গান্ধর্ব তাল
প্রাচীন ভারতের গান্ধর্ গানে ব্যবহৃত তালসমূহের শ্রেণিগত নাম হলো- গান্ধর্ব তাল ।

বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের কাবুল ও সোয়াত নদীর তীরে, খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০-১২০০ অব্দের থেকে গান্ধার রাজ্য গড়ে উঠেছিল। অনেক সময় এই রাজ্যকে প্রাচীন ভারতের ১৬ জনপদের অন্যতম জনপদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনিতে এই রাজ্যের দুটি বিখ্যাত নগরী কথা জানা যায়। এই নগর দুটি হলো- তক্ষশীলা ও পুস্করাবতী।

গান্ধর্বদের মাধ্যমে গান্ধর্ব গানের বিকাশ শুরু হয়েছিল বৈদিক যুগের শেষের দিকে, অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দের দিকে। ধারণা করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময় তথা বৈদিকোত্তর যুগে রচিত হয়েছিল বাল্মীকি রামায়ণ। এই সময় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বৈদিক গানের পাশাপাশি আর্যপল্লীর দেশী গান ও অনার্য লোকগানের চল ছিল। এদের ভিতরে গান্ধর্বরা সঙ্গীতে সবচেয়ে অগ্রগামী ছিল। এদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আদি রূপ।

বৈদিক যুগ এবং বৈদিকোত্তর পৌরাণিক যুগের শুরুর দিকে বৈদিক ও সংস্কৃত কাব্যসাহিত্য ও সঙ্গীত শাসিত হয়েছে- অক্ষর ভিত্তিক সংস্কৃত ছন্দের অনুশাসনে। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে এই অনুশাসন থেকে মুক্ত হয়ে নব্যধারার ছন্দের প্রকাশ ঘটেছিল- ছন্দের আবর্তনের মাধ্যমে। ফলে আবর্তিত ছন্দই হয়ে উঠলো তাল।

গান্ধর্ব তালের প্রথম বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় ভরতের রচিত নাট্যশাস্ত্রে। স্বরের উৎপত্তি-স্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে- বীণা ও কণ্ঠস্বর। তাল ব্যবহৃত হতো অবনদ্ধ বা তালযন্ত্রের মাধ্যমে। স্বর, তাল ও পদের সমন্বয়ে যত গান সৃষ্টি হয়, সেগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো- স্বর গান্ধর্ব, তাল গান্ধর্ব ও পদ গান্ধার্ব। [২৮।১১-১২]

প্রাচীন গ্রন্থাদি অনুসরণে মাত্রাপরিমাপক মানগুলো যে মানসমূহ পাওয়া যায়,দেশীয় রীতিতে সময় মাপার প্রাথমিক মান ছিল ক্ষণ। ১০০টি পদ্মফুলের পাপাড়িকে একটি সূচের সাহায্যে দ্রুত বিদ্ধ করার সময়কে বলা হয়েছে ক্ষণ। এই সময় মান কোনো আদর্শিক মান তৈরি করে না। এই মান সময়ের একটি ক্ষুদ্র সময়ের ধারণা দেয় মাত্র। তারপরেও এই ক্ষণ থেকেই শুরু করা হয়েছিল সময় মাপার পদ্ধতি। 'ক্ষণ'-এর মানানুসারে দেশীয় অন্যান্য যে সকল সময়জ্ঞাপক মান পাওয়া যায়,হলো- নাট্যশাস্ত্রে তালব্যঞ্জক অধ্যায়ে বলা হয়েছে- পাঁচ নিমেষে হয় ১ মাত্রা। আর শার্ঙ্গদেবের রচিত সঙ্গীতরত্নাকরে -পাঁচটি লঘুঅক্ষর উচ্চারণকালকে ১ মাত্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। নাট্যশাস্ত্রে তালের লয়কে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগ তিনটি হলো- দ্রুত, মধ্য ও বিলম্বিত। তালের প্রতিটি মাত্রাকে কলা বলা হয়ে থাকে। যেমন চঞ্চৎপুট তালের যথাক্ষরে থাকে দুটি গুরু, ১টি লঘু এবং ১টি প্লুত। সব মিলয়ে এর মাত্রা হবে ৮টি=৪মাত্রা+(দুটি গুরু)+ ১ মাত্রা (১টি লঘু)+৩ মাত্রা (১টি প্লুত)। গান্ধর্ব গানে একে বলা হবে ৮ কলা। নাট্যশাস্ত্রে কলার মান অনুসারে তিনটি মার্গের কথা বলা হয়েছে। এই মার্গ তিনটি হলো- তালের ছন্দভাগের বিচারে তালের জাতি নির্ধরিত হতো। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে তালের দুটি জাতির উল্লেখ রয়েছে। এই জাতি দুটি হলো-চতুরস্র জাতি ও ত্র্যস্র জাতি। চতুরস্র জাতির তাল হলো চঞ্চৎপুট এবং ত্র্যস্র জাতির তাল হলো চাপুট। প্রতিটি তালের তিনটি শ্রেণি রয়েছে। এই শ্রেণি তিনটি হলো-যথাক্ষর, দ্বিকল, চতুষ্কল। যথাক্ষর হলো-তালের মূল অক্ষর ও মাত্রা বিন্যাস। যথাক্ষরের দ্বিগুণ হবে দ্বিকল এবং দ্বিকলের দ্বিগুণ হলো- চতুষ্কল।
গান্ধর্ব তালের ক্রিয়াকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। এই ভাগ দুটি হলো- সশব্দ ক্রিয়া ও নিঃশব্দ ক্রিয়া।

সশব্দ ক্রিয়া:শব্দের দ্বারা তালের প্রকাশ করার প্রক্রিয়াকে বলা হয়েছে সশব্দ ক্রিয়া। তুড়ি এবং তালির দ্বারা সশব্দ ক্রিয়া প্রকাশ করা হতো। সশব্দ ক্রিয়া চার প্রকার। যথা-

নিঃশব্দ ক্রিয়া:শব্দ সৃষ্টি না করে হাতের সঙ্কেতের মাধ্যমে তাল প্রকাশের প্রক্রিয়া। হতো। নিঃশব্দ ক্রিয়া চার প্রকার। যথা

  
তথ্যসূত্র: