সাংখ্যকারিক-১

দুঃখত্রয়াভিঘাতৎ জিজ্ঞাসা তদপঘাতকে হেতৌ।
দৃষ্টে সাহপার্থা চেন্নৈকান্তাত্যন্ততোহভাবাৎ

অর্থাৎ: ত্রিবিধ দুঃখের অভিঘাতের ফলে তার নিবৃত্তির উপায় বিষয়ে জিজ্ঞাসার উদয় হয়। লৌকিক উপায়ে দুঃখের অবশ্যম্ভাবী চিরনিবৃত্তি হয় না বলে, সেই উপায় বিষয়ে জিজ্ঞাসা ব্যর্থ হয় না।

তিন প্রকার দুঃখের আঘাতে, মানুষের মনে সকল দুঃখানুভূতির জন্ম হয়। এ সকল দুঃখ থেকে কিভাবে মুক্তির পাওয়া যায়, এই ভাবনা থেকে জন্য মানুষের মনে নানা ধরনের প্রশ্নের উদয় হয়। ঠিক কোন তিনটি দুঃখের আঘাতে দুঃখানুভূতির জন্ম হয়, তার সুষ্পষ্ট উল্লেখ সাংখ্যতত্ত্ব থেকে প্রত্যক্ষভাবে জানা যায় না। বাচস্পতি মিশ্র তাঁর ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’ গ্রন্থে এই তিনটি দুঃখের নামকরণ করেছেন- আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক।

তাঁর মতে আধ্যাত্মিক দুঃখ তৈরি হয় শরীরের ভিতরে। এর একটি অংশ শরীরের সমস্যা থেকে উৎপন্ন হয়। অপরটি কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, ভয়, ঈর্ষা, বিষাদ এবং অপ্রাপ্তি থেকে মনে উৎপন্ন হয়। আধিভৌতিক এবং আধিদৈবিক দুঃখ উৎপন্ন হয় শরীরের বাইরে পর্থিব উপকরণ দ্বারা। এই দুঃখের কারণ পারে মানুষ, পশু-পক্ষী, সম্পত্তি ইত্যাদি। আর যে সকল দুঃখ অজ্ঞাত কারণে হয়, বা যার উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ নেই, সেগুলোকে বলা হয় আধিদৈবিক। এই জাতীয় দুঃখের কারণ হিসেবে দেবতা বা অদৃশ্য কোনো শক্তির হাত আছে মনে করা হয়। সাংখ্যদর্শন সৃষ্টির আমলে মহামারী, ভূমিকম্পকে  আধিদৈবিক মনে করা হতো। এই জন্য আধিদৈবিক দুঃখের কারণের ভিতরে ছিল, দেবতা, যক্ষ, রাক্ষস, গ্রহ-নক্ষত্র।

এই তিন ধরনের দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় পাওয়া যায় বাচস্পতি মিশ্র তাঁর ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’ গ্রন্থে। তাঁর মতে চিকিৎসার দ্বারা শারীরীক দুঃখ দূর করা যায়। ভোগ্য বিষয় অধিকার এবং ভোগের দ্বারা মানসিক দুঃখ দূর করা যায়। নীতিশাস্ত্রপাঠ, নিরাপদ স্থানে বসবাস ইত্যাদির দ্বারা আধিভৌতিক দুঃখ দূর করা যায়। সহজলভ্য মণি, মন্ত্র, ঔষাধির দ্বারা আধিদৈবিক দুঃখ দূর করা যায়। সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী মতে দুঃখ নিবারণের উপায় হিসেবে যে সকল বিষয় বলা হয়েছে, তার ভিতর মণি ও মন্ত্র ছাড়া সবই বিজ্ঞানসম্মত। আনুশ্রবিক বা বেদবিহিত যাগ-যজ্ঞের দ্বারা দুঃখের নিবারণ হয় না। 'পশু হত্যায় পাপ হয়', এই শাস্ত্রবাক্যের লঙ্ঘন করা হয়  যজ্ঞের পশু বলি দানের মধ্য দিয়ে। পঞ্চশিখাচার্য–এর মতে– ‘যাগাদিক্রিয়া স্বল্পসঙ্কর, সপরিহার ও সপ্রত্যবমর্ষ’। এই মতে পশুহিংসা–জাত দুঃখের হেতু–রূপ অল্প পরিমাণ পাপের যোগ থাকে। তাই যাগাদিক্রিয়ার বলিদান  স্বল্পসংকর হবে। তবে প্রায়শ্চিত্ত দ্বারা বলিদানের পাপ দূর করা যায়, তাই পাপ সপরিহার। আবার ভুল করে যদি এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত না করা হয়, পশুহিংসা জনিত পাপের ফল দুঃখ ভোগ করতে হবে। যজ্ঞের ফলভোগের সাথে এই দুঃখকে সহজেই সহ্য করা যাবে। এর ভিতর দিয়ে যে সুখবোধ জন্মাবে তাকে বলা হয়েছে সপ্রত্যবমর্ষ।

সাংখ্যদর্শনে দুঃখ নিবারণের উপায় হিসেবে যাগযজ্ঞ করা অপেক্ষাকৃত সহজ। যাগযজ্ঞের দ্বারা জীবের স্বর্গসুখ লাভ হলেও তার মুক্তি হয় না। এর জন্য প্রয়োজন তত্ত্বজ্ঞান।


সূত্র: