কাগজ
ইংরেজি : paper

তৃণ জাতীয় উদ্ভিদ (বাঁশ, ঘাস, নলখাগড়া), আখের ছোবড়া, তুলা ইত্যাদি থেকে উৎপন্ন মণ্ডকে বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে পাতলা পাত তৈরি করা হয়, তাকে সাধারণভাবে কাগজ বলা হয়। সাধারণত কাগজ লেখা, ছাপার উপযোগী মাধ্যম হিসাবে, মোড়ক বা মলাটের জন্য কাগজ ব্যাপক ব্যবহৃত হয়।

মিশরে সৃষ্ট প্যাপিরাস কাগজ

এছাড়া বাংলা ভাষায় কাগজ শব্দটি এসেছে ফার্সি کاغذ  শব্দ থেকে। মিশরের নীল নদের তীরে উৎপন্ন প্যাপিরাস নামক নলখাগড়ার গাছ থেকে মিশরের লোকেরা কাগজ তৈরি করতো। এই গাছ প্রথমে তারা ফালি ফালি করে কেটে পাশাপাশি সাজিয়ে চাদরের মতো তৈরি করতো। তারপর তা শুকিয়ে লেখার উপযোগী পাতে পরিণত করতো। প্যাপিরাস গাছ থেকে উৎপন্ন হওয়ার সূত্রে এই ইউরোপীয় ভাষা সমূহে paper শব্দটি গৃহীত হয়েছে।

কাগজ তৈরির ইতিহাস
প্রায় ২০০০ বৎসর পূর্বে চীনে কাগজ আবিস্কৃত হয়েছিল বলে দাবী করা হয়। চীনে পুরানো কাপড়, আঁশযুক্ত গাছের বাকল পচিয়ে তার সাথে চুন ও আঠা মিশিয়ে কাগজ তৈরি করা হতো। একে বলা হতো তুলোট কাগজ। ১০৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে চীনা বিজ্ঞানী কাই লুন বা সাই লুন উন্নতমানের কাগজ তৈরি করেন। এই কাগজের উপাদান হিসাবে তিনি ধান গাছের নাড়া ব্যবহার করেছিলেন। ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে জাপানে ও ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে সমরখন্দে কাগজশিল্প বিকাশ লাভ করে।

১১৫০ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনে প্রথম কাগজের কারখানা স্থাপিত হয়। ১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যাণ্ডে এবং ১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর আমেরিকা ও জার্মানীতে কাগজের কারখানা স্থাপিত হয়। ১৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি বিজ্ঞানী নিকালোস লুইস রবার্টএকটি কাগজ তৈরির যন্ত্র আবিষ্কার করেন। ব্রিটিশ হেনরি ও শেলি নামক দুই ভাই মিলে এই যন্ত্রের উন্নতি ঘটান ১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ।  এরপর থেকে বিভিন্ন দেশে, নানা রকমের উন্নতর ব্যবহারোপযোগী কাগজ উদ্ভাবিত হয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) বাংলাদেশের সহজলভ্য ও পরিবেশ বান্ধব ধইঞ্চা গাছের আঁশ দিয়ে কাগজ তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। এটি খুব সাশ্রয়ী পদ্ধতি।সাধারণ বায়ুচাপে ৬০ থেকে ৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সম্পূর্ণ সালফার ও ক্লোরিনমুক্ত পদ্ধতিতে এই গাছ থেকে কাগজ তৈরি করা যায়। এছাড়াও কলকারখানা থেকে নির্গত ধোয়া থেকে কাগজ তৈরির কাঁচামাল প্রিসিপিটেটেড ক্যালসিয়াম কার্বোনেট (পিসিসি) তৈরি করা যায়। সুইডেনে প্রাকৃতিক সেলুলোজ ন্যানোফাইবার থেকে তৈরি ন্যানোপেপার নামের একটি কাগজ উদ্ভাবন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই কাগজকে সবচেয়ে মজবুত কাগজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্টকহোমের সুইডিশ রয়াল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিজ্ঞানী লারস বার্জল্যান্ড এর থেকে জানা যায় যে, কাগজ তৈরির জন্য কাঠ থেকে মন্ড তৈরির সময় এর ভেতরের প্রাকৃতিক আঁশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দুর্বল হয়ে পড়ে। এই আঁশগুলো অক্ষত অবস্থায় সংগ্রহ করার একটি প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করা হয়েছে। ন্যানোপেপারের সেলুলোজ ফাইবারগুলোর অক্ষত এবং নেটওয়ার্কের মতো সজ্জিত অবস্থায় থাকে তাই এটি এত শক্ত। ফাইবারগুলো একটির সঙ্গে অন্যটির কঠিন বন্ধন তৈরি করে রাখে কিন্তু যেকোনো চাপ বা টানের মতো বাইরের চাপে এগুলো একটি আরেকটির ভেতর দিয়ে পিছলে গিয়ে চাপ সহ্য করতে পারে। প্রচলিত কাগজের আঁশের চেয়ে এই সেলুলোজ ফাইবার অনেক ছোট। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এর চাপ সইবার ক্ষমতা ২১৪ মেগাপ্যাসকেল, যা ঢালাই লোহার (১৩০ মেগাপ্যাসকেল) চেয়ে বেশি এবং ভবন ও সেতুতে ব্যবহূত ইস্পাতের (২৫০ মেগাপ্যাসকেল) কাছাকাছি। প্রচলিত কাগজের চাপ সইবার ক্ষমতা এক মেগাপ্যাসকেলেরও কম।

কাগজ তৈরির উপকরণ
বর্তমানে কারখানায় কাগজের উপাদান হিসাবে নরম কাঠ, বাঁশ, তুলা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। মূল উপদান বা কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত উপকরণ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দলিত করে মণ্ড তৈরি করা হয়। এরপর কস্টিক সোডা ও ব্লি্চিং পাউডার মিশিয়ে কাগজের রঙকে সাদা বানানো হয়। সবশেষে মণ্ডকে রোলারে মধ্য দিয়ে চালিত করে পাতলা শিটে পরিণত করা হয়।

তবে সকল ধরনের কাগজের জন্য একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। লেখা বা ছাপার উপযোগী কাগজ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত উপকরণ ও তৈরির প্রক্রিয়ার সাথে মোড়ক, বোর্ড জাতীয় কাগজের জন্য ব্যবহৃত উপকরণ ও তৈরির প্রক্রিয়ার পার্থক্য আছে।

কাগজের মাপ
কাগজের পরিমাপ করা হয় এর স্তর, পরিমাণ, ওজন ও আকার দিয়ে।


সূত্র :