সীতা
অযোনিজন্মা,
অযোনিজা,
অযোনিসম্ভবা,
অযোনিসম্ভূতা।
হিন্দু পৌরাণিক
কাহিনি মতে- হিন্দু পৌরাণিক
কাহিনী'র
অতি আলোচিত ও প্রখ্যাত চরিত্র বিশেষ।
মিথিলার রাজা জনক যজ্ঞভূমি চাষ করার সময় লাঙ্গলের ফলা থেকে এই কন্যাকে লাভ করেন।
লাঙ্গলের রেখা অর্থাৎ সীতায় জন্মেছিলেন বলে ইনি সীতা নামে পরিচিত হয়ে উঠেন।
রাজা জনক একে কন্যার ন্যায় প্রতিপালিত করেছিলেন বলে,
ইনি জনকের কন্যা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
জনকের কন্যা বলে এঁর অপর নাম ছিল জানকী।
কথিত আছে-
মহর্ষি কুশধ্বজের কন্যা বেদবদীকে রাবণ ধর্ষণ করার উদ্যোগ নিলে- বেদবতী জ্বলন্ত
চিতায় প্রাণত্যাগ করেন এবং রাবণকে বলেন যে,
ত্রেতা যুগে তিনিই কোন ধার্মিকের অযোনিসম্ভবা কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করবেন এবং
রাবণের মৃত্যুর কারণ হবেন।
এই বেদবতীই জনকরাজার লাঙ্গলের ফলা থেকে জন্মলাভ করেছিলেন।
সীতা বিবাহযোগ্যা হলে ইনি বিবাহের পাত্র সন্ধান করতে থাকেন। দক্ষযজ্ঞের সময় মহাদেব যে ধনু ব্যবহার করেছিলেন, সেই ধনু জনকরাজার পূর্বপুরুষদের হাত ঘুরে তাঁর হাতে এসে পড়েছিল। জনক প্রতিজ্ঞা করলেন যে, যে পুরুষ এই হরধনুতে জ্যা পড়িয়ে ভাঙতে পারবে তাঁর সাথেই সীতার বিয়ে দেবেন। এরপর সীতাকে পাবার জন্য অনেক রাজপুরুষই চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ফলে সীতা জনকের ঘরে বেশ কিছুদিন অবিবাহিতাই রয়ে গেলেন।
এদিকে বিশ্বামিত্র মুনি রাক্ষসদের হাত থেকে যজ্ঞ রক্ষার জন্য অযোধ্যার রাজা দশরথের কাছে অনুরোধ করে, দশরথের দুই পুত্র রাম ও লক্ষ্মণকে তাঁর আশ্রমে নিয়ে যান। সে সময় রামের বয়স ছিল চৌদ্দ বৎসর। রাম ও লক্ষণ সম্মিলিতভাবে তাড়কা ও অন্যান্য রাক্ষসদের হত্যা করেন। পরে বিশ্বামিত্র এঁদের নিয়ে মিথিলায় আসেন এবং জনকরাজার আতিথ্য গ্রহণ করেন। সেখানে বিশ্বামিত্রের পরামর্শে রাম জনকের হরধনু প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে, জনক-কন্যা সীতাকে বিয়ে করেন। উল্লেখ্য একই আসরে সীতার কনিষ্ঠা ভগ্নী উর্মিলার (জনকের ঔরসজাতা কন্যা) সাথে লক্ষ্মণের বিবাহ হয়।দেখুন : রাম
কিছুদিন পর দশরথ
রামকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে অগ্রসর হলে,
দশরথের দ্বিতীয়া স্ত্রী কৈকেয়ী ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন।
ইনি তাঁর দাসী মন্থরার পরামর্শে দশরথের এক পূর্ব প্রতিজ্ঞা স্মরণ করিয়ে রামকে
যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে বাধা দেন।
ফলে কৈকেয়ীর পুত্র ভরত যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হন।
পক্ষান্তরে রাম চৌদ্দ বত্সরের জন্য বনবাসী হন।
এই বনবাসে সীতা ও লক্ষণ তাঁর অনুগামী হন।
রাম বনবাসে যাওয়ার পথে নিষাদরাজের সাহায্যে গঙ্গানদী অতিক্রম করে প্রয়াগের কাছে ভরদ্বাজ মুনির আতিথ্য গ্রহণ করেন। পরে মুনির পরামর্শে ইনি চিত্রকূট পর্বতের দণ্ডকারণ্যে বাস করতে থাকেন। উল্লেখ্য রামের বনে যাওয়ার কিছুদিন পর তাঁর পিতা পুত্র শোকে মৃত্যুবরণ করেন। ভরত রাজ্যলোভ ত্যাগ করে রামকে ফিরিয়ে আনার জন্য দণ্ডকারণ্যে উপস্থিত হলে, রাম পিতৃসত্য রক্ষার জন্য সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর ভরত রামের প্রতীক স্বরূপ তাঁর জুতো নিয়ে যান এবং নন্দীগ্রামে থেকে রামের প্রতিনিধি হিসাবে রাজত্ব করতে থাকেন। চিত্রকূট পর্বত ত্যাগ করার সময় অত্রিপত্নী অনসূয়া দিব্যমাল্য, অলঙ্কার ও অঙ্গরাগসমূহ সীতাকে উপহার দেন।
এরপর ইনি রাম-লক্ষ্মণের সাথে বিভিন্ন আশ্রমে আশ্রমে দশ বত্সর কাটিয়ে, বিন্ধ্য পর্বতে অগস্ত্য মুনির আশ্রমে উপস্থিত হন। এরপর মুনির পরামর্শে গোদাবরী নদীর তীরে পঞ্চবটী নামক বনে কুটির নির্মাণ করে এঁরা বাস করতে থাকেন। এই সময় এই বনের অধিকর্তী ছিলেন রাবণের বিধবা বোন শূর্পনখা। রামের রূপে মুগ্ধ হয়ে শূর্পনখা তাঁকে প্রণয় নিবেদন করলে, রাম তা প্রত্যাখ্যান করেন। কোনো কোনো মতে, শূর্পনখা রামের কাছে সাড়া না পেয়ে লক্ষণের কাছেও অনুরূপ নিবেদন করেছিলেন। ব্যর্থ শূর্পনখা এরপর সীতাকে গ্রাস করার চেষ্টা করলে, রামের নির্দেশে লক্ষ্মণ নাক ও কান কেটে দেন। এরপর শূর্পনখা লঙ্কায় গিয়ে রাবণকে সকল বিষয় বলেন এবং সীতার রূপলাবণ্য বর্ণনা করে রাবণকে উত্তেজিত করে তোলেন। রাবণ সীতা লাভের আশায় এবং বোনের অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য তাড়কা রাক্ষসীর পুত্র মারীচকে পঞ্চবটীতে পাঠান। মারীচ প্রথমে একটি স্বর্ণমৃগের রূপ ধরে সীতার সামনে ভ্রমণ করতে থাকলে, সীতা উক্ত স্বর্ণমৃগকে ধরে দেবার জন্য রামের কাছে আবদার করলে, রাম স্বর্ণমৃগের অনুসরণ করে শরাঘাত করেন। এরপর বনের মধ্য থেকে মারীচ রামের কণ্ঠস্বর অনুকরণ করে, 'হা লক্ষ্মণ, হা সীতা' বলে বিলাপ করতে লাগলে, সীতা লক্ষণকে রামের সাহায্যের জন্য পাঠালেন। এই অবসরে রাবণ ভিখারির বেশে সীতার সামনে উপস্থিত হয়ে প্রথমে সীতাকে বিভিন্নভাবে ঘরের বাইরে আনার চেষ্টা করলেন। শেষ পর্যন্ত কার্যসিদ্ধ না হওয়ায়, রাবণ জোর করে সীতাকে রথে উঠিয়ে লঙ্কার পথে রওনা হলেন। পথে জটায়ু নামক এক পক্ষী রাবণকে বাধা দিলে, রাবণ জটায়ুর পাখা কেটে ফেলে অগ্রসর হন। এরপর বন্দিনী সীতা যাওয়ার পথে তাঁর অললঙ্কারসমূহ ঋষমূকপর্বতে বানরদের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করেন। লঙ্কায় গিয়ে রাবণ সীতাকে বশ করার বহুচেষ্টা করে অপারগ হলে, ইনি সীতাকে অশোকবনে বন্দিনী করে রাখেন। ইনি সীতাকে বশে আনার জন্য বেশ কিছু রাক্ষসী নিয়োগ করেন এবং ঘোষণা দেন যে, দশ মাসের মধ্যে সীতা বশীভূত না হলে, ইনি তাঁকে খেয়ে ফেলবেন।
পরে রাম যুদ্ধে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করেন। সীতা উদ্ধারের জন্য রামের অভিযান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে- রাম চরিত্রের সাথে। সীতাকে উদ্ধার করে, রাম বিভীষণকে লঙ্কার রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর রাম-লক্ষ্মণ অযোধ্যার পথে রওনা দেন। পথিমধ্যে বন্দিনী সীতার সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠলে, সীতা অগ্নি পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করলেন যে, তিনি সতী। এরপর রাম চৌদ্দ বত্সর পর সীতা ও লক্ষণসহ অযোধ্যাতে প্রবেশ করেন। ভরত রামের হাতে রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন। কিছুদিন রাজত্ব করার পর সীতার সতীত্ব নিয়ে প্রজাদের ভিতর আবার গুঞ্জন শুরু হলে, রাম সীতাকে বাল্মীকির তপোবনে নির্বাসন দেন। আর তাঁর তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে সাথে লক্ষ্মণকে পাঠান। এই সময় সীতা গর্ভবতী ছিলেন। এই আশ্রমে সীতা যমজ সন্তান প্রসব করেন। বাল্মীকি এই দুই পুত্রের নাম দেন লব ও কুশ।
সীতাকে নির্বাসন দেওয়ার কিছুদিন পর রাম অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন। বাল্মীকি উক্ত যজ্ঞস্থলে লব-কুশকে নিয়ে উপস্থিত হন। উক্ত আসরে লব-কুশ রামায়ণ গান করেন। এই গান শুনে রাম মুগ্ধ হন। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে লব-কুশ তাঁরই পুত্র। বাল্মীকির কাছ থেকে সমুদয় জেনে এবং বাল্মীকির অনুরোধে সীতাকে ফিরে আসার অনুমতি দিলেন। এরপরও প্রজাদের সামনে সীতার সতীত্ব পরীক্ষার কথা পুনরায় উত্থাপিত হলে, সীতা ব্যথিত হয়ে মাতা বসুমতীর কাছে, তাঁর কোলে স্থান দেবার জন্য অনুরোধ করলেন। সেই সময় পৃথিবী দ্বিবিভঙ্গত হলে- সীতা তাঁর মধ্যে প্রবেশ করেন।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মতে- রাম সীতার বনবাসকালে অগ্নি ভবিষ্যত্বাণী করেন যে, সাতদিনের মধ্যে রাবণ সীতাকে অপহরণ করবেন। এরপর রাম অগ্নিকে অনুরোধ করে সীতার রক্ষার ভার দেন এবং মূল সীতার পরিবর্তে একটি ছায়া সীতা বানিয়ে রামের সঙ্গী হিসাবে প্রদান করেন। রাবণ এই ছায়া সীতাকেই অপহরণ করেছিলেন। সীতার অগ্নিপরীক্ষার সময় ছায়াকে রক্ষা করে মূল সীতাকে রামের কাছে ফিরিয়ে দেন। পরে এই ছায়া সীতা একশত বত্সর মহাদেবের আরাধনা করে পাঁচবার স্বামী প্রার্থনা করেন। সেই কারণে পরবর্তীকালে দ্রৌপদীর জন্ম হয়। ইনি সত্যযুগে বেদবতী, ত্রেতাতে ছায়া সীতা এবং দ্বাপরে দ্রৌপদী হিসাবে জন্মগ্রহণ করেন।