দক্ষিণ ভারতীয় তাল
অন্য নাম কর্ণাটী তাল।

ভারত উপমহাদেশের দাক্ষিণ্যাতে প্রচলিত সঙ্গীত পদ্ধতিতে ব্যবহৃত তালকে সাধারণভাবে দক্ষিণ ভারতীয় তাল বলা হয়। অন্যদিক দক্ষিণ ভারতে অন্যতম প্রদেশ কর্ণাটকে প্রচলিত তাল হিসেবে কর্ণাটী তাল বলা হয়। কর্ণাটী তালের কোনো ফাঁক বা খালি নাই।

এক সময় কর্ণাটী তালের সংখ্যা ছিল ১০৮টি। বর্তমান কালে তালের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৩৫টি। তবে কর্ণাটি পদ্ধতিতে মূল তালের সংখ্যা ৭টি। এই তালগুলো হলো- ধ্রুবতাল, মঠতাল, রূপকতাল, ঝম্পতাল, ত্রিপুটতাল, অঠতাল ও একতাল। এই মূল তালের প্রত্যেকটির রয়েছে ৫টি করে জাতি। এই জাতিগুলো হলো- চতস্রজাতি, তিস্রজাতি, মিশ্রজাতি, খণ্ডজাতি ও সঙ্কীর্ণজাতি। সব মিলিয়ে তালের সংখ্যা দাঁড়ায় মোট ৩৫টি।

কর্ণাটী পদ্ধতিতে মাত্রা ৬ প্রকার। প্রতিটি মাত্রার জন্য পৃথক পৃথক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। এগুলো হলো-

মাত্রা নাম

মাত্রা মান

চিহ্ন

অনুদ্রুত বা বিরাম

১ মাত্রা

দ্রুত    

২ মাত্রা

0

লঘু

৪ মাত্রা

|

গুরু

৮ মাত্রা

S

প্লুত

১২ মাত্রা

কাকপদ

১৬ মাত্রা

+


অনেকে এই ৬টি প্রকরণের সাথে, আরও দুটি প্রকরণের উল্লেখ করে থাকেন। এই দুটি প্রকারণ হলো-

মাত্রা নাম

মাত্রা মান

চিহ্ন

দ্রুত বিরাম

৩ মাত্রা

লঘু বিরাম

৬ মাত্রা


বর্তমানে মাত্রার জন্য তিনটি চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। এই চিহ্নগুলো হলো- অনদ্রুত, দ্রুত ও লঘু। এর ভিতরে তালের জাতিভেদে লঘু মাত্রার প্রয়োগ সংখ্যার হেরফের ঘটে থাকে। যেমন-

চতস্র জাতিতে লঘু মাত্রা ৪টি ব্যবহৃত হয়
তিস্র জাতিতে লঘু মাত্রা ৩টি ব্যবহৃত হয়
মিশ্র জাতিতে লঘু মাত্রা ৭টি ব্যবহৃত হয়
খণ্ড জাতিতে লঘু মাত্রা ৫টি ব্যবহৃত হয়
সঙ্কীর্ণ জাতিতে লঘু মাত্রা ৯টি ব্যবহৃত হয়

জাতি অনুসারে প্রতিটি তালের মাত্রা সংখ্যা এবং ছন্দবিভাজন পৃথক পৃথক হয়ে থাকে। নিচে জাতি অনুসারে তালের বিভাগ, ং মাত্রা বিন্যাস এবং তালচিহ্ন দেখানো হলো।

 

চতস্র জাতিতে তালের বিন্যাস

 

তালের নাম তালের বিভাগ তালের মাত্রা বিন্যাস মাত্রা সংখ্যা তালের চিহ্ন
ধ্রুবতাল ৪+২+৪+৪ ১৪

o।।

মঠতাল ৪+২+৪ ১০ o
রূপকতাল ৪+২ o
ঝম্পতাল ৪+১+২ o
ত্রিপুটতাল ৪+২+২ oo
অঠতাল ৪+৪+২+২ ১২ ।।oo
একতাল
 

 

তিস্র জাতিতে তালের বিন্যাস

 

তালের নাম তালের বিভাগ তালের মাত্রা বিন্যাস মাত্রা সংখ্যা তালের চিহ্ন
ধ্রুবতাল ৩+২+৩+৩ ১১

o।।

মঠতাল ৩+২+৩ o
রূপকতাল ৩+২ o
ঝম্পতাল ৩+১+২ o
ত্রিপুটতাল ৩+২+২ oo
অঠতাল ৩+৩+২+২ ১০ ।।oo
একতাল
 

 

মিশ্র জাতিতে তালের বিন্যাস

 

তালের নাম তালের বিভাগ তালের মাত্রা বিন্যাস মাত্রা সংখ্যা তালের চিহ্ন
ধ্রুবতাল ৭+২+৭+৭ ২৩

o।।

মঠতাল ৭+২+৭ ১৬ o
রূপকতাল ৭+২ o
ঝম্পতাল ৭+১+২ ১০ o
ত্রিপুটতাল ৭+২+২ ১১ oo
অঠতাল ৭+৩+২+২ ১৮ ।।oo
একতাল
 

খণ্ড জাতিতে তালের বিন্যাস

 

তালের নাম তালের বিভাগ তালের মাত্রা বিন্যাস মাত্রা সংখ্যা তালের চিহ্ন
ধ্রুবতাল ৫+২+৫+৫ ১৭

o।।

মঠতাল ৫+২+৫ ১২ o
রূপকতাল ৫+২ o
ঝম্পতাল ৫+১+২ o
ত্রিপুটতাল ৫+২+২ oo
অঠতাল ৫+৫+২+২ ১৪ ।।oo
একতাল
 

সঙ্কীর্ণ জাতিতে তালের বিন্যাস

 

তালের নাম তালের বিভাগ তালের মাত্রা বিন্যাস মাত্রা সংখ্যা তালের চিহ্ন
ধ্রুবতাল ৯+২+৯+৯ ২৯

o।।

মঠতাল ৯+২+৫ ২০ o
রূপকতাল ৯+২ ১১ o
ঝম্পতাল ৯+১+২ ১২ o
ত্রিপুটতাল ৯+২+২ ১৩ oo
অঠতাল ৯+৯+২+২ ২২ ।।oo
একতাল

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, দক্ষিণ ভারতীয় পদ্ধতিতে ৩৫টি তাল। প্রতিটি তালের পৃধক নাম রয়েছে। এই তালগুলো ৭টি মূল তালের (ধ্রুবতাল, মঠতাল, রূপকতাল, ঝম্পতাল, ত্রিপুটতাল, অঠতাল ও একতাল) এবং ৫টি জাতি'র (চতস্রজাতি, তিস্রজাতি, মিশ্রজাতি, খণ্ডজাতি ও সঙ্কীর্ণজাতি) অন্তর্ভুক্ত। এই মূল তালের অন্তর্গত বিশেষ একটি তাল মূল তালের প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন শ্রীকর নামক তালটি.  ধ্রুবতালের পরিচায়ক। নিচে ৩৫টি তালের নাম ও পরিচয় তুলে ধরা হলো।
 

ধ্রুবতালের পরিচায়ক তাল হলো- শ্রীকরতাল
মূল তাল অধীনস্ত নাম জাতি মাত্রা বিন্যাস মাত্রা সংখ্যা তাল-চিহ্ন
ধ্রুবতাল মণি তিস্র ৩+২+৩+৩ ১১ ।o।।
ধ্রুবতাল শ্রীকর চতস্র ৪+২+৪+৪ ১৪ ।o।।
ধ্রুবতাল প্রমাণ খণ্ড ৫+২+৫+৫ ১৭ ।o।।
ধ্রুবতাল পূর্ণ মিশ্র ৭+২+৭+৭ ২৩ ।o।।
ধ্রুবতাল ভূবন সংকীর্ণ ৯+২+৯+৯ ২৯ ।o।।

মত্ততালের পরিচায়ক তাল হলো- সমতাল
মূল তাল অধীনস্ত নাম জাতি মাত্রা বিন্যাস মাত্রা সংখ্যা তাল-চিহ্ন
মত্ততাল সার তিস্র ৩+২+৩ ।o।
মত্ততাল সম চতস্র ৪+২+৪ ১০ ।o।
মত্ততাল উদয় খণ্ড ৫+২+৫ ১২ ।o।
মত্ততাল উদীর্ণ মিশ্র ৭+২+৭ ১৬ ।o।
মত্ততাল রাও সংকীর্ণ ৯+২+৯ ২০ ।o।

রূপকতালের পরিচায়ক তাল হলো- পত্তিতাল
মূল তাল অধীনস্ত নাম জাতি মাত্রা বিন্যাস মাত্রা সংখ্যা তাল-চিহ্ন
রূপকতাল চক্র তিস্র ৩+২ o
রূপকতাল পত্তি চতস্র ৪+২ o
রূপকতাল বাজ খণ্ড ৫+২ o
রূপকতাল কূল মিশ্র ৭+২ o
রূপকতাল বিন্দু সংকীর্ণ ৯+২ ১১ o


ঝম্পতালের পরিচায়ক তাল হলো- সুরতাল
মূল তাল অধীনস্ত নাম জাতি মাত্রা বিন্যাস মাত্রা সংখ্যা তাল-চিহ্ন
ঝম্পতাল কদম্ব তিস্র ৩+১+২ o
ঝম্পতাল মধুর চতস্র ৪+১+২ o
ঝম্পতাল চন খণ্ড ৫+১+২ o
ঝম্পতাল সুর মিশ্র ৭+১+২ ১০ o
ঝম্পতাল কর সংকীর্ণ ৯+১+২ ১২ o


ত্রিপুটতালের পরিচায়ক তাল হলো- শঙ্খতাল
মূল তাল অধীনস্ত নাম জাতি মাত্রা বিন্যাস মাত্রা সংখ্যা তাল-চিহ্ন
ত্রিপুটতাল শঙ্খ তিস্র ৩+২+২ ।oo
ত্রিপুটতাল আদি চতস্র ৪+২+২ ।oo
ত্রিপুটতাল দুষ্কর খণ্ড ৫+২+২ ।oo
ত্রিপুটতাল লীল মিশ্র ৭+২+২ ১১ ।oo
ত্রিপু্টতাল ভোগ সংকীর্ণ ৯+২+২ ১৩ ।oo

অটতালের পরিচায়ক তাল হলো- বিদলতাল
মূল তাল অধীনস্ত নাম জাতি মাত্রা বিন্যাস মাত্রা সংখ্যা তাল-চিহ্ন
অঠতাল গুপ্ত তিস্র ৩+৩+২+২ ১০ ।।oo
অঠতাল লেখা চতস্র ৪+৪+২+২ ১২ ।।oo
অঠতাল বিদল খণ্ড ৫+৫+২+২ ১৪ ।।oo
অঠতাল লয় মিশ্র ৭+৭+২+২ ১৮ ।।oo
অঠতাল ধীর সংকীর্ণ ৯+৯+২+২ ২০ ।।oo

একতালের পরিচায়ক তাল হলো- মানতাল
মূল তাল অধীনস্ত নাম জাতি মাত্রা বিন্যাস মাত্রা সংখ্যা তাল-চিহ্ন
একতাল সূত তিস্র
একতাল মান চতস্র
একতাল রথ খণ্ড
একতাল রাগ মিশ্র
একতাল বসু সংকীর্ণ

মার্গ না তাল প্রদর্শন
দক্ষিণ ভারতীয় পদ্ধতিতে তাল প্রদর্শন করার রীতি রয়েছে। এই বিশেষ রীতিকে মার্গ বলা হয়। এক্ষেত্রে তালের মাত্রা, পদ, গতিভঙ্গি, তালি ও খালি প্রদর্শন করা হয়। শাস্ত্রানুসারে চার প্রকার মার্গের কথা বলা হয়ে থাকে। এর লেখ্য রূপ এবং হস্ত-নির্দেশক রূপ লক্ষ করা যায়।
 
লেখ্য-রূপ:

১. ধ্রুবমার্গ: একমাত্রার পদের প্রথম মাত্রায় তালাঘাত করা হয়। যেমন:  ১
২. চিত্রমাত্রিক: দ্বিমাত্রিক পদ এবং এর প্রথম মাত্রায় তালি ও দ্বিতীয় মাত্রায় ফাঁক। যেমন: ১ 
৩. বার্তিক মার্গ: চতু্রমাত্রিক পদ। প্রথম মাত্রায় তালি। তিনটি মাত্রায় খালি। যেমন: ১ 
৪. দক্ষিণ মাত্গ: অষ্টমাত্রিক পদ। প্রথম মাত্রায় তালি। তিনটি মাত্রায় খালি। যেমন: ১

ক্রিয়া-রূপ:
হাতের সাহায্যে তালের তালি, খালি, মাত্রা ইত্যাদি প্রদর্শন করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ক্রিয়া। ক্রিয়া হাতের দ্বারা উৎপন্ন শব্দ দ্বারা বা ইশারার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। এই বিচারে ক্রিয়াকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলো-

  • সশব্দ ক্রিয়া:
    এই প্রক্রিয়ায় হাতের মাধ্যমে শব্দ তৈরি করে তালকে প্রকাশ করা হয়। সশব্দ তৈরির প্রক্রিয়া অনুসারে সশব্দ ক্রিয়াকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। এ্‌ই ভাগ চারটি হলো-

    ১. ধ্রুব: মধ্যমা এবং বৃদ্ধাঙ্গুলী তুড়ি বাজানো হয়।
    ২. শম্পা: বাম হাত দিয়ে ডান হাতে আঘাত করে শব্দ তৈরি করা হয়।
    ৩. তাল: ডান হাত দিয়ে বাম হাতে আঘাত করে শব্দ তৈরি করা হয়।
    ৪. সন্নিপাত: উভয় হাতের আঘাতে তালি বাজানো হয়।

  • নিঃশব্দ ক্রিয়া
    এই প্রক্রিয়া তাল প্রদর্শনের সময় হাতে কোনো শব্দ উৎপন্ন করা হয় না। এই প্রক্রিয়াটি দুই ভাবে প্রকাশ করা হয়। এই প্রক্রিয়া দুটি সাধারণ নিঃশব্দ ক্রিয়া ও  বিসর্জিতম।

    সাধারণ ক্রিয়া: এই প্রক্রিয়ার ক্রিয়া চার প্রকার। যথা-

    ১. আবাপ: আঙুল কুঞ্চিত করে বাঁ হাত উপরে তোলা হয়।
    ২. নিষ্ক্রাম: হাত উত্তলিত করে আঙুল প্রসারিত করা হয়।
    ৩. বিক্ষেপ: প্রসারিত বাম হাত ডান দিকে স্থাপন করা হয়।
    ৪. প্রবেশক: হাতকে মুষ্ঠিবদ্ধ করে নিচে নামানো হয়।

    বিসর্জিতম
    বিসর্জিতম তিন প্রকার। এই প্রকার তিনটি হলো-

১. পতাঙ্ক বিসর্জিতম: হাত উপরে উঠানো হয়।
২. কৃষয় বিসর্জিতম: হাত বাম দিকে দেখানো হয়।
৩. সর্পিণী বিসর্জিতম: হাত ডান দিকে দেখানো হয়।

কলা ও কলাপাত
তালের আবর্তনে তালি প্রকাশ করা হয় সশব্দে এবং খালি প্রকাশ করা হয় নিঃশব্দে। দক্ষিণ ভারতীয় তাল পদ্ধতিতে নিঃশব্দের তাল প্রকাশের ক্রিয়াকে বলা হয় কলা। আর সশব্দে তালের প্রকাশকে বলা হয় কলাপাত। ভরত 'কলা'কে মন্দলয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে কলার গতি দ্বারা তালের গতি নির্ধারিত হয়। এর একটি মাত্রাগত মান রয়েছে। এই মান হলো আট মাত্রার সমান। এই বিচারে দ্বিকলা হবে ৩২ মাত্রা এবং চতুষ্কলা হবে ৩২ মাত্রা।

শাস্ত্রীয় তালের কলার প্রকৃত রূপ নির্ধারিত হয় লঘু মাত্রার বিচারে। ৬টি লঘু মত্রা নিয়ে গঠিত এই কলাকে বলা হয় যথাক্ষর।

লয় প্রকৃতি
সাধারণভাবে তালের গতিকে লয় বলা হয়। লয়ের গতি-প্রকৃতি অনুসারে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগগুলো যতি নামে পরিচিত। পাঁচ প্রকার যতি হলো-

১. সমাযতি: যখন তালের গতি সব সময় একই থাকে।
২. সরিৎযতি: যখন তালের শুরুতে গতি থাকে বিলম্বিত, কিন্তু মধ্যে মধ্য লয় ও অন্তে লয় দ্রুত হয়। এর অপর নাম স্রোতাগতা।
৩. গোপুচ্ছযতি: যখন তালের শুরুতে গতি থাকে দ্রুত, কিন্তু মধ্যে মধ্য লয় ও অন্তে লয় বিলম্বিত হয়।
৪. মৃদঙ্গযতি:  যখন তালের শুরু এবং অন্তে গতি থাকে বিলম্বিত, কিন্তু মধ্যে মধ্য ও দ্রুত লয়ের মিশ্রণ হয়।
৫. পিপীলিকা-যতি: যখন তালের শুরু এবং অন্তে গতি থাকে বিলম্বিত, কিন্তু মধ্য দ্রুত লয়ের মিশ্রণ হয়। এর অপর নাম ডমরুযতি।


সূত্র:

  • তাল অভিধান। মানস দাশগুপ্ত। প্রকাশিকা মমতা দাশগুপ্তা। জ্যৈষ্ঠ ১৪০২।পৃষ্ঠা:১২৭

  • সঙ্গীতশাস্ত্র (তৃতীয় খণ্ড)। ইন্দুভূষণ রায়। আদি নাথ ব্রাদার্স। জানুয়ারি ২০১৮। পৃষ্ঠা:২৫