পারমাণবিক বোমা
ইংরেজি Atom bomb, A-bomb

এক প্রকার বোমা জাতীয় মারণাস্ত্র। এতে ব্যবহার করা হয় ইউরেনিয়াম-২৩৫ এবং প্লুটোনিয়াম-২৩৯। দ্রুত নিউট্রনের সুশৃঙ্খল বিক্রিয়ার দ্বারা এর বিস্ফোরণ ঘটে থাকে। শুধু ফিশন প্রক্রিয়ায় বিস্ফোরণ ঘটে। উল্লেখ্য নিউক্লিয়ার বোমার ভিতরে ফিউসন প্রক্রিয়া ঘটে হাইড্রোজেন বোমাতে।

 

হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত বোমা  Little Boy

নিক্ষেপিত বোমা
এখন পর্যন্ত ২টি পারমাণবিক বোমা নিক্ষিপ্ত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম সময়ে
জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে।

হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত বোমা
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ৬ আগষ্ট হিরোশিমা নগরে প্রথম পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়। ইউরেনিয়াম দ্বারা সৃষ্ট এই বোমার সাঙ্কেতিক নাম ছিল
Little Boy। এর ওজন ছিল ৯৭০০ পাউন্ড (৪৪০০ কেজি)। এটি লম্বায় ছিল ১২০ ইঞ্চি (৩.০ মিটার) এবং এর ব্যাস ছিল ২৮ ইঞ্চি (৭১০ মিলিমিটার)।

 

মার্কিন বিমান বাহিনীর ৩৯৩ বোমারু স্কোয়াড্রনের কর্নেল ওল টিব্বেটস (Colonel Paul Tibbets) বি-২৯ বোমারু বিমানের সাহায্যে এই বোমা নিক্ষেপ করেছিল। হিরোশিমা শহরের ৩১০০০ ফুট (৯,৪০০) মিটার উপর থেকে এই বোমা নিক্ষেপ করা হয়। ১৯৬৮ ফুট (৬০০ ফুট) উপরে এই বোমা বিক্রিয়া শুরু করে। এবং ভূমির উপরে থাকতেই ১৩ থেকে ১৮ কিলোটন শক্তি শহরে আঘাত করে।

 

নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত বোমা  Fat Man

নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত বোমা

হিরোশিমায় বোমা বর্ষণের পর জাপান আত্মসমর্পণ না করায়, ৯ আগষ্টে জাপানের নাগাসাকিতে দ্বিতীয় পারমণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়। প্লুটোনিয়াম-জাত এই বোমার সাঙ্কেতিক নাম ছিল Fat Man। এর ওজন ছিল ১০২১৩ পাউন্ড (৪৬৩৩ কেজি)। এটি লম্বায় ছিল ১০.৭ ফুট (৩.৩ মিটার) এবং এর ব্যাস ছিল ৫ ফুট (১.৫ মিটার)।
 

নাগাসাকিতে বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার পরের দৃশ্য

মার্কিন বিমান বাহিনীর ৩৯৩ বোমারু স্কোয়াড্রনের মেজর চার্লস সুইনে (Major Charles Sweeney) বি-২৯ বোমারু বিমানের সাহায্যে এই বোমা নিক্ষেপ করেছিল। নাগাশাকি শহরের ১৬৫০ ফুট (৫০০ ফুট) উপরে এই বোমা বিক্রিয়া শুরু করে।  এই বোমা থেকে নির্গত শক্তির পরিমাণ ছিল প্রায় ২১ কিলোটন। তাৎক্ষণিকভাবে এই বোমার আঘাতে প্রায় ২৯, ০০০ লোক মৃত্যবরণ করেছিল।

 

এই দুটি বোমার আঘাতে প্রচণ্ড উত্তাপে, অগ্নিকাণ্ডে এবং যন্ত্রণাদায়ক তেজস্ক্রিয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে বহু মানুষের মৃত্য ঘটেছিল। আর পরবর্তীয় সময়ে তেজস্ক্রিয়তার কারণে বহুলোক ক্যান্সারে মৃত্যবরণ করেছিল। সব মিলিয়ে এই দুটি বোমার কারণে প্রায় দুই লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করেছিল।
 

নাগাসাকির বোমাবর্ষণের পর জাপান আত্মসমর্পণ করে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত অনেকবার অনেক দেশ পারমাণবিক বোমা পরীক্ষামূলকভাবে বিস্ফোরণ ঘটালেও, যুদ্ধে আর এই বোমা ব্যবহার করা হয় নাই। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক দেশই এই বোমা তৈরি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরে এই বোমা তৈরি করেছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া। ধারণা করা হয়, ইস্রায়েল এবং ইরান এই বোমা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিজ্ঞানীদের সংগঠন  Federation of American Scientists -এর হিসাব মতে, ২০১২ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে প্রায় ১৯,০০০ পারমাণবিক বোমা রয়েছে। এর ভিতর ৪,৪০০টি বোমা নিক্ষেপ করার উপযোগী অবস্থায় রয়েছে।

 

পারমাণবিক তৈরির ইতিহাস
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে দুইজন জার্মান বিজ্ঞানী জেমস্ ফ্রাঙ্ক এবং গুস্তাভ হার্টজ ইলেক্ট্রন দ্বারা পারদের পরমাণুর উপর আঘাত করে পরীক্ষা করে দেখতে পান যে, এই আঘাতের ফলে শক্তি নির্গত হচ্ছে। তাঁরা এই পরীক্ষার ফলাফল বিজ্ঞানী নিলস্ বোরের কাছে পাঠান। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে অটো হান এবং লিজে মেইট্‌নের নিউক্লিয়ার
সমাণুক (nuclear isomer) আবিষ্কার করেন। এরপর ক্রমান্বয়ে তেজষ্ক্রিয়া বিক্রিয়া নিয়ে বিজ্ঞানীরা ব্যাপক গবেষণা করতে থাকেন। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দর দিকে রোম বিশ্ববিদ্যালয়ের এনরিকো ফেরমি এবং এমিলিও সেগ্রে ইউরেনিয়ামের পরমাণুতে নিউট্রন দ্বারা আঘাত করে নানাবিধ পরীক্ষা করেন। ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে এঁরা শ্লথ নিউট্রোন আবিষ্কার করেন। এই সময়ে অটো হান এবং লিজে মেইট্‌ন এই গবেষণার জন্য ফ্রিট্‌জ্ স্ট্রাসমান-এর সাথে যুক্ত হন এবং নিউট্রোনের আঘাত দ্বারা ইউরেনিয়ামের নিউক্লেই বিভাজন প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন।

১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানীতে বসবাসরত বহু ইহুদি অধ্যাপক ও গবেষক জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাকেন্দ্র থেকে বিতারিত হন। এই কারণে জার্মানির একজন ইহুদি গবেষক মেইট্‌নে, জার্মানি থেকে সুইডেনে চলে যান এবং তাঁর ভাতিজার সাথে বসে তিনি ইউরেনিয়াম থেকে কত ভয়ঙ্কর বোমা তৈরি হতে পারে, তার উপর একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। এই সূত্রে ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে পদার্থবিজ্ঞানের এক সম্মেলনে পারমাণিবক বোমা তৈরির বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় বিভিন্ন বিজ্ঞানী এই বোমা তৈরিতে সম্মত হন নাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় স্বার্থে এঁরা সম্মত হন।

 

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ আলবার্ট আইনস্টাইন, লেও জিলার্ড এবং ইউগেনে উইগনের ইউরোপ থেকে পালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উপস্থিত হন এবং ২রা আগষ্টে তাঁরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে একটি পত্র লেখেন। এই পত্রে তাঁরা জানান যে, পারমাণবিক বোমা তৈরির ক্ষেত্রে জার্মানি বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। রুজভেল্ট এই বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে তদন্ত করার নির্দেশ দেন এবং ব্রিটিশ সরকারের সাথে আলোচনাও করেন।

 

১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে জার্মান-বাহিনী ডেনমার্ক অধিকার করে। এই সময় নিয়েল বোর ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের সহায়তায় ডেনমার্ক থেকে পালিয়ে সুইডেন চলে আসেন এবং এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন সরকার পারমাণবিক বোমা তৈরির উদ্দেশ্যে Manhattan Engineer Project নামক প্রকল্প চালু করে। এই প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্ব পান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল লেসলি গ্রোভস (Leslie Groves)। এই প্রকল্পে যে সকল প্রখ্যাত বিজ্ঞানীরা যুক্ত ছিলেন, তাঁরা হলেন রবার্ট ওপেনহেইমার (Robert Oppenheimer মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), ডেভিড বোহম (David Bohm, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), লিও জিলার্ড (Leo Szilard হাঙ্গেরি), ইউগেনে উইগ্‌নের (Eugene Wigner হাঙ্গেরি), এডওয়ার্ড টেলার (Edward Teller হাঙ্গেরি), রুডলফ পেইয়ের্লস (Rudolf Peierls জার্মানি), অটো ফ্রিসখ (Otto Frisch জার্মানি), জেমস ফ্রাঙ্ক (James Franck জার্মানি), ক্লাউস বুকস (Klaus Fuchs জার্মানি), নিয়েলস বোর (Niels Bohr, ডেনমার্ক) ফেলিক্স ব্লোচ (Felix Bloch সুইজারল্যান্ড), জেমস চাডউইক (James Chadwick ব্রিটেন), এমিলিও সে্গ্রে (Emilio Segre  ইতালি), এনরিকো ফেরমি (Enrico Fermi ইতালি) প্রমুখ ।

 

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে কুইবেক সম্মেলনে, জার্মানির পারমাণবিক কার্যক্রম ধ্বংস করার ক্ষেত্রে সম্মত হন। এই প্রক্রিয়ায় ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে মিত্র বাহিনী, নরওয়েতে স্থাপিত নিউক্লিয়ার কারাখানায় বোমা বর্ষণ করে ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু জার্মানরা দ্রুত এই কারখানা পুনরায় তৈরি করে। এরপর ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন বোমারু বিমান এই কারখানাও ধ্বংস করে দেয়। এর দুই মাস পরে নরওয়ের মুক্তিযোদ্ধারা এক আক্রমণে নিউক্লিয়ার বোমার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ বহনকারী জাহাজ ডুবিয়ে দেয়।

 

এই সময় মার্কিন Manhattan Engineer Project প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা ইউরেনিয়াম এবং প্লুটোনিয়াম ব্যবহার করে পারমণবিক বোমা তৈরি করতে সক্ষম হন। এঁরা ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাইতে নিউ মেক্সিকো প্রদেশের আলামোগোর্ডো-তে, প্রথম তিনটি বোমা সার্থকভাবে পরীক্ষা করতে সক্ষম হন। জার্মানরা যাতে আত্মাসমর্পণে বাধ্য হয়, এই জন্য জার্মানিতে এই বোমা নিক্ষেপের কথা প্রথমে বিবেচনা করা হয়েছিল। কিন্তু হাঙ্গেরির বিজ্ঞানি লিও জিলার্ড এবং জার্মানির বিজ্ঞানী জেমস ফ্রাঙ্ক জার্মানিতে এই বোমা নিক্ষেপের ঘোর বিরোধিতা করেন এবং একই সাথে তাঁরা অন্যান্য বিজ্ঞানীদেরকেও এই বিরোধিতায় অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হন। এরপর মার্কিন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জাপানে এই বোমা নিক্ষেপে সম্মতি দেন। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ৬ আগষ্ট হিরোশিমা নগরে মার্কিন বি-২৯ বোমারু বিমানের সাহায্যে এই বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এরপর জাপান আত্মসমর্পণ না করায়, ৯ আগষ্টে জাপানের নাগাসাকিতে দ্বিতীয় পারমণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এই বোমাবর্ষণের জাপান আত্মসমর্পণ করে।
 


সূত্র :http://www.spartacus.schoolnet.co.uk/2WWatom.htm