লোকসঙ্গীত
কোনো অঞ্চলের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মুখে মুখে বা বংশ পরম্পরায় কণ্ঠে গীত গান। মানুষের সহজাত সুর ও বোধের মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই গান বিকশিত হয়। এর বিষয় হিসেবে থাকে স্থানীয় মানুষের সাধারণ কর্মপ্রেরণা, মানবিক প্রেম, জীবিকার সাথে সম্পর্কিত আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্থানীয় মানুষের উৎসব ইত্যাদি। এই কারণের লোকগান সর্বার্থে জীবন-যাপনের সম্পৃক্ত থাকে। সুরের বিচারে এই গান কোনো শাস্ত্রীয় বিধির দাসত্ব করে না। গানের শব্দ ব্যাকরণসিদ্ধ প্রমিত রীতকে অনুসরণ করার পরিবর্তে আঞ্চলিক রীতি অনুসারে নির্বাচিত হয়। শব্দের ধ্বনিরূপও আঞ্চলিক রীতি অনুসারে হয়ে থাকে। কখনো কখনো এই গানে আখ্যান হিসেবে উপস্থাপিত। এই আখ্যানের বিষয় থাকে নানা ধরনের লোককাহিনি। স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত প্রেম-উপখ্যান, বীরগাঁথা, অন্যায় অত্যাচরের প্রতিবাদ ইত্যাদি বিষয়নির্ভর লোককাহিনিই সুর ও ছন্দের  আশ্রয়ে লোকগানে হয়ে ওঠে। এর বাইরে বিষয় হিসেবে থাকতে পারে পৌরাণিক বা রূপকথা
লোকগানের মতো লোকনৃত্যও গড়ে উঠে আঞ্চলিক নৃত্যরীতি অনুসরণ করে।

আদিম লোকগানে কথা ও সুর রচয়িতার নাম পাওয়া যায় না। এমন কি এসব গানে ভনিতা বলে কিছু ছিল না। নাগরিক গানের ছোঁয়ায় ভনিতা যুক্ত হতে দেখা যায়। বাংলা গানে এর শুরু হয়েছিল চর্যাপদ থেকে। বাংলা নাগরিক গান চর্যাপদের পরে, বিদ্যাপতি, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ভনিতা দেখতে পাই। পরবর্তী সময়ে ভনিতা লোকশিল্পীরাও যুক্ত করা শুরু করেছিল।

শাস্ত্রীয় অলঙ্কার সর্বস্ব দেহভঙ্গিমা, অঙ্গসঞ্চালন এই নাচে ব্যবহৃত হয় না। বরং সরল ছন্দে প্রাকৃতিক সহজাত সৌন্দর্য লোকনাচের প্রধান বৈশিষ্ট্য। লোক মানুষ নাচার আনন্দের নাচে। কাহিনিভিত্তিক নৃত্যে থাকে অভিনয়ধর্মী অভিব্যক্তি। এর জন্য কৃত্রিম মুদ্রা, অর্থবহ দেহভঙ্গিমা প্রাধান্য পায় না।

গান ও নাচের সঙ্গ দেওয়ার জন্য যে সকল বাদ্য যন্ত্র ব্যবহৃত হয়, তার সবই দেশীয় উপকরণ দিয়ে তৈরি হয়। শিল্পীরা নিজেরাই তৈরি করে নেয়। লোকগানের বাদ্যযন্ত্র প্রকৃতপক্ষে লোকগান বা লোকনৃত্যের অনুষঙ্গী।

লোকগানের শ্রেণিবিন্যাস:
যেহেতু লোকগান আঞ্চলিকতা নির্ভর। তাই শ্রেণি বিভাজনে আঞ্চলিকতাকে প্রথমেই বিবেচনা করা উচিৎ। যে কোনো অঙ্গের গানের শুরুতেই অঞ্চলের নামোল্লেখটা জরুরি। আবার লোকগানের গানের কিছু সুর ও ছন্দের বৈশিষ্ট্য অনুসারে সুরাঙ্গ তৈরি হয়। তাই ভাবগত বিষয়ের পার্থক্য থাকলেও সুর ও ছন্দের চলনে লোকগানকে শনাক্ত করা যায়। যখন কোনো আনকে ঝুমুর, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়, তখন তার সুরের ভঙ্গিমাটার কথাই প্রথমে মনে পড়ে। যখন প্রমিত বাংলায় এই সুরে গান বাঁধা হয়, তখন আঞ্চলিকতার বিচারে বিশুদ্ধ ঝুমুর, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি ইত্যাদি হয়ে উঠে না সত্য, কিন্তু তাকে ঝুমুরাঙ্গ, বা ভাওয়াইয়া অঙ্গের গান বলা হয়।

ধরা যাক ঝুমুর একটি বিশেষ অঙ্গের লোকগান। এই গান হতে পারে মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের। এই গানের বিষয় প্রেম বা পৌরাণিক হতে পারে। এই বিচারে ঝুমুরে শ্রেণিকরণটা হবে-

বিষয়বস্তু ছাড়া গান হয় না। তাই এর পরবর্তী ধাপে বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া উচিৎ। লক্ষ্য করা যায় কোনো বিশেষ ধারার লোক গানে প্রেম, ভক্তি, বীরগাঁথা ইত্যাদি থাকতে পারে। এই বিচারে বিষয় হিসেবে হতে পারে।