শ্রুতি
শ্রুতি হলো- সঙ্গীতোপযোগী যৌগিক ধ্বনি। একটি স্বরাষ্টকে অসংখ্য
সঙ্গীতোপযোগী পাওয়া যায়। শ্রবণযোগ্য প্রতিটি সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিই শ্রুতি।
শ্রাব্যক্ষমতার বিচারে খুব কাছাকাছি শ্রুতিগুলোকে পৃথকভাবে শনাক্ত করা যায় না।
প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীতগুরুরা শ্রবণযোগ্য শনাক্ত করা যায় এমন সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিকে
চিহ্নিত করেছিলেন।
আধুনিক শব্দবিজ্ঞানের মতে একই কম্পাঙ্কযুক্ত এক বা একাধিক শব্দের সমন্বিত রূপ চিত্তরঞ্জনকারী। পক্ষান্তরে বহুকম্পাঙ্কযুক্ত শব্দ কোলাহলধর্মী। সঙ্গীতে এই চিত্তরঞ্জনকারী ধ্বনিই হলো সঙ্গীতোপযোগী
(musical)
পক্ষান্তরে কোলাহলধর্মী শব্দ সঙ্গীত-অনুপযোগী।
শনাক্তকৃত নির্ণিত শ্রুতির ক্রমধারায় অনুসরণ করে, তাঁরা লক্ষ্য করেছিলেন যে,- খাদের
কোনো একটি শ্রুতি উচ্চতর শ্রুতির সাথে মিলিত হলে একটি একক শ্রুতিতে পরিণত হয়ে যায়।
এই সূত্রে নির্ধারিত হয়েছিল- শ্রুতি সোপান। এরপর এই সোপানের ভিতরে শনাক্তকৃত
শ্রুতিগুলোর নামকরণ করেছিলেন। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে নারদ তাঁর 'শিক্ষা'
গ্রন্থে মাত্র ৫টি শ্রুতিকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। এগুলো হলো- দীপ্তা, আয়তা,
করুণা, মৃদু ও মধ্যা।
নানা সঙ্গীত গবেষকদের গবেষণার সূত্রে- ৬৬টি শ্রুতি ধারণা পাওয়া গিয়েছিল। কালক্রমে এর সংখ্যা নেমে হয়েছিল ২২টি। এই শ্রুতিগুলো যে পৃথকভাবে সব সময় অনুভব বা শ্রবণ করা সহজসাধ্য নয়। এ কথা প্রাচীন সঙ্গীতগুরুরা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই এঁরা শ্রুতির ব্যাখ্যায় এঁরা কিছু বিমূর্ত ধারণা উপস্থাপন করেছিলেন। সঙ্গীতরত্নকরের এরূপ ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে― মানব দেহের ১৪টি নাড়ির ভিতর ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ি থেকে ২২টি অপ্রত্যক্ষ নাড়ি নির্গত হয়েছে। এই নাড়িগুলো ক্রমিক উচ্চ উচ্চতর রূপে অবস্থান করে এবং এই নাড়িগুলোর দ্বারা শ্রুতি উপলব্ধি করা যায়। এই বিচারে শ্রুতির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২টি। এই ২২টি শ্রুতির উপর স্থাপন করা হয়েছে সঙ্গীতের স্বরসমূহ।
ভরতের নাট্যশাস্ত্রে শ্রুতির সংখ্যা ২২টি। গ্রামভেদে এই
শ্রুতিতে স্বর বিন্যাস ছিল ভিন্নতর। যেমন-
- ষড়্জ গ্রামে শ্রুতি: ষড়্জে ৪ শ্রুতি, ঋষভে ৩টি
শ্রুতি, গান্ধারে ২ শ্রুতি, মধ্যম চার শ্রুতি ও পঞ্চমে চার শ্রুতি, ধৈবতে তিন
শ্রুতি এবং নিষাদে ২ শ্রুতি।
- মধ্যম গ্রামে শ্রুতি বিন্যাস:
ষড়্জে ৪ শ্রুতি, ঋষভে ৩টি শ্রুতি, গান্ধারে ২ শ্রুতি,
মধ্যম ৪ শ্রুতি ও পঞ্চমে ৩ শ্রুতি, ধৈবতে ৪ শ্রুতি এবং নিষাদে ২ শ্রুতি।
স্বরগুলোকে শ্রুতি অনুসারে বিভাজনের
ক্ষেত্রে মতভেদ ছিল। নিচে সঙ্গীতপারিজাত ও সঙ্গীতরত্নাকরের তুলনামূলক সারণী দেওয়া
হলো-
শ্রুতি সংখ্যা ও নাম |
জাতি |
সঙ্গীতপারিজাত |
সঙ্গীতরত্নাকর |
১.
তীব্রা |
দীপ্তা |
তীব্র নিষাদ |
কৈশিকী নিষাদ |
২.
কুমুদ্বতী |
আয়তা |
তীব্রতর নিষাদ |
কাকলি নিষাদ |
৩.
মন্দা |
মৃদু |
তীব্রতম নিষাদ |
চ্যুত ষড়্জ |
৪.
ছন্দোবতী |
মধ্যা |
ষড়্জ
(স) |
স |
৫.
দয়াবতী |
করুণা |
পূর্ব ঋষভ |
― |
৬.
রঞ্জনী |
মধ্যা |
কোমল ঋষভ |
― |
৭. রক্তিকা |
মৃদু |
ঋষভ বা পূর্ব গান্ধার |
শুদ্ধ
ঋষভ |
৮.
রৌদ্রী |
দীপ্তা |
তীব্রতর ঋষভ/কোমল গান্ধার |
― |
৯. ক্রোধা |
আয়তা |
শুদ্ধ গান্ধার |
শুদ্ধ গান্ধার |
১০.
বজ্রিকা |
দীপ্তা |
তীব্র গান্ধার |
সাধারণ গান্ধার |
১১.
প্রসারিণী |
আয়তা |
তীব্রতর গান্ধার |
অন্তর গান্ধার |
১২.
প্রীতি |
মৃদু |
তীব্রতম গান্ধার |
চ্যুত মধ্যম |
১৩.
মার্জনী |
মধ্যা |
মধ্যম/অতি তীব্রতম গান্ধার |
শুদ্ধ মধ্যম |
১৪.
ক্ষিতি |
মৃদু |
তীব্র মধ্যম |
― |
১৫.
রক্তা |
মধ্যা |
তীব্রতর মধ্যম |
― |
১৬.
সন্দীপিনী |
আয়তা |
তীব্রতম মধ্যম |
মধ্যমগ্রামোক্ত বা কৌশিক পঞ্চম |
১৭.
আলাপিনী |
করুণা |
পঞ্চম |
পঞ্চম |
১৮.
মদন্তী |
করুণা |
পূর্ব ধৈবত |
― |
১৯.
রোহিণী |
আয়তা |
কোমল ধৈবত |
― |
২০.
রম্যা |
মধ্যা |
ধৈবত/পূর্ব নিষাদ |
শুদ্ধ ধৈবত |
২১.
উগ্রা |
দীপ্তা |
তীব্র ধৈবত বা কোমল নিষাদ |
― |
২২.
ক্ষোভিণী |
মধ্যা |
তীব্র নিষাদ/তীব্রতর নিষাদ |
শুদ্ধ নিষাদ |
শ্রুতিতে স্বরের অবস্থান নিয়ে মতটা
বর্তমানে প্রচলিত আছে
তা হলো-
শ্রুতি সংখ্যা ও নাম |
প্রচলিত স্বর |
প্রচলিত
আকারমাত্রিক
স্বরচিহ্ন |
১.
তীব্রা |
ষড়্জ |
স |
২.
কুমুদ্বতী |
অতি কোমল ঋষভ |
ঋ১ |
৩.
মন্দা |
কোমল ঋষভ |
ঋ |
৪.
ছন্দোবতী |
অনুকোমল ঋষভ |
ঋ২ |
৫.
দয়াবতী |
শুদ্ধ ঋষভ |
র |
৬.
রঞ্জনী |
অতি
কোমল
গান্ধার |
জ্ঞ১ |
৭. রক্তিকা |
কোমল
গান্ধার |
জ্ঞ |
৮.
রৌদ্রী |
গান্ধার |
গ |
৯. ক্রোধা |
- |
|
১০.
বজ্রিকা |
শুদ্ধ মধ্যম |
ম |
১১.
প্রসারিণী |
- |
|
১২.
প্রীতি |
কড়ি মধ্যম |
হ্ম |
১৩.
মার্জনী |
- |
|
১৪.
ক্ষিতি |
পঞ্চম |
প |
১৫.
রক্তা |
অতি কোমল ধৈবত |
দ১ |
১৬.
সন্দীপিনী |
কোমল ধৈবত |
দ |
১৭.
আলাপিনী |
অনুকোমল ধৈবত |
দ২ |
১৮.
মদন্তী |
শুদ্ধ ধৈবত |
ধ |
১৯.
রোহিণী |
অতি
কোমল
নিষাদ |
ণ১ |
২০.
রম্যা |
কোমল
নিষাদ |
ণ |
২১.
উগ্রা |
নিষাদ |
ন |
২২.
ক্ষোভিণী |
- |
|
আধুনিককালে শ্রুতির মান নির্ধারণ করা হয় ধ্বনির
কম্পাঙ্কের বিচারে। নানা রকম গাণিতিক সূত্রের সাহায্যে শ্রুতির সাথে পাশ্চাত্য
কম্পাঙ্ক-নির্দেশক মানের সাথে সমন্বয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রকৃত অর্থে ভারতীয়
সঙ্গীতের শ্রুতিকে গণিতের নিয়মে বাধা যায় নাই।
বর্তমানে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সাথে সমন্বয় করে
শ্রুতির যে কম্পাঙ্কমান নির্ধারণ করা হয়ে থাকে, তা হলো-
শ্রুতি |
12-TET Notes |
Name |
Ratio |
Cents |
Frequency
(Hz) |
Name |
Frequency
(Hz) |
ক্ষোভিণী |
1 |
0 |
261.6256 |
C |
261.6256 |
তীব্রা |
256/243 |
90 |
275.6220 |
C♯ |
277.1826 |
কুমুদ্বতী |
16/15 |
112 |
279.0673 |
মন্দা |
10/9 |
182 |
290.6951 |
D |
293.6648 |
ছন্দোবতী |
9/8 |
203 |
294.3288 |
দয়াবতী |
32/27 |
294 |
310.0747 |
D♯ |
311.1270 |
রঞ্জনী |
6/5 |
316 |
313.9507 |
রক্তিকা |
5/4 |
386 |
327.0319 |
E |
329.6275 |
রৌদ্রী |
81/64 |
407 |
331.1198 |
ক্রোধা |
4/3 |
498 |
348.8341 |
F |
349.2282 |
বজ্রিকা |
27/20 |
519 |
353.1945 |
প্রসারিণী |
45/32 |
590 |
367.9109 |
F♯ |
369.9944 |
প্রীতি |
729/512 |
612 |
372.5098 |
মার্জনী |
3/2 |
702 |
392.4383 |
G |
391.9954 |
ক্ষিতি |
128/81 |
792 |
413.4330 |
G♯ |
415.3047 |
রক্তা |
8/5 |
814 |
418.6009 |
সন্দীপিনী |
5/3 |
884 |
436.0426 |
A |
440.0000 |
আলাপিনী |
27/16 |
906 |
441.4931 |
মদন্তী |
16/9 |
996 |
465.1121 |
A♯ |
466.1638 |
রোহিণী |
9/5 |
1017 |
470.9260 |
রম্যা |
15/8 |
1088 |
490.5479 |
B |
493.8833 |
উগ্রা |
243/128 |
1110 |
496.6798 |
ক্ষোভিণী |
2 |
1200 |
523.2511 |
C |
523.2511 |
তথ্যসূত্র: