প্রবারণা পূর্ণিমাফানুস উড়ানো

প্রবারণা পূর্ণিমা
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব।

আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা থেকে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বর্ষাব্রত পালন করেন। এই সময় তাঁর বিহারে অবস্থান এবং জ্ঞানচর্চা করেন। এই সাধনার সময় নানা ধরনের ভুলভ্রান্তি হতে পারে। তাই এই ব্রত শেষে তারা আশ্বিনী পূর্ণিমায় প্রবারণা করে থাকেন। প্রবারণায় তাঁরা জ্ঞাত বা অজ্ঞাত সকল ভুলের সংশোধনের জন্য প্রধান ভিক্ষুর কাছে আসেন। এই সময় জ্যেষ্ঠ ভিক্ষুরাও নবীনদের কাছে তাদের ভুলের কথা জানান। এজন্য একে বলা হয় ভিক্ষুদের আত্নসমর্পন ও আত্ননিবেদনের অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধরা প্রবারণ উৎসব করে থাকেন।

প্রবারণা পূর্ণিমার পরে, কঠিন চীবরদান অনুষ্ঠান হয়। গৌতমবুদ্ধ আনন্দকে বলেছিলেন 'পৃথিবীতে আমি প্রথম বুদ্ধ নই। শেষ  বুদ্ধ নেই। মানুষের ভিতর থেকে মানুষের নেতা জন্মাবে। ভবিষ্যতে যিনি বুদ্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করবেন, তিনি 'মৈত্রীয় বুদ্ধ' নামে পরিচিত হবেন। এবং তিনি প্রবারণা পূর্ণিমায় জন্মগ্রহণ করেবন।

কথিত আছে এই তিথিতে গৌতম বুদ্ধ ৬০জন প্রশিক্ষিত শিষ্যকে ধর্ম প্রাচারণার জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেন। তিনি বলেছিলেন 'চরত্থ ভিকখবে চারিকং, বহুজন হিথায় বহুজন সুখায়'- অর্থাৎ তোমরা বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য চারিদিক ছড়িয়ে পড়। এই আদেশ অনুসারে এখনও এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা অদূরবর্তী গ্রামগঞ্জে বৌদ্ধের বাণী প্রচারের জন্য বিহারের বাইরে চলে যান। বৌদ্ধ সত্যকে বরণ এবং লোভকে বর্জন করার উপদেশ দিয়েছিলেন। বরণ ও বারণের কারণেও একে প্রবারণা পূর্ণিমা বলা হয়। উল্লেখ্য, পালি পবারণ শব্দ থেকে প্রবারণা শব্দটি গৃহীত হয়েছে। এর অর্থ হলো আমন্ত্রণ। প্রবারণাকে বৌদ্ধেরা বলে বড় ছাদাং। ছাদাং শব্দের অর্থ বড় উপবাস দিবস। আর উপবাস শেষ হলে গৃহীদের চবিবশ ঘণ্টার জন্য অষ্টশীল ব্রত পালন করতে হয়। তারপর সকালবেলায় বৌদ্ধ নরনারী শুচি শুভ্র হয়ে, পরিষ্কার পোশাকে বৌদ্ধ বিহার সমবেত হযন। এই সময় বুদ্ধকে পূজা দেওয়া হয়। একই সাথে ভিক্ষুদের আহার্য প্রদান, দান প্রদান, অষ্টশীল ও পঞ্চশীল গ্রহণ কার্যক্রম হয়। দুপুরে বিহারে বিহারে ভাবনা হয়, বিকেলে আয়োজিত হয় ধর্মসভা। এতে পণ্ডিতেরা অংশগ্রহণ করেন। এই সময় বৌদ্ধধর্মের মূল বাণীগুলোর উপর আলোচনা হয়। আর রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।

এদিন গৃহীরা ভাল ভাল রান্না করেন। অতিথিদের জন্য পায়েস পরিবেশন করা হয়। এই দিনের সর্বশ্রেষ্ঠ আকর্ষণ হলো- সন্ধ্যায় ফানুস উড়ানো উৎসব। দেশের বিহারে বিহারে অনেক ফানুস উড়ানো হয়। ফানুস উড়ানো হয় আকাশে ভাসমান গৌতমের পবিত্র কেশধাতুকে প্রদীপ দিয়ে বন্দনা করার জন্য। এই তিথিতে বিহার গৃহশীর্ষে আকাশ প্রদীপ জ্বালানো হয়। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, বুদ্ধদেব আধ্যাত্মিক শক্তিবলে দেবলোকে গিয়ে তাঁর মাকে ধর্মদেশনা দিয়ে স্বর্গ থেকে মর্তে নেমে আসেন। এ নিয়ে অপর একটি কাহিনীতে বলা হয়- সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগের পর মাথার চুল কেটে মনে মনে বলেন, 'আমার সংকল্প যদি সফলকাম হয়, তবে এই চুল উড়ে যাবে।' এরপর তিনি চুলগুলো শূন্যে ছুঁড়ে দেন। এই সময় তাঁর চুলগুলো একটি দমকা বাতাসে উড়ে যায়। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, এই চুল স্বরগের দেবতারা পূজা করে। আর পৃথিবীর মানুষ ফানুস উড়িয়ে সে চুলের পূজা করে।

এদিন সন্ধ্যায় বৌদ্ধেরা পঞ্চশীল গ্রহণ করেন এবং বুদ্ধমূর্তির সামনে প্রদীপ ও মোমবাতি জ্বালান। অন্যদিকে নবীনেরা প্রবীণদের প্রণাম করেন এবং  প্রবীণেরা ছোটদের আশীর্বাদ করে। সমবয়সীরা কোলাকুলি করেন, প্রবাসীরা ঘরে ফিরেন, গৃহবধূরা বাপের বাড়ি যান।