র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটিশরা ভারতের স্বাধীনতা প্রদান করবে এই অঙ্গীকারের সূত্রে- কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের সম্মতিতে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রস্তুত হয়। স্যার সিরিল জন র‌্যাডক্লিফের ভারতের ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারক এই বিধিকে র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদ বলা হয়ে থাকে।

১৯৪৭ সালের ৩রা জুন বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষকে ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান নামে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে বিভক্ত করার সরকারি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এই পরিকল্পনা অনুসারে বঙ্গীয় আইনসভা দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এরা প্রথম ভাগে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার সদস্য ও অন্য ভাগে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার সদস্যগণ অন্তর্ভুক্ত হন। ২০শে জুন বিভক্তিকরণ বিষয়ের ওপর ভোটা-ভুটির হয়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার প্রতিনিধিগণ বিভক্তির পক্ষে এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার প্রতিনিধিরা বিপক্ষে ভোট দেন। শেষ পর্যন্ত ভোটা-ভুটির মাধ্যমেই বাংলা বিভক্তির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এর পরেই  পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে চূড়ান্ত সীমানা চিহ্নিত করার জন্য সীমান্ত কমিশন
(Boundary Commission) গঠন করা হয়।

এক্ষেত্রে উভয় রাষ্ট্রে সীমানা নির্ধারণের জন্য স্যার সিরিল জন র‌্যাডক্লিফের (১৮৯৯-১৯৭৭) উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। র‌্যাডক্লিফ অখণ্ড বঙ্গ এবং এর সীমান্তবর্তী আসামের ভূমি জরিপ অনুসারে বিভাজনে হাত দেন। এক্ষেত্রে তিনি হিন্দু মুসলমানের সংখ্যাগড়িষ্ঠতা, আঞ্চলিক  সুবিধাদি বিবেচনায় রাখেন।

পূর্ববঙ্গের ভূমি দলিল ও জরিপ (১৯৫১) থেকে দেখা যায় যে, বাংলা প্রদেশের ২৫৭৪৭৮ বর্গ কিমি এলাকা হতে নতুন সৃষ্ট পূর্ববঙ্গের ভাগে ১৩০৩৮৩.১৯ বর্গ কিমি এবং আসাম (সিলেট জেলার বৃহৎ অংশ) হতে আসে ১২৩৯৩.১৫ বর্গ কিমি। এ সময় পূর্ববঙ্গের লোক সংখ্যা ছিল ৩.৯১ কোটি  এবং এর মধ্যে ১.১৪ কোটি ছিল হিন্দু। অপরপক্ষে পশ্চিমবঙ্গের ভাগে পড়ে প্রায় ৭২৫২০ বর্গ কিমি এবং লোক সংখ্যা ছিল ২.১১ কোটি, যার মধ্যে প্রায় ৫৩ লক্ষ ছিল মুসলমান।

কংগ্রেস দলের মতে মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া জেলার নদীপ্রবাহ হুগলি নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অপরিহার্য ছিল। কংগ্রেসের এই যুক্তি তিনি সম্পূর্ণ মেনে নেন এবং সমগ্র মুর্শিদাবাদ জেলা পশ্চিমবঙ্গকে দেওয়া হয়। র্যাডক্লিফ আরও সিদ্ধান্ত নেন যে, মাথাভাঙ্গা নদীর পশ্চিমের অংশ ব্যতীত খুলনা জেলা পূর্ববঙ্গের ভাগে পড়বে। একই সময়ে স্থির হয় যে বোদা, দেবীগঞ্জ ও পঞ্চগড় এলাকার পাঁচটি মুসলিম অধ্যুষিত থানা (পুলিশ স্টেশন) ব্যতীত চা উৎপাদনকারী জেলা দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি পশ্চিমবঙ্গের ভাগে পড়বে।

অবশ্য, মুসলিম লীগের পেশ করা যুক্তি অনুসারে তিনি রাজশাহীর বোয়ালিয়া এবং নদীয়ার একাংশ পূর্ববঙ্গকে দেন।

র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। মুর্শিদাবাদ ও নবদ্বীপের মুসলমানগণ পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে পড়ায় রুষ্ট হয়, আবার জলপাইগুড়ি জেলার দক্ষিণের পাঁচটি থানার হিন্দু অধিবাসিগণ পূর্ববঙ্গে পড়ায় হতাশা প্রকাশ করে। এরূপ অনিশ্চয়তার কারণে এই রোয়েদাদ অনেক বিতর্কের জন্ম দেয়।


সূত্র :