ ফিরে এলে, ভাস্কর পণ্ডিত মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে কাটোয়ায় ফিরে যান এবং সেখানে মারাঠী ঘাঁটি স্থাপন করে গঙ্গা নদীর পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত নিজেদের অধিকারে রাখতে সক্ষম হন।

১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে রঘুজী ভোঁসলে বাংলা আক্রমণের উদ্যেশ্যে রওনা হন। এই সময় তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্‌বী ছিলেন বালাজী রাও। মোগল সম্রাটের অনুরোধে বালাজী রাও রঘুজী ভোসলেঁর বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে, রঘুজী ভোসলেঁ নিজ রাজ্যে ফিরে যান। ফলে রঘুজী ভোসলেঁর আক্রমণ থেকে আলীবর্দী খান রক্ষা পান।

১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ভাস্কর পণ্ডিত পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। এই সময় মারাঠী সেনাবাহিনীর তুলনায় আলীবার্দী খাঁর সেনবাহিনী দুর্বল ছিল। এই কারণে আলীবার্দী খাঁ প্রতারণার আশ্রয় নেন। তিনি সন্ধির নাম করে ভাস্কর পণ্ডিতকে আমন্ত্রণ জানান। পরে আফগান সেনাপ্রধান মুস্তফা খাঁর সহায়তায় ভাস্কর পণ্ডিতকে হত্যা করা হয়। ভাস্কর পণ্ডিতকে হত্যা করতে পারলে, আলীবর্দী খাঁ তাঁকে বিহারের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেবেন, এই প্রতিশ্রুতি অনুসারে  মুস্তফা খাঁ ভাস্কর পণ্ডিতকে হত্যা করলেও আলীবর্দী খাঁ তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন নাই। এই কারণে মুস্তফা বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং শেষ পর্যন্ত উভয়ের ভিতর যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। যুদ্ধে মুস্তফা নিহত হলে, বিহারের শাসনভার আলীবর্দী খাঁ'র পছন্দের শাসকের হাতেই রয়ে যায়।

ভাস্কর পণ্ডিতের মৃত্যুর পর, রঘুজী ভোসলেঁ মারাঠী সৈন্যদের ভাস্কর পণ্ডিতের হত্যার প্রতিশোধের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন এবং ১৭৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা আক্রমণ করেন। রঘুজী প্রাথমিকভাবে উড়িষ্যা ও বিহার দখল করে মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু আলীবর্দী খাঁর কাছে পরাজিত হয়ে নিজ রাজ্যে ফিরে যান।

১৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দে রঘুজীর পুত্র জনজীর ভোঁসলে বাংলা আক্রমণ করে বাংলার মেদিনীপুর ও উড়িষ্যা দখল করে নেন। এরপর টানা তিন বৎসর মারাঠী সৈন্যদের সাথে আলীবার্দীর খাঁর যুদ্ধ হয়। এই সময় আলীবর্দী খাঁর শত্রু মীর হাবিব মারাঠী বাহিনীর সাথে যোগ দেয় এবং নবাবের বাহিনীর আফগান সৈন্যরা বিদ্রোহ করে। নবাব এই বিদ্রোহ দমন করলেও, উড়িষ্যার পুরোপুরি মারাঠীদের দখলে চলে যায়।

১৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে উভয় বাহিনীর মধ্যে একটি সন্ধি হয়। এই সন্ধি অনুসারে, উড়িষ্যায় মারাঠীদের অধিকারে থেকে যায়। এছাড়া বাৎসরিক ১২ লক্ষ টাকা মারাঠীদের কর প্রদানে আলীবর্দী খাঁ অঙ্গীকার করেন। কিন্তু বাংলাতে মারাঠীরা আর কখনো আক্রমণ করবে না, এই অঙ্গীকার মারাঠীরা প্রদান করে। এই সন্ধির মধ্য দিয়ে বর্গীর হাঙ্গামার পরিসমাপ্তি ঘটে।


সূত্র :
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।
https://commons.wikimedia.org/wiki/File:Alivardi_Khan.jpg