গম্ভীরা
উত্তর বঙ্গের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবাগঞ্জ এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক গান। কথিত আছে অবিভক্ত বাংলার মালদার ভোলাহাট শিবগঞ্জ ছিল এর পীঠস্থান। বর্তমানে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জে গম্ভীরা গানের চর্চা রয়েছে।

গম্ভীরা শব্দ নিয়ে নানা ধরনের মতবাদ আছে। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য মতবাদগুলো হলো

১. হিন্দু পৌরাণিক দেবতা মহাদেবের অপর নাম গম্ভীর। মধ্যযুগে গম্ভীরা বলতে বিশেষ ভাবে শিবের মন্দির বুঝানো হতো। কিন্তু বাস্তবে গম্ভীরা নামক কোনো মন্দিরকে কেন্দ্র করে কোনো পূজা ও উৎসবের আয়োজন করা হতো না। বহু আগে থেকে উত্তরবঙ্গে চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়কপূজা, শিবের নৃত্য ইত্যাদির প্রচলন ছিল। এই কারণে উত্তরবঙ্গের কোথাও কোথাও শিবকে গম্ভীরা বলা হতো। এই শিবের গাজনের (গাজন: ধর্মমঙ্গলের কাহিনী থেকে জানা যায় রানী রঞ্জাবতী ধর্মকে তুষ্ট করার লক্ষ্যে গাজন উৎসবের প্রচলন করেন)। বাঙালিরা ছাড়াও কোচ, রাজবংশী, পলিয়া এবং মাহালী , হাঁড়ি, বাগদী, কেওট, নুনীয়া, চামার, পোদ নাগর, ধানুক চাঁই, তুড়ী ইত্যাদি সম্পদায়ও এই পূজা করতো। এই সূত্রে যে গীত রচিত এবং পরিবেশিত হতো, তাই কালক্রমে গম্ভীরা নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।

২. বিহারে গাওহার বৃক্ষ, উত্তরবঙ্গে গাম্ভীর নামে অভিহিত হয়। শিবপূজায় এই কাঠের  পিঁড়ি ব্যবহৃত হতো। সেখান থেকে গম্ভীরা নামটি এসেছে এমনটা কেউ কেউ দাবি করেন।

বঙ্গদেশে বৌদ্ধযুগের শেষে হিন্দু ধর্মের পুনরভ্যুত্থান ঘটে। এই সময় বুদ্ধ মূর্তির আদলে শিব মূর্তি তৈরি হওয়া শুরু হয়। শিবের মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং শিবপূজার ব্যাপক প্রচলনের সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল শৈবধর্ম। বাংলায় পাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর, হিন্দু ধর্মের উত্থান শুরু হলে, শৈবধর্ম সুদৃঢ় অবস্থানে চলে আসে। গোড়ার দিকে হিন্দু তান্ত্রিকবাদ এবং শৈববাদের ভিতর দ্বন্দ্ব ছিল। সে সময় শৈবধর্মের অঙ্গ হিসেবে বিভিন্ন অঞ্চলে শিবের গান প্রচলিত হয়। এই গান আঞ্চলিকতার বিচারে গাজন, নীল, গম্ভীরা নামে পরিচিতি লাভ করে। গোড়ার দিকে এই সকল গানের প্রধান উপকরণ ছিল শিববন্দনা। কালে কালে আঞ্চলিক ভাবনা, আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে শিব-সঙ্গীত আঞ্চলিক সংস্করণ নানারূপ লাভ করে। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে এই গানের নাম হয় গম্ভীরা, উত্তরবঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের অঞ্চল বিশেষ গাজন এবং পূর্ববঙ্গে এর নাম হয় নীল।

গম্বীরা গানের উৎসস্থান ব্রিটিশ ভারতের বৃহত্তর মালদহ জেলা। এই জেলার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের বর্তমান রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় এই গানের প্রচল আছে। বাংলাদেশে গম্ভীরাকে রাজশাহীর আঞ্চলিক গান হিসেবে অভিহিত করা হয়।

মালদহ জেলার গম্ভীরা মেলা হয় গম্ভীরা পূজার সূত্রে। মালদহের শিবরূপী গম্ভীর, পৌরাণিক শিব নয়। নিতান্তই কৃষকদের নিজস্ব সংস্কৃতির দেবতা। সেখানে শিবকে পরিবারের মুরুব্বির দাদাঠাকুরের মতো করে মান্য করা হয়। সেখানে শিবকে রঙ্গ করা হয়, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে গান পরিবেশন করা হয়। মালদহে গম্ভীরা পূজা চলে চার দিন ধরে। এর প্রথম দিনে অনুষ্ঠিত হয় 'ঘটভরা'। এই দিনে একটি মণ্ডবে শিবের প্রতীক হিসেবে একটি ঘট স্থাপন করে পূজা করা হয়। দ্বিতীয় দিনে 'ছোট তামাশা'। এই দিনে ঘটপূজা ছাড়া সারারাত ধরে মণ্ডবের সামনে নৃত্যগীত করা হয়। তৃতীয় দিনে হয় 'বড় তামাশা'। এই দিনে শিবভক্তরা কাঁটাভাঙা, ফুলভাঙা অনুষ্ঠান করে। মূলত কাঁটাগাছের ডাল বুকে ধরে এঁরা উপাসনা করেন পরে কাঁটা-বিছানো বিছানায় গড়াগড়ি দেয়। অনেক জায়গায় ত্রিশূলের অগ্রভাগ কোমরে বিদ্ধ করে শায়িত দশায় থাকার চেষ্টা করে। এদিনও এছাড়া মণ্ডবের সামনে নৃত্যগীত হয়। তবে নৃত্যশিল্পীরা নানা রকমের মুখোশ পরিধান করে। চতুর্থ দিনে নীল পূজা ও
আহারা পূজা হয় এবং রাতভর গম্ভীরা গানের আসর চলে।

গম্ভীরা মুখোশ নৃত্য:
গম্ভীরা নৃত্য মূলত মুখোশ নৃত্য। উত্তরবঙ্গের বহু স্থানে চড়কপূজার সময় মুখোশ নৃত্যের প্রচলন আছে। সাধারণ মানুষের উৎসবের নৃ্ত্যের সাথে তান্ত্রিক ও ঐন্দ্রজালিক বিশ্বাসে সৃষ্ট ভাব এই নৃত্য অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আগে নিম ও ডুমুর কাঠ দিয়েই এই সব মুখোশ তৈরি হতো। কখনো কখনো কাগজের মণ্ড দিয়েও এ নৃত্যের মুখোশ তৈরি হতো। ধর্মীয় আচারযুক্ত এসব মুখোশের নির্মাণ ও সংরক্ষণের নির্দিষ্ট পদ্ধতি ছিল। চামুণ্ডা, ঝাঁটাকালী, কালী, উগ্রচণ্ডা, নারসিংহী ইত্যাদি এর একক নৃত্যে নানা ধরনের মুখোশ ব্যবহার করা হতো।

গম্ভীরা গান:
গম্ভীরা উৎসবের জন্য নিবেদিত গান ছিল গম্ভীরা গান। এই গানে শিব-পার্বতীর লীলা, দুর্গার স্বামীর ঘর ছেড়ে বাপের বাড়ি আসার উপাখ্যান গম্ভীরা গানের বিষয় ছিল। কালক্রমে দেবতার অংশ বাদ দিয়ে শুধু সামাজিক সমস্যা এই গানের বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়েছ। আজকালকার গম্ভীরা গানে শিবের কোনো উল্লেখই থাকে না। বর্তমানের গম্ভীরা গানে নানা-নাতির প্রশ্নোত্তরমূলক কথোপকথনের ভিতর দিয়ে সমাজের নানাবিধ সমস্যা এবং তার সমধানের কথা হাস্যরসাত্মক উপস্থাপনায় পরিবেশিত হয়। মূলত প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনের পর লোকসমাজের রুচির তাগিদে সামাজিক লোকনাট্যের রূপ নিয়েছে গম্ভীরা গান। বর্তমানে গানের সাথে অনুষঙ্গ যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় ঢোল, হারমোনিয়াম, বাঁশি, তবলা ও জুঁড়ি।