্রজভাষা

গঙ্গা-যমুনা বিধৌত অববাহিকা অঞ্চলের প্রচলিত ভাষার সাধারণ নাম। ভারতের একটি বিশাল অংশজুড়ে কথিত ভাষা। এই বিচারে ব্রজভাষাকে কোনো প্রদেশের ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। তবে এর প্রমিত রূপ মথুরা, আগ্রা, আলীগড় তথা ধৌলপুর অঞ্চলে প্রচলিত আছে।

প্রাচীন 'শূরসেন' নামক জনপদের কেন্দ্র ছিল মথুরা
, আর শৌরসেনী অপভ্রংশ ছিল এখানকার প্রচলিত ভাষা। ব্রজভাষা এই শৌরসেনী অপভ্রাংশেরই উত্তরসূরী। বুলন্দ্‌শহর, বদাউন এবং নৈনিতালের তরাই ভূমিতে অবশ্য এই ভাষাতে খড়ীবোলীর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। অপরদিকে এটোয়া, মৈনপুরী, বেরিলীর ব্রজভাষায় কনৌজী বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। আবার গুড়গাঁও, ভরতপুর এবং গোয়ালিয়রের পশ্চিমোত্তর ভূভাগের ব্রজভাষায় বুন্দেলী এবং রাজস্থানীর কিছু বৈশিষ্ট্য নজরে পড়ে। প্রসিদ্ধ হিন্দী ভাষা-বিজ্ঞানী শ্রীধীরেন্দ্র বার্মার মতে, পীলীভীত এবং এটোয়ার ভাষা কনৌজীর চেয়ে ব্রজের বেশি কাছাকাছি। গিয়ারসন তাঁর
Linguistic Survey of India নামক গ্রন্থে ব্রজভাষার পরিচয় দিয়েছেন ‘অন্তর্বেদী’ ভাষারূপে'।

ব্রজ ভাষাঞ্চলের উত্তরে বাঙ্গরূ এবং খড়ীবোলী, পূর্বে কনৌজী ও অব্রধী, দক্ষিণে বুন্দেলী এবং পশ্চিমে রাজস্থানী ভাষাসমূহ অবস্থিত। প্রায় ৩৮ হাজার বর্গমাইল জুড়ে এই ভাষার মানুষ বসবাস করে। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের হিসেব অনুসারে এই ভাষার জনসংখ্যা ছিল ৭৬ হাজার ১৮৯। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে এই ভাষার  জনসংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২৫ হাজার ৮৬৪। বর্তমানে হিন্দির চাপে এই ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

ব্রজভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারা
ব্রজভাষার সাহিত্যিক মর্যাদা প্রকৃতপক্ষে ১৩শ শতকের উত্তরার্ধেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এক সময় সমগ্র উত্তর ভারতে এই ভাষার চর্চা ছিল ব্যাপক। সে সময়ে বিভিন্ন ভাষাভাষীর সাধক-কবিরা মাতৃভাষার পরিবর্তে ব্রজভাষাতেই লিখতেন। বিশেষকরে মীরাবাই (১৪৯৮/১৫০৩-১৫৪৬ খ্রিষ্টাব্দ), গুরু নানক (১৪৬৯-১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ), কবি তুলসীদাস (১৫৩২-১৬২৩ খ্রিষ্টাব্দ). কবীর (১৩৯৯-১৫১৮ খ্রিষ্টাব্দ) প্রমুখ ব্রজভাষা অথবা মিশ্রিত ব্রজভাষায় তাঁদের বক্তব্য প্রকাশ করেছেন।

ধারণা করা হয়, ব্রজভাষার প্রাচীনতম লেখক ছিলেন প্রসিদ্ধ গীতকার গোপাল নায়ক। িনি ছিলেন আমীর খুসরুর (১২৫৪-১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দ) সমসাময়িক। ব্রজবুলিতে রচিত তাঁর কিছু কিছু ধ্রুপদ গান এখনও প্রচলিত আছে। উত্তর যুগের সংগীতসাধক বৈজু বাওরা এবং তানসেনও ব্রজবুলিতে পদ রচনা করেছিলেন।

সন্ত কবিরকে(১৩৯৯-১৫১৮ খ্রিষ্টাব্দ) ব্রজভাষার প্রথম পূর্ণাঙ্গ লেখক হিসেবে অনেকে মনে করেন। উল্লেখ্য বারাণসীর এই ভক্তকবি জাতে মুসলমান জোলা ছিলেন। কথিত আছে তিনি বিখ্যাত বৈষ্ণবাচার্য রামানন্দের (১৪০০-১৪৭০ খ্রিষ্টাব্দ) কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পরিণত বয়সে তাঁর অধ্যাত্ম ধ্যানধারণা নাথ, সুফি ও বৈষ্ণব ধর্মের সমন্বয়ে ভিন্ন ধারার সৃষ্টি হয়েছিল। বৈষ্ণবীয় প্রেম ও ভক্তি, সুফি রহস্যবাদ ও নাথপন্থীদের  উপাসনার তাঁর আদর্শে তিনি নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাঁর মাতৃভাষা ছিল ভোজপুরী। এই ভাষায় বেশ কিছু দোহা রচনা করলেও তাঁর অধিকাংশ রচনাতে পাওয়া যায়  মিশ্র ভাষা। এই মিশ্রভাষাকে বলা হয় 'সাধুক্কড় বোলী'। আধুনিক ভাষা-গবেষকরা অবশ্য, কবিরের এই ভাষাকে সরস ব্রজভাষা নামে অভিহিত করে থাকেন। এই সংকর ভাষায় তিনি বহু ইসলাম ধর্মের সাথে সম্পর্কিত আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করছিলেন। তাঁর রচিত দোহাগুলি 'বীজক' (তিনভাগে বিভক্ত) এবং 'বাণী' আকারে সংকলিত হয়েছে। কবীরের বহু কবিতা, ১৬০৪ খ্রিষ্টাব্দে শিখধর্মগ্রন্থ 'আদিগ্রন্থ'-এ সংকলিত হয়েছে। উল্লেখ্য এই গ্রন্থের সংকলক ছিলেন পঞ্চম শিখগুরু অর্জুন।

কবিরের অনুগামী কবিদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন খ্রিষ্টীয় ১৬শ শতকের কবি ধর্মদাস।  ধর্মদাস ব্রজবুলি ছাড়া ভোজপুরীতেও কবিতা লিখেছিলেন। ব্রজবুলির অন্যান্য কবিরা ছিলেন রইদাস বা রবিদাস, গুরু নানক (১৪৬৯-১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) এবং দাদু দয়াল (১৫৪৪-১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দ)। রইদাস ছিলেন রামানন্দের শিষ্য এবং রামভক্ত। গুরু নানক প্রধানত পশ্চিমা হিন্দীতেই রচনা করেছিলেন, কিন্তু তাতে পাঞ্জাবি শব্দের মিশ্রণ ঘটেছে। কবিরের মত ও পথ অনুসরণকারী সুফিসাধক দাদু দয়াল গুজরাটে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন রাজস্থানের অম্বরে। এই সূত্রে রাজস্থানী ভাষায় তিনি ছিলেন সাবলীল। তারপরেও তিনি কাব্য রচনা করেছিলেন ব্রজভাষায়। তাঁর কবিতায় প্রাচীন খড়ীবোলীর (দিল্লী বোলী) মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। এই কারণে এঁর ভাষাকেও 'সাধুক্কড় বোলী' নামে অভিহিত করা হয়।

অন্যদিকে তুলসীদাসের (১৫৩২-১৬২৩ খ্রিষ্টাব্দ) কবিতা অব্রধী সাহিত্যকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তিনি কৃষ্ণবিষয়ক কাহিনি লিখেছিলেন ব্রজভাষায়। এই ভাষার কৃষ্ণলীলার অগ্রণী কবিরা 'অষ্টছাপ' নামে পরিচিত ছিলেন। উল্লেখ্য অষ্টছাপভুক্ত এই আটজন কবি হলেন সুরদাস (১৪৮৪ বা ১৫০৩-১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দ), নন্দদাস, কৃষ্ণদাস, পরমানন্দদাস, কুম্ভনদাস, চতুর্ভুজদাস (জন্ম ১৫১৬ খ্রিষ্টাব্দ), ছিত স্বামী ও গোবিন্দ স্বামী। এঁদের গুরু বল্লভাচার্য (১৪৭৯-১৫৩১ খ্রিষ্টাব্দ)  ছিলেন সাধক কবি। তাঁর অনুগামী ভক্তকবিদের রচিত কীর্তন গান এক সময় বৃন্দাবনের গোবিন্দ মন্দিরে গীত হতো। এঁদের মধ্যে বল্লভার্চার্যের শিষ্য ছিলেন সুরদাস। শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা ও গোপীপ্রেমের ওপর তাঁর কয়েক হাজার পদ আছে। এগুলি ব্রজভাষার শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর ভিতর সুরসাগর, সুর-সারাবলী উল্লেখযোগ্য। এছাড়া অনেকে মনে করেন সাহিত্য লহরী নামক গ্রন্থটিরও রচয়িতা ছিলেন সুরদাস।

বল্লভাচার্যের পুত্র বিঠ্‌ঠল নাথের শিষ্য ছিলেন নন্দদাস । তাঁর রচিত প্রাপ্ত ১৬টি প্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাসপঞ্চাধ্যায়ী এবং ভন‌‌ব্রর-গীত। অপর তিনিজন কবি
পরমানন্দ দাস (ধ্রুবচরিত, দানলীলা), কৃষ্ণদাস (ভ্রমর-গীত, প্রেমতত্ত্ব নিরূপণ) এবং চতুর্ভুজ দাস (দ্বাদশ যশ, ভক্তি প্রতাপ, হিতু কো মঙ্গল ব্রজভাষাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তবে এই তিন কবির খুব বেশি রচনা পাওয়া যায় নি।  ব্রজভাষার অপরাপর শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে ছিলেন, গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রধান গদাধর ভট্ট, ষড়্‌ গোস্বামীর ও গোপাল ভট্ট। এর বাইরে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন হিত হরিবংশ (১৫০৩ খ্রিষ্টাব্দ)। তিনি প্রথমে ছিলেন শ্রীচৈতন্যপন্থী। কিন্তু পরে রাধাবল্লভীয় সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করেন। তাঁর রচিত ৮৪টি পদের সংকলন 'হিত চৌরাশী' নামে পরিচিত।

ভক্তসাধিকা মীরাবাই গৌড়ীয় বৈষ্ণব জীব গোস্বামীর দ্বারা আংশিক প্রভাবিত ছিলেন। ধারণা করা হয় তিনি ছিলেন মেবারের রানী এবং রাজপুতপ্রধানের কন্যা। তাঁর বেশিরভাগ রচনা ব্রজভাষায় রচিত হয়েছিল।

সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে) আমলেও সম্রাটের সহায়তায় ব্রজভাষা বিশেষভাবে চর্চিত হয়েছিল। সম্রাট নিজেও কিছু ব্রজভাষায় কবিতা রচনা করেছিলেন। তাঁর উৎসাহ ও আনুকূল্যে বহু কবি ও গায়ক ব্রজভাষা চর্চা করেছেন। তাঁর রাজসভাতে ব্রজভাষায় কাব্য রচনায় উৎসাহিত করা হতো। আকবরের রাজসভার 'নবরত্ন' কবিদের অন্যতম কবি অবদুর রহীম খান্‌-খানান্ (১৫৫৬-১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন সম্রাটের শিক্ষক বৈরাম খাঁর পুত্র। তাঁর কবিতাগুলির বেশিরভাগই ব্রজবুলিতে লিখিত। এর বাইরে তিনি কিছু কবিতা অব্রধী ভাষায় লিখেছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর ভিতর উল্লেখযোগ্য ছিল রহিম দোহাবলী, বর্ব্রে নায়িকা ভেদ, মদনাষ্টক, শৃঙ্গার সোরঠ এবং রাসপঞ্চাধ্যায়ী। আকবরের রাজসভার অন্যান্য কবিদের ভিতরে নরহরি, বীরবল, টোডরমল, অলম, গঙ্গ (১৫৭৮-১৬১৭), মনোহর কবি, বলভদ্র মিশ্র, কেশবদাস। এর ভিতরে কবি কেশবদাস (১৫৬৫-১৬১৭ খ্রিষ্টাব্দ) আলঙ্করিকের কাব্যরীতির জন্য খ্যাতি লাভ করেছিলেন। এই কারণে তাঁকে  আলঙ্করিক কাব্যরীতির প্রবর্তক নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। তাঁর প্রধান কাব্যগুলো হলো রসিক প্রিয়া (১৫৯১ খ্রিষ্টাব্দ, কবি প্রিয়া (১৬০১ খ্রিষ্টাব্দ)। এই বিশেষ কাব্যধারাকে পরিচিত করে তুলেছিলেন রামচন্দ্র শুক্ল। খ্রিষ্টীয় ১৭শ-১৮শ শতকের কবিরা কাব্যের কোন মৌলিক ভাবনাকে তুলে ধরতে পারেন নি। তাঁদের রচনাগুলি ছিল অতি অলঙ্কারে ক্লিষ্ট। তাঁদের কবিতার বিষয় ছিল রস, অলংকার, নায়ক-নায়িকাভেদ, নায়িকার রূপবর্ণনা, ঋতুবর্ণন ইত্যাদি। এই রীতিধারার কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন কবি বিহারীলাল (১৬০৩-৬৩ খ্রিষ্টাব্দ)। উল্লেখ্য কবি বিহারীলাল ছিলেন অম্বররাজ জয়সিংহের সভাকবি। তিনি জনপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন অভাবনীয়। এই ধারার অপর কবি ভূষণ (১৬৩১-১৭১২ খ্রিষ্টাব্দ) শিবাজীর আদর্শ ও স্বদেশপ্রেমে উদ্বৃদ্ধ হয়ে চমৎকার কল্পনাকুশল ব্রজভাষায় সুমধুর একখানি বীরকাব্য (শিবা-বাব্রনী) রচনা করেছিলেন। এই কাব্যেটি বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে ছিল অভিনব। রোমান্টিক কয়েকজন কবি অবশ্য এই যুগে কিছুটা ভিন্নতর স্বাদ আনতে পেরেছিলেন। এঁদের ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ঘনানন্দ (১৬৯৯-১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দ), দাদু-শিষ্য সুন্দরদাস (১৫৯৭-১৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দ), মলুকদাস (১৫৭৪-১৬৮২ খ্রিষ্টাব্দ), অক্ষর অনন্য (১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দ)। তবে রীতিধারার শেষ শ্রেষ্ঠ কবি  পদ্মাকর (১৭৫৩-১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দ)-কে শ্রেষ্ট কবি হিসেবে মান্য করা হয়।

ব্রজভাষায় গদ্যরচনায় সূত্রপাত হয়েছে ১৬শ শতকে। বিশেষত চুরাশি বৈষ্ণবের জীবনী রচনায় (‘চৌরাশি বৈষ্ণবোঁ কী বার্তা’) অথবা বৈষ্ণব ভক্তের কাহিনীতে (‘দো সৌ বাত্তন বৈষ্ণবোঁ কী বার্তা’) গ্রন্থে এঁর নমুনা পাওয়া যায়।

উনিশ শতক থেকেই ব্রজভাষার ধারা ম্লান হয়ে যায়। ওই ভাষার স্থান দখল করে নেয় খড়ীবোলী হিন্দুস্থানী।

মধ্যযুগে বঙ্গদেশে এই ভাষায় যে সকল কবিতা রচিত হয়েছে, তা বাংলা দ্বারা প্রভাবিত। বাংলা ও বিহার অঞ্চলে এই ভাষায় রচিত পদে বাংলা এবং মৈথিলি ভাষার প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। বঙ্গদেশে ব্রজভাষার অন্যতম কবিদের ভিতরে ছিলেন বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাশ, চণ্ডীদাশ প্রমুখ।

ব্রজভাষার ধ্বনি রূপ ও রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ