ষষ্ঠী তাল
রবীন্দ্রসঙ্গীতে ব্যবহৃত ছয় মাত্রা বিশিষ্ঠ একটি তাল বিশেষ। উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতে এইরূপ ছন্দের কোনো তাল নেই। তবে দক্ষিণ ভারতীয় পদ্ধতিতে এই তালটি পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ এই দক্ষিণ ভারতীয় তালটি তাঁর গানে সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ যেভাবে এই তালটির সাথে পরিচিত হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে শান্তিদেব ঘোষ তাঁর ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত' নামক গ্রন্থের ১৪২-৪৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন।
“গুরুদেব, এই ছন্দের তালটি তাঁর গানে ব্যবহার করলেও তার নামকরণ তিনি করে যান নি। ২-৪ মাত্রার, কর্ণাটি রূপক তালের ছন্দে তিনি, ১৩২৯ সালে প্রথম যে গানটি রচনা করেছিলেন সেটি হল, “আমার যদিই বেলা যায় গা বয়ে”। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এর পূর্বে তিনি এই ছন্দ বা তালটি তাঁর গানে ব্যবহার কেন করেন নি ? এর কারণ হল, ১৯১৮ খৃষ্টাব্দের পর, এই ছন্দটির সঙ্গে গুরুদেবের ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ।”
 
 “অন্ধপ্রদেশস্থিত পিঠাপুরম রাজদরবারের প্রখ্যাত কর্ণাটি সংগীতজ্ঞ বীণাবাদক, সঙ্গমেশ্বর শাস্ত্রী, সেযুগে মাঝে মাঝে শান্তিনিকেতনে এসে বেশ কয়েক মাস থাকতেন। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় গুরুদেব এবং শান্তিনিকেতনবাসীদের বীণা বাজিয়ে শোনাতেন। সেই যুগের, কিছু অধ্যাপক এবং ছাত্রছাত্রীরা, তাঁর কাছে বীণা বাজানো শিক্ষা গ্রহণ করতেন। এইভাবে তিনি, ইংরেজি ১৯২৫ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকবার শান্তিনিকেতনে এসে, কয়েক মাস থেকে, বীণার বাজনা শুনিয়েছেন এবং বীণা বাজাতে শিখিয়েছেন। তাঁর কাছে বীণার শিক্ষা শুরু হত ‘মায়ামালব গৌড়’ রাগের নানাবিধ ছন্দবহুল পাল্টা’, রূপকতালের ‘সারগম’ ও একটি গান দিয়ে তিনি যখন সন্ধ্যায় সকলকে বীণা বাজিয়ে শোনাতেন, তখন তাতে প্রায়ই নানা রাগিণীতে গঠিত ২-৪ মাত্রার রূপক তালের কিছু গানও থাকত।”
 
দক্ষিণ ভারতীয় সপ্ততালের মধ্যে ‘রূপক’ তালের চতুরস্র ক্রমিক সংখ্যার অন্তর্ভুক্ত। ব্যবহারিক নাম ‘পত্তি’। বি. বটব্যাল তাঁর ‘তবলা শিক্ষা' গ্রন্থে এই তালটির একটি ঠেকা লিপিবদ্ধ করেছেন। উক্ত গ্রন্থানুসারে দক্ষিণ ভারতীয় এই তালটির ঠেকা নিম্নরূপ-

  +               +
 

 

 

 

       
I

ধা

ধিন্

ধা

তু

না

I ধা
 

 

   

 

প্রসঙ্গক্রমে শান্তিদেব ঘোষ তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত গ্রন্থের ১৪৩-৪৫ পৃষ্ঠায় আরো একটি তথ্য দিয়েছেন উক্ত তথ্যটির গুরুত্ব বিবেচনা করে, এখানে তা হুবহু তুলে ধরা গল তথ্যটি হলো-

 “২-৪ মাত্রার এইরূপ একটি তাল, ১২৯৮ সালে (১৮৯৩),  গুরুদেবের পরিবারে পরীক্ষামূলকভাবে, নামসহ প্রচলনের চেষ্টা যে করা হয়েছিল, সম্প্রতি তার সন্ধান পাওয়া গল। গুরুদেবের ভ্রাতুষ্পুত্র, হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, একটি ব্রহ্মসংগীতে এইরূপ একটি তাল ব্যবহার করেছিলেন। তিনি সংখ্যামাত্রিক স্বরলিপিতে, ১৮১৪ শকাব্দের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়, ‘লচ্ছাসার’ রাগে এবং ‘চপক’ তালে, ‘জয় জয় ব্রহ্মণ ব্রহ্মণ, মহাদেব, ভূমা ভূমা, অজর অমর’ শীর্ষক একটি গান প্রকাশ করেন। ‘চপক’ তালটি, সে যুগে উত্তর ভারতীয় সংগীত-রসিকদের মধ্যে অজানা ছিল বলেই বোধ হয়, স্বরলিপির সঙ্গে তার পরিচয় দিয়ে, তিনি লিখেছিলেন- “চপক তালটি অনেকটা সুরফাঁকতালের মত। সুরফাঁকতাল তিনটি তালিতে বিভক্ত। তাহার প্রথম এবং সর্বশেষ তালি প্রত্যেক চারি মাত্রা এবং মধ্যের তালি দুই মাত্রা অধিকার করিয়া থাকে। এই সুরফাঁকতালের প্রথম তালবিভাগটি ছাড়িয়া দিয়া অবশিষ্ট তালিবিভাগ রাখিয়া দিলেই তাহা চপক তালের তালিবিভাগ হইল। সুরফাঁকতালের যেমন প্রথম তালিতে সম চপকতালেরও সেইরূপ প্রথম তালিতে সম পড়ে।” এই তালটি কিভাবে তিনি পেয়েছিলেন, বা নতুন সৃষ্টি কিনা সেইরূপ কোনো কথা তিনি পরিষ্কার করে বলেন নি। হিতেন্দ্রনাথের বক্তব্যটিকে মাত্রাবিভাগের দ্বারা বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করেছি।
 
সুরফাঁকতাল মোট ১০ মাত্রার তাল। দুই প্রকার মাত্রা ভাগে, এই তালটি সংগীতজ্ঞদের মধ্যে প্রচলিত। যথা-

       +                  ২       ৩ 
১.    ১  ২  ৩  ৪  ।  ৫  ৬ । ৭  ৮  ৯  ১০  অর্থাৎ এইরূপ সুরফাঁকতালে, সম সমেত মোট তিনটি তালি পড়ে, কোনো ফাঁক নেই।

       +       ০          ২        ৩       ০
২.    ১  ২ । ৩  ৪  ।  ৫  ৬ । ৭  ৮।  ৯  ১০  অর্থাৎ এতে সম সমেত মোট তিনটি তালির সহিত দুটি ফাঁক দেখাবার রীতি প্রচলিত। গুরুদেব এবং তাঁর আত্মীয়দের গানে দুই রকমের সুরফাঁকতালই ব্যবহৃত হয়েছে। হিতেন্দ্রনাথ, ফাঁকবিহীন সুরফাঁকতালের সাহায্যে যে ‘চপক’ তালটির উদ্ভাবনের কথা বলেছিলেন, তাঁর উপরের উদ্ধৃত উক্তি থকে তা অনুমান করা যায়।”

উল্লিখিত বিষয়াবলী থেকে আমরা নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তসমূহে আসতে পারি।

ক. ২-৪ ছন্দের এই তালটি দক্ষিণ ভারতীয় পদ্ধতির একটি তাল।
খ. রবীন্দ্রনাথের পূর্বে এই তালের চর্চা প্রথম করেন, তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র হিত্রেনাথ ঠাকুর।
গ. রবীন্দ্রনাথ পিঠাপুরম রাজদরবারের প্রখ্যাত কর্ণাটি বীণাবাদক- সঙ্গমেশ্বরর শাস্ত্রী’র কাছে এই ছন্দটি শুনে, তাঁর গানে এই তাল প্রয়োগের ব্যাপারে উৎসাহিত হন।
 
রবীন্দ্রনাথ এই ২।৪ ছন্দের এই তালটির কোনো নামকরণ করে যান নি। প্রথম কে এই ছন্দটিকে ‘ষষ্ঠী’ নামে চিহ্নিত করেছিলেন, তা জানা যায় না। তবে বর্তমানে এই ছন্দটি ‘ষষ্ঠী’ নামেই পরিচিত।

মাত্রা সংখ্যা:
ছন্দপ্রকৃতি: বিষমপদী। ২/৪
তালি: ২টি
খালি: নাই

প্রথম নমুনা

 

+

 

 

 

      +
I

ধা

গে

ধা

গে

তে

টে  I

ধা

 

 

 

 


দ্বিতীয় নমুনা

 

+

 

 

 

      +
I

ধিন্

না

ধা

ধিন্

ধিন্

না I

ধিন্

 

 

 

তথ্যগত দিক থেকে বিবেচনা করলে, এই তালটিকে রবীন্দ্রনাথের উদ্ভাবিত তাল হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। কিন্তু বাংলা গানে এই তালের সার্থকভাবে প্রয়োগ ও প্রচলনের ক্ষেত্রে, তিনিই একমাত্র কৃতিত্বের দাবীদার হতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ৩৭টি গানে, এই তালটি ব্যবহার করেছেন।