সহজিয়া 
একটি ধর্মসম্প্রদায় বিশেষ।


সহজিয়া হলো সহজপথে সাধনা আধ্যাত্মিক সাধন-প্রক্রিয়া। এই সাধন প্রক্রিয়ায় মূলে রয়েছে যাবতীয় প্রাণী ও জড় বস্তুর ভিতরে সমন্বয় এবং এর ভিতর দিয়ে জগৎকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা। এই উপলব্ধির প্রণালীই হলো সহজপথ। এই সহজ পথ হলো জীবনযাপনের সরল পথ। অসততা, কুটিল আচরণ, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা থেকে বক্র পথের জন্ম নেয়। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের ভিতরে সরল পথে আত্মোপলব্ধির চেষ্টা করাই সহজিয়া মতের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে অটল থেকে পরমসত্তাকে উপলব্ধি করার সাধনা সহজিয়া সাধকরা করে থাকেন। তাঁরা মনে করেন, মানুষের ভিতরে পরমসত্তা জ্ঞানরূপে বিরাজ করেন। এই সত্তার অবস্থান দেহের মধ্যে। সহজিয়াপন্থীরা দেহকে ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড মনে করা হয়। এই দেহের ভিতরে এই ব্রহ্মাণ্ডকে উপলব্ধি করতে হয় জ্ঞানের দ্বারা। প্রকৃত গুরুই এই জ্ঞানের সন্ধান দিতে পারেন। তাই সহজ-সাধনায় গুরু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই আদর্শের উপর ভিত্তি করে রচিত কাব্য এবং সঙ্গীত সহজিয়া সাহিত্য নামে পরিচিত।

খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর দিকে বজ্রযানী বৌদ্ধ মতালম্বীদের একটি অংশ এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কালক্রমে এই মতাদর্শ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তর ভারতের পূর্ব-মধ্যাঞ্চলে। এঁদের দ্বারাই ধীরে ধীরে বৌদ্ধ সহজিয়া মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। বজ্রযানী বৌদ্ধদের মধ্যে মন্ত্র-তন্ত্র, পূজার্চনা, ব্রত-নিয়ম, শাস্ত্রপাঠ ইত্যাদির প্রাবল্য রয়েছে। তবে সহজিয়া বৌদ্ধরা মনে করেন শাস্ত্রাচার পালন নিরর্থক। তাঁরা মনে করেন প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই বোধি বা বুদ্ধ আছেন। শুধু সহজ-সাধনায় তাঁকে উপলব্ধি করতে পারলেই মোক্ষলাভ করা যায়।

বঙ্গদেশের রাজা শশাঙ্ক (৬০৬ থেকে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ) -এর রাজত্বকাল এবং পরবর্তী মাৎস্যন্যায় (৬৫০-৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ) পর্বের ভিতরে বৌদ্ধ সাধকদের ভাবনা পরিবর্তন ঘটে।  বিশেষ করে মাৎস্যন্যায় বা অরাজকতার সময় মানুষ যে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হয়েছিল, বৌদ্ধ ধর্মের আচারানুষ্ঠান বা তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে সে অবস্থা থেকে উত্তোরণ বা উদ্ধার সম্ভব ছিল না। এই সময় বৌদ্ধ-ধর্মগুরুদের অনেকে ভেবেছিলেন, মানুষের ভিতরেই রয়েছে পরমাত্মা ও জীবাত্মার। জীবাত্মার অসততা, লোভ-লালসা, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদির বিসর্জন দিলেই পরমাত্মার সাথে মিলিত হওয়া সম্ভব। এর জন্য ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা, তন্ত্র-মন্ত্রের জটিলতার প্রয়োজন নেই। এরই ভাবনার ধারাবাহিকতায় জন্ম নিয়েছিল বৌদ্ধ সহজিয়া মতাদর্শ। পরবর্তী
পাল রাজবংশ (৭৫০-১১৬২ খ্রিষ্টাব্দ) শাসনামলে বাংলায় বৌদ্ধ সহজিয়া মতের পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল পর্যায়ক্রমে। সহজিয়া এই ভাবনার সূত্রে, এই সময়ে ভিতরে আবির্ভাব ঘটেছিল বহু সিদ্ধা বা ধর্মগুরু। এঁদের অধিকাংশই বাংলা, মিথিলা, উড়িষ্যা ও কামরূপের অধিবাসী ছিলেন। এই কারণে এসকল অঞ্চলে সহজিয়া-সাধনতত্ত্বে প্রাধান্য পেয়েছিল। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষভাগে, সহজিয়া বৌদ্ধ-দর্শনের সাথে শৈবধর্মের সমন্বয় হয়ে তৈরি হয়েছিল নাথধর্ম। ফলে আদি সহজিয়া এবং মিশ্র নাথ মতাদর্শের গুরু সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছিল অনেক। তবে উল্লেখযোগ্য ৮৪জন সাধককে সিদ্ধাচার্য হিসেবে মান্য করা হয়। এদের সাধনমার্গের অবলম্বন ছিল তন্ত্র, হঠযোগ,  সহজিয়া ও শৈবাচারের মিশ্র দর্শন। এঁদের অনেকর দ্বারা রচিত হয়েছিল বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের আদি নমুনা চর্যাপদ।
সিদ্ধাচার্যরা নিজেদের কুল ও জাতি পরিচয় গোপন রেখে ছদ্মনাম গ্রহণ করতেন। তাঁর তাঁদের মতকে প্রকাশ করতেন,  উপমা-রূপক মিশ্রিত হেঁয়ালিতে। এই কারণে চর্যাপদের ভাষাকে অনেকে সন্ধ্যাভাষা বা আলো-আঁধারির ভাষা বলে থাকেন।

সনাতন হিন্দু ধর্মের বিষ্ণু তথা কৃষ্ণভক্তদের দ্বারা বৈষ্ণব ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে। পরে এই বৈষ্ণব মতের একটি অংশ সহজিয়া মতের অনুসারী হয়ে যায়। এই সূত্রে উদ্ভব ঘটে বৈষ্ণব সহজিয়া। চতুর্দশ শতকের কবি বড়ু চণ্ডীদাসের মাধ্যমে বৈষ্ণব সহজিয়া মতের বিকাশ ঘটে। বৈষ্ণব সহজিয়াদের মূল আদর্শ রূপ-প্রেম-আনন্দ। গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা পরকীয়া প্রেমকে সাধনার রূপক হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সহজিয়া সাধকরা বাস্তব জীবনেও পরকীয়া প্রেমকে সাধনার অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেছিল।  ফলে বৈষ্ণব সহজিয়াদের দার্শনিক মত ও সাধন-পদ্ধতি দুইই গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের থেকে স্বতন্ত্র রূপ লাভ করেছিল।
 

শ্রীচৈতন্যের (১৪৮৬ -১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) বৈষ্ণব মতে বৈষ্ণবমত ও রাধাকৃষ্ণতত্ত্ব একাকার হয়ে গিয়েছিল পরমাত্মার সাথে জীবত্মার মিলনের আকাঙ্ক্ষায়। চৈতন্য-উত্তর বৈষ্ণব সাধকরা নিমাই-নিতাইচাঁদের নাম স্মরণ করে প্রেমধর্মের এক বিচিত্ররূপ নির্মাণ করেছিলেন। তাঁদের অনেকের সাধন-ভজনের একদিকে ছিল বৈদেহী সাধনা, অন্যদিকে ছিল দেহমার্গে মহাসুখোপলব্ধি। সহজমতের বৈষ্ণবরা মনে করতেন, নর-নারীর দৈহিক রূপের মধ্যেই রয়েছে সাধনার সহজরূপ। নররূপী কৃষ্ণ এবং নারীরূপী রাধা প্রেমের প্রতীকরূপ। উভয় রূপের মিলন ঘটে মহাভাব বা সহজানন্দ।

বৈষ্ণব সহজিয়ারা এই দর্শনকে দৈহিক কামকে সাধনার অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এঁরা মনে করতেন রস ও রতির প্রতীক হলো কৃষ্ণ ও রাধা। এঁদের মিলনে সৃষ্টি হয় রসলীলা। এই লীলার ভিতর দিয়ে সাধক অপার্থিব স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন। এই সাধনার মধ্য দিয়ে সাধকের আত্মোপলব্ধি ঘটে। এই আত্মোপলব্ধি এমন একটি স্তরে নিয়ে যায় যেখানে কাম গৌণ হয়ে যায় এবং কাম পরম-প্রেমে পরিণত হয়। তাই বৈষ্ণব সহজিয়ারা মানব দেহকেই দেবপীঠস্থান হিসেবে বিবেচনা করেন। পরকীয়া প্রেম বা দেহসাধনার চর্চার কারণে গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা সহজিয়া বৈষ্ণবদের সম্মানের চোখে দেখেন না।

আঠারো শতকে বাউল সম্প্রদায়ের সহজিয়া মত ছড়িয়ে পড়ে। জীবাত্মা-পরমাত্মার ধারণা বাউলরা গ্রহণ করেছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ-সাধকদের সূত্রে। সকলপ্রকার ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা বর্জন করেছিলেন। জাতবিচার বর্জন করে, সকল মানুষকে এক কাতারে এনে হাজির করেছিলেন। তবে এঁরাও সহজিয়া বৈষ্ণবদের মতো সাধনসঙ্গীকে সাধনার অঙ্গ হিসেবে নিয়েছিল।