কীর্তনাঙ্গ
কীর্তন হলো বাংলা গানের একটি বিশিষ্ট ধারা। আর
কীর্তনাঙ্গ হলো- এমন এক ধরনের গান, যা কীর্তনের মতো, কিন্তু যথাযথ কীর্তন নয়।
কীর্তনাঙ্গ গানে মূলত কীর্তনের সুর-বৈশিষ্ট্যকেই বিবেচনা করা হয়। এই গানে বিষ্ণু বা
কৃষ্ণের আরাধনা বা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা নাও থাকতে পারে, কিন্তু সুরের চলন যেন
কীর্তনের মতো হয়, এই দাবিটুকু রাখা যেতে পারে। মূলত কীর্তনের প্রভাব আছ, এমন দাবি
নিয়ে সব গানকে একনিষ্ঠতার সাথে কীর্তন বলা যায় না। ধরা যাক, রাধা-কৃষ্ণের কথা আছে
বা বংশিধ্বনির কথা আছে, যমুনা নদীও আছে, কিন্তু সুরটা কীর্তনের মতো নয়, তাহলে
তাকে কীর্তনাঙ্গ বলা যাবে না।
এই জাতীয় গানের সুর কোনো রাগ বা রাগের ছায়ায় রচিত হলেও, রাগের বিচারের চেয়ে কীর্তনের সুরের ঢং-টাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই জাতীয় গানকে রাগাশ্রয়ী
খাঁটি কীর্তন গান ছাড়া বিভিন্ন সুরকার প্রচুর কীর্তনাঙ্গে সুর বেঁধেছেন। এই তালিকায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, রজনীকান্ত সেন প্রমুখ গীতিকার ছাড়াও আধুনিককালেও অনেকে কীর্তনের সুরে গান বেঁধে থাকেন।
রবীন্দ্রনাথের কীর্তনাঙ্গের গান
বাংলা লোকগীতির মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ বাউল গান করেছিল। সুর এবং ভাবের বিচারে রবীন্দ্রনাথের গানে বাউলের প্রভাবও তাই অনেক বেশি। এই বিচারে রবীন্দ্রসঙ্গতে কীর্তনের ভাবের চেয়ে সুরের প্রভাব সর্বাধিক। যে কোনো ধরনের বা অঙ্গের গানের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ উপাদান সংগ্রহ করেছেন অকৃপণভাবে, কিন্তু সে সকল উপাদান তাঁর গানে এসেছে তাঁর নিজস্ব শৈলীবিন্যাসে। যাকে এক কথায় বলা যায়, রাবীন্দ্রিক। শৈশবে রবীন্দ্রনাথ ঢপ্কীর্তনের প্রখ্যাত গায়ক মধুকানের গান শুনেছিলেন। তার একটা প্রভাব ছিল, পরবর্তী সময়ে শিলাইদহ, সাহাজাদপুরে আনোগোনা বা অবস্থানের সূত্রে গ্রামীণ কীর্তনীয়াদের গানও শুনেছিলেন। এসবের প্রভাবকেও অস্বীকার করা যায় না।
রবীন্দ্রনাথের হাতে কীর্তনাঙ্গের সূচনা ঘটেছিল গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে [তথ্য] সূত্রে। এই গানটি ভারতী পত্রিকার কার্তিক ১২৮৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এই গানটি রচনার সঠিক তারিখ জানা যায় না। তবে এই গানটির মাধ্যমেই 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' রচনার সূচনা ঘটে। রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি থেকে জানা যায়- 'একদিন মধ্যাহ্নে খুব মেঘ করিয়াছে। সেই মেঘলাদিনের ছায়াঘন অবকাশের আনন্দে ভিতরের এক ঘরে খাটের উপর উপুড় করিয়া পড়িয়া একটা শ্লেট লইয়া লিখিলাম 'গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে'। [জীবনস্মৃতি। রবীন্দ্ররচনাবলী সপ্তদশ (১৭) খণ্ড, (বিশ্বভারতী, ভাদ্র ১৩৯৩)। পৃষ্ঠা : ৩৪৬-৩৪৭।]।
ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলির ২২টি পদে কীর্তনের বাণীগত ভাব পাওয়া যায়। সুরের বিচারেও কীর্তন হিসাবেও অনেকেই স্বীকার করেছেন। অধ্যাপক ভূদেব চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে এবং গ্রন্থানায় ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীর যে রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এই গানগুলোকে কীর্তন হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ভানুসিংহের পদাবলীর ২২টি গানের ভিতর ৯টি গানের সুর পাওয়া যায়। এগানগুলোতে তিনি সুর দিয়েছিলেন ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে। এছাড়া তিনি বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাসের দুটি পদের সুর দিয়েছিলেন। পদ দুটি হলো- এ ভরাবাদর মাহ ভাদর/বিদ্যাপতি ও সুন্দরী রাধে আওয়ে বনি (গোবিন্দদাস)।
ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী ছাড়া তিনি কীর্তনাশ্রয়ী প্রায় দুই শতাধিক গান রচনা করেছিলেন।
তথ্যসূত্র :
রবীন্দ্রসংগীতের ক্রমবিকাশ ও বিবর্তন। ডঃ দেবজ্যোতি দত্ত মজুমদার।
সহিত্যলোক,
ডিসেম্বর ১৯৮৭।
রবীন্দ্রসঙ্গীত: রাগ-সুর নির্দেশিকা। সুধীর চন্দ।প্যাপিরাস। ডিসেম্বর ২০০২।
রবীন্দ্রনাথের কীর্তনাঙ্গের গান। স্মৃতি চট্টোপাধ্যায়। জুলাই ২০০৯।
জীবনস্মৃতি। রবীন্দ্ররচনাবলী সপ্তদশ (১৭) খণ্ড, (বিশ্বভারতী, ভাদ্র
১৩৯৩)। পৃষ্ঠা : ৩৪৬-৩৪৭।]।