ষট্চক্র
প্রাচীন ভারতীয় বৌদ্ধ ও তন্ত্র মতে, মানবদেহ ষট্চক্রের অধীন। মূলত মানুষের শরীরের মধ্যে যে স্নায়ুতন্ত্র আছে, তান্ত্রিকরা তাকে নাড়ি নামে অভিহিত করেছেন। এই সকল নাড়ি দেহের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে প্রধান ছয়টি কেন্দ্রের মাধ্যমে। তান্ত্রিকদের মতে এই কেন্দ্রগুলোকে বলা হয় চক্র। চক্রে সংখ্যা ৬টি বলে, একে ষট্চক্র বলা হয়। এই চক্রগুলোর নাম হলো- আজ্ঞা, বিশুদ্ধ, অনাহত, মণিপূরক, স্বাধিষ্ঠান এবং মূলাধার।
আজ্ঞাচক্র : এই চক্রটি দুই ভ্রূরুর
মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। তান্ত্রিকদের মতে— এই চক্র থেকে রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ
ইত্যাদির অনুভূতি নিয়ন্ত্রিত হয়। এই চক্রের খুব কাছেই আজ্ঞা চক্রের উপরেই রয়েছে মনস ও সোম
নামক দুটি ক্ষুদ্র চক্র। তান্ত্রিকদের মতে এই চক্রের মাধ্যমে গুরু আজ্ঞা বা নির্দেশ
আসে। এই কারণে এর নাম আজ্ঞাচক্র।
বিশুদ্ধচক্র : এর অবস্থান মেরদণ্ড সংলগ্ন কণ্ঠমূল বরাবর। তান্ত্রিকরা মনে
করেন, এই চক্রের মাধ্যমে মানুষ শুদ্ধ হয়।
অনাহত চক্র : হৃদপিণ্ড বরাবর নাভিপদ্মের উপরে মেরুদণ্ড সংলগ্ন অঞ্চলে এই
চক্রটি অবস্থিত। তান্ত্রিকদের মতে, এই চক্রের মাধ্যমে সাধকরা অনাহত নাদ শুনতে
পারেন।
মণিপূরক চক্র : নাভিদেশের কেন্দ্রে এই
চক্রের অবস্থান। গোতময়ী তন্ত্রের মতে এই স্থানে অসীম এবং শক্তিশালী তেজ অবস্থান
করে। এই তেজকে মণির সাথে কল্পনা করে এর নামকরণ করা হয়েছে মণিপূরকচক্র।
স্বাধীষ্টান চক্র : এর অবস্থান নাভিচক্রের নিচে।
মূলাধার চক্র :
এই চক্রে রয়েছে সকল নাড়ির মূলবিন্দু।
জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদেশের
মাঝখানে অবস্থিত স্থানকে বলা হয় কুন্দস্থান। এই কুন্দস্থান থেকে ইড়া, পিঙ্গলা,
সুষুম্না, কুহূ, শঙ্খিনী প্রভৃতি প্রধান প্রধান নাড়িগুলো উৎপন্ন হয়েছে। এই চক্রে
সকল শক্তির আধার বিদ্যমান থাকে। এই শক্তিকে বলা হয় কুলকুণ্ডলিনী। কুন্দস্থানে এই
কুলকুণ্ডলিনী নিদ্রিত সাপের আকারে বিরাজ করে। হিন্দু তন্ত্রমতে— শরীরের পদ্মসূত্রের
মতো সূক্ষ্ম আদ্যাশক্তি ও প্রাণশক্তির মূল কুলকুণ্ডলিনী শক্তি কুন্দস্থানে ঘুমিয়ে
আছেন। সেই মত অনুসরণ করে যোগীরা এই কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগরিত করে সিদ্ধিলাভ করার
চেষ্টা করে থাকেন।
কুণ্ডলিনীকে জাগরিত করার উপায় হিসেবে স্বামী বিবেকানন্দ বলেন- 'প্রাণায়ামের পূর্বে
ঐ ত্রিকোণ মণ্ডলকে ধ্যানে দেখবার চেষ্টা কর। চোখ বন্ধ করে এঁর ছবি মনে মনে
স্পষ্টরূপে কল্পনা কর। ভাবো এর চার পাশে আগুনের শিখা, তার মাঝখানে কুণ্ডলীকৃত সর্প
ঘুমিয়ে রয়েছে। ধ্যানে যখন কুণ্ডলিনীশক্তি স্পষ্টভাবে দেখতে পাবে তখন কল্পনায় তাকে
মেরুদণ্ডের মূলাধারে স্থাপন কর; এবং তাকে অনুভব করার চেষ্টা কর। প্রাণায়ামসহ
বিভিন্ন মুদ্রা ও বন্ধন অভ্যাস কালে কুম্ভকে শ্বাস রুদ্ধ রাখার সময় সুপ্ত
কুণ্ডলিনীকে জাগাবার জন্যে ঐ রুদ্ধ বায়ু সবলে তার মস্তকে নিক্ষেপ করবে। যার কল্পনা
শক্তি যত বেশি সে তত শীঘ্র ফল পায়, আর তার কুণ্ডলিনীও তত শীঘ্র জাগেন। যতদিন তিনি
না জাগেন ততদিন কল্পনা কর- তিনি জাগছেন। আর ইড়া ও পিঙ্গলার গতি অনুভব করার চেষ্টা
কর, জোর করে তাদের সুষুম্না পথে চালাতে চেষ্টা করো- এতে কাজ খুব তাড়াতাড়ি হবে। মনের
সংযমের দ্বারাই কল্পনা করা সম্ভব।'
নাড়ি :
মানবদেহে অসংখ্য স্নায়ুতন্তু বা
নাড়ি রয়েছে। এর ভিতর
১৪টি নাড়িকে প্রধান। এগুলো হলো–
ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, সরস্বতী, বারূণী, পূষা, হস্তিজিহ্বা, যশস্বিনী, বিশ্বোদরী,
কুহূ, শঙ্খিনী, পরদ্বিণী, অম্লম্বুষা ও গান্ধারী। এই সব নাড়ী যে সকল স্নায়ুকেন্দ্র
থেকে নির্গত হয়ে মস্তিষ্কের সাথে সংযোজক স্থাপন করছে, তন্ত্রমতে সে সকল তন্ত্রকে
বলা হয় চক্র।
ইড়া-পিঙ্গলা- সুষম্না : স্নায়ুতন্ত্রের কেন্দ্রীয় বা প্রধান নাড়ির নাম
সুষম্না। এটা
মস্তিষ্কের নিম্নাংশ থেকে বের হয়ে মেরুদণ্ডের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে গুহ্যদেশে এসে
শেষ হয়েছে। এই সুষম্নার ভিতরের ধূসর পদার্থকে বলে বজ্রিণী নাড়ি। এই বজ্রিণীর
ভিতরের অংশকে বলে চিত্রিণী নাড়ি। আর চিত্রিণী নাড়ির অভ্যন্তরে যে রন্ধ্র
আছে, তার ভিতরের নাড়িকে বলা হয় ব্রহ্ম নাড়ি। সুষম্না নাড়ির দুই পাশে আরও দুটি নাড়ি আছে।
এর বাম দিকের নাড়ির নাম ইড়া, আর ডান দিকের নাড়ির নাম পিঙ্গলা।
এই নাড়ি দুটি বাম ও ডান শুক্রাশয় থেকে নির্গত হয়ে বক্রভাবে অগ্রসর হয়ে মস্তিষ্কের
দিকে অগ্রসর হয়েছে। অনেক সময় তান্ত্রিকরা সুষম্না নাড়িকে অগ্নি নামে অভিহিত করেছেন।
আবার সুষুম্নাকে বলা হয়, সূক্ষ্ম, জ্যোতির্ময়, সূত্রাকার তন্তুময় পথ। এই পথ দিয়েই
কুণ্ডলিনীকে উর্ধ্বদিকে চালিত করতে হয়। প্রণয়মূলক চিন্তা বা পাশব-কার্য থেকে যে
যৌনশক্তি উত্থিত হয়, তাকে যৌনশক্তি 'ওজঃ' বলা হয়। এই শক্তিকে মস্তিষ্কে প্রেরণ করতে
পারলে, ওজঃ সঞ্চিত হয়। এই শক্তি আধ্যাত্মিক শক্তিলাভে সাহায্য করে। এই 'ওজঃ'
শক্তিকে মনুষ্যত্বও বলা হয়। একমাত্র মনুষ্যশরীরেই এই শক্তি সঞ্চয় করা সম্ভব।
তান্ত্রিকদের মতে— কুলকুণ্ডলিনী অত্যন্ত
সূক্ষ্ম তন্তুর মত। এর আকার অনেকটা সাপের মতো প্যাঁচানো। অপান বায়ু নিচের দিকে এর
উপর চাপ প্রয়োগ করে, তখন জীব শ্বাস ত্যাগ করে। আর যখন এই চাপ তুলে নেওয়া হয়, তখন
জীব শ্বাস গ্রহণ করে। কুলকুণ্ডলিনীর প্রাণশক্তিই সুষম্নার ভিতর দিয়ে ঊর্ধ্ব দিকে
গমন করে এবং শেষ পর্যন্ত তা মস্তিষ্কে প্রবেশ করে।
তন্ত্রমতে কোনো শক্তিই নতুন করে তৈরি করা যায় না। সকল শক্তি দেহাধারেই আছে। শুধু
একে ঈপ্সিত পথে চালিত
করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে রাজযোগ করা হয়। কিন্তু এটা সাধারণ গৃহীদের কাজ নয়।
একমাত্র যোগীরাই যোগ প্রভাবে এই সমস্ত নাড়ী সম্বন্ধে সবিশেষ জানতে পারেন এবং তা
অনুভবও করেন। রাজযোগ অভ্যাস করতে হলে প্রথমে হঠযোগ আয়ত্তে আনতে হয়। হঠযোগই রাজযোগের
সোপান। আর এই হঠযোগের একটা বিরাট অংশ হলো অষ্টাঙ্গযোগ। কারণ এর অঙ্গ হলো আটটি। এই
অঙ্গগুলো হলো— ১. যম ২. নিয়ম ৩. আসন , ৪. প্রাণায়াম ৫. প্রত্যাহার, ৬ ধারণা,
৭. ধ্যান ও ৮. সমাধি।
কূহ : কুহূনাড়ি
জননেন্দ্রিয়ের সমস্ত কাজ সুসম্পন্ন করে। এর অবস্থান সুষম্নার বাম দিকে।
বিশ্বোদরা : ইড়া ও সুষম্নার মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই নাড়ি অবস্থিত। এই
নাড়ি উভয় নাড়ির সমান্তরলাভাবে বিস্তৃত।
গান্ধারী : সুষম্নার বাম দিককার সহযোগী স্নায়ুমণ্ডলীর মধ্যে এই নাড়ি
অবস্থিত। বাম চোখের প্রান্তের তলদেশ থেকে বাম পা পর্যন্ত এই নাড়ি অবস্থিত।
হস্তীজীহ্বা : সুষম্নার সম্মুখভাগে এই নাড়ি অবস্থিত। বাম চোখের প্রান্তভাগ
থেকে বাম পায়ের বুড়ো আঙুল পর্যন্ত এই নাড়ি অবস্থিত।
শঙ্খিনী :
আর আর শঙ্খিনী নাড়ি দেহের মলাদি নির্গমনে সহায়তা করে।