ভরতনাট্যম
ভারতীয় চিরায়ত নৃত্যশেলীর
একটি অন্যতম ধারা।
অনেকে মনে করেন, ভরত নামক মুনি এই নৃত্যের প্রবর্তন করেছিলেন, এই কারণে এই নৃত্যের
নাম ভরতনাট্যম। তবে এই সিদ্ধান্ত সবাই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না। এই নাচ
ভারতবর্ষে প্রথাগত ক্রমবিবর্তনের ধারায় সমৃদ্ধিলাভ লাভ করেছে। গোড়ার দিকে ভারতীয়
নৃত্য ধর্মীয় ভাবধারার সাথে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত ছিল। সে সময় এই নৃত্য মন্দিরে,
রাজগৃহে বা লোকালয়ে ধর্মীয় ভাবাবেগে উপস্থাপিত হতো। কালক্রমে বিভিন্ন দেবমন্দিরে
নৃত্যকলায় পারদর্শিনী দেবদাসীরা এই নাচে অংশগ্রহণ করা শুরু করে। ভবিষ্য পুরাণে
সূর্যের উপাসনায় নৃত্যগীতেকুশলা স্ত্রীলোকদের উৎসর্গ করার বিধান ছিল। দেবমন্দিরে
নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান সম্পর্কে পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, শ্রীমদভগবদ, বিষ্ণুপুরাণ,
অগ্নিপুরাণে উল্লেখ পাওয়া যায়।
ভরতনাট্যমের আদি বা শুদ্ধতম রূপ হলো সাদিরনাট্যম। এই নাচ পরিবেশন করতেন দেবাদাসীরা। পরে এই নাচই দাসীআট্যম, চিন্নমেলন, ভোগমেলম, তাঞ্জোরী নামে ভারতের নানাস্থানে ছড়িয়ে পড়ে। শৃঙ্গার রসাত্মক এই নাচ শুধু নারীদের ভিতরে প্রচলিত ছিল। দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক চর্চার ভিতর দিয়ে এর সাথে অন্যান্য উপাদান যুক্ত হয়েছে। সমগ্র ভারতবর্ষেই নাচের চর্চা ছিল, তা অনেকটাই ব্যাহত হয়েছিল মুসলমানদের শাসনামলে। উত্তর ভারতে মুসলমানদের আক্রমণ এবং মুসলিম শাসনের সূত্রে শুরুতে
সকল ধরণের প্রথাগত নৃত্যধারার স্বাভাবিক বিকাশে ব্যাহত হয়েছিল। মুসলিম শাসনামলের মধ্যভাগে, রাজদরবারে ভারতীয় নৃত্য এবং পারশিক নৃত্যধারার সূত্রে মুসলিম রাজদরবারে কত্থক নৃত্য বিকশিত হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে সনাতন ধর্মের ভাবধারায় পুষ্ট নাচগুলো অবহেলিত নৃত্যধারায় পরিণত হলেও, ভরতনাট্যমের চর্চা দক্ষিণ ভারতে হিন্দু রাজন্যবর্গের আনুকূল্যে অব্যাহত ছিল। ফলে দক্ষিণ ভারতে এই নাচের বিকাশ ঘটেছিল স্বাভাবিক গতিতেই। তাঞ্জোরের রাজা অছুথাপ্পা (১৫৭২-১৬১৪ খ্রিষ্টাব্দ), রঘুনাথ নায়ক, বিজয়রাঘব নায়ক (১৬১৪-১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দ) প্রমূখের রাজত্বকালে ভরতনাট্যম চরম উৎকর্ষতায় পৌঁছায়। পরবর্তীকালে রাজা প্রতাপসিংহ এবং তুলাযাজীর রাজত্বকালে ভরতনাট্যমের আধুনিক রূপ পায়। এক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন চিন্নাইয়া, পুন্নাইয়া, ওয়াডিভেলু ও শিবানন্দ।
বর্তমানে ভরতনাট্যম কোনো ধর্মীয় নৃত্য নয়। এর আখ্যান অংশে সনাতন ধর্মের কোনো কোনো বিষয় উপস্থাপন করা হয় বটে, কিন্তু তা করা হয় শৈল্পিক চেতনা থেকে। এর সাথে কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস যুক্ত থাকে না। এই কারণে এই নাচ সকল ধর্মের মানুষই চর্চা করে থাকেন।
আধুনিক ভরতনাট্যম কোনো ক্ষুদ্র নৃত্য পরিবেশন নয়। এটি একটি দীর্ঘ উপস্থাপনযোগ্য নৃত্যশৈলী। সময়াভাবে বেশিরভাগ সময়, এর কোনো একটি বা একাধিক অংশ উপস্থাপন করা হয়। দীর্ঘ উপস্থাপনযোগ্য এই নৃত্যধারার ৬টি ধাপকে পরপর উপস্থাপন করা হয়। এই ধাপগুলো হলো আল্লারিপু, যতিস্বরম, শব্দম, বর্ণম, পদম এবং তিলস্নানা।
আল্লারিপু: ভরতনাট্যমের প্রথম ধাপ। তেলেগু আল্লারিম্পু শব্দ থেকে আল্লারিপু শব্দটি এসেছে। উল্লেখ্য আল্লারিম্পু শব্দের অর্থ হলো প্রস্ফুটিত হওয়া। ভরতনাট্যমের প্রথম এই ধাপে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বিশুদ্ধ নৃত্যের উপযোগী করে দেহভঙ্গিকে সুষম সৌন্দর্যে প্রস্ফুটিত করা হয়। এই অংশে শিল্পী মাথার উপরে নমস্কারের ভঙ্গিতে দুই হাত তুলে, ছন্দের সাথে দৃষ্টি ও গ্রীবার কাজ করেন। এই অংশে শিল্পী রঙ্গদেবতা, দর্শক, সঙ্গীতশল্পী প্রমুখের কাছ থেকে আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। বিশুদ্ধ ভরতনাট্যমে এই অংশ তিন থেকে পাঁচ মিনিটের ভিতরে শেষ করা হয়।
যতিস্বরম: আল্লারিপু'র পরে এই অংশ উপস্থাপন করা হয়। একে বলা হয় শোভাবর্ধক নৃত্য। এই অংশে পাঁচ থেকে সাতটি জটিল রাগাশ্রয়ী সরগম ও তালের সাথে নৃত্য পরিবেশন করা হয়। তাল রক্ষার জন্য মৃদঙ্গ ও মন্দিরা ব্যবহৃত হয়। এই অংশে দৃষ্টি, গ্রীবা, হস্ত ও পাদকর্ম প্রাধান্য পায়। কোনো বিশেষ ভাবকে এই অংশে প্রকাশ করা হয় না। তালের এক একটি অধ্যায় ধরে একটি যতি গঠিত হয়। একটি অধ্যায় শেষে তালের সমে এসে পরবর্তী যতি শুরু করা হয়। এই অংশটিকে সুচারূপে সংযমের সাথে উপস্থাপন করা হয়। শাস্ত্র সম্মত রীতির বাইরে এর সাথে অতিরিক্ত কোনো কিছু আরোপ করা নিষিদ্ধ।
শব্দম: যতিস্বরম-এর পরে এই অংশ উপস্থাপন করা হয়। ভক্তিমূলক সঙ্গীতের ভক্তিরসকে নৃত্যের ছন্দে অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয় এই অংশে। সাধারণত তেলেগু ভাষায় এই ভক্তিগীতি পরিবেশন করা হয়। এই অংশের ভক্তি করা হয় দেবতাকে। আগে এই অংশে রাজার মহত্ব বর্ণনা করা হতো। এই কারণে এই ভক্তিগীতিকে অনেক সময় যশোগীতি বলা হয়।
বর্ণম: শব্দম-এর পরে এই অংশ উপস্থাপন করা হয়। 'বর্ণম' কথাটির অর্থ রঞ্জিতকরণ, অর্থাৎ এই অংশে নৃত্যাভিনয়ের মাধ্যমে দর্শনার্থীদের হৃদয়কে রাঙিয়ে তুলতে হয়। গীত, বাদ্য ও নৃত্য অভিনয়ের সমন্বয়ে এই অংশ বেশ জটিলভাবে উপস্থাপন করা হয়। বেশ দীর্ঘ সময় ধরে এই অংশ উপস্থাপিত হয়। এর যতিগুলো জটিল এবং তা দ্রুত শেষ করা হয়। বর্ণমের এই যতি উপস্থাপন রীতিকে বলা হয় থিরণ্ম। এই অংশে মুখাভিনয়, মুদ্রাবিন্যাস ও দ্রুত পায়ের কাজ করা হয়। এই অংশের সাথে কল্যাণী, নবরত্নমালিকার মতো অল্পপ্রচলিত রাগ ব্যবহার করা হয়।
পদম: বর্ণম-এর পরে এই অংশ উপস্থাপন করা হয়। পদম মূলত অভিনয়-প্রধান অংশ। এতে দেবদেবীর কাহিনীর বর্ণনা সংবলিত গান নৃত্যের ছন্দে অভিনয় দ্বারা প্রদর্শিত হয়। এর সঙ্গীতাংশ জয়দেব, পুরন্দর দাস, ক্ষেত্রয়া রচিত পদগুলোই ব্যবহার করা হয়।
তিলস্নানা: পদম-এর পরে এই অংশ উপস্থাপন করা হয়। ভরতনাট্যমের সর্বশেষ উপস্থাপনা এটি। এই অংশে দক্ষিণ ভারতীয় পদ্ধতিতে তারানার সাথে নৃত্য পরিবেশন করা হয়। এই অংশে যতির অংশগুলো বিলম্বিত, মধ্য ও দ্রুতলয়ে পরিবেশন করা হয়। শিল্পী তাঁর নৃত্যকুশলতার পরিচয় এই অংশে তুলে ধরেন। এই অংশে নানা ধরনের মুদ্রা, পাদকর্ম, শিরকর্ম, দৃষ্টিকর্ম, নাসকর্ম, ভ্রূকর্মের জটিল বিষয়কে উপস্থাপন করেন।
ভারতনাট্যমের আশ্রয়রূপে চারটি অভিনয় উপস্থাপিত হয়। এই চারটি অভিনয় হলো আঙ্গিক, বাচিক, সাত্ত্বিক, কৈশিকী। এর দুটি ধর্ম রয়েছে। ধর্ম দুটি হলো লোকধর্মী ও নাট্ধর্মী। এর চারটি বৃত্তি রয়েছে। এগুলো হলো ভারতী, সাত্ত্বতী, কৈশিকী ও আরভট্টী। এর সিদ্ধি দুটি, দৈবী ও মানুষী। এর আসন সংখ্যা পাঁচটি। এগুলো হলো— মণ্ডলা, অর্ধমণ্ডলা, সমমণ্ডলা ও নৃত্যমণ্ডলা। তিনটি পদসংস্থান— অঞ্চিতা, কুঞ্চিতা ও অর্ধাঞ্চিতা। তিনটি ভঙ্গী— সম, ললিতা ও বলিতা। তিনটি প্রকার— করণ, অঙ্গহার ও মুদ্রা। ভরতনাট্যম অনুষ্ঠানের মূলরস হলো শৃঙ্গার। মূল শৃঙ্গার রস থেকে তাণ্ডব ও লাস্য শৃঙ্গারের উদ্ভব হয়েছে।
এই
নাচের অন্যতম অঙ্গ হলো সঙ্গীত। এর সঙ্গীতাংশ একজন কণ্ঠশিল্পী সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
আবহসঙ্গীত হিসেবে এতে থাকে বীণা, তানপুরা, বাঁশি, নফরী, সারেঙ্গী, বুদবুদিকা,
মৃদঙ্গম, করতাল, বেহালা, সরশৃঙ্গার, পুঙ্গী, নাগেশ্বরম ও মন্দিরা। কণ্ঠ সঙ্গীতে
প্রায় সকল ধরনের রাগই ব্যবহৃত হয়।
ভরতনাট্যমের জাম্বাই, এরাবম, তিরপড্ডাই, আড়াতালম, মিট্টিয়াম, একতালম প্রভৃতি ৯টি
তালের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। এর ভিতরে সাধুশ্রম (চারমাত্রা), তিশ্রম (তিনমাত্রা),
মিশ্রম (সাতমাত্রা), কাণ্ডম (পাঁচমাত্রা) ও সংকীর্ণম (নয় মাত্রা) ব্যবহৃত হয়।
সূত্র :
ভারতের নৃত্যকলা । গায়ত্রী বসু। নবপত্র প্রকাশন। নভেম্বর ১৯৮৯।