টাইটানিক

এটি একটি ডুবে যাওয়া বহুল-আলোচিত বিলাসবহুল প্রমোদতরী। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে এই জাহাজটি আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যায়। প্রায় ২২০০ জন যাত্রী এবং জাহাজের কর্মী নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যায়। এর ফলে প্রায় ১৫০০ যাত্রী মৃত্যুবরণ করেন আর উদ্ধার পেয়েছিলেন প্রায় ৭০০ জন যাত্রী।

জন পিয়ারপন্ট মরগান নামক জনৈক মার্কিন ধনকুবের সর্বপ্রথম এই জাহাজটি
তৈরির উদ্যোগ নেন। গ্রেট ব্রিটেনের বেলফাস্টের হারল্যান্ড এন্ড ওলফ্ শিপইয়ার্ডে এই জাহাজটি তৈরি করা শুরু করেছিল ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ই মার্চ। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ২ এপ্রিলে নির্মাণকাজ সমাপ্ত হ্য়জাহজটি তৈরির জন্য অর্থায়ন করেছিল ইন্টারন্যাশনাল মার্কেন্টাইল মেরিন কোম্পানি। সে সময়ের হিসাবে খরচ হয়েছিল প্রায় ৭.৫ মিলিয়ন (বর্তমান প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন) ডলার। তৈরির পর ব্রিটিশ শিপিং কোম্পানি হোয়াইট স্টার লাইন-এ জাহাজটি অন্তর্ভুক্ত হয়। এই সময় এর পূর্ণনাম দেওয়া হয়েছিল আরএমএস টাইটানিক
(RMS TITANIC (RMS = Royal Mail Ship))পরবর্তী সময়ে জাহাজটি 'টাইটানিক' নামে খ্যাতি লাভ করেছিল উল্লেখ্য গ্রিক পৌরাণিক জাতিগোষ্ঠী টাইটান থেকে এই নামটি গ্রহণ করা হয়েছিল।

পানি থেকে জাহাজটির ডেকের উচ্চতা ছিল ৫৯ ফিট (১৮মিটার), দৈ
র্ঘ্য ছিল প্রায় ৮৮২ ফুট ২ ইঞ্চি (প্রায় ২৬৯.১ মিটার) এবং প্রস্থ ছিল প্রায় ৯২ ফিট (২৮ মিটার)। এ জাহাজটি ওজন ছিল প্রায় ৪৬৩২৮ লং টন। বহন ক্ষমতা ছিল ৫২,৩১০ টন।

এতে ব্যবহার করা হয়েছিল চার সিলিন্ডারের দুটি রিসিপ্রোকল ইঞ্জিন, ট্রিপল এক্সপ্যানশান স্টি ইঞ্জিন। এর তিনটি প্রোপেলারকে চালানের জন্য একটি লো প্রেসার টারবাইনের ব্যাবস্থা ছিল। জাহাজটির প্রধান জ্বালানি ছিল কয়লা। এর ২৯টি বয়লারকে সক্রিয় রাখার জন্য ছিল ১৫৯টি কয়লা পোড়ানো চুলো। আর কয়লা পোড়ানো গ্যাস নিষ্ক্রমণের জন্য ছিল তিনটি চিমনি। একটি অতিরিক্ত চিমনি ছিল বায়ু চলাচলের জন্য রাখা হলেও মূলত এট রাখা হয়েছিল জাহাজের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য।

এর সর্বোচ্চ গতি ছিল ২ নট (৪কি.মি./ঘণ্টা)। তৎকালীন ব্রিটিশ জাহাজ নীতিমালা অনুসারে, ১০০০০ হাজার টনের চেয়ে বেশি ভারি জাহাজে কমপক্ষে ১৬টি লাইফবোট থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু টাইটানিকে প্রায় ৬৪টি লাইফবোট ছিল।

টাইটানিকের ক্যাপ্টেন ছিলেন ইংল্যান্ডের রাজকীয় কমান্ডার এডওয়ার্ড জন স্মিথের। ইনি 'নিরাপদ ক্যাপ্টেন', 'মিলিয়নিয়ার ক্যাপ্টেন' ইত্যাদি বিভিন্ন নামে খ্যাত
ছিলেন। ১৫ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই কমান্ডারকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন হিসাবে বিবেচনা করা হতো।

ধারণক্ষমতা ছিল ২,৪৩৫ যাত্রী ও ৮৯২ ক্রু । এর অভ্যন্তরে ছিল সুদৃশ্য সুইমিং পুল, জিমনেসিয়াম, স্কোয়াস খেলার কোর্ট, ব্যয়বুহল স্নানাগার, বিশাল এবং ব্যয়বহুল ক্যাফে। প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণির যাত্রীদের জন্য ছিল পৃথক পৃথক বিশাল গ্রন্থাগার। প্রথম শ্রেণির যাত্রীর ভাড়া ছিল ৪৩৫০ ডলার। এই শ্রেণির যাত্রীদের জন্য বিলাসবহুল খাবার ঘর ছিল। এই ঘরে একই সাথে ৫৫০ জন খাবার খেতে পারতো

টাইটানিক ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল
, বুধবার, ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন থেকে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। এই সময় জাহাজে ছিল প্রায় ২২০০ জন যাত্রী এবং জাহাজের কর্মীদল।
    যাত্রী তালিকা : প্রথম শ্রেণি। দ্বিতীয় শ্রেণি তৃতীয় শ্রেণি
    জাহাজকর্মী : ডেক ক্রু ইঞ্জিনিয়ারিং ক্রু অন্যান্য ক্রু
    যাঁরা মৃত্যু থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।

পিছনের জাহাজটি টাইটানিক


যাত্রার শুরুতেই
SS City of New York নামক একটি জাহাজের সাথে ধাক্কা লাগতে লাগতে রক্ষা পায়।
১৪ই এপ্রিল ১৯১২ তারিখ রাত্রে সমুদ্রের তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি নেমে যায়। আকাশ পরিষ্কার থাকলেও সে সময় চাঁদ দেখা যাচ্ছিল না। জাহাজের সমানে ভাসমান হিমশিলার সংকেত পাওয়ার পর, ক্যাপ্টেন জাহাজকে সামান্য দক্ষিণ দিকে চালিত করেন। পরের দিন দুপুর ১:৪৫ এর দিকে Amerika নামক একটি জাহাজ, রেডিওর মাধ্যমে যোগাযোগ করে, টাইটানিকের সামনে একটি হিমশিলা আছে এমন তথ্য জানায়। কিন্তু টাইটানিকের রেডিও যোগাযোগের দায়িত্বে থাকা জ্যাক পিলিপস্ এবং হ্যারল্ড ব্রীজ এ তথ্যটিকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে টাইটানিকের মূল্য নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে এ তথ্য প্রেরণ করে নি। একই দিনেই পরবর্তিতে Mesaba নামক আরেকটি জাহাজ টাইটানিকের পথে অবস্থিত ঐ বিশাল হিমশিলাটির ব্যাপারে আবারও সতর্ক করে দেয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই তথ্যটি ক্যাপ্টেনকে তারা জানান নি। এরপর টাইটানিক দুর্ঘটনার মাত্র ৪০ মিনিট আগে Californian নামক জাহাজ থেকে রেডিও অপারেটর টাইটানিকের সাথে যোগাযোগ করে হিমশিলাটির সম্পর্কে বলতে চেয়েছিল। কিন্তু টাইটানিকের রেডিও অপারেটর ক্লান্ত জ্যাক পিলিপস্ রাগান্বিত ভাবে বলে ‍‍'আমি কেইপ রেসের সাথে কাজে ব্যস্থ এবং লাইন কেটে দেয়।' এরপর Californian -এর রেডিও অপারেটর তার ওয়ার্লেস বন্ধ করে ঘুমাতে চলে যায়। উল্লেখ্য টাইটানিক ডুবে যাওয়ার আগে টাইটানিক থেকে Californian জাহাজে যোগাযোগ করলে, পরে তারা আর কোনো সাড়া দেয় নি।

এরপ রাত ১১:৪০ এর সময় টাইটানিকের পথ পর্যবেক্ষণকারীরা সরাসরি টাইটানিকের সামনে সেই হিমশিলাটি দেখতে পায়। যদিও টাইটানিকের ফার্স্ট অফিসার মুর্ডক আকস্মিকভাবে বামে মোড় নেওয়ার অর্ডার দিয়ে জাহাজটিকে সম্পূর্ণ উল্টাদিকে চালনা করার আদেশ দেন। কিন্তু এরই ভিতরে সরাসরি হিমশিলার ডানদিকে আঘাত হানে। এরপর হিমশিলার সাথে প্রচণ্ড ঘর্ষণ খেতে খেতে চলতে থাকে। ফলে টাইটানিকের প্রায় ৯০ মিটার অংশ জুড়ে চিড় দেখা দেয়। প্রচণ্ডবেগে জাহাজের ভিতর পানি প্রবেশ শুরু হলে, প্রথমে পাম্প করে পানি নিষ্কাষণ শুরু করে। কিন্তু পানির প্রবল তোড়ে দ্রুত এর খোলের ৫টি কম্পার্টমেন্ট ডুবে যায়। এরপর জাহাজের সামনের অংশ ডুবে যেতে থাকে। ক্যাপ্টেন স্মিথ জাহাজটি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেন। ১৫ তারিখ মধ্যরাত্রির দিকে জাহাজ থেকে লাইফবোটগুলো নামানো শুরু হয় এবং বিভিন্ন দিকে জরুরি বিপদ সংকেত পাঠানো শুরু করে। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে উদ্ধারকাজে এগিয়ে এসছিল মাউন্ট ট্যাম্পল, ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং অলিম্পিক। সবচেয়ে নিকটে অবস্থিত
Carpathia জাহাজটি টাইটানিকের প্রায় ৯৩ কি.মি. দূরে ছিল।

রাত ০২:০৫ দিকে জাহাজের সম্পূর্ণ মাথাই প্রায় পানির কাছাকাছি চলে আসে। ০২:১০ এর দিকে প্রপেলারকে দৃশ্যমান করে দিয়ে জাহাজের পেছনের দিক উপরের দিকে উপরে উঠতে থাকে। ০২:১৭ এর দিকে জাহাজের সামনের দিকের ডেক পর্যন্ত পানি উঠে যায়। এ মূহুর্তেই শেষ দুটি লাইফবোট টাইটানিক ছেড়ে যায় বলে এত বিস্তারিত ভাবে জানা গেছে। জাহাজের পেছনের দিক ধীর ধীর আরো উপরের দিকে উঠতে থাকে এসময় জাহাজের বিদ্যুতিক সিস্টেম বন্ধ হয়ে যায় এবং চারদিকে অন্ধকার হয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পরেই ভারের কারণে টাইটানিকের পেছনের অংশ সামনের অংশ থেকে ভেঙ্গে যায় এবং জাহাজের সম্মূখভাগ সম্পূর্ণরূপে পানির নিচে চলে যায়। ফলে জাহাজের পেছনের অংশ ধীরে ধীরে খাড়া হতে হতে একেবারে লম্বভাবে খাড়া হয়ে যায়। বায়ুজনিত কারণে এ অংশটি কিছুক্ষণ ভেসে থাকার পর রাত ০২:২০ এর দিকে ধীরে ধীরে জাহাজের এ বাকী অংশটিও সমূদ্রের অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়।

মাত্র দুটি লাইফবোট আবার উদ্ধার কাজে ফিরে এসেছিল। এর মধ্যে লাইফবোট-৪ পাঁচজন যাত্রীকে উদ্ধার করেছিল যার মধ্যে দুজন পরবর্তিতে মারা যায়। একঘণ্টার মধ্যে লাইফবোট-১৪ ফিরে আসে এবং আরো ৪ জন ব্যক্তিকে উদ্ধার করে যাদের একজন পরে মারা যায়। সকাল ০৪:১০ এর দিকে Carpathia জাহাজটি এসে পৌছায় এবং বেঁচে থাকাদের উদ্ধার করা শুরু করে। সকাল ০৮:৩০ মিনিটে জাহাজটি নিউ ইয়র্কের দিকে রওনা দেয়। যারা বেঁচে গিয়েছিল তাদের সংক্ষিপ্ত তালিকা:

শ্রেনী জাহাজে অবস্থান করছিল বেঁচে গিয়েছিল বাঁচার হার মৃতের সংখ্যা মৃতের হার
            ফার্স্ট ক্লাস ৩২৫ ১৯৯ ৬০.৫% ১৩০ ৩৯.৫%
            সেকেন্ড ক্লাস ২৮৫ ১১৯ ৪১.৭% ১৬৬ ৫৮.৫%
            থার্ড ক্লাস ৭১০ ১৭৪ ২৪.৫% ৫৩৬ ৭৫.৫%
            জাহাজের ক্রিউ ৮৯৯ ২১৪ ২৩.৮% ৬৮৫ ৭৬.২%
                মোট ২২২৩ ৭০৬ ৩১.৮% ১৫১৭ ৬৮.২%

এই জাহাজ ডুবিতে বেশির ভাগ লোকই মারা গিয়েছিল প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কারণে কারণ তখন সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা ছিল ২৮ ডিগ্রী ফারেনহাইট (-২ ডিগ্রী সেলসিয়াস) উল্লেখ্য এই তাপমাত্রায় মানুষ সাধারণত ১৫ মিনিটের এরও কম সময়ে ভিতর মারা যায়

টাইটানিক ডুবে যাওয়ার কারণ
যে পথ ধরে টাইটানিক নিউইয়র্কের পথে যাত্রা শুরু করেছিল, সে পথে কোনো হিমশিলা থাকার কথা ছিল না। এই কারণে, আশেপাশের অন্যান্য জাহাজ থেকে হিমশিলার উপস্থিতির কথা টাইটানিকে সংকেতের মাধ্যমে জানালেই, টাইটানিকের রেডিও অপারেটর পাত্তাই দেন নি। এই পথে কি করে এতবড় হিমশিলা এলো, এটা অনেক বড় প্রশ্ন ছিল।  টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিদরা এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের মতে
এই হিমশিলার এসেছিল উত্তরের গ্রিনল্যান্ড থেকে। মূলত গ্রিনল্যান্ডকে ঘিরে অসংখ্য হিমশিলা ভাসমান অবস্থায় থাকে। কিন্তু জলস্রোত দুর্বল থাকায় এই হিমশিলা আটলান্টিকে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারি তারিখে চাঁদ পৃথিবীর অত্যন্ত কাছে এসে পড়েছিল। সাধারণত প্রতি ১৪০০ বছরে মাত্র একবার এরূপ ঘটনা ঘটে। সেই সাথে সূর্য একটি বিশেষ অবস্থানে থাকার জন্য ১৪০০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতার জোয়ারের সৃষ্টি হয়েছিল। এই কারণে ওই সময় ল্যাব্রাডর এবং নিউ ফাউন্ডল্যান্ড থেকে পর্বত আকারের বহুসংখ্যক হিমশিলা ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে জোয়ারের থাকায় আটলান্টিকের জাহাজ চলাচলের পথে এসে পোঁছেছিল। এরূপ একটি বিশালাকার হিমশিলাতে টাইটানিক থাক্কা খেয়েছিল। এই ধাক্কায় জাহজের তলদেশে ফাটলের সৃষ্টি হয়েছিল। এর ফলে জাহাজের তলদেশের প্রকোষ্ঠগুলোতে পানি ঢুকে পড়ে।  টাইটানিকের মতো বড় জাহাজগুলো ভাসিয়ে রাখার জন্য এর মধ্যে ১৬টি হাওয়া প্রকোষ্ঠ থাকে এর ভিতর অন্ততঃ ৪টি প্রকোষ্ঠ পানিতে পূর্ণ হয়ে গেলেও জাহাজ ভাসতে পারে। টাইটানিকের ক্ষেত্রে পাঁচের অধিক সংখ্যক প্রকোষ্ঠ অল্পময়ের ভিতর পানিতে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।


সূত্র :
http://www.encyclopedia-titanica.org/

http://en.wikipedia.org/wiki/RMS_Titanic