আদিপর্ব
প্রথম অধ্যায়

বিগব্যাং থেকে ছায়াপথ
১৩৮০-১৩৫০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ

অনেক অনেক দিন আগের কথা। তখন মহাবিশ্ব জুড়ে ছিল যতসব অদ্ভুতুড়ে বস্তুকণা। সে সকল কণার নাম ঠিকানা কেউ জানে না। এদের না ছিল কোনো শৃঙ্খলা, না ছিল কোনো বন্ধন। সেটা ছিল- যেন থাকার জন্যই থাকা।

তারপর বস্তুকণাগুলো কিসের এক অজানা আকর্ষণে একত্রিত হওয়া শুরু করলো। একটি দুটি নয়, দলে দলে। গায়ে গায়ে ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলি। গোঁয়ারের মতো সব একটি কেন্দ্রের দিকে ছুটে চললো। শেষমেশ তৈরি হলো বস্তুকণার একটি বিশাল গোলক। এত বিশাল যে, তা আজকের কোনো বড় বস্তুর উপমা দিয়েও বুঝানো সম্ভব না। এই গোলকের কণাগুলোর ঠোকাঠুকিতে ভিতরটা গরম হয়ে উঠতো লাগলো। ক্রমাগত তাপবৃদ্ধির কারণে এটি একটি অগ্নিগর্ভ গোলকে পরিণতি হয়ে উঠলো। তারপর একসময় এর প্রবল চাপ এবং তাপের কারণে সেই মহাগোলক বিস্ফোরিত হলো। এই ঘটনাটিকে বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন
বিগব্যাং (
Big-bang)। বাংলায় বলা যায় মহাবিস্ফোরণ। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই ঘটনাটি ঘটেছিল প্রায় ১৩,৮০,০০,০০, ০০০ বৎসর আগে। বিজ্ঞানীরা অবশ্য আরও একটু বেশি হিসাব করে বলেন- বিগব্যাং-এর ঘটনাটি ঘটেছিল প্রায় ১৩৭৯.৮ ±০.০৩৭০০ কোটি বৎসর আগে।

মহাবিশ্ব কিভাবে সৃষ্টি হলো- এ নিয়ে নানা ধরনের গল্প রচিত হয়ে চলেছিল, মানব সভ্যতার  ঊষালগ্ন থেকেই। গোড়াতে হয়তো সে সব ছিল রূপকথা। ধর্মীয় বিশ্বাসের মোড়কে সে সব গালগল্পই হয়ে গেল পৌরাণিক কাহিনী। এসবের ভিতরে হয়তো কেউ কেউ বিজ্ঞান সম্মতভাবে ভাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সে সব ভাবনা পৌরাণিক কথকথার আড়ালে সরব হয়ে উঠে নি।  কালক্রমে আদিকালের সে সব রূপকথা বা ধর্মকথার গল্পে মানুষ অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু মুক্ত মনের অনেকেই এসব গল্প মানতে পারছিলেন না, মনেপ্রাণে। এই না মানার সূত্রে, নানা জনের নানারকম তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছিল। তাঁরা যতটুকু সম্ভব সত্যাশ্রয়ী হয়ে তত্ত্বকথার অবতারণা করেছিলেন বটে, কিন্তু তার সাথে 'হতে পারে' এই ভাবনাও ছিল। ফলে বিশ্বলোকের সৃষ্টি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যেও তৈরি হয়েছিল মতানৈক্য।

এরই ভিতরে একটি তত্ত্বগত বড় ধাক্কা দিলেন বেলজিয়ামের এক পদার্থ  বিজ্ঞানী জর্জ লেমিটর ( Georges Lemaître)। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জানালেন প্রায় ১৫০০ কোটি বৎসর আগে, মহাবিশ্বের সকল বস্তু আন্তঃআকর্ষণে একটি পরম পরমাণুতে (Supper Atom) পরিণত হয়েছিল। জর্জ লেমিটর এই পরমাণুটির নাম দিয়েছিলেন আদিম পরমাণু (primæval-atom)। তাঁর মতে এই পরম পরমাণুটিই বিস্ফোরিত হয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি করেছিল। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে এই মতবাদকে সমর্থন ও ব্যাখ্যা করেন এডুইন পাওয়েল হাবল (Edwin Powell Hubble)। তবে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে এই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন জর্জ গ্যামো এবং অন্যান্য সমকালীন বিজ্ঞানীরা। হাবল পর্যবেক্ষণ দ্বারা প্রমাণ পান যে মহাকাশের গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে ক্রমান্বয়ে নির্দিষ্ট গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। তাঁর মতে, আদিতে মহাবিস্ফোরণের ফলে গ্যালাক্সিগুলো সৃষ্টি হয়েছিল এবং এগুলোর দূরে সরে যাওয়ার আচরণ বিগব্যাং-কেই সমর্থন করে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন এই মহাবিস্ফোরণের ফলে একটি মহাবিকিরণ সৃষ্টি হওয়ার কথা, তার নিদর্শন কোথায়? বলাই বাহুল্য, তার অস্তিত্ব প্রথম দিকে প্রমাণ করা যায় নাই। ফলে, বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি  হয়েছিল। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে Arno Penzias এবং Robert Wilson নামক দুজন বিজ্ঞানী বিকিরণের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। ফলে বিগব্যাং-এর ধারণা আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। মহাবিশ্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এই তত্ত্বকেই সত্য বলে বিবেচনা করা হয়।  কিন্তু তারপরে কি হলো?

আদি অদ্ভুতুড়ে কণা দিয়ে যখন বিশাল অণ্ড তৈরি হয়েছিল, তখন কোন স্থান ও কালের অস্তিত্ব ছিল না। অসীম ঘনত্বের এই মহাপরমাণুর ভিতরে বস্তুপুঞ্জের ঘন সন্নিবেশের ফলে এর তাপমাত্রা দাঁড়িয়েছিল- ১০১৮ কেলভিন। এই প্রচণ্ড তাপ এবং সেই সাথে বস্তুপুঞ্জের চাপ- এই মহাপরমাণু সহ্য করতে পারলো না। ফলে ১৩৮০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তা দুম করে ফেটে গেল। এটি ছিল বিশ্বচরাচরের সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণ। সেই মহাবিস্ফোরণের পর আদি অদ্ভুতুড়ে কণাগুলো পাল্টে গেল।

মহাবিস্ফোরণের প্রথম দিকে রূপ বদল করে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা তৈরি হয়েছিল, সেগুলো নতুন জীবন পেয়ে কেউ কেউ পরস্পরের সাথে মিলে নতুন কণার তৈরি করলো, কেউ কেউ আবার ঠোকাঠুকি করে ধ্বংস হয়ে গেল। তাদের ধ্বংসের ভিতর দিয়ে তৈরি হলো শক্তি। সে সময়ের সেই ধ্বংস ও সৃষ্টির লীলার ভিতর দিয়ে এক সময় তৈরি হয়েছিল আদিম
কোয়ার্ক কণা। এই কণাগুলোর মধ্যে কিছু কিছু কণা মিলিত হয়ে তৈরি করেছিল একটু বড় কণা। যেমন- দুটি আপ কোয়ার্ক (up quarks) এবং একটি ডাউন কোয়ার্ক (down quark) মিলিত হয়ে তৈরি হয়েছিল প্রোটন কণা। এই অবস্থায় দুটি আপ কোয়ার্কের  আধান হলো- ২/৩+২/৩=৪/৩ আধান। আবার এর সাথে যুক্ত হয়েছিল -১/৩-যুক্ত ডাউন কোয়ার্ক কণা। সব মিলেয় প্রোটন কণার মান দাঁড়িয়েছিল ৪/৩-১/৩= ১। এই কারণে এর আধান মান ধ্বনাত্বক এবং ১। আবার দুটি ডাউন কোয়ার্ক  এবং একটি আপ কোয়ার্ক দিয়ে নিউট্রন গঠিত হয়। এর দুটি ডাউন কোয়ার্কের আধান হয় -১/৩-১/৩= -২/৩। এর সাথে ২/৩ (আপ কোয়ার্ক) থাকায় এর আধান মান হয়েছিল ০।

এইভাবে প্রোটন নিউট্রন তৈরি হলেও,
ইলেক্ট্রন কিন্তু এই ভাবে তৈরি হয় নি। এই কণা তৈরি হয়েছিল লেপ্টন নামক অপর ঋণাত্বক কণা দিয়ে। এরপর ইলেক্ট্রনপ্রোটন নিয়ে তৈরি হয়েছিল মহাবিশ্বের আদিম পরমাণু হাইড্রোজেন। বস্তুর এই ক্রমবিবর্তনের ঘটনাটা ঘটেছিল ১৩৬৫ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে। তারপর এ সব বস্তুর সমাবেশে সৃষ্টি হয়েছিল মহাকাশীয় বিশাল বিশাল মেঘ। এই মেঘ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল রাশি রাশি নক্ষত্র, গ্যালাক্সি এবং নানা ধরনের মহাকাশীয় উপকরণ।

এসব ঘটনাকেই ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপনের জন্য, নিচে দেওয়া হলো- বিশ্বলোকের সৃষ্টি এবং তার পরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া কালানুক্রমকি কালপঞ্জি।

১৩৮০ কোটি খ্রিষ্টপূর্ব্বাব্দ

১৩৬৫-১৩০ কোটি খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ : এই সময়কে বলা হয় পুন সংযোজন (Recombination) অন্তঃযুগ। এই অন্তঃযুগে তাপমাত্রা মোটামুটিভাবে ৪০০০ কেলভিন-এর কাছাকাছি স্তরে পৌঁছেছিল। এই সময়ে প্রথম  প্রোটন নিউট্রন মিলিত হয়ে আয়োনিত হাইড্রোজেনহিলিয়াম পরমাণু তৈরি হয়েছিল। এরপর এই আয়োনিত পরমাণুগুলো- ইলেক্ট্রনকে আকৃষ্ট করা শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত  হাইড্রোজেন, হিলিয়ামলিথিয়াম অণু তৈরি হয়। এই অন্তঃযুগের শেষে মহাবিশ্বের প্রায় ৭৫ ভাগ ছিল হাইড্রোজেন। এছাড়া ছিল অতি সামান্য লিথিয়াম ছাড়া অবশিষ্ট অংশ জুড়ে ছিল হিলিয়াম। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছিল আণবিক মেঘের (molecular cloud)

ধীরে ধীরে আদি মহাকাশকে ব্যাপকভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল আণবিক মেঘমালা। এই আমলের শুরুতে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ৪০০০ কেলভিন থাকলেও, আণবিক মেঘ সৃষ্টির পর থেকে এর তাপমাত্রা হ্রাস পেতে থাকে। আর অন্ধকার যুগের শেষে এসে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা নেমে এসেছিল ৬০ কেলভিনে। এই সময়ে কিছু সৃষ্ট নক্ষত্রের সূত্রে মহাকাশে কিছুটা আলোর ক্ষীণ আভার সৃষ্টি হয়েছিল বটে, কিন্তু তা আলোকিত মহাবিশ্বে রূপ লাভ করে নি। সেকালের মহাবিশ্ব  'আকাশ ভরা সূর্যতারা'র দশায় ছিল না। এক কথায় মহাকাশ ছিল লুকিয়ে ছিল অন্ধকার-সমুদ্রে। এই কারণে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই সময়ের নামকরণ করেছেন অন্ধকার আমল (Dark Age)। 

এই সময়ের ভিতরে নক্ষত্র এবং গ্যালাক্সি তৈরি হওয়া  শুরু হয়েছিল। প্রতিটি গ্যালাক্সির ভিতরে রয়েছে একটি কৃষ্ণগহ্বর। মহাকালের কোনো গল্পই এই তিনটি বিষয়কে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে পারে না। তাই এই পর্যায়ে এই তিনটি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করবো।

নক্ষত্র, কৃষ্ণগহ্বর গ্যালাক্সি
েকালের আণবিক মেঘমালা বিগব্যাং-এর কেন্দ্র থেকে অনির্দিষ্ট দূরের পথে ছুটে যাচ্ছিল। এই মেঘ কোথাও কোথাও ছিল হাল্কা, কোথাও কোথাও ঘন। এই মেঘমালার চলার পথে কোথাও কোথাও সৃষ্টি হয়েছিল আবর্ত। এই আবর্তের সূত্রে তৈরি হয়েছিল নানা ধরনের ঘূর্ণায়মান গ্যাসীয় গোলক। একবার এরূপ কোন গোলক তৈরি হলে, তা আর থামতে পারে না। কারণ, ঘূর্ণায়মান দশায় এই জাতীয় গ্যাসীয় গোলক তার পার্শ্ববর্তী গ্যাসীয় উপকরণসমূহ নিজের কেন্দ্রের দিকে টানতে থাকে। এর ফলে গোলকটি বড় হতে থাকে। এর ফলে গোলকের ভর বাড়তে থাকে। আর যত ভর বাড়ে ততই তার মাধ্যাকার্ষণ ক্ষমতাও বাড়তে থাকে। সেই সাথে শুরু হয় কেন্দ্রের গ্যাসীয় পদার্থের চাপ।

শুরুর দিকে এই গোলকগুলোর নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারা গ্যাসীয় চাপ নিয়ন্ত্রণে ছিল।  এর ফলে ক্রমে ক্রমে এই গোলকটি অল্প ভর বিশিষ্ট প্রাক্-নাক্ষত্রিক (Protostar) ভ্রূণে উপনীত হয়েছিল। এই ভ্রূণটি আরও বড় হয়ে ভর অনুসারে নানা শ্রেণির নক্ষত্রের জন্ম দিয়েছিল।

পদার্থবিজ্ঞানীদের মতে- প্রাক্-নক্ষত্রের প্রবল আকর্ষণে যখন প্রচুর গ্যাসীয় পদার্থের সমাবেশ ঘটে, তখন এর মধ্যস্তরে ঘন বস্তুর সমাবেশের কারণে ভ্রূণটি অস্বচ্ছ হয়ে উঠে। এই সময় বস্তুর ঘনত্ব দাঁড়ায় ১০-১৩ গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার। এই অবস্থায় কেন্দ্রের সংকোচন বন্ধ হয়ে যায় এবং গ্যাস ভ্রূণের অস্বচ্ছ অংশে প্রবেশ করে পাক খেতে থাকে। এর ফলে শকওয়েভের সৃষ্টি হয় এবং একই সাথে নক্ষত্র-ভ্রূণের কেন্দ্রে প্রচুর উত্তাপের সৃষ্টি হয়। এই তাপমাত্রা যখন ২০০০ কেলভিনে পৌঁছায় তখন হাইড্রোজেন অণু ভেঙে যায়। এই প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন এবং সেই সাথে হিলিয়াম আয়োনিত হয়ে যায়। এই সময় ভ্রূণ একটি স্থিতি দশায় চলে যায়। এরপরেও যদি বাইরে থেকে আগত বস্তুরাশি প্রবেশ করতেই থাকে, তাহলে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। বাস্তবে নক্ষত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাইরে থেকে বস্তুরাশি প্রবেশ করতেই থাকে এবং ঘনত্ব বাড়তেই থাকে। যখন এই ঘনত্ব দাঁড়ায় ১০-৮ গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার-এ পৌঁছায়, তখন তাপ ও চাপ আরও বৃদ্ধি পায়। এই সময় এই নাক্ষত্রিক ভ্রূণকে ঘিরে তৈরি হয় নাক্ষত্রিক বলয়।

প্রাক্-নক্ষত্রের কেন্দ্রের তাপমাত্রা যখন ১০
কেলভিন অতিক্রম করে, তখন ডিউটেরিয়াম সংশ্লেষণ ঘটা শুরু করে। তবে এই তাপমাত্রা বজায় থাকার জন্য প্রয়োজন হয়ে প্রাক্-নক্ষত্রের ভিতরে বস্তুর ব্যাপক সমাবেশ। সেই কারণে কম ভরের প্রাক্-নক্ষত্রের কেন্দ্রে ডিউটেরিয়াম সংশ্লেষণ শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা বন্ধ হয়ে যায়। এর জন্য প্রয়োজন ১০ কেলভিন বা  ১ কোটি কেলভিন তাপমাত্রা। মূলত সৌরভরের .০৮ গুণ কম ভরের মহাকাশীয় গ্যাসপুঞ্জের কেন্দ্রে তাপমাত্রা ১ কোটি কেলভিনে উন্নীত হতে পারে না। এই কারণে এগুলো নক্ষত্রে পরিণত হয় না। ফলে এরা সঙ্কোচনজনীত তাপ হারিয়ে একসময় শীতল হয়ে যায়। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণজনীত কারণে এই জাতীয় গ্যাসপুঞ্জ জমাটবদ্ধ গোলক হয়ে মহাকাশে বিরাজ করে। এদেরকে সাধারণভাবে বলা হয়- বাদামী বামন (brown dwarf)

নক্ষত্রের প্রধান পরিচয় হলো- এর নিজস্ব আলো ও তাপ আছে। এই বিচারে বাদমী বামন তারাকেও নক্ষত্র বলা হয়। বাস্তবতা হলো বাদমী বামন নক্ষত্র তার নিভন্ত চুল্লির শক্তি অনুসারে এই তাপ ও আলো প্রদান করে না। এই জাতীয় নক্ষত্র কখনও যথার্থ নক্ষত্রগুণ লাভ করতে পারে না। তাই এদেরকে বলা হয় অ-প্রধান ধারার তারা। পক্ষান্তরে যে সকল গ্যাসীয় দশা থেকে যথার্থ নক্ষত্র হয়ে আত্মপ্রকাশ করে তাদেরকে বলা হয় প্রধান ধারার নক্ষত্র। ভরের বিচারে প্রধান ধারার তারার সর্বনিম্ন পরিমাণ হলো- সৌর ভরের বিচারে .০৭৫ গুণ। প্রধান ধারার নক্ষত্রগুলোকে ভরের বিচারে নিম্ন ও উচ্চ মানে ভাগ করা হয়। যে সকল নক্ষত্রের ভর সৌর ভরের ১.৫ গুণের কম হয়, তাদেরকে নিম্নস্তরের প্রধান তারা বলা হয়। আর সৌরভরের  ১.৫ গুণের বেশি ভরের নক্ষত্রকে বলা হয় ভারি তারা।

1
1
H
 
1
1
H
 
→  2
1
D
 
e+
 
ν
e
 
0.42 MeV

এই পর্যায়ে পজিট্রন এবং ইলেকট্রনের সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় এবং উভয়ই ধ্বংস হয়ে যায়। এই শক্তি দুটি গামা রশ্মি ফোটন দ্বারা বাহিত হয়
e
 
e+
 
→  γ  1.02 MeV
2
1
D
 
1
1
H
 
→  3
2
He
 
γ  5.49 MeV
41H → 4He + 2e+ + 2γ + 2νe (26.7 MeV)

প্রকৃত পক্ষে এই পর্যায়ে একটি নক্ষত্রের জন্ম হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এই জাতীয় নক্ষত্রকে প্রধান ধারার নক্ষত্র বলা হয়। উল্লেখ্য আমাদের সূর্য প্রধান ধারার নক্ষত্রের একটি উদাহরণ। প্রধান ধারার নক্ষত্রে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরির প্রক্রিয়ায় যে সকল উপাদান তৈরি হয়, তা পর্যায়ক্রমে নক্ষত্রের অভ্যন্তরে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু নিউট্রিনো কোনো কিছুর সাথে বিক্রিয়া করে না, তাই এই কণা সূর্য থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। মূলত এই নিউট্রিনোর পরিমাণ থেকে এই জাতীয় নক্ষত্রের অভ্যন্তরে ঘটিত বিক্রিয়ার হার সম্পর্কে ধারণা করা যায়।

যে সকল নক্ষত্রের ভর সূর্যের ভরের সাধারণত ০.০৭৫ গুণ হয়ে থাকে। এরা লাল বামন তারা (red dwarf star) -তে পরিণত হয়। এই নক্ষত্রগুলো শেষ পর্যন্ত মৃত্য বরণ করে। মূলত লাল বামন তারার মোট হাইড্রোজেনের এক দশমাংশ যখন হিলিয়ামে পরিণত হয়, তখন নক্ষত্রের কেন্দ্রে হিলিয়ামের একটি বিশাল ভাণ্ডার গড়ে উঠে। কিন্তু এই হিলিয়াম দহনের দ্বারা নক্ষত্রের অভ্যন্তরভাগে আবার নতুন চুল্লি চালু হওয়ার জন্য যে পরিমাণ তাপমাত্রা দরকার, তা এই জাতীয় নক্ষত্রে অভ্যন্তরে সৃষ্টি হয় না। ফলে নক্ষত্রটি ক্রমে ক্রমে মৃত্যু বরণ করে। এই নক্ষত্রের ক্ষণস্থায়ী অপর্যাবৃ্ত্ত প্রকৃতির শক্তি নির্গমনের ফলে কখনো কখনো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠে। এই অবস্থায় রাতের আকাশে মনে হয়, তারাটিতে আগুন ধরে গেছে। এই নক্ষত্রের এই দশাকে প্রদীপ্ত তারা বলা হয়।

  • নক্ষত্র সৃষ্টি দ্বিতীয় স্তর: হিলিয়াম প্রজ্জ্বলন
    প্রধান ধারার নক্ষত্রের মোট হাইড্রোজেনের এক দশমাংশ যখন হিলিয়ামে পরিণত হয়, তখন নক্ষত্রের কেন্দ্রে হিলিয়ামের বিশাল ভাণ্ডার গড়ে উঠে। কিন্তু হিলিয়ামের প্রজ্জ্বলিত হওয়ার মতো পর্যাপ্ত তাপ না থাকায়
    কেন্দ্রের চুল্লীটি নিভে যায়। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের টানে হিলিয়াম কেন্দ্রে সঙ্কুচিত হতে থাকে। এই সময় বাইরে দিকে তখনও বিপুল পরিমাণ অপ্রক্রিয়াজাত হাইড্রোজেন থাকে । সেই সাথে থাকে হাইড্রোজেন জ্বলে উঠার মতো পর্যাপ্ত তাপ। এর ফলে নক্ষত্রের বাইরের স্তরে জমে থাকা হাইড্রোজেন-চুল্লী জ্বলে উঠে। কিন্তু এর ফলে নক্ষত্রের বাইরের অংশ প্রসারিত হতে থাকে। ফলে প্রসারিত নক্ষত্রের উপরিতলের তাপমাত্রা তূলনামূলকভাবে অসম্ভব রকম কমে যায় এবং নক্ষত্রটি থেকে লালবর্ণের আলো বিচ্ছুরিত হতে থাকে। কোনো কোনো নক্ষত্রের তাপমাত্রা ৫ হাজার কেলভিনের কাছাকাছি পৌঁছায়। তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে এই জাতীয় নক্ষত্রের রঙের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। রঙের পার্থক্য হতে পারে কমলা থেকে লাল। এই অবস্থায় এই নক্ষত্রকে বলা হয় লাল দানব তারা (red giant star)। এই শ্রেণির নক্ষত্রের উল্লেখযোগ্য নমুনা হলো অমল আর্দ্রা । অবশ্য এই জাতীয় নক্ষত্রকে অতি দানবতারাবলা হয়।
  • নক্ষত্র সৃষ্টি তৃতীয় স্তর: হিলিয়াম সংযোজন  
    লাল দানব তারার অভ্যন্তরভাগ অতি সঙ্কোচনের কারণে, যখন এর আভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ১০কেলভিন এবং ঘনত্বের পরিমাণ ১০গ্রাম/বর্গ সেন্টিমিটার হয়, তখন নক্ষত্রের ভিতরে জমে থাকা হিলিয়ামের দহন শুরু হয়। প্রথাবস্থায় হিলিয়াম সংযোজিত হয়ে বেরিলিয়াম-৮ তৈরি করে।
4He + 4He + 92 keV → 8*Be

এরপর বেরিলিয়াম-৮ এর সাথে আরও একটি হিলিয়ামের সাথে যুক্ত হয়ে তৈরি হয় কার্বন-১২। এই অবস্থায় হিলিয়াম ঝলক (helium flash)- এর সৃষ্টি হয়

                  4He + 8*Be + 67 keV → 12*C

সব মিলিয়ে চূড়ান্ত বিষয়টি দাঁড়ায়-

                34He → 12C + γ + 7.2 MeV

হিলিয়াম দহনের ফলে বেরিলিয়াম উৎপন্ন হয়, এরপর বেরিলিয়ামের সাথে হিলিয়ামের সংযোজনে তৈরি হয় কার্বন। ক্রমে ক্রমে লাল দানব তারার অভ্যন্তরে কার্বনের বিশাল ভাণ্ডার গড়ে উঠে। একটা সময় কার্বন সমৃদ্ধ লাল দানব তারাটিই কার্বন তারা (Carbon Star)-য় পরিণত হয়। এদের উপরিতলের তাপমাত্রা থাকে ২০০০-৩০০০ কেলভিন। এই নক্ষত্রের বাইরের স্তরের জমে থাকা কার্বন নক্ষত্রে লাল আলোকে শোষণ করে।

হিলিয়াম দহন শেষে নক্ষত্রটি শ্বেত বামন (white dwarf)  নক্ষত্রে পরিণত হয়। শ্বেত বামন তারার ভর হয়ে থাকে সৌরভরের ০.১৭ থেকে ১.৩৩ গুণ পর্যন্ত। কিন্তু এর ব্যাস হয়ে থাকে, সৌরব্যাসের .০০০৮ থেকে ,০২ গুণ পর্যন্ত। অর্থাৎ সহজভাবে এই ভর এবং ব্যাসের হিসাবটা বলা যেতে পারে যে, শ্বেত বামন এমন এক ধরনের তারা, যার আয়তন হবে পৃথিবীর মতো আর এর ভর হবে সূর্যের মতো। ফলে ছোট একটি নক্ষত্রের প্রচণ্ড মাধ্যাকর্ষণ ক্ষমতার অধিকারী হয়। এদের উপরিতলের তাপমাত্রা অত্যধিক হয়। সাধারণত এই তাপমাত্রা হয়ে থেকে ৮০০০ থেকে ৪০,০০০ কেলভিন পর্যন্ত।

প্রধান ধারার নক্ষত্রের ভরের উপর নক্ষত্রের বিবর্তনের প্রকৃতি নির্ভর করে। যদি কোনো নক্ষত্রের মোট ভর সূর্যের ১.৪৪ গুণের সমান বা তার চেয়ে কম হয়, তাহলে ওই নক্ষত্র শ্বেত বামন (white dwarf) তারায় পরিণত হয় [চন্দ্রশেখর সীমা সূত্রানুসারে]। তবে কিছু অল্প ঘনত্বের লাল দানব তারার হিলিয়াম ঝলক-এর সময় বিপুল পরিমাণ তেজ নক্ষত্রের বাইরে বেরিয়ে আসে, কিন্তু নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণের ফলে ওই তেজ আবার নক্ষত্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এই তেজের নির্গমণ এবং অভ্যন্তরে গমনের প্রক্রিয়াটি একটি সুষম সময় অনুসরণ করে ঘটতে থাকে। ফলে এক ধরনের স্পন্দনের সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় নক্ষত্রটিকে বলা হয় শেফালি বিষমতারা (cepheid Variable star)আবার নক্ষত্রের অভ্যন্তরে হিলিয়াম থেকে কার্বন তৈরির সময় যখন তাপমাত্রা অতিরিক্ত পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, তখন নক্ষত্রের বহিরাংশের কিছু অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তা বলয়াকারে মূল নক্ষত্রকে ঘিরে থাকে। এই অবস্থায় ওই নক্ষত্রকে বলা হয় গ্রহান্বিত নীহারিকা (Planetary nebula)

  • নক্ষত্র সৃষ্টি চতুর্থ ধাপ: কার্বন দহন প্রক্রিয়া (Carbon-burning process)
     কার্বন নক্ষত্রের অভ্যন্তরে যখন
    কার্বনের ঘনত্ব  > 3×109 kg/m3 হয় এবং ক্রম সঙ্কোচনের কারণে এর অভ্যন্তরের তাপমাত্রার প্রায় 5×108 K or 50 keV -এ উন্নীত হয়, তখন নক্ষত্রের অভ্যন্তরে কার্বনের দহন শুরু হয় এবং অক্সিজেন তৈরি হতে থাকে। কার্বন-১২ পুড়ে তৈরি হয় অক্সিজেন-১৬।

12
6


C
 
+ 4
2

He

16
8

O

+ γ (+7.162 MeV)

এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় নিওন, সোডিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, অথবা ম্যাগনেশিয়াম ও অক্সিজেন   নিচে এই বিক্রিয়াগুলো দেখানো হলো

12
6
C
 
12
6
C
 
→  20
10
Ne
 
4
2
He
 
4.617 MeV
12
6
C
 
12
6
C
 
→  23
11
Na
 
1
1
H
 
2.241 MeV
12
6
C
 
12
6
C
 
→  23
12
Mg
 
−  2.599 MeV

বিকল্পে

12
6
C
 
12
6
C
 
→  24
12
Mg
 
γ  13.933 MeV
12
6
C
 
12
6
C
 
→  16
8
O
 
4
2
He
 
−   0.113 MeV

কার্বন দহনের শেষ  অক্সিজেন, নিওন, সোডিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম-এর ভারি কণা নক্ষত্রের অভ্যন্তরে জমা হতে থাকে। ফলে এই কণাগুলো ক্রমান্বয়ে শীতল হয়ে মৃত নক্ষত্রে পরিণত হয়।

  • নক্ষত্র সৃষ্টি পঞ্চম ধাপ: নিওন দহন প্রক্রিয়া (Neon-burning process)
    কার্বন দহনের শেষে নক্ষত্রের কেন্দ্রে জমা হয় অক্সিজেন,
    নিওন , সোডিয়ামম্যাগনেশিয়াম। এই সময় নক্ষত্রের সংকোচনের ফলে এর অভ্যন্তরে বস্তুর ঘনত্ব এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই দুটি উপাদানের বৃদ্ধির ফলে নিওন দহন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর জন্য তাপমাত্রা প্রয়োজন হয় 1.2×109 K or 100 KeV এবং ঘনত্বের প্রয়োজন হয় 4×109 kg/m3। এই অবস্থায় নক্ষত্রের অভ্যন্তরে প্রথমে নিওন গামা রশ্মি ত্যাগ করে হিলিয়াম তৈরি করে। পরে এই হিলিয়ামের সাথে নিওন বিক্রিয়া করে ম্যাগনেশিয়াম তৈরি করে। নিচে বিক্রিয়াটি দেখানো হলো।

20
10
Ne
 
γ  →  16
8
O
 
4
2
He
20
10
Ne
 
4
2
He
 
→  24
12
Mg
 
γ

আবার নিওন-২০ এর সাথে নিউট্রোন যুক্ত হয়ে নিওন-২১ তৈরি করে। পুনরায়  নিওন-২১-এর সাথে হিলিয়াম-৪ যুক্ত হয়ে তৈরি হয় ম্যাগনেশিয়াম-২৪। নিচে বিক্রিয়াটি দেখানো হলো।

20
10
Ne
 
→  21
10
Ne
 
γ
21
10
Ne
 
4
2
He
 
→  24
12
Mg
 
  • নক্ষত্র সৃষ্টি ষষ্ঠ ধাপ: অক্সিজেন দহন প্রক্রিয়া (Oxigen-burning process)
    নিওন দহনের ফলে নক্ষত্রের কেন্দ্রে জমা হয় অক্সিজেন এবং ম্যাগনেশিয়াম। এর কেন্দ্রের ঘনত্ব যখন
    1010 kg/m3 হয় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে 1.5×109 K বা 130 keV  উন্নীত হয়, তখন নক্ষত্রের অভ্যন্তরে অক্সিজেনের দহন শুরু হয়।  এই নতুন বিক্রিয়ার ফলে তৈরি হবে সিলিকন।
16
8
O
 
16
8
O
 
→  28
14
Si
 
4
2
He
 
9.594 MeV
      →  31
15
P
 
1
1
H
 
7.678 MeV
      →  31
16
S
 
n  1.500 MeV
      →  30
14
Si
 
1
1
H
 
0.381 MeV
      →  30
15
P
 
2
1
D
 
2.409 MeV

বিকল্পে

      →  32
16
S
 
γ
      →  24
12
Mg
 
4
2
He
  • নক্ষত্র সৃষ্টি সপ্তম ধাপ: সিলিকন দহন প্রক্রিয়া (Silicon-burning process)
    নক্ষত্রের
     অভ্যন্তরের তাপমাত্রা যখন ২.৭-৩.৫ ×106 K-এ উন্নীত হয়, তখন সিলিকনের দহন শুরু হয়। এই পর্যায়ে সিলিকনের সাথে হিলিয়াম যুক্ত হয়ে পর্যায়ক্রমে তৈরি হতে থাকে, গন্ধক, আর্সেনিক, ক্যালসিয়াম, টাইটেনিয়াম, ক্রোমিয়াম, লৌহ।
28
14
Si
 
4
2
He
 
→  32
16
S
32
16
S
 
4
2
He
 
→  36
18
Ar
36
18
Ar
 
4
2
He
 
→  40
20
Ca
40
20
Ca
 
4
2
He
 
→  44
22
Ti
44
22
Ti
 
4
2
He
 
→  48
24
Cr
48
24
Cr
 
4
2
He
 
→  52
26
Fe

ক্রোমিয়াম-এর দহন শেষে তৈরি হয় লৌহ-৫২। কিন্তু এই লৌহ অচিরেই হিলিয়ামের সাথে বিক্রিয়া করে নিকেল-৫৬ তৈরি করে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে মাত্র ১ দিনে।

52
26
Fe
 
4
2
He
 
→  56
28
Ni

নিকেল-৫৬- এর অর্ধ জীবন মাত্র ৬.০২ দিন। এটা থেকে বিটা রশ্মি নির্গত হয়ে তৈরি হয় কোবাল্ট-৫৬। এর নতুন অর্ধ-জীবন ৭৭.৩ দিন। এই সময় কোবাল্ট-৫৬ পরিবর্তিত হয়ে উৎপন্ন হয় লৌহ-৫৬। এর পরে নিকেলের সাথে হিলিয়াম বিক্রিয়া করে কিছু দ্স্তাও তৈরি হয়। কিন্তু কেন্দ্রে লৌহ বেশি পরিমাণে জমা হয়।

56
28
Ni
 
4
2
He
 
→  60
30
Zn
 

সিলিকন থেকে দস্তা তৈরির পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানোর পর, এক সময় নক্ষত্রের শক্তি শেষ হয়ে যায়। নতুন কোনো বিক্রিয়া করার মতো তাপ না থাকায়, নক্ষত্রটি একসময় লৌহ সমৃদ্ধ একটি নক্ষত্রে পরিণত হয়।

  • নক্ষত্র সৃষ্টি অষ্টম ধাপ: লৌহ সমৃদ্ধ নক্ষত্রের পরিণতি
    লৌহ সমৃদ্ধ নক্ষত্রের ভিতরে আর নতুন কোনো চুল্লি জ্বলে উঠে না। ফলে নক্ষত্রের কেন্দ্রে অসম্ভব চাপের সৃষ্টি হয়। এই প্রবল চাপ নক্ষত্রটি ধরে রাখতে পারে না। ফলে এক সময় নক্ষত্রটি নিজের অভ্যন্তরীণ চাপেই বিস্ফোরিত হয়। নক্ষত্রের এই দশাকে অতি-নবতারা বলা হয়। এর ফলে দুটি ঘটনা ঘটতে পারে।
    • সূর্যের চেয়ে ২ বা ৩ গুণ ভারি নক্ষত্রগুলো এই বিস্ফোরণের পর লৌহসমৃদ্ধ নক্ষত্রটি নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত হবে।
    • লৌহ নক্ষত্রের ভর যখন ৩ গুণের চেয়ে বেশ ভারি হবে, তখন তা কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হবে। ১৩৬০ কোটি খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে এরূপ একটি কৃষ্ণগহ্বর থেকে জন্মগ্রহণ করেছিল আমাদের ছায়াপথ নামক গ্যালাক্সি।

১৩৮০ থেকে ১৩৬০ কোটি খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের সৃষ্ট নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি

আমাদের ছায়াপথ
এটি একটি কুণ্ডলিত গ্যালাক্সি (Sb বা SBb কুণ্ডলিত গ্যালাক্সি)। পৃথিবী থেকে রাতের আকাশে এই গ্যালাক্সিকে আলোর ফিতার মতো মনে হয়। বাংলাতে এর সমার্থক অন্যন্য নাম- অজবীথি, অজবীথিকা, অজবীথী, অমরমার্গ, আকাশগঙ্গা, আকাশসরিৎ, ছায়াপথ, দুধপথ, দুগ্ধসরণি, দেবযান, দ্বীপবিশ্ব, হরিতালিকা, হরিতালী, হারাবলী।
ইংরেজি :
Milky Way, Milky Way Galaxy, Milky Way System

গ্রিক পুরাণে ছায়াপথ তৈরির একটি গল্প আছে। দেবরাজ জিউস রাজা এ্যাম্ফিট্রায়োনের পত্নী এ্যাল্ক্‌মেনের রূপে মুগ্ধ হয়ে, সঙ্গোপনে তাঁর সাথে মিলিত হন। এর ফলে এ্যাল্ক্‌মেনে গর্ভবতী হন। যথাসময়ে  এ্যাল্ক্‌মেনে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন এবং ‌এই পুত্রের নাম রাখেন হেরাক্লেজ (রোমান নাম হার্কিউলস)। এ্যাল্ক্‌মেনে তাঁর এই সন্তানের অমঙ্গলের আশংকায় অস্থির হয়ে উঠেন। কারণ জিউসের স্ত্রী হেরা এই পুত্র সন্তানের কথা জানতে পারলে হেরাক্লেজ-এর ক্ষতি করার চেষ্টা করবেন। এই সে কারণে তিনি হেরাক্লেজ-এর জন্মের পরপরই তাকে উন্মুক্ত প্রান্তরে রেখে আসেন। কারণ, এ্যাল্ক্‌মেনের বিশ্বাস ছিল যে, জিউস তাঁর সন্তানকে রক্ষা করবেন। ঘটনাক্রমে কিছুক্ষণ পর হেরা এবং  এথেনা ওই প্রান্তর অতিক্রম করার সময় এই শিশুটিকে দেখতে পান। মাতৃস্নেহে হের এই শিশুটির স্তন্যদান করতে থাকেন। কিন্তু শিশু হেরাক্লেজ এত জোরে স্তন্যপান করতে থাকেন যে, হের ব্যথাতুর ও বিরক্ত হয়ে স্তন ফিরিয়ে নেন। এর ফলে কিছুটা দুধ ছিটকে বাইরে পড়ে। গ্রিক পৌরাণিক কাহিনিতে- বলা হয়, হেরর এই ছিটকে পড়া দুধ থেকে আকাশের ছায়াপথ তৈরি হয়।

আদিকাল থেকে এই রাতের আকাশে সাদাটে পথকে মানুষ নানা নামে চিহ্নিত করেছেন। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্যালাক্সি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিয়েছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলাই। ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী চার্লস মেসিয়ার ছায়াপথ-সহ ৩২টি গ্যালাক্সি অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম হার্শেল প্রথম ছায়াপথের আকৃতি সম্বন্ধে একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন, এর জন্য তিনি আকাশের বিভিন্ন অঞ্চলে দৃশ্যমান তারার সংখ্যা গণনা করেন।

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, মহাবিশ্বের সকল গ্রহ-নক্ষত্র এই গ্যালাক্সিই রয়েছে। এরপর ধীরে বিজ্ঞানীরা ধারণা করতে শুরু করেন যে, ছায়াপথের বাইরে অন্যান্য গ্যালাক্সিতে অসংখ্য নক্ষত্র রয়েছে।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে এডুইন পাওয়েল হাবল এ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকা এবং ত্রিকোণমণ্ডলের ভিতরে বিষম তারা আবিষ্কার করেন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে এ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকার ভিতরে তিনি ১২টি বিষম তারা আবিষ্কার করেন। তিনি বলেন এ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকা পৃথিবীর ছায়াপথের বাইরে এবং পৃথিবী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। তাঁর এই সকল আবিষ্কার প্রথম প্রকাশিত হয় নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার ২৩ নভেম্বর সংখ্যায়। অবশ্য সে সময় অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী তাঁর মতামতের সাথে একমত হতে পারেন নি।

এখন পর্যন্ত জানা গেছে যে এই ছায়াপথ লানিয়াকি নামক প্রধান মহা-গ্যালাক্সিগুচ্ছ (Laniakea Supercluster) অধীনে। এই প্রধান মহা-গ্যালাক্সিগুচ্ছের অধীনে রয়েছে চারটি মহা-গ্যালাক্সিগুচ্ছ। এগুলো হলো-

এর ভিতরে ধনু মহা-গ্যালাক্সিগুচ্ছের অধীনে অন্তর্গত ছায়াপথ একটি কুণ্ডলিত গ্যালাক্সি  

১৩৬০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে বর্তমান ধনু-এ (Sagittarius A) নক্ষত্রে নিকটবর্তী অঞ্চলে একটি অতি-বৃহৎ নক্ষত্র কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়েছিল। এই কৃষ্ণগহ্বরকে কেন্দ্র গড়ে সৃষ্টি হয়েছিল আমাদের ছায়াপথ নামক গ্যালাক্সি। বর্তমানে এর অবস্থান  সৌরজগত থেকে এর দূরত্ব ২৬,০০০ আলোকবর্ষ।

এই গ্যালাক্সিটির নিকটবর্তী গ্যালাক্সি হলো- মৃগব্যাধ বামন গ্যালাক্সি (
Canis Major Dwarf, ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে আবিষ্কার হয়েছে)। এর কেন্দ্র থেকে ছায়াপথের দূরত্ব প্রায় ৪২,০০০ আলোকবর্ষ। আর আমাদের সৌরজগৎ থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২৫,০০০ আলোকবর্ষ। অবশ্য বিজ্ঞানীরা এই গ্যালাক্সিকে ছায়াপথের একটি দূরবর্তী অংশ হিসাবে বিবেচনা করে থাকেন। এছাড়া ছায়াপথের নিকটবর্তী অপর গ্যালাক্সি হলো এ্যান্ড্রোমিডা (Andromeda Galaxy (M31)। এই গ্যালাক্সিটিও ছায়াপথের সাথে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দ্বারা আবদ্ধ। এই কারণে উভয় গ্যালাক্সি একটি স্থানীয় দলের (Local Group) অংশ হিসেবে হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উল্লেখ্য এই স্থানীয় দলে আছে ছায়াপথ, এ্যান্ড্রোমিডা এবং আরও প্রায় ৩০টি ছোটো বড় গ্যালাক্সি  পৃথিবী থেকে এ্যান্ড্রোমিডার দূরত্ব প্রায় ২,৫০,০০,০০০ আলোকবর্ষ।


ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে সৌরজগতের গড় দূরত্ব ২৭,০০০ আলোকবর্ষ।
এই গ্যালাক্সি ভর ৫.৮´১০১১(M) সৌরভর ছায়াপথ ১৩০ কিমি/সে থেকে ১০০০কিমি/সে গতিতে নিজ অক্ষের উপর ঘুরছে।

কুণ্ডলিত এই গ্যালাক্সির মূল বাহু রয়েছে,  পাঁচটি। এই বাহুগুলির নাম হলো-

এই অধ্যায়ে আমরা খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৮০ কোটি থেকে ১৩৬০ কোটি বৎসরে বিবর্তনের গল্পের সাথে পরিচিত হয়েছি।  এর পরবর্তী আমরা ছায়াপথ নামক গ্যালাক্সি থেকে যাত্রা শুরু করবো সৌরজগতের দিকে। ওই অধ্যায়ে আমরা সৌরজগতের সৃষ্টি এবং সৌরজগতের পরিচয় জেনে নেওয়ার গল্প জেনে নেব। এই সময়ের সাথে মহাবিশ্বের কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কেও অবগত হব।
 


সূত্র: