অষ্টক গান
বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ভিতরে প্রচলিত লোকসঙ্গীতের একটি প্রকরণ। এর অপর নাম অষ্ট গান। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, চৈত্র মাসে শিবের ভক্তরা, চৈত্রসংক্রান্তিতে নীলের গাজন উপলক্ষে এই গান গেয়ে থাকেন। এই কারণে বৈষ্ণব-প্রধান অঞ্চলে এই গানের প্রচলন দেখা যায় না। তবে অনেক অঞ্চলে অষ্টকগানে শিল্পীরা রাধা-কৃষ্ণের লীলা, নিমাই সন্ন্যাসী, ব্রহ্মা ইত্যাদির কাহিনি বর্ণনা করে থাকেন। অনেক সময় চণ্ডীদাস-রজকিনী, বেহুলা-লখিন্দর-এর মতো উপাখ্যানও পরিবেশন করা হয়। বাংলাদেশের পাবনা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলে এই গানের প্রচলন ছিল। বর্তমানে প্রায় বিলুপ্তির পথে। মুর্শিদাবাদ, নড়াইল অঞ্চলে এর কমবেশী প্রচলন আছে।
অষ্টক গানের নামকরণে নানারকমের মত রয়েছে। যেমন-
অষ্টপ্রহরের গান, এই কারণে অষ্টক গান। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অষ্টগান চৈত্রসংক্রান্তিতে নীলের গাজন উপলক্ষে তিন দিন এই গান গাওয়া হয়। সেই কারণে এই গানকে অষ্টপ্রহরের গান বলা যায় না।
এই গানে অষ্ট চরিত্রের সমন্বয় ঘটে বলে এ গানের নাম অষ্টক। এই মতে- অষ্ট চরিত্র হলো রাধা, কৃষ্ণ, সুবল, বিশাখা, ললিতা, বৃন্দা, বড়িমাই ও বলরাম। এই চরিত্রগুলোর সাথে শিব অনুপস্থিত। সম্ভবত বৈষ্ণবরা শিবের উদ্দেশ্যে রচিত গানের আদলে, রাধা-কৃষ্ণের লীলা ভিত্তিক এই জাতীয় অষ্টক গান তৈরি করেছিলেন। বাংলাদেশের নড়াইল, ঝিনাইদহ অঞ্চলে এই অষ্টক গানের চর্চা আছে। নাড়াইল অঞ্চলে অষ্টক গানে কৃষ্ণের সখী নিয়ে লীলা ভিত্তিক গানকেও অষ্টক বলা হয়।
অষ্ট অধ্যায়ে ভাগ করে, এই গান উপস্থাপন করা হয়, এই কারণে অষ্টক গান বলা হয়। বাস্তবে অষ্টক গানে এরূপ আটটি অধ্যায় কালেভদ্রে পাওয়া যায়। তবে অষ্টক গানের আদিতে হয়তো শিবের সাথে সম্পর্কিত কাহিনি আটটি অধ্যায়ে পরিবেশিত হতো। কালক্রমে অঞ্চলভেদে এর পরিবর্তন ঘটলেও নামটি থেকেই গেছে।
এক সময়
পাবনা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া অঞ্চলের পদ্মা পাড়ের শিবভক্তরা,
চৈত্রসংক্রান্তিতে দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অষ্টগান পরিবেশন করতেন। গৃ্স্থরা তাঁদের
সাধ্যমত, চাল, ডাল, অর্থকড়ি দিয়ে সন্তুষ্ট করতেন। এক্ষেত্রে প্রতিটি দলে বাদক, গায়ক
ও নৃত্যদল থাকতো। সমবেত কণ্ঠে শিল্পীদের সাথে শিব, পার্বতী, কালী, অসুর, ইত্যাদি
চরিত্রে অভিনেতারা মুখোস ও সাজসজ্জা গ্রহণ করে নৃত্যাভিনয় করতো। ছোট দলগুলোর এই
গানের প্রধান বাদ্যযন্ত্র ছিল কাঁসা এবং ঢোল। অনেক সময় সুর ঠিক রাখার জন্য গলায়
হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে মূল গায়ক নেচে নেচে গাইতেন। কিন্তু বড় দলগুলোতে বাঁশি, ঢোল,
হারমনিয়াম, মন্দিরা ও খোল ব্যবহার করা হতো।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে এই গানের কোনো উল্লেখ নেই। নাগরিক গানের দলেও এই গান স্থান
পায় নি। সেই বিচারে অষ্টক গান পুরোপুরি লোকধারার গান। এই গানের জন্য আদর্শ লেখ্য
রূপ ছিল না। অধিকাংশ সময়, দলের সরদার বা অধিকারী মুখে মুখে এই গান পরিবেশন করতেন।
অধিকারীর কাছে এর একটি লিখিত রূপ থাকলেও, অন্যান্য শিল্পীরা মুখস্থ গাইতেন। অধিকারী
নিজের অধিকার বজায় রাখার জন্য মূলপালা নিজের কাছেই রেখে দিতেন। এই কারণে বিভিন্ন
অধিকারীর গানের কাহিনি একই রকম হলেও, বাণীর হেরফের দেখা যেতো। এছাড়া প্রতিটি দলের
নৃত্যশৈলীর কাঠামো একটা থাকলেও, সর্বার্থে একরকম ছিল না। সংরক্ষণের অভাবে এই সকল গান হারিয়ে গেছে। মূলত অষ্টক গান
বর্তমানে একটি বিপন্ন লোকসঙ্গীতে পরিণত হয়েছে। নিচে আশুতোষ ভট্টাচার্যের
'লোক-সঙ্গীত রত্নাকর' গ্রন্থের প্রথম খণ্ড থেকে মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের দুটি গানের নমুনা দেওয়া হলো।