ভাওয়াইয়া
বাংলা লোকগানের সুরাঙ্গের প্রধান চারটি ধারার একটি। এই ধারটির বিকাশ ঘটেছে বরেন্দ্র-অঞ্চল-সহ উত্তরবঙ্গের বিশাল অঞ্চল জুড়ে। এই অঞ্চলের ভিতরে রয়েছে অখণ্ড বঙ্গদেশের কোচবিহার, জলপাইগুড়াই, দার্জিলিং-এর সমভূমি, উত্তর দিনাজপুর, রংপুর, আসামের গোয়ালপাড়া ও ধুবড়ি জেলা।

ভাওয়াইয়া নামের উৎপত্তি নিয়ে নানা রকমের মত রয়েছে। এর ভিতরে দুটি মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। যেমন

ভাওয়াইয়া নৃগোষ্ঠী: উত্তরবঙ্গের লোক গান হিসেবে ভাওয়াইয়া সর্বাধিক পরিচিত। বৃহত্তর উত্তরবঙ্গের বাঙালি ছাড়াও প্রধান প্রধান নৃগোষ্ঠীর ভিতরে এই গান প্রচলিত রয়েছে। বাঙালি ব্যতীত নৃগোষ্ঠীগুলো হলো- রাজবংশী, কোচ, মেচ, রাভা, খেন, যুগী ইত্যাদি। দৈহিক বৈশিষ্ট্যের বিচারে এই নৃগোষ্ঠীর ভিতরে মঙ্গোলয়েডদের  প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মঙ্গোলয়েড, দ্রাবিড় এবং প্রটো-অস্ট্রালয়েডদের সংমিশ্রণে এই নৃগোষ্ঠীগুলোর উদ্ভব হলেও মঙ্গোলীয়ডদের প্রভাব বেশি।

ভাওয়াইয়ার বিষয়
ভাওয়াইয়া গানের বিকাশ ঘটেছিল কোচ ও রাজবংশী জাতিগোষ্ঠীর ভিতরে। ধীরে ধীরে এই গান উত্তরবঙ্গের বাঙালিদের ভিতরে এই গানের ধারা সঞ্চালিত হয়েছে। এই গানের সুরের নানা ধরনের বিষয়াঙ্গ যুক্ত হয়েছে। এই বিষয়াঙ্গের সাথে গভীরভাবে মিশে আছে, জীবনযাপনের নানা প্রকরণ। আনন্দ-বেদনা, বিরহ-মিলন, নানা ধরনের চাওয়া-পাওয়া-বিলাস। এসব বিষয় গ্রথিত হয়েছে বিয়েবাড়ির উৎসব, মেয়েলী আবেগ, পূজা-পার্বনের  কথা, কৃষকের কিম্বা মৈষাল বন্ধুর মনের কথা ইত্যাদি। তবে এর প্রধান বিষয় হলো নারীর প্রেম-বিরহ। প্রবাসী স্বামীর বিরহে যুবতী নারীর দেহ-মনে যে তীব্র কামনা কিম্বা বিরহ জেগে উঠে, এই গানে সেই কথাই উঠে এসেছে। তবে এ গান রচনা করে পুরুষ এবং পরিবেশনও করেছে পুরুষ। এই গানের নায়ক মাহুত, মৈষাল বন্ধু, বাউদিয়া, চেংড়া বন্ধু, সাধু (স্বামী বা বন্ধু) বৈদ্য, রাখাল প্রমুখ। অধিকাংশ ভাওয়াইয়ায় নারীর অভিব্যক্তিতে এসব নায়কদের সম্বোধন পাওয়া যায়। তবে পুরুষের অভিব্যক্তি যে নেই তা নয়। যেমন

    ও মোর সোনার কইন্যারে
    ও মোর গুণের কইন্যারে
আজি আশা দিয়া ভাসালু মোক
        অকূল সাগরে।

ভাওয়াইয়ার ভাষারীতি
উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর, কোচবিহার ইত্যাদি অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষারীতি ভাওয়াইয়া গান পাওয়া যায়। ফলে এই আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণরীতির সাথে সমন্বয়ে ভিন্নতর গায়নরীতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই অন্য অঞ্চলের মানুষের কাছে এই গানের ভাবগত বিষয় উপলব্ধি করার জন্য, এই আঞ্চলিক ভাষার রূপতত্ত্ব, শব্দ-উৎস, অর্থতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব অনুসারে বিশেষভাবে জানা প্রয়োজন। কিছু কিছু শব্দের সাথে আঞ্চলিক এমন কিছু অনুভূতি থাকে, যা অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব বোধ। এই সকল গানের ভাব স্থানীয় মানুষের ভিতরে যে গভীর অনুভব সৃষ্টি করে, সহজে অন্য অঞ্চলের মানুষের ভিতরে সঞ্চালিত হয় না।

সুর-সহযোগে ভাওয়াইয়ার বাণীতে হ ধ্বনির বিশেষ প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন প্রাণ হয়ে যায় প্রাহ্‌য়ান, মোর হয় মোহ-ওর। শব্দের বিচারে বিশেষ কিছু প্রতীকী শব্দ ভাওইয়াতে পাওয়া যায়। যেমন অনেক গানে স্বামীকে সাধু সম্বোধন করা হয়। যেমন-
        ও প্রাণ সাধুরে সাধু
        যদি সাধু বাণিজ্যে যাও
        অষ্ট অলঙ্কার খুলিয়া নেও রে

আবার রাজবংশী ভাওইয়াতে ং-এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এই গানে চলং, বলং ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়।

সুর ও ছন্দ: ভাওয়াইয়ার সুরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো টানা সুর। এর মাঝে সুরের ভাঙ্গন রয়েছে। গবেষকদের মতে উঁচিনিচু বা অসমান পথে চলমান মহিষের গাড়িতে গাড়িয়াল যখন গান গাইতে থাকে, তখন চাকার উত্থান পতনে কণ্ঠস্বরে ভাঙানির প্রভাব পড়ে। এর সুরের মূল কাঠামো দাঁড়ায় স রে গ ম প ধ ণ। এরই নানারূপ আরোহ, অবরোহ ও বক্র রীতি অনুসারে সুরবিন্যাস হয়। ভাওয়াইয়া গানে কোমল ঋষভ, কড়ি মধ্যম ও শুদ্ধ নিষাদের ব্যবহার বিরল। তবে কোমল গান্ধার ও কোমল ধৈবতের অল্পবিস্তর ব্যবহৃত হয়।

সাধারণভাবে ভাওইয়ার সুরে ধাপে ধাপে আরোহ-অবরোহের চলন পাওয়া যায়। সাধারণ তার সপ্তকে গানের সুরে 'ভাঙানি'। এবং ভাঙানির পরে নিচের স্বরে নেমে আসে। সুরের এরূপ প্রয়োগের কারণে ভাওয়াইয়া একটি বিশেষ সুরে ধারায় চেনা যায়।

তাল: সাধারণভাবে সবেচেয়ে বেশি দেখা যায় কাহারবা ও দাদরা তাল। কিছু গান পাওয়া যায় তেওরাতে। তবে ভাওইয়ার দাদরা ঠিক ৩।৩ ছন্দের, কিন্তু ছন্দের দোলাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই কারণে অনেকে একে ৬ মাত্রার সোওয়ারি বলে থাকেন। অনেকে একে মৈষালি চালও বলে থাকেন। কিছু ভাওয়াইয়া বৈতালিকে গাওয়া হয়।

সুরের চলনের বিচারে ভাওয়াইয়া গানকে প্রাথমিকভাবে ৩টি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ ৩টি হলো দরিয়া, চটকা ও বৈতালিক।

রাজবংশীদের আদি সুরে বাঁশী ও ঢোল ব্যবহৃত হতো। বাংলা ভাওয়াইয়া গানে যুক্ত হয়েছে দোতরা। তবে এই দোতারায় ব্যবহৃত হয় ইস্পাতের তারের পরিবর্তে মুগা সুতা।


সূত্র :